somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তৃতীয় পর্বঃ হাসপাতালের জীবন এবং পায়ের পূর্নাঙ্গ অপারেশন।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আগেই বলে রাখি, যারা প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্ব পড়েননাই, তারা এই পর্ব নাও বুঝতে পারেন। এজন্য প্রথমেই এই দুটো লিঙ্ক দিয়ে দিলাম ।

প্রথম পর্বঃ
আমার দুর্ঘটনার পুরো বর্ননা। (প্রথম পর্ব )

দ্বিতীয় পর্বঃ
হাসপাতালের চিকিৎসা এবং বিভীষিকাময় মুহুর্ত।

ঘুম যখন ভাঙল, তখন হাসপাতালের ওয়ার্ডের বিছানায় । আসলে সেটা বিছানাও না, ওয়ার্ডের দুই সারির বেডের মাঝখানে মানুষ চলাচলের যেই রাস্তাটা, সেখানেই ফ্লোরে পাটি পেতে তোষক বিছিয়ে জায়গা হলো আমার। চারিদিকে হাড়ভাঙ্গা রোগী আর রোগী, তাদের আর্ত চিৎকার, স্বজনদের কোলাহল, আমার শরীর ঘেঁসেই শত মানুষের হাটাচলা, একেবারে দুনিয়াবী আজাবের পরিস্থিতি। একেতো চোখ দিয়ে দেখিনা, শরীর নাড়াতে পারছিনা, নাক বন্ধ থাকায় মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছি, তার উপর হাড়ভাঙ্গার ব্যাথা। সবই অনুভব করছি কিন্তু সহ্য করা ছাড়া কিছুই করার নাই। ঘুম ভাঙ্গার এক দেড় ঘন্টার মধ্যেই আমার ডানপাশের এক রোগি মারা গেলো। তার স্বজনেরা উচ্চস্বরে বিলাপ করছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে শুধু বলছি, কিছুদিনের জন্য যাতে আমাকে অনুভূতিশুন্য করে দেওয়া হয় । এই নারকীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাইছি বারবার । অথচ হাতটা উচু করে চোখের পানি মোছারও ক্ষমতা তখন অবশিষ্ট নাই ।
এর মাঝেই ডাক্তার এসে কি যেন ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন । পরে শুনেছি, সেটা নাকি “মরফিন” ইঞ্জেকশন ছিলো । এই মরফিন এমন একটা জিনিস, যেটা দিয়ে উচ্চমাত্রার মাদকাসক্তরা নেশা যেমন করে, তেমনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে চুড়ান্ত পর্যায়ের পেইন কিলার হিসেবেও ব্যাবহার করা হয় । এই নেশার ঘোরে ১ সপ্তাহ কীভাবে কেটে গেলো বুঝতেই পারলামনা । শুধু সামান্য কিছুক্ষনের জন্য জেগে ব্যাথায় কাতরাতাম, একটু পরে আবারও ঘুমিয়ে যেতাম । পরে শুনেছি মরফিনের হাই ডোজ দেওয়াতে আমার মুখ দিয়ে নাকি সাদা ফেনাও বের হতো । যাইহোক, ১ সপ্তাহ পরে আমার এরকম অবস্থা শুনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক মহোদয় আমাকে তার জন্য স্পেশালী রিজার্ভ করা একটি কেবিন দিয়ে দেন এবং অন্য কোন কেবিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই থাকতে বলেন । এমনকি তার ব্যাক্তিগত সহকারীকে নির্দেশ দেন যাতে সার্বক্ষণিক আমার কন্ডিশন সম্বন্ধে উনাকে জানানো হয়। এর পর থেকে আমার চিকিৎসা ব্যবস্থাও ডাক্তাররা জোরদার করলেন। বিশেষ করে শেরপুরের বিখ্যাত ডাক্তার এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ যেভাবে সবসময় খোজখবর, দিক নির্দেশনা এবং ডাক্তারদের আমার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তা সেইসময় আমার অনেক উপকারে এসেছে। চিকিৎসা চলতে চলতে ২৪ শে অক্টোবর আমার অপারেশনের তারিখ চলে এলো । এখন পায়ের ওই রড খুলে নতুন দুইটা রড এবং ১৮ টা স্ক্রু ভেতরে ঢুকানো হবে ।
অপারেশনের সময় যত ঘনিয়ে আসে, আমি আরও আতঙ্কিত হই। কতক্ষন অপারেশন হবে? আবারকি অবশ ছাড়াই ড্রিল করবে? একটা ছিদ্রই সহ্য করতে পারিনাই, ১৮ টা সহ্য করতে পারবো তো? অপারেশন সাকসেসফুল না হলে কি হতে পারে? তখন পা কেটে ফেলবে? মোটকথা আমি বেচে ফিরবো তো ? এরকম নানান প্রশ্ন গিজগিজ করছে মাথায় । এভাবেই চলে এলো সেই মুহূর্ত। অপারেশন থিয়েটার থেকে নার্স এবং বয় সবুজ এপ্রোন পড়ে এসে বললো তাদের সাথে যেতে হবে । নিজেকে তখন ফাসির আসামী মনে হচ্ছে । যেন সামনে আমার মৃত্যু কিন্তু ফেরানোর কোনই পথ নাই। আমি রাজি না হলেও যেন জোর করে ঝুলিয়ে দিবে। যাওয়ার আগে আম্মুকে আর বন্ধু জাহাঙ্গীরকে বলে গেলামঃ আমার কিছু হয়ে গেলে যাতে সবাই ইহানকে দেখে রাখে ।

নানান ফরমালিটিজ শেষে থিয়েটারে ঢুকলাম। সিনেমা-টিভি ছাড়া, বাস্তবে এরকম অপারেশন থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা জীবনের এই প্রথম। সেই টিভির চাইতেও থরে থরে ছুড়ি, কাচি, ড্রিল মেশিন সহ নানান যন্ত্রপাতি সাজানো। পার্থক্য শুধু এটাই, টিভিতে দেখার সময় ভয় পেলে চ্যানেল চেঞ্জ করা যায় কিন্তু এখান থেকে পালাবার কোনই পথ নাই । আমাকে সেই বিছানায় বসিয়ে কয়েকটা ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরে বিশেষ একটা ইঞ্জেকশন আমার পিঠের মেরুদন্ডের দুই হাড়ের চিপায় দিলো যাতে পুরো স্পাইনাল কর্ডই অবশ হয়ে যায় । কিছুক্ষন পরেই অনুভব করলাম, কোমড়ের নিচ থেকে পুরোপুরি অবশ । আমাকে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপরে উচু করে পর্দা দিয়ে দিলো যাতে ডাক্তারদের কাজকর্ম আমি দেখতে না পারি । সৌভাগ্যক্রমে এনেসথিয়ার ডাক্তার ছিলেন আমারই এক আন্টি যিনি পুরো সাড়ে ছয় ঘন্টা ধরে আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন , আমাকে সাহস দিয়েছেন । উনি আমার কাছে তখন ছিলেন আল্লাহ প্রদত্ত ফেরেশতার মতো । অপারেশন শুরু হওয়ার আনুমানিক দুই ঘন্টা পর থেকে আবারও একের পর এক ড্রিলের ভয়ংকর শব্দ । আগেই বলেছি, সিরিয়াস অবস্থাতেও আমার মজা করার বাজে অভ্যাস। মেইন ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “স্যার, ঘরের টাইলস কিংবা কারেন্টের ওয়ারিং এর কাজ করতেছেন নাকি? শব্দ শুনেতো তেমনই মনে হচ্ছে।“ রুমের সবাই সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে এরপর হো হো করে হেসে দিলো। এর কিছুক্ষন পরেই তাদের লাঞ্চ আওয়ার এসে পড়েছে । শুধু দেখলাম রক্তমাখা এপ্রোনগুলো রেখেই অন্যরুমে নামাজ পড়তে আর খাবার খেতে গেলো । তারা সরে যেতেই হঠাত আমার ডানপাশে চকচকে আয়নার মতো কিছু একটায় দেখি আমার পা-টা প্রতিফলিত হয়ে দেখা যাচ্ছে । লাল মাংস কেটে সম্পূর্ণ ফাক করে রাখা ভেতরের হাড়টা পুরোপুরি স্পস্ট দেখা যাচ্ছে । এমনকি হাটুর বাটিটার নিচেও আংশিক দেখা যাচ্ছে। চোখটা অন্যদিকে সড়িয়ে নিয়ে মাইন্ড ডাইভারশনের উদ্দেশ্য আরেকজন স্টাফের সাথে গল্পে মেতে উঠলাম। এই বীভৎস অবস্থা দেখেও ডাক্তারদের গলা দিয়ে ভাত কিভাবে ঢুকে সেটা মাথায় ধরেনা । অবশ্য এগুলো দেখতে দেখতে তাদের সয়ে গেছে । পৃথিবীর চ্যালেঞ্জিং জবের মধ্যে যে এটাও একটা , সেটা স্বীকার করতে আমি বাধ্য । বিরতির পরে অপারেশন আবারও শুরু হওয়ার পরে বাধলো বিপত্তি । আমি খুব বেশি কাপতে লাগলাম । যাকে খিচুনিও বলা যেতে পারে । দাতে দাত ঠকঠক করে কাপতেছে , কাপুনির চোটে আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে । ডাক্তাররাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন । অপারেশন ফেলে রেখে কি কি যেন যন্ত্রপাতি দিয়ে ট্রিটমেন্ট করার ১৫-২০ পরে কিছুটা কম হলো । আমিই তখন অক্সিজেন মাস্ক খুলে বললাম, “আবার শুরু করেন। এখন যতটুকু কাপুনি আছে , এইটুকু ব্যাপার না ।“ বড় ডাক্তার বললেন, “আপনার মতো শক্ত মনোবলের রোগীকেই আমরা পছন্দ করি। এইসব রোগী সুস্থ হয় দ্রুত।“ এটা শুনে কনফিডেন্স লেভেল আরেকটু বেড়ে গেলো আমার। এতোদিনের জমে থাকা সকল ভয় তখন সম্পূর্ণ গায়েব । উনাদের সাথে আরও কিছুক্ষন গল্প করার পরে আন্টি আমাকে বললো , অপারেশন মোটামুটি শেষের পথে, এখন শুধু সেলাইগুলো করবে।
পাক্কা সাড়ে ছয় ঘন্টা অপারেশন শেষে সেখানকার সকলকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বাহিরে আসলাম । আমাকে নেওয়া হলো পোস্ট অপারেটিভ রুমে । এক ঘন্টা পর থেকে শুরু হলো সেসব জায়গায় তীব্র ব্যাথা । ব্যাথার চোটে চিতকারে অন্যান্য সিরিয়াস রোগিদেরও সমস্যা হচ্ছে কিন্তু আমিতো থাকতে পারছিনা । আবার ব্যাথানাশক ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরেও নিজের কেবিনে গিয়েও সারারাত চিৎকার। অবশেষে ভোরের দিকে তীব্রতা একটু কম । তখন ঘুমের রাজ্যে আবারও হারিয়ে গেলাম ।।

সম্ভবত ১১ম দিনে আমার সেলাই তোলা হলো। এর আগে শুধু দুইবার ড্রেসিং করা হয়েছে । অবশেষে ফেব্রুয়ারীর ১২-১৩ তারিখে বাড়িতে যাওয়ার ছুটির ঘন্টা বাজলো ।

তুর্থ এবং শেষ পর্বঃ আমার এখনকার অবস্থা এবং জীবন থেকে পাওয়া কিছু শিক্ষা । ( কয়েকদিনের ভেতরই লিখে ফেলবো ইনশা আল্লাহ )

কিছু ছবিঃ
অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিট আগেঃ



অপারেশনে ব্যবহৃত রড আর স্ক্রূ এর একাংশঃ


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:০১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×