( যারা প্রথম পর্বটি পড়েননাই, তারা এই পর্ব নাও বুঝতে পারেন। এজন্য সবার আগে প্রথম পর্বটি পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন :
https://www.somewhereinblog.net/blog/Xptushar/30325172 )
বউ বাচ্চাকে ফাঁকা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে আবারও এম্বুলেন্স ছুটলো ঢাকার দিকে। যারা ইদানীং জামালপুর থেকে মুক্তাগাছা হয়ে ময়মনসিংহ কিংবা ঢাকার দিকে গিয়েছেন তারা হয়তো জানেন, বর্তমানে অত্র জনপদে সবচাইতে জঘন্যতম রাস্তার তকমা এটাকেই দেওয়া হয়। রাস্তার কাজ চলাতে সেসময় ২০% রাস্তা চমৎকার আর বাকি রাস্তা মারাত্মক এবরোথেবরো। এম্বুলেন্স একেকটা ঝাকি খাচ্ছে আর আমার মনে হচ্ছে ভাঙ্গা পায়ের চোখা হাড়গুলো মাংসের মধ্যে বিধছে আর বের হচ্ছে। ব্যথার বর্ননা নাহয় নাইবা দিলাম। শুধু আমার ফুফাতো ভাই সাফিকে বললাম, "পা টা চেপে ধরে থাক। যাতে যতটা সম্ভব কম নড়ে। " এরপরও খুব একটা লাভ হচ্ছেনা। একেকটা ঝাকি খাচ্ছি আর চিৎকার দিয়ে উঠছি। এভাবে পৌঁছে গেলাম ময়মনসিংহ। সেখানে আবারও ব্যথানাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
৩-৪ ঘন্টা পরে জয়দেবপুর থেকে টঙ্গীর খারাপ রাস্তা পার হয়ে রাত ১ টার দিকে পৌঁছে গেলাম পঙ্গু হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো এতক্ষনের ঝাকিতে পায়ের রক্তমাখা সাদা হাড় আবারও বের হয়ে আছে এবং মুখমন্ডলও ফোলা শুরু করেছে। ডাক্তাররা আমার অবস্থা দেখে বললেন, "আমরা নাহয় পায়ের চিকিৎসা করতে পারবো কিন্তু মাথার আঘাতের চিকিৎসা তো এখানে হয়না। রোগিকে তাড়াতাড়ি অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান নাহলে বাচাতে পারবেননা। " একইসাথে তারা পা ধরে মোচড় দিয়ে হাড়টা আবারও ভেতরে ঢুকিয়ে বিদায় দিলো। আবারও শুরু হলো জার্নি।
ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে ভর্তি করে সিটি স্ক্যান এবং এক্স রে করালো। আলহামদুলিল্লাহ সিটিস্ক্যানের রিপোর্টে মস্তিষ্কে আঘাতের কোন আলামত পাওয়া গেলোনা। এরপরও ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে যাওয়া নাকটা উপরে তুলতে, নাকের গোড়ায় তৈরী হওয়া গর্তের চিকিৎসা করতে ৩য় তলায় অপারেশন থিয়েটারে নিতে বললো। লিফটের কাছে গিয়ে দেখা গেলো আশ্চর্যজনক ভাবে সে রাতে প্রতিটি লিফটই হয় নষ্ট, নাহয় অপারেটর তালা লাগিয়ে ঘুমুতে গেছে। আমাকে বাঁচানোর তাগিদে প্রায় ৫-৭ জন মানুষ আমাকে বহনকারী ট্রলিটি উচু করে সিড়ি দিয়ে ৩ তলায় তুলে ফেললো। আমার ৯৮ কেজির শরীরের সাথে ৫০-৬০ কেজি ট্রলি ৩ তলায় তুলতে একেকটা মানুষ পুরোপুরি নাস্তানাবুদ। যাইহোক অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানোর পরে একে একে মাথার সকল ক্ষতের চিকিৎসা হলো। কিন্তু চোখের মনির উপরের সাদা অংশটার ক্ষতটার জন্য চক্ষু বিভাগে যেতে বললো। সবাই আবারও দৌড়িয়ে চক্ষু বিভাগে। সেখানে চোখের ভেতরেও সেলাই করলো এবং চোখের পাতা ছিড়ে গাল পর্যন্ত এসে পড়েছিলো, সেটাও সেলাই দিয়ে দিলো। এখন বাকি রইলো ভাঙ্গা নাক উপরে তোলা। কি কি যেন মেডিসিন নাকের ভেতর স্প্রে করে শক্ত কাঠি জাতীয় কিছু দিয়ে নাকটা উপরে তুললো। ভেতরের নরম হাড়গুলো কি করলো জানিনা। একেকটা নাকের ছিদ্রে দেড় দুই ফুট করে গজ ঠেসে ঠেসে গুজে পুরোপুরি ব্লক করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আবার এটাও বললো, আগামী ৫-৬ দিন যেন ভুলেও হাঁচি দেওয়ার পরিবেশ না তৈরি হয়। তাহলে এসব ছিটকে বের হওয়ার আশংকা থাকে। অথবা ফুসফুসে চাপ খাবে।
রাত ২ টা থেকে সকাল সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত একটানা অপারেশন শেষে এখন আমি অনেকটাই আশংকা মুক্ত। যদিও এখনও পায়ের চিকিৎসা শুরুই হয়নাই। এর চিকিৎসা শুরু হয় হবে করতে করতে দুপুর আড়াইটা বেজে গেলো। অর্থাৎ এক্সিডেন্টের ১৯ ঘন্টা অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কয়েকদফা এক্সরে করা ছাড়া ভাঙ্গা পায়ের চিকিৎসাই শুরুই হয়নি। এদিকে একটানা অপারেশনে আমিও ক্লান্ত বিধ্যস্ত। ঘুমিয়েছি মাত্র ১ ঘন্টা তাও আবারও অপারেশন শেষে সকালে। অর্থাৎ এক্সিডেন্টের পর থেকে সকাল পর্যন্ত এতোক্ষন পুরোপুরি সজাগ। এর মধ্যে পা ফুলে ঢোল, রক্ত জমাট বেধে পায়ের নিচের অংশ লাল-কালো হয়ে গেছে। ব্যথায় টিকতে না পেরে আত্মীয় স্বজনদের সামনেই ডাক্তারকে অনুরোধ করলাম, "এই পা নিয়ে যদি এতই সমস্যা হয়, তাহলে নাহয় কেটেই ফেলেন। তবুও এতো কষ্ট সহ্য হচ্ছেনা। " প্রিয় পাঠক, একটা মানুষ কতটা অসহায় হলে নিজের পা নিজেই কেটে ফেলতে বলে সেটা একবার চিন্তা করেন।
যাইহোক, অবশেষে আড়াইটার দিকে আবারও অপারেশন থিয়েটারে ঢুকালো। আমি তখনও জানিনা, একটু পরেই আমার জন্য কি বিভীষিকা অপেক্ষা করছে। তিনজন ডাক্তার মিলে ভাঙ্গা পা উচু একটা কাঠামোতে রাখলো। যেখানে থেকে স্পষ্ট আমি এক চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে পারছিলাম। অন্য চোখ ব্যান্ডেজ করা। হাঁটুর নিচে একটা স্টিলের গামলা রেখেই হঠাৎ করে সেই কালো অংশটা ছোট চাকু দিয়ে কেটে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই পায়ের ভেতরের জমা রক্তগুলো গামলায় পড়তে শুরু করলো। যেভাবে আমরা মোটরসাইকেলের মবিল পাল্টাই সেভাবেই রক্ত পড়তে লাগলো। রক্তের ধারা সামান্য কম হওয়া মাত্রই ভাঙ্গা জায়গাটাই চিপে চিপে বাকি রক্তটা ফেলা শুরু করলো। আমি হাউমাউ করে কান্না শুরু করলাম। একটা মানুষ আর কতইবা সহ্য করতে পারে?
অপারেশন এর প্রথম ধাপ শেষ, দ্বিতীয় ধাপ শুরু। হঠাৎ করেই দেখলাম তারা আমার ভাঙ্গা জায়গা ছেড়ে পায়ের গোড়ালির কাছে চলে গেলো। সিনিয়র ডাক্তারটা অন্য দুইজন তুলনামূলক জুনিয়র ডাক্তারকে কি যেনো ইশারা করলো। সেই দুইজন পায়ের গোড়ালির আশেপাশে চেপে ধরে থাকলো। সিনিয়র ডাক্তারের হাতে দেখি একটা ড্রিল মেশিন। দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেও কোন প্রকার জবাব দিলোনা। হঠাৎ দেখলাম অন্য দুইজন পূর্ন শক্তি দিয়ে পা চেপে ধরলো আর সিনিয়র ডাক্তারটা গোড়ালির ১ ইঞ্চি উপরে ড্রিল দিয়ে হাড় ফুটো করা শুরু করেছে। পৃথিবীর সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করছি আর কালেমা পড়ছি আমি। মনে হচ্ছে এরচাইতে হয়তো গুলি খেয়ে মারা যাওয়া অনেক সহজ। ভালো পা দিয়ে ডাক্তারের ঘাড় লাথি দেওয়ার পরে সামান্য সময়ের জন্য থামলো আর চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালো। শুধু দেখলাম ড্রিলের অর্ধেক সুচ পায়ের ভেতরে ঢুকে আছে। এইবার আরও পুর্ণশক্তিতে বাকিটুকু ছিদ্র করে ওইপাশ দিয়ে বের করে ফেললো। এই ব্যথার বর্ননা করা পৃথিবীর কারও পক্ষে সম্ভব কিনা আমার জানা নাই।
আমার গগনবিদারী চিৎকার শুনে ফুফাতো ভাই অপারেশন থিয়েটারের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আর ডাক্তারদের কাছে হাতজোর করে বলছে, "নূন্যতম অবশ করে নেন। নাহলে ভাইটা মারা যাবে। " ডাক্তার ধমক দিয়ে তাকে বাহিরে পাঠিয়ে দিলো। চিৎকার করে আমার গলা ভেঙ্গে গেছে। এখন আমার নিজের কথা আমি নিজেই শুনতে পাচ্ছিনা। এই প্রথম মনে হচ্ছে আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো। ততক্ষনে ছিদ্রটা দিয়ে রড ঢুকিয়ে দড়ি দিয়ে দুইটা ইটের সাথে টানা দেওয়া হয়ে গেছে। এটাই নাকি আগামী ১০-১৫ দিনের চিকিৎসা। ভাঙ্গা জায়গায় ব্যান্ডেজ শুরু হয়ে গেলো। নাহ। আর পারছিইনা। এখন ঘুমাতে হবেই ..... এটা ভাবতে ভাবতে হয়তো ১ মিনিটের মতো সজাগ ছিলাম। এরপর আর কিছুই মনে নাই ....... (চলবে)
তৃতীয় পর্বঃ হাসপাতালের জীবন এবং পায়ের পূর্নাঙ্গ অপারেশন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:০৫