পায়ের পুরানো ঘা টাতে দপ দপ করছে জয়নাল মিয়ার। আজ এত বছর পেড়িয়ে গেছে তবুও ঘা টা এখন মাঝে মাঝেই জানান দেয়।স্মরন করিয়ে দেয় সেই ভয়াবহ দিনটার কথা। যদিও ডাক্তার বলেছিল সারাজীবন এই ব্যাথাটা তাকে সইতে হবে।স্ক্যাচ এ ভর করে চলতে হয় তাকে। এভাবেই সে কিছু নূরানি কিতাব আর তসবি বিক্রি করে চলে সে।তিন কুলে কেউ না থাকায় অল্পতেই চলে যায় তার। আজ রোদ টাও অনেক কড়া। তার মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। আমি বুঝতে পেরে তাকে ধরলাম।আমাকে বলল বাবা আমাকে একটু ধরে ছায়ায় নিয়ে যাবেন। আমি তাই করলাম,আমার যায়গায় যে কেউ হলেও একই কাজ করত। জয়নাল মিয়ার বয়স প্রায় ষাট হবে। যদিও সে নিজেও জানেনা তার সঠিক বয়স কত। জন্মদিন টা শুধু বড়লোকের উৎসব তাই তারা বয়স মনে রাখে। জয়নাল মিয়ার সাথে কিছু কথা হয় আমার।
জয়নালঃ আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম বাবা।আসলে ব্যাথাটা মাঝে মাঝেই অসহ্য হয়ে যায়।তখন শরীরে জোর পাইনা। তাই আপনাকে বিরক্ত করলাম।
আমি অবাক লোকটি কি সুন্দর পরিস্কার ভাষায় কথা বলছে।আমি তাকে স্বান্তনা দিলাম।
আমিঃ আরে নাহ কিছুনা। আমি কেন, যে কেউ হলেও আপনাকে এটুকু সাহায্য করতই।
জয়নালঃ ঢাকা শহরে অনেক দিন হল, তাই দেখেছি। কেউ কাওকে সাহায্য করেনা আজ কাল।
আমিঃ আপনার পায়ে কি হয়েছিল? দেখেত মনে হয় অনেক পুরানো কাটা,কিভাবে কেটেছে।
প্রথমে বলতে কিছুটা সংশয় থাকলেও আমার জোরাজুরিতে সে রাজি হল সব বলতে।
জয়নালঃ তখন আমি তাগরা জোয়ান,দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। দেশ কে বাচাতে যুদ্ধে গেলাম। শত্রুদের বিরুধ্যে অনেক পরিশ্রম করার পরেও আমরা পিছু হঠতে বাধ্য হই। তখন শরাফ নামের এক সহযোগী দুইজন মিলে আমরা গোলাগুলি চালিয়ে যেতে থাকি। হঠাৎ একটা গুলি আমার পায়ে লাগে। আমি মাটিতে পরে যাই। শরাফ আমাকে পাজা কোলা করে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। চিকিৎসা করাতে দেরি হয়। তাই পা টা কেটে বাদ দিতে হয়। যুদ্ধে জয় হয় আমাদের। তার বদলে এই একটা পা আমার।এটাতো খুবই ছোট্ট ব্যাপার। জীবন দিতেইতো প্রস্তুত ছিলাম সবাই।
আমার কিছুটা সন্দেহ হলো, একজন মুক্তিজোদ্ধা ফেরি করে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে প্রশ্ন করে ফেললাম।
আমিঃ আচ্ছা সরকারতো মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সুবিধে দিচ্ছে, ভাতা দিচ্ছে। আপনি নিচ্ছেন না কেন?
জয়নালঃ আমিত ভিক্ষা করছিনা। তাছাড়া অই ভাতা নিব কেন আমি?
আমিঃ কেন নিবেন না? তাছাড়া আপনার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট আছেত?
জয়নালঃ না বাবা আমার সার্টিফিকেট নেই।
আমার সন্দেহ বেড়ে গেল। আমি ভাবলাম বেটা আমার সাথে গুল মারছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হলে তার তো সার্টিফিকেট থাকবেই। কিন্তু জয়নাল মিয়ার কথা শুনে আমি হতভম্ব।
জয়নালঃ দেখেন বাবা দেশ কে বাচাতে যুদ্ধ করেছি। কোন কিছুর বিনিময়েতো করিনি। কোন কিছুর বিনিময়ে করলেতো সেটা ব্যাবসা হয়ে যায়।আমি ব্যাবসা করতে যুদ্ধ করিনি। তাছাড়া আমি সার্টিফিকেট দিয়ে কি করবো? উপরে আল্লাহ আছেন তিনি সব দেখেন সব জানেন। কৈফিয়ত যদি দিতে হয় তার কাছেই তো দিতে হবে। আর তিনি তো জানেন আমি কি করেছি আর কি করিনি। কাওকে বলার জন্যে বা বাহাদুরি দেখাতে যেমন আল্লাহর ইবাদত করিনা। তেমনি দেশ কে বাচাতে লড়েছি, সেটা দেশ মা জানে। আর কাঊকে জানানোর দরকার কি বলেন?ধন্যবাদ বাবা, ব্যাথাটা কমেছে।এখন আমাকে ফেরি করে বেড়াতে হবে। ভালো থাকবেন,আল্লাহ আপনাকে অনেক ভাল রাখবেন। আপনি ভালো মানুষ। আল্লাহ হাফেয বাবা।
আমার মুখে কথা নেই, আমি কি বলব তাকে? আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল অনেক আগেই। সেটা আপনা আপনি শুকিয়েও গেছে। এবার তার পথের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। স্যালুট জানাবো এই সত্তিকারের দেশ প্রেমিক জয়নাল মিয়াকে? নাকি নিজেকে ধিক্কার জানাবো এমন একজন মানুষকে আমি সন্দেহ করেছি তাই?
Aarif chanchal