somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্ববিবেককে কাঁপিয়েছিল যে ছবি

২৪ শে অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭২ সালের ৮ই জুন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে নাপাম বোমার আগুনে জ্বলছে Trang Bang গ্রাম। আগুনে দগ্ধ নয় বছরের নগ্ন বালিকা Kim Phúc (ফুক) ও আতঙ্কিত কিছু শিশু জীবন বাঁচাতে দৌড়ছে। উল্লিখিত ছবিটি তুলেছিলেন Associate Press-এর ফটোগ্রাফার Nick Ut। তিনি এই ছবিটির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। নাপামের আগুনে দগ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্থ কিম ফুকের নগ্ন ছবিটি ভিয়েতনাম যুদ্ধ তথা ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে আগুনে ঘৃতাহুতির মত কাজ করেছিল।
__________________________________________
ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৯-৭৫): ভিয়েতনাম চীন ও জাপানের পর ফ্রান্সের অধীনে ছিল। ১৯৫৪ সালে জেনেভা চুক্তির আওতায় কমিউনিস্ট ও জাতীয়তাবাদীদের দাবীর মুখে সাময়িকভাবে ভিয়েতনামকে উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে বিভক্ত করা হয়। ১৯৫৭ সালে উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট গেরিলারা National Liberation Font for South Vietnam-র (ভিয়েতকং) অধীনে সংগঠিত হয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনামকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬৮ সালে নিক্সন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের নৃশংসতা বেড়ে যায়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, যুদ্ধবিরোধী মার্কিন জনমত, মাই লাই হত্যাকান্ডের নৃশংসতা, বিশ্বব্যাপী মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ-নিন্দা ইত্যাদি কারণে আমেরিকানদের আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে চরম মূল্য দিয়ে পর্যুদস্ত হয়ে দেশে ফিরে যায় এবং পরে দক্ষিণ ভিয়েতনামী সৈন্যরা উত্তর ভিয়েতনামের কাছে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭৬ সালে কমিউনিস্ট সরকার উভয় ভিয়েতনামকে একত্রিত করে। যুদ্ধে আমেরিকার নিহতের সংখ্যা ৫৮,০০০ ও আহতের সংখ্যা ৩,০৪,০০০। উত্তর ভিয়েতনামের নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ।
__________________________________________

ট্রাং বাং সায়গনের চল্লিশ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি গ্রাম। ভিয়েতনামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর সায়গন ও নমপেনের সংযোগকারী একমাত্র সড়ক "রুট ওয়ান" গেছে এই গ্রামের মধ্য দিয়ে। উত্তর ভিয়েতনামী সৈন্য ও কম্যুনিস্ট গেরিলারা গ্রামটি দখল করে সড়কটি বন্ধ করে দেয়। দঃ ভিয়েতনামী সৈন্যরা সড়কটি মুক্ত করতে ট্রাং বাং গ্রামের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কয়েকদিন ধরে মাঝেমধ্যে দুই একটা গুলির শব্দ শোনা গেলেও যুদ্ধের তেমন একটা আলামত দেখা গেল না। যুদ্ধের খবর পেয়ে সেখানে জড়ো হয়েছিল নিক ওটসহ দেশবিদেশের কিছু সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার। গ্রামটির অনেক লোক ইতিমধ্যে অন্যত্র চলে গেলেও কিছু লোক রয়ে গেল। তাদের ধারণা এখানে যুদ্ধ হবে না। কারণ কমুনিস্ট গেরিলারা গ্রামটি ছেড়ে চলে গেছে। দুপুরের দিকে দঃ ভিয়েতনামী সৈন্যদের কমান্ডার অতিরিক্ত সাহায্যের জন্য Bien Hoa Airforce Base-এ বার্তা পাঠালেন। সাংবাদিকেরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে গ্রামটির দিকে নজর রাখলেন। যে কোন মুহুর্তে গেরিলারা পাল্টা আক্রমণ করতে পারে। দঃ ভিয়েতনামী সৈন্যরা গ্রামটির দিকে কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করল। সেগুলো বিষ্ফোরিত হয়ে বাতাসে হলুদ বর্ণের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। গ্রেনেডের শব্দ শোনে ভাইবোনসহ কিম ফুক ও তার কাজিনরা গ্রামের একমাত্র প্যাগোডাতে আশ্রয় নিল। কয়েক মিনিট পর দু'টি এয়ারক্রাফট উড়ে এসে প্যাগোডার পাশে বোমা ফেলল। এরপরও কোন গেরিলাকে পাল্টা আক্রমণ করতে বা পালিয়ে যেতে দেখা গেল না। এয়ারক্রাপ্টগুলো আরেকটা চক্কর মেরে এসে একই জায়গায় আবারো বোমা ফেলল। তবে এবারের বোমাগুলো দেখতে বড় বড় ড্রামের মত। এগুলো ছিল নাপাম বোমা। চোখের পলকে পুরো গ্রামটি একটি অগ্নিকুন্ডে পরিণত হল। কিম ফুকের শরীরে আগুন ধরে গেলে সে জামাকাপড় টেনে ফেলে দিল। নাপামের আগুনে তখন তার শরীর ঝলসে গেছে। যন্ত্রনায় চিৎকার করে সে ও অন্যান্য সবাই রাস্তার দিকে দৌঁড়তে লাগল। দঃ ভিয়েতনামী সৈন্য ও সাংবাদিকেরা হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগলেন, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড থেকে দগ্ধ-অর্ধদগ্ধ মানুষের গগনবিদারী চিৎকার, দিগ্বিদিক ছুটাছুটি এবং জীবন বাঁচানোর শেষ প্রচেষ্টার বীভৎস দৃশ্য! বিশ্ব কাঁপানো ছবিটি ছিল নিক ওটের তোলা এইসব বিভৎস দৃশ্যেরই একটি। ওট যখন কিম ফুককে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলেন তখন সে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে আর চিৎকার করছে "Nong qua, Nong qua" (খুব গরম, খুব গরম)। সেই মুহুর্তে সাংবাদিকরা তাঁদের কাছে পান করার যে পানিটুকু ছিল তা ফুকের শরীরে ঢেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।


___________________________________________
নাপাম বোমা: কৃষি কাজে আগাছা নির্মূলের জন্য পেট্রোলিয়াম জেলি দিয়ে যে নাপামের উদ্ভব হয়েছিল তা ক্রমে শক্তিশালী হয়ে যুদ্ধের মারণাস্ত্রের রূপ ধারণ করল। Crude oil থেকে naphthenic acid এবং coconut oil থেকে নেয়া palmitic acid এলুমিনিয়াম সোপের সাথে মিশিয়ে বেসিক নাপামের সৃষ্টি। একে আরো শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য যোগ করা হল গ্যাসোলিন ও জেট ফুয়েল। একটি শক্তিশালী নাপামের আগুনের তাপ ২৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত Napam-B তে দেয়া হয়েছিল ম্যাগনেসিয়াম ও হোয়াইট ফসফরাস। নাপামের আগুন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে নীরব ঘাতক গ্যাস কার্বন মনোক্সাইড (CO) সৃষ্টি করে। আগুন থেকে বাঁচতে কেউ মাটির নিচে গর্তে বা সুরঙ্গে আশ্রয় নিয়েও রক্ষা পায় না, সেখানে শ্বাসরোধ করে এই কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস।
__________________________________________


ট্রাং বাং গ্রাম থেকে হাসপাতাল প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। ফটোগ্রাফার ওট আর দেরী না করে ফুক ও গুরুতর আহত অন্য দু'জনকে নিজের গাড়িতে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলেন। ব্যাথা ও যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে ফুক গাড়িতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ওট হাসপাতালে এসে দেখলেন, সেখানে এক নারকীয় অবস্থা। ফ্লোরে, বারান্দায় যুদ্ধাহত মানুষের আর্তনাদ আর ছটফটানি। এতলোকের চিকিৎসার স্থান, লোকবল, ঔষধপত্র কিছুই নাই। ডাক্তার-নার্সরা যেসব আহতদের বাঁচানো সম্ভব শুধু তাদের জরুরী চিকিৎসা করছেন। সুতরাং তাঁরা মৃত্যুপথযাত্রী ফুকের Hopeless case নিয়ে সময় নষ্ট করতে চাইলেন না। ওট ডাক্তারদেরকে বিনীত অনুরোধ করে বললেন, আমি ফুকের দুরাবস্থার ছবি পত্রিকায় পাঠাবো, অনেক লোক তার ঘটনা পড়বে। আমি তাদেরকে ফুকের চিকিৎসার সুসংবাদটুকুও দিতে চায়। অনেক অনুরোধ ও পীড়াপীড়ির পর ডাক্তাররা রাজী হয়ে ফুককে অপারেশন রুমে নিয়ে গেলেন। ওট পত্রিকায় রিপোর্ট করতে সায়গনের দিকে চলে গেলেন। ওটের পাঠানো ছবিগুলো থেকে কিম ফুকের নগ্ন ছবিটি পত্রিকায় প্রকাশ হল। মাই লাই হত্যাকান্ডের বর্বরতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে নিন্দা-প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছিল তা না থামতেই দগ্ধ কিম ফুকের নগ্ন ছবিটি মার্কিন প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে দিল এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তিকে আরো ত্বরান্বিত করল।
___________________________________________
মাই লাই হত্যাকান্ড (My Lai Massacre) ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত সবচেয়ে কুখ্যাত গণহত্যা। ১৯৬৮ সালের ১৬ই মার্চ দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে লেপটেন্যান্ট উইলিয়াম কেলি-র (Lt. William Calley) নির্দেশে এটি পরিচালিত হয়। অনুমান করা হয় প্রায় সাড়ে চার শো থেকে পাঁচ শো লোক এতে নিহত হয়। নিহতদের সবাই ছিলেন নিরস্ত্র ও নিরপরাধ গ্রামবাসী এবং তাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী ও শিশু। এদের শরীরে ছিল পাশবিক অত্যাচার ও নিপীড়নের চিহ্ন। যুদ্ধোন্মাদ নরপিশাচ মার্কিন সৈনিকেরা হত্যার আগে গণধর্ষণ করেছিল নারীদের, গুলি করার আগে শিশুদের নিয়ে তামাশা করেছিল বিড়াল-ইঁদুর খেলার মত, যেসব গ্রামবাসী হাত জোড় করে অবনত মস্তকে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন তাদেরকে হত্যা করেছিল রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। শুধু মানুষ নয়, নড়াচড়ার শব্দ শোনে এই কাপুরুষরা গুলি করেছিল আশেপাশের জীবজন্তু এমনকি গাছের পাতা পর্যন্ত।
বিস্তারিত : উইকিপিডিয়া : মাই লাই
___________________________________________

কিম ফুককে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল ১৪ মাস আর অপারেশন হয়েছিল ১৭টি। তার চিকিৎসায় নিক ওট এবং পরবর্তীতে আরো অনেকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। হাসপাতালে দীর্ঘদিন ডাক্তার-নার্সের সান্নিধ্যে থেকে ফুক স্বপ্ন দেখত বড় হলে সেও একজন ডাক্তার বা নার্স হবে। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হল।


যুদ্ধ থেমে গেছে, জীবনতো থেমে থাকে না। ফুকের মা-বাবার চাষাবাদের কিছু জমি ও রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছু ছিল না। যুদ্ধবিদ্ধস্থ পোড়াবাড়িতে ফিরে এল ফুকের পরিবারের সবাই। শূন্য থেকে শুরু হল বেঁচে থাকার সংগ্রাম। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে মা-বাবা ও ভাইবোনদের সাথে সে সংগ্রামে যোগ দিল রুগ্ন-দুর্বল দেহের ফুক। যুদ্ধের পর ফটোগ্রাফার উটও আমেরিকায় চলে গেলেন। যুদ্ধ, খরা, মহামারী, বন্যা, সাইক্লোন ইত্যাদির মর্মান্তিক শিকার হয়ে কিম ফুকের মত অনেকেই সংবাদ শিরোনাম হয়। মানুষের মুখে মুখে কিছুদিন আলোচিত হয় এদের নাম। অনেকেই এদের জন্য সাময়িক সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করে। তারপর কালের স্রোতে, সময়ের ব্যবধানে এরা আবার হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফুকের বেলায়ও তাই ঘটল। উল্লিখিত ঘটনার পর দশটি বছর কেটে গেল। বিশ্ববাসী দূরে থাক এমনকি ভিয়েতনামবাসীও জানত না বা জানতে চাই নি দুনিয়া কাঁপানো ছবিটির সেই হতভাগা মেয়েটি কোথায় আছে, কেমন আছে।

১৯৮২ সাল। ভিয়েতনামের কম্যুনিস্ট সরকারের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক তখন ভালো ছিল না। একজন জার্মান সাংবাদিক কোন এক ফটো প্রদর্শনীতে ফুকের সেই ছবিটি দেখে একটি ডকুমেন্টারি করার উদ্দেশ্যে ভিয়েতনাম এসে ফুককে খুঁজতে লাগলেন। এক বছর পর তাকে খুঁজে পেলেন হো চি মিন সিটির (সায়গন) নার্সিং কলেজের ক্যাম্পাসে। তার ছবি ও সাক্ষাৎকার নিলেন। ব্যাপারটি ভিয়েতনাম সরকার ভালো চোখে দেখল না। ফুকের সাথে পশ্চিমা মিডিয়ার যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা হল। সেইসাথে মার্কিন বিরোধী প্রোপাগান্ডা হিসেবে সরকারী মিডিয়াতে কিম ফুকের পুরানো ছবি ও কাহিনী প্রকাশ করা হল। ফুক আবার সংবাদ শিরোনাম হল বিশেষ করে ভিয়েতনামে। ফুককে নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার ডকুমেন্টারীর প্রচেষ্টা ও কম্যুনিস্ট সরকারের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। ১৯৮৬ সালে ফুক ভিয়েতনাম সরকারের বিভিন্ন শর্ত মেনে ফার্মাসিস্টে উচ্চ শিক্ষার্থে কিউবা যাওয়ার অনুমতি পেল। যুদ্ধের ১৪ বছর পর লস এঞ্জেলস টাইম ম্যাগাজিনে কিম ফুকের কিউবা আগমনের খবর পেয়ে নিক ওট তাঁকে দেখতে কিউবা গেলেন।

১৯৮৯ সালে "American Peace" নামে একটি সংগঠন যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানালে ভিয়েতনাম ও কিউবা সরকারের আপত্তির কারণে ফুক সেখানে যেতে পারেননি। ১৯৯২ সালে কিউবায় অধ্যায়নকালে কিম ফুক Bui Huy Toan নামে আরেক ভিয়েতনামী ছাত্রকে বিয়ে করে বন্ধুবান্ধবের উপহারের টাকায় হানিমুন করতে মস্কো সফর করেন। আগুনের স্মৃতিকে ভুলে স্বাধীন ও নিরাপদ জীবনের জন্য মস্কো থেকে ফেরার পথে ফুয়েল ট্রানজিটের প্রাক্কালে তাঁরা কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফুক আবারও সংবাদ শিরোনাম হলেন, এবার কানাডায়। প্রাণে বেঁচে গেলেও আগুনের স্মৃতি আজও তাঁকে তাড়া করে ফিরে। ১৯৭২ সালের ৮ই জুন আগুন থেকে বাঁচতে ফুক যে দৌড় শুরু করেছিলেন তা আজও থামে নি। ফুকের পুরো নাম Phan Thị Kim Phúc যার অর্থ "Golden happiness"। সেই "স্বর্নালী সুখের" আশায় কিম ফুক সব বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে চাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য ফুকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে কানাডা সরকার তাঁদেরকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দিলেন।

১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Vietnam Veternas Memorial Fund ফুককে আমন্ত্রণ জানালেন। কিম ফুক আবার সংবাদ শিরোনাম হলেন, এবার যুক্তরাষ্ট্রে। ফুক ওয়াশিংটনের ভিয়েতনাম মেমোরিয়াল হলে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কয়েকশত সৈনিকের সভায় যুদ্ধের অভিশাপ নিয়ে বক্তৃতা দিলেন। সবাইকে শুনালেন বিশ্ব কাপাঁনো ছবিটির যুদ্ধাহত নগ্ন সেই বালিকার জীবন সংগ্রামের কাহিনী, আর দেখালেন ২৪ বছর আগে তাদের নিক্ষিপ্ত বোমার আগুনে ঝলসে যাওয়া সেই দগদগে ক্ষত।


এই সভায় কিম ফুকের নামে একটি ফাউন্ডেশন গঠন হল যার উদ্দেশ্য - যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ শিশুদের সাহায্য করা। কিমকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, "আপনার নয় বছর বয়সের নগ্ন ছবিটি দেখে আপনি কি বিব্রত হন?" উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "মোটেই না, বিশ্ববাসীকে দেখতে দাও, যুদ্ধের নৃশংসতা কত ভয়াবহ হতে পারে।"


কিম ফুক স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বর্তমানে কানাডায় বসবাস করেন। বর্তমানে তিনি Canadian Comission for UNESCO-র সদস্য

১৯৭২ সালে পাইলটদের যে টিমটি ফুকের গ্রামে বোমা ফেলেছিল পরবর্তীতে তাদেরই একজন অনুতপ্ত হয়ে ফুকের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন। যাদের বোমার আগুনে ফুকের ভাইসহ অনেকের মৃত্যু হয়েছিল, পঙ্গু হয়েছিল অনেকে এবং অনেক নিরপরাধ মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল দুর্ভোগ, তাদেরই এক পাইলটকে অপ্রত্যাশিতভাবে খুব কাছে পেয়ে নির্বাক হয়ে গেলেন তিনি। পাইলটটিকে দেখতে লাগলেন, একজন মানুষ কিভাবে এত নির্মম হতে পারে! পাইলটটি তার অনিচ্ছাকৃত কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে যা বললেন তার ভাবার্থ কবির ভাষায়,
"যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা।"
সেই ভয়াল আগুনের স্মৃতিচারণ করে কিম ফুক অনেকক্ষণ কাঁদলেন আর পাইলটটিকে বললেন, 'ইতিহাস তো আর আমরা পরিবর্তন করতে পারি না।' তারপর তিনি অশ্রুর ধারায় ও হৃদয়ের মমতায় মানবতার দৃষ্টান্ত রেখে পাইলটটিকে ক্ষমা করে দিলেন। কিম ফুকের এই ক্ষমা ও ভালোবাসার উষ্ণতার কাছে ম্লান হয়ে গেল নাপামের ভয়ঙ্কর উত্তাপ।


যুদ্ধ, ধর্ম, রাজনীতি ও প্রতিশোধের নামে নিরপরাধ মানুষ হত্যা এখনও চলছে। যার খুব সামান্যই ছবি হয়ে মিডিয়াতে আসে। যুদ্ধের প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের আগুন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশুরাও। আজকের বিশ্ববিবেক জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল ইত্যাদি ইস্যুতে বহুধা বিভক্ত। মানুষ এখন সমষ্টিগত প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের শিকার নিরপরাধ ও অসহায় মানুষের আর্তনাদে সাড়া দেয় না, যদি সে ভিন্ন জাতি/ধর্ম/মতের লোক হয়। মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ও মানব সভ্যতার কলঙ্ক নিরপরাধ মানুষ হত্যার এই বিভৎস চিত্রের পুনরাবৃত্তি বন্ধের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি, লিঙ্গ, গোষ্টী, সম্প্রদায়, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, রাজনীতি ও দলীয় সংকীর্ণতার উপরে উঠে "মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা"।
-----------------------------------------------------------------------
ছবি ও তথ্যসূত্র:
The Survivor by Horst Faas and Marianne Fulton,
http://www.kimfoundation.com
Wikipedia
দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকা
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:৪৪
১১৫টি মন্তব্য ৭৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইরান ইসরাইলের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ আর আমাদের সুন্নী-শিয়া মুমিন, অ-মুমিন কড়চা।

লিখেছেন আফলাতুন হায়দার চৌধুরী, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩০

(ছবি: © আল জাযীরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক)

শ্রদ্ধেয় ব্লগার সামিউল ইসলাম বাবু'র স্বাগতম ইরান পোষ্টটিতে কয়েকটি কমেন্ট দেখে এই পোষ্ট টি লিখতে বাধ্য হলাম।
আমি গরীব মানুষ, লেখতে পারিনা। তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৯




আমরা পৃথিবীর একমাত্র জাতী যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য, নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য প্রাণ দিয়েছি। এখানে মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান চাকমা মারমা তথা উপজাতীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। উপমহাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×