তার গত তিনটি কর্মদিবস একটানা কেটেছে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। গরীবের ঘোড়া রোগ অথবা একটি মাথা গোঁজার ঠাই করার বাসনায় একটি বহুজাতিক মহাজন, আধুনিক অর্থনীতির ভাষায় বহুজাতিক ব্যাংক, এর কাছে ১১ বছরের জন্য ঋণগ্রস্ত থাকা এবং গৃহীত ঋণের ডাবল টাকা ফেরত দেয়ার মুছলেকা দিয়ে বাড়ি কেনার পরিবর্তে একটি 'তলা'র অর্ধেক কিনেছেন। লগ্নি পুঁজির কাছে অনেকটা দাসখত দিয়ে মাটি থেকে একশো গজ ওপরে আপাতত স্থায়ী নিবাসের ব্যবস্থা করেছেন। তাও আবার এ ঢাকা শহরে। অবশ্য একে 'তলা' বললে তিনি নারাজ হতে পারেন। তার কাছে এটি হচ্ছে স্বপ্নের ফ্লাট। আর এ ফ্লাটটির রেজিস্ট্রেশনের কাজ সারতে গিয়েই গত তিনটি কর্মদিবস অত্যন্ত ব্যাস্ত সময় কাটিয়েছেন। মিরপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। এ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে না এলে তাঁর ভুলে যাওয়া শৈশববের একটি পুনপৌনিক প্রশ্ন এতদিন পর আবার স্মৃতির দুয়ারে হয়তো কিছুতেই নাড়া দিত না। নতুন উদ্যমে উকিঝুকি মারতো না।
এ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বড় ম্যাডাম মানে সাব-রেজিস্ট্রার আপা থেকে পিওন পর্যন্ত সবার কাজ-কর্ম দেখে হলফ করে বলা যায়-তারা বাংলাদেশের ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। তাদের ব্যস্ততা নিরবিচ্ছিন্ন। এ নিরবিচ্ছিন্নতার ফাঁকে ফাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনা-দুর্ঘটনাগুলো আস্তে আস্তে তাকে নস্টালজিক করে তোলে। তিনি হারিয়ে যান তার শৈশবে। তখনও স্কুলের গণ্ডি পাড়ি দেওয়া হয়নি। থাকেন মফস্বল শহরে। সামন্ত নানার 'বংশের বাতি' চার ছেলের মধ্যে সেজ মামুজান তার ভীষণ প্রিয়। মামুজানও তাকে খুব আদর করেন। মামুজান পড়েন সমাজতত্ত্বে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্স শেষ করেছেন। আধা সামন্ত পরিবার আর আধা উপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোর সামাজিকায়নে বেড়ে উঠা মামুজান সরকারি কর্মচারী হওয়াটাকে দরকারী মনে করে নিয়মিত ইত্তেফাক পড়া শুরু করেছেন। কোন নিউজ নয়, চাকরির বিজ্ঞাপনই মামুজানের পাঠযোগ্য কনটেন্ট। সে যে অনার্সের পর থেকে শুরু। তারপর একে একে দীর্ঘ চার-ছয় বছর। ইতোমধ্যে মামুজানের মাস্টার্স কমপ্লীট হয়েছে। অথচ চাকরির পরীক্ষা আর শেষ হয় না। একের পর এক চলছে। চলছে তো চলছে। মামুজানের এ ক্রমাগত চাকরির পরীক্ষার ইতিহাসে বার কয়েক সাব রেজিস্ট্রারের পরীক্ষা দিয়েছেন। এবং প্রতিবারই অসফল হয়েছেন। মামুজানের মতো মেধাবী শিক্ষার্থীর বারবার সাব-রেজিস্ট্রার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া এবং পুনপৌনিক অকৃতকার্য হওয়ার ঘটনা সে শৈশবে তার ছোট্র মনের কোনায় প্রশ্ন তৈরি করেছিল। বারবার মনে হয়েছিল এত চাকরি থাকতে মামু কেন সাব-রেজিস্টার হতে চান? শৈশবের সে দুরন্ত দিনগুলোতে সে প্রশ্নের কোন সুরাহা না হলেও আজ যেন সব দিবালোকের মতো তার কাছে স্পস্ট হয়ে উঠেছে। গত তিনদিনের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে তিনি বুঝতে পারলেন রেজিস্ট্রি অফিসের প্রতিটি কাগজের গতি আনতে দরকার স্পীড মানি আর তেল। স্পীড মানি যতবেশি হবে তেলটাও তত বেশি লব্রিকেটেড হবে। তাতে ফাইলের গতিও সচল হবে বেশি। এ দৃশ্য নিজ চোখে দেখে মামু জানের জন্য আজ তার খুব কষ্ট হচ্ছে। যদি মামুর সপ্নটা পুরণ হতো তাহলে মামুজানও সারা জীবন এ স্পীড মানি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতেন। মূল বেতনে কখনো হাত দিতে হতো না। এ সাব রেজিস্টার হওয়ার জন্যও নাকি আবার প্রচুর তেল খরচ করতে হয়েছে তাদের। ইনভেস্টম্যান্ট আর কি! যেমন ইনভেস্টম্যান্ট তেমন প্রফিট। আর তাই জরুরি অবস্থা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান কিছুই ঠেকাতে পারছে না। অবলীলায় সব চলছে এখনও। হায়রে মামুজান সত্যি তুমি বড় দুর্ভাগ্যবান। দোয়া করি পরজনমে যেন বিধাতা তোমায় সাব-রেজিস্টার বানিয়ে দেয়.........
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০০৮ সকাল ১০:৫৭