somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায়ের অতীত ও বর্তমান

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানবসমাজে জন্মগত ও পেশাগত বৈষম্যের কারণে বঞ্চনার শিকার এক শ্রেণির মানবগোষ্ঠী আন্তর্জাতিকভাবে এবং বিজ্ঞজনদের কাছে 'দলিত' নামে পরিচিত। দলিত শব্দের আভিধানিক অর্থ "মর্দিত, মাড়ানো হয়েছে এমন (পদদলিত), পিষ্ট, দমিত, শাসিত, নিপীড়িত"। বাংলাদেশে দুই ধরনের দলিত শ্রেণি লক্ষ্য করা যায়। যার একটি হচ্ছে 'বাঙালি দলিত' এবং অপরটি 'অবাঙ্গালি দলিত'। এই দলিত শ্রেণির মানুষেরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত এবং সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
বাঙালি দলিত বলতে সমাজে যারা অস্পৃশ্য তাদের বোঝায়। যেমন: চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, বাউলিয়া, ভগবানীয়া, মানতা, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, রানা কর্মকার, রায়, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি সম্প্রদায় সমাজে অস্পৃশ্যতার শিকার। এই সব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত।

ইসলাম ধর্ম জাতিভেদকে অস্বীকার করলেও এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকে পেশার কারণে সমাজে পদদলিত হয়ে রয়েছে, যেমন: জোলা, হাজাম, বেদে, বাওয়ালী।


আর অবাঙালি দলিত বলতে বোঝায় যেসকল দলিত শ্রেণি জাতীয়তা ভেদে বাঙালি নয়। ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি (১৮৩৮-১৮৫০) বিভিন্ন সময়ে পূর্ববঙ্গে ভারতের উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, উড়িষ্যা, কুচবিহার, রাচি, মাদ্রাজ ও আসাম থেকে হিন্দি, উড়িষ্যা, দেশওয়ালী ও তেলেগু ভাষাভাষী মানুষের পূর্ব-পুরুষদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী, চা-বাগানের শ্রমিক (১৮৫৩-৫৪), জঙ্গল কাটা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য নিয়ে এসেছিল। অভাবি এই অভিবাসীরা দেশের সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং সিলেটে চা-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। ভূমিহীন ও নিজস্ব বসতভিটাহীন এসকল সম্প্রদায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জমি, রেলস্টেশনসহ সরকারি খাস জমিতে বসবাস করছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: হেলা, মুচি, ডোম, বাল্মিকী, রবিদাস, ডোমার, ডালু, মালা, মাদিগা, চাকালি, সাচ্চারি, কাপুলু, নায়েক, নুনিয়া, পরাধন, পাহান, বাউরি, বীন, বোনাজ, বাঁশফোর, ভূঁইয়া, ভূমিজ, লালবেগী, জনগোষ্ঠি। এসব জনগোষ্ঠি তেলেগু, ভোজপুরী, জোবালপুরী, হিন্দি, সাচ্চারী ও দেশওয়ালী ভাষায় কথা বলে। এই সম্প্রদায়গুলিই মূলত অবাঙ্গালি দলিত শ্রেণি।
ঋষিঃ বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বিশেষ করে-উত্তর বঙ্গে এরা ‘রুইদাস’ নামে পরিচিত। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ঋষিদের সংখ্যাগত নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছে যশোরের ঝিকরগাছার শিমুলিয়া, মনিরামপুর, কেশবপুর; সাতক্ষীরার তালা, কাশিমনগর, আশাশুনি; বাগেরহাটের মোল্লারহাট, ফকিরহাট; ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ এবং জয়পুরহাট ও মানিকগঞ্জ জেলার প্রায় সকল উপজেলায়। ঋষিরা প্রধানত হিন্দু ধর্মালম্বী। তবে বর্তমানে অনেকে খ্রিস্টান ধর্মেও ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ঋষিরা চামড়ার কাজ ছাড়াও বাঁশ বেতের দ্বারা বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে থাকে। ঋষিদের আদিভাষা ‘ঠার’ তবে তা এখন প্রায় বিলুপ্ত।
কায়পুত্রঃ শুকর পালন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠি। এদের ‘কাওরা’ নামেও সম্বোধন করা হয়। কায়পুত্র সম্প্রদায়কে ঋষিদের একটি শাখাও বিবেচনা করা হয়। খুলনা, যশোর, গোপালগঞ্জ, গাজিপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট প্রভৃতি অঞ্চলে কায়পুত্রদের বসবাস রয়েছে। শুকরের মাংসের চাহিদা আছে এবং শুকর চরানোর জন্য পর্যাপ্ত চারণভূমি আছে এমন জেলাগুলিতে শুকরের পালসহ কায়পুত্রদের দেখা যায়। অধিকাংশই সনাতন ধর্মের অনুসারী। কায়পুত্ররা সাধারণভাবে পাঁচটি গোত্রে বিভক্ত।
কুমারঃ কুম্ভকার, পাল বা রুদ্রপাল নামেও পরিচিত। এ সম্প্রদায় মূলত মৃৎশিল্পী। মাটির তৈরি দৈনন্দিন ব্যবহার্য তৈজসপত্র প্রস্ত্তত ও বিক্রয়ের মাধ্যমে জীবন ধারণ করে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৮০ হাজার পাল পরিবার রয়েছে। সনাতন ধর্মালম্বী কুমাররা নিজেদের ‘তফশিলী সম্প্রদায়’ ভুক্ত বলে থাকে। অনেকে আবার নিজেদের ক্ষত্রিয় বলেও দাবি করে।
কামারঃ কামাররা মূলত কৃষি সমাজের বিভিন্ন উপকরণ যেমন: নিড়ানি, শাবল, কুড়াল, লাঙ্গলের ফলা, কাঁচি, দা-বটি ইত্যাদি তৈরি করে। লোহার পাশাপাশি যারা কাঁসা পিতলের কাজ করে তারা অনেক সময় ‘বসাক’ বা ‘কর্মকার’ হিসেবে পরিচিত হন। অতীতে কেবল হিন্দু ধর্মালম্বীরা এ পেশায় থাকলেও বর্তমানে মুসলমানদেরও এই পেশায় দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে বিশেষ করে জয়পুরহাটে ‘রানা কর্মকার’ বলে আর একটি জনগোষ্ঠির সন্ধান পাওয়া যায়। এই জনগোষ্ঠি ভারত থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। তখন তারা কর্মকার পেশায় নিযুক্ত থাকলেও এখন অন্যান্য পেশায় ছড়িয়ে গেছে। রানা কর্মকারদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও তার কোন লিখিত রূপ নেই। সনাতন ধর্মলম্বী এই জনগোষ্ঠি উঁচু মাটির তৈরি ঘরে বাস করে এবং তারা অনেক গোত্রে বিভক্ত। তাদের সুপরিচিত একটি উৎসব হলো ‘লবান’ (নবান্ন)।
কলুঃ এদের পেশা ঘাঁনিতে শষ্য দিয়ে তেল তৈরি করা। পরিবারের সবাই মিলে কাজটি করা হয়। তেল তৈরির কাজটিকে বলা হয় ‘গাওয়াল’ করা। বীজ থেকে তেল তৈরির নতুন প্রযুক্তি আসায় এবং সামাজিক অসম্মান থেকে মুক্তি পেতে কলুরা আদি পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েই কলুদের দেখতে পাওয়া যায়। এই সম্প্রদায়ের হিন্দুদের তেলি বলা হয়। কলুরা নিজ ধর্মের প্রার্থনার পাশাপাশি গাছ বা ঘাঁনিকে সম্মান জানিয়েও প্রার্থনা করে। কুষ্টিয়া জেলায় কলু সম্প্রদায়ের প্রায় ছয় হাজার মানুষ রয়েছে। এছাড়াও ময়মনসিংহ, যশোর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট এবং খুলনায় অনেক কলু পরিবার রয়েছে।
জেলেঃ সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা প্রাচীন বাংলায় কৈবর্ত সমাজের এক অংশ চাষী এবং অপর অংশ জেলে হিসেবে পেশা বাছাই করে নিয়েছিল। জেলেরা অঞ্চলভেদে মালো, রাজবংশী, জলদাস হিসেবেও পরিচিত। এদের মধ্যে রাজবংশীরা এককালে খুবই প্রভাবশালী জনগোষ্ঠি ছিল। মালদা, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এদের রাজত্ব ছিল। পরে তারা পাল বংশের কাছে পরাস্ত হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এখনো বিপুল সংখ্যায় রাজবংশী ও মালো রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এরা মৎস্যজীবী হলেও মাছ ধরার ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় এরা এখন অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। মৎসজীবীদের মাঝে যারা মাছ ধরার পাশাপাশি চাষেও যুক্ত তারা ক্ষেত্র বিশেষে কৈবর্ত হিসেবে পরিচিত। মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে যারা মাছ ধরার চেয়ে কেনা-বেচায় অধিক সংশ্লিষ্ট তারা নিকারি নামে পরিচিত। যশোর, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে অধিকাংশ নিকারির বাস।
ডোমঃ হিন্দু ধর্মের একটি অন্যতম নিম্ন বর্ণ। ডোমেরা মূলত মৃতদেহ পরিচর্যা, ব্যবচ্ছেদ ও সেলাই করা এবং ময়না তদন্তকাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধানের কাজে জড়িত। এরা মৃতদেহ সৎকারের কায়িক কাজও করে থাকে। বর্ণপ্রথার কারণে ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবেই এরা চিহ্নিত। পূর্বে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে তারা দড়ি, মাদুর, পাখা, ঝুড়ি তৈরি এবং ঝাড়ুদারের কাজ করতো। এক সময় ডোম নারীরা গান-বাজনা ও অভিনয় করতো।
বাংলাদেশে বাঙালি এবং অবাঙালি- এই দুই ধরনের ডোম আছে। অবাঙালি ডোমদের ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝিতে বিভিন্ন কাজের জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উড়িষ্যা, কুচবিহার, রাঁচি, মাদ্রাজ ও আসামের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা হয়। অনেকের ধারণা মধ্যযুগে ডোমরা দাক্ষিণাত্য থেকে বাংলায় এসেছিল। ধারণা করা হয় যে, এরা ১৮৩৫-১৮৫০ এর দিকে ভারতের পাটনা এবং অন্ধপ্রদেশ থেকে এসেছে। চর্যাপদে ডোম শব্দের উল্লেখ আছে এবং এটা থেকে ধরে নেওয়া হয় যে, তারা এই বাংলায় বসবাস শুরু করে আর্যদেরও আগে। বর্তমানে সমাজ বিজ্ঞানী এবং বাম-রাজনীতিবিদগণ ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত ও শোষিত শ্রেণীকে ‘দলিত’ অর্থাৎ নীপিড়িত বলে আখ্যায়িত করেন, কেননা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ডোমেরা উপরিশ্রেণীর সর্বনিম্নে অবস্থিত।
১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত পোস্তগলা শ্মশানঘাটের পাশে এখনও ৭টি ডোম পরিবার আছে যারা ১৫০ বছর যাবত বংশ পরম্পরায় বসবাস করছে। ১৮৯১ সালের আদমশুমারিতে ডোমদের নমশুদ্র বলা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত এরা চাড়াল হিসেবে পরিচিতি ছিল। মহাত্মা গান্ধী এদেরকে হরিজন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ডোম নারীদের অনেকেই দাইয়ের কাজ করে থাকেন। ডোমদের বিবাহ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান নিজস্ব নিয়মে পালিত হয়।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায়ই ডোমদের বসতি রয়েছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ডোমদের সংখ্যা ৩১৭,৩৩৭। বর্তমানে ডোমদের প্রধান কর্মক্ষেত্র বিভিন্ন হাসপাতাল। তাছাড়া এদের অনেকেই গৃহস্থালির জিনিসপত্র যথা কুলা, ঝুড়ি, সরপোস, ঢাকনা, ফুলরাখার ঝুড়ি, পাখা, খাঁচা, বড় বড় টুকরি, চাল ধোয়ার ডালা ইত্যাদি নির্মাণে কর্মরত থাকে।
অধিকাংশ ডোম ধর্মীয়ভাবে বৈষ্ণব মতের অনুসারী, কিন্তু আদর্শের প্রতীক ধর্মরাজ তাদের উপাস্য। তাদের প্রধান অনুষ্ঠান শ্রাবণী পূজা। এটা অনুষ্ঠিত হয় জুলাই এবং আগস্ট মাসে। পূজায় শূকরছানা বলি দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে এক বাটি রক্ত সংগ্রহ করে আরেক বাটি দুধসহ তা দেবতা নারায়ণের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়। আবার ভাদ্র মাসের অন্ধকার রাতে এক কৌটা দুধ, একটি নারকেল, এক ছিলিম তামাক ও অল্পপরিমাণ শন হরিরাম দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়। এরপর তারা শূকর জবাই করে ভোজ উৎসবের আয়োজন করে।
তবে বর্তমানে মুসলিমরাও ডোমের কাজে আসছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত ডোমদের একটা বড় অংশ মুসলমান যার কারণে বংশ পরম্পরায় তৈরি হওয়া জাত ডোমদের কাজের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে আসছে।
ডালুঃ বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ডালুরা ইন্দো-মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর একটি শাখা। এরা নিজেদেরকে মহাভারতের তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের পুত্র বভ্রুবাহনের বংশধর বলে মনে করে। কিংবদন্তি আছে যে, বভ্রুবাহনের বংশধর সুবলা সিং বা ডাল্জী মনিপুর হতে বিতাড়িত হয়ে স্বীয় দলবলসহ আসামের পুরো মধ্যাঞ্চল এবং দুর্গম গারো পাহাড় অতিক্রম করে বর্তমান বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভোগাই নদীর তীরে বারেঙ্গাপাড়া নামক স্থানে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। যে স্থানটিতে ডাল্জী সদলবলে বসতি স্থাপন করেন সেই স্থানটি পরবর্তীকালে তাঁর নামানুসারে ডালুকিল্লা নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে স্থানটি ডালুবাজার নামে পরিচিত। পরে এই ডালুবাজার বা ডালুগাঁওকে কেন্দ্র করেই উত্তরে হাড়িগাঁও হতে দক্ষিণে হাতিপাগাড়, কুমারগাতী, সংড়া, জুগলী প্রভৃতি স্থানে এবং কংশ নদীর পাড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ডালুদের বসতি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে বর্তমান ডালু জনসংখ্যা দেড়হাজারের মত এবং তারা বিক্ষিপ্তভাবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এবং শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায় বসবাস করছে।
ডালুরা মূলত কৃষিজীবী। তবে বর্তমানে এদের শতকরা নববই ভাগই ভূমিহীন; তাই কৃষিজীবী এ সম্প্রদায় বর্তমানে ভূমিহীন শ্রমজীবী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। ডালু সমাজে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম, মাত্র ১০%। শিক্ষিত ডালুদের অনেকে ইদানীং সরকারি-বেসরকারি চাকুরিও করছে। ডালুরা স্বভাবে শান্ত প্রকৃতির এবং সুশৃংখল জীবন যাপন করতে তারা অভ্যস্ত।
ডালুদের পরিধেয় পোশাকপরিচ্ছদ হাজং ও বানাইদের মত। ডালু মহিলারা যে পোশাক পরিধান করে সেটিকে তাদের ভাষায় পাথানি বলে। এই পাথানি দৈর্ঘ্যে ৬৩ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ৪৫ ইঞ্চির মত হয়ে থাকে। ডালু মহিলারা আগে নিজেরাই নিজেদের পাথানি বুনতেন। বর্তমানে তারা বাঙালিদের মত শাড়ি পরিধানে অভ্যস্ত হচ্ছে। ডালু পুরুষেরা ধুতি-জামা ব্যবহার করে থাকে।
ডালুদের মৌখিক এবং লিখিত ভাষা বাংলা। বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণেও তারা বাংলা ভাষাকেই ব্যবহার করে, তবে উচ্চারণগত সামান্য পার্থক্য রয়েছে। এক সময় মণিপুরী ভাষায় ডালুরা কথা বলতো। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশি ডালুরা সেই ভাষা আর ব্যবহার করে না।
ডালুদের প্রধান খাদ্য ভাত। তরকারি রান্নার বিশেষত্ব প্রায় ক্ষেত্রেই গারোদের অনুরূপ। হিঁদল শুঁটকি তাদের তরকারি রান্নার অন্যতম উপকরণ। বাঁশের কোঁড়, কলার মোচা তাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়। এরা সকল প্রজাতির মাছ, শূকর, ছাগল, ভেড়া, হাঁস প্রভৃতির মাংস খায়। গরু ও মহিষের মাংসকে তারা নিষিদ্ধ মনে করে। নিজগৃহে প্রস্ত্ততকৃত ভাতের পঁচুই মদ ডালুরা পান করতে পছন্দ করে।
ডালুরা কয়েকটি গোত্র বা দলে বিভক্ত। চিকাং, পিড়া এবং মাশী এই তিনটি হচ্ছে ডালুদের প্রধান গোত্র এবং তারা এগুলিকে দপ্ফা বলে। এই তিনটি প্রধান দপ্ফা ছাড়াও ডালুদের আরও সাতটি অপ্রধান গোত্র বা দপ্ফা রয়েছে। সেগুলি হলো: দরুং, নেংমা, কাড়া, মাইবাড়া, বাপার, কনা এবং গান্ধী। এই দপ্ফা বা গোত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। আন্তঃগোত্র বিবাহ ডালুসমাজে নিষিদ্ধ। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম করে তবে তার জন্য কঠোর সামাজিক শাস্তির বিধান রয়েছে। মাতৃসূত্রীয় সমাজ না হলেও ডালুরা মায়ের দপ্ফা বা গোত্রনাম গ্রহণ করে। সম্প্রতি ডালুরা তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দপ্ফা নামের পরিবর্তে বর্ণহিন্দুদের অনুকরণে গোত্রনাম ব্যবহারে উৎসাহী হচ্ছে।
ডালুরা হিন্দু সনাতন ধর্মের অনুসারী। তাদের উপাস্য দেবদেবীর মধ্যে গৌর, নিতাই, মনসা প্রভৃতি প্রধান। আদি দেবতা, যেমন- কেড়েং-কুড়ি, পথ-খাওরি, হয়দৈব প্রভৃতির নাম হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ডালুরা বাস্ত্তদেবতার থান রাখে। বাস্ত্তদেবতাকে তারা গ্রামের রক্ষাকর্তা হিসাবে গণ্য করে। প্রায় প্রতিটি বসত বাটিতেই তুলসী মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ডালু নারীরা শুভ সন্ধ্যাকে আবাহন করে নেয়।
ভূমিজঃ বাংলাদেশের একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। আদিনিবাস বিহার ছেড়ে তারা ভূমির সন্ধানে পূর্বদিকে পাড়ি জমায় এবং কৃষি কাজকে পেশা হিসাবে বেছে নেয়। ফলে তাদের নতুন নাম হয় ভূমিজ অর্থাৎ ভূমির সন্তান। বিশ শতকের প্রথম দিকে ভূমিজরা সিলেট অঞ্চলে আসে এবং এখানকার চা বাগানগুলিতে কাজ শুরু করে। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে চা-শ্রমিক হিসেবে তারা বাস করছে। ভূমিজদের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।
ভূমিজরা নিজেদের মধ্যে মুন্ডারী ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। ধর্মবিশ্বাসে ভূমিজরা সনাতনপন্থী হিন্দু। তবে তারা তাদের আদি ধর্মের কিছুকিছু ঐতিহ্যকে এখনও পর্যন্ত সযত্নে লালন করে চলেছে। আদি দেবদেবীর মধ্যে রয়েছে বরম দেওতা, ধরম দেওতা, সিংবোঙ্গা, জাহুবোড়া এবং উৎসবগুলি হচ্ছে বন্দনা, টুসু, কারাম। পৌষ সংক্রান্তির দিনে অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষ দিনে ভূমিজরা টুনু পর্ব পালন করে। ভাদ্রমাসে তারা পালন করে কারাম উৎসব। বিভিন্ন পূজা পার্বণে এবং উৎসব আয়োজনে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী লোকগাঁথা পরিবেশন এবং সমভাবে নারী পুরুষ এতে অংশগ্রহণ করেন। বাধ্যযন্ত্র হিসেবে বাঁশি তাদের নিকট খুব প্রিয় এবং তাদের বাঁশি বাজানোর দক্ষতাও ভাল। পূজা-পার্বণে তারা হিন্দু ব্রাহ্মণদেরকেই পৌরোহিত্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আদিধর্মের দেবদেবী পূজার বেলায় তারা নিজ সম্প্রদায়ের পুরোহিত অর্থাৎ ‘লাভা’কে কাজে লাগায়।
ভূমিজ সমাজ বিভিন্ন গোত্র যেমন: বান, বাউন্দ্রা, ভুগল, গরুড়, কাছিম, কাইট্টা, নাগ, ষাড়, সোনা, ট্রেশা প্রভৃতিতে বিভক্ত। নিজ গোত্রমধ্যে বিবাহ ভূমিজ সমাজে নিষিদ্ধ। ভূমিজরা নিজেদেরকে ক্ষত্রিয় বলে মনে করে। ভূমিজ সমাজে পুত্রসন্তানরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এ সমাজ অসম প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের দ্বারা বিবাহবিচ্ছেদের প্রথা রয়েছে। ছোটখাটো সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা প্রবীণ এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যস্থতায় নিষ্পন্ন হয়।
ভূমিজরা মৃতদেহ দাহ করে। তবে ছয়মাসের কম বয়েসী শিশুকে তারা সমাহিত করে। মৃতব্যক্তির নিকটাত্মীয়েরা এগারোদিন অশৌচকাল পালন করে।
শবরঃ শিকারি জাতি হিসেবে রয়েছে এদের পরিচিতি। সিলেট অঞ্চলে বিশেষত মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলিতে শবরদের বসতি রয়েছে। আলীনগর, শমসেরনগর, ভাড়াউড়া ইত্যাদি বাগানে অনেক শবর পরিবার রয়েছে। অনেক গবেষকের মতে শবরদের ভাষার সাথে বর্তমান ভারতের মুঙ্গের জেলার ভাষার মিল রয়েছে। সিলেটস্থ শবররা সাধারণত বাংলাতেই কথা বলে।
শব্দকরঃ এদের পেশা বাড়িবাড়ি ঘুরে বা হাটবাজারে গানবাজনা করে দাক্ষিণা নেওয়া। এই সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বাস মৌলভীবাজার জেলায়। এই জেলায় বিভিন্ন থানায় প্রায় তিন শত ‘শব্দকর’ পরিবার রয়েছে। নামের শেষে এরা ‘শব্দকর’ পদবী ব্যবহার করে। মূলত হিন্দু ধর্মালম্বী, তবে এই ধর্মের সংকর জনগোষ্ঠিভূক্ত। শিব পূজা, চড়ক পূজা ইত্যাদির প্রচলন আছে শব্দকরদের মধ্যে। মুসলিম পীর ও দরগা সংস্কৃতির প্রতিও শব্দকরদের অনুরাগ দেখা যায়। ৭০ শতাংশ শব্দকর ভূমিহীন।
তবে দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক নতুন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সমাজসেবা অধিদফতর কতৃক নতুন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় -* ১৮ বছর বা তদূর্ধ দলিত, হরিজন ও বেদে জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক প্রশিক্ষণ* ৫০ বছর বা তদূর্ধ দলিত, হরিজন ও বেদে জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা/ বয়স্ক ভাতা প্রদান (মাথাপিছু ৩০০/- হারে) * দলিত, হরিজন ও বেদে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। প্রাথমিক স্তরে মাথাপিছু ৩৫০/-, মাধ্যমিক স্তরে মাথাপিছু ৪৫০/-, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মাথাপিছু ৬০০/- এবং উচ্চতর স্তরে মাথাপিছু ১,০০০/- হারে উপবৃত্তি দেয়া হবে।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাপিডিয়া ও ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:১৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×