ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছদ্মপরিচয়ে আস্তানা গড়ে তুলে বসবাস করছে প্রায় ২০ হাজার জঙ্গি সদস্য। এর মধ্যে ঢাকায়ই রয়েছে তাদের তিন শতাধিক আবাসস্থল বা আস্তানা। সারা দেশে নেতৃত্বপর্যায়ে রয়েছে ১০৩ জন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি। তারা জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী, আহলে হাদিস আন্দোলন, হিযবুত তাহ্রীর এবং পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও তাদের যুব ফ্রন্ট জইশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সূত্রমতে এসব তথ্য জানা গেছে।
লস্কর-ই-তৈয়বা আর জইশ-ই-মোহাম্মদেরও একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে বাংলাদেশে। হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও তাদের অধিকাংশ সদস্যই
জঙ্গি নয় বলে র্যাব সদর দপ্তর জানায়।
সূত্রমতে, এর মধ্যে সারা দেশে জেএমবি আর হরকাতুল জিহাদের সদস্য সংখ্যাই প্রায় সাত হাজার। এ ছাড়া হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য রয়েছে ১০ হাজারের মতো। তবে হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও তাদের সব সদস্যকে পুরোদস্তুর জঙ্গি বলা যাবে না।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, ঢাকা ও এর আশপাশের ব্যস্ত জেলা শহরগুলোতে শতাধিক আবাসস্থলকে জঙ্গিরা আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। গত রবিবার রাতে রাজধানীর কদমতলীতে জঙ্গিদের যে আস্তানায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছে, সেটি ছিল অন্যতম একটি ঘাঁটি। এ ঘাঁটিতে ব্যবহৃত আর উদ্ধার হওয়া গ্রেনেডই প্রমাণ করে তারা কতটা সুরক্ষিতভাবে নিজেদের আস্তানা গড়ে তুলেছিল।
সূত্রমতে, ঢাকার আগারগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, পল্লবী, আদাবর, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, শ্যামপুর, কেরানীগঞ্জ, উত্তরা, উত্তর খান, দক্ষিণ খান, সবুজবাগ, খিলগাঁও ও বাড্ডা এলাকায় তাদের একাধিক ঘাঁটি বা আস্তানা আছে বলে জানা গেছে। কিন্তু তারা এত ঘন ঘন ঠিকানা বদলায় যে গোয়েন্দারা ঠিকানা পাওয়ার পর তা খুঁজে বের করতে করতেই সেটা বদল হয়ে যায়। ঢাকার বাইরে জঙ্গিদের বড় ঘাঁটি হচ্ছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর রাজশাহী এবং কক্সবাজার। উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও এ জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে। তাদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট উদ্ধার হয়। এ ছাড়া দেশের সীমান্ত এলাকায়ও তাদের বসত ঘাঁটি রয়েছে। পাহাড় অঞ্চলে আছে প্রশিক্ষণ ঘাঁটি।
জানা গেছে, প্রতি মাসে এ জঙ্গিদের একবার করে টিএস বা ট্রেনিং সেশনে যোগ দিতে হয়। সেখানে তাদের জঙ্গি তৎপরতার নানা কাজের কৌশল শেখানো হয়। তবে তারা একত্র হলেও কেউই নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে একে অপরকে কিছু বলে না। ফলে একজন ধরা পড়লেও একমাত্র ওই বাসার অন্য সদস্য ছাড়া ভিন্ন কোনো আস্তানার ঠিকানা পাওয়া সম্ভব হয় না বলে গোয়েন্দারা জানান।
গত রবিবার কদমতলীর আস্তানায় পাওয়া পুস্তিকাতেও তাদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট। একটি পুস্তিকায় বলা হয়েছে, 'নিজ এলাকার বাইরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করবে না এবং কাউকে নিজের অবস্থানস্থল জানানো ও বোঝানো যাবে না।' ব্যক্তিগত করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, 'যাকে যে কাজ দেওয়া হয়, এর বাইরে অন্যের কাজ জানার চেষ্টা না করা। তানজিমের গোপনীয়তাই হচ্ছে আমানত। অতি উৎসাহী হয়ে নিজ দায়িত্বের বাইরের কাজ জানার চেষ্টা করা এবং ওই কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করার বদ অভ্যাস পরিহার কর।' পাঠ্য হিসেবে জঙ্গিদের যেসব বই পড়তে বলা হয় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জিহাদ সন্ত্রাস না রহমত, জিহাদের চলি্লশ হাদিস, খুন রাঙ্গা আরাকান, কারাগারের রাতদিন, আল জিহাদ, শায়খ আবদুর রহমানের তাওহিদের মর্ম কথা, সন্ত্রাস ও জিহাদ।
যেখানে জঙ্গি, সেখানেই বোমা বা গ্রেনেড। অস্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে র্যাবের মহাপরিচালক খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গিরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে কম। করলেও সেটা ক্ষুদ্র ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। তবে তাদের কাছে যে বড় ধরনের কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই, সেটাও নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
বেশ কিছুদিন আগে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়েছিল গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গি নেতা মিজান ওরফে বোমারু মিজানের সঙ্গে। মিজান জানিয়েছিল, জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কাজে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার খুবই কম করে। করলেও সেটা ছোট আগ্নেয়াস্ত্র। তবে এই ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারটাও সম্প্রতি শুরু হয়েছে। মূলত তারা অস্ত্র বলতে বোমা বা গ্রেনেডকেই বোঝে। তাদের প্রায় প্রতিটি সদস্য-সদস্যারই গ্রেনেড ছোড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে জানিয়েছিল মিজান।
বড় হামলার আশঙ্কা : র্যাব, পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্রমতে, জঙ্গি কর্তৃক যেকোনো সময় বড় ধরনের সহিংস ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের সামনের একটি টাওয়ার থেকে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের নেতা ও পাকিস্তানি নাগরিক রেজওয়ান আহম্মেদসহ তার তিন সহযোগী এবং একই দিন নিউমার্কেট এলাকা থেকে নান্নু মিয়া ওরফে বেলাল ওরফে বিল্লালকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে এ আশঙ্কা আরো জোরালো হয়েছে। রেজওয়ান হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় পারদর্শী। সে যেকোনো পিস্তল, রিভলবার, একে-৪৭ রাইফেল, এলএমজি, এইচএমজি, আরপিজি-৮, স্নাইপার রাইফেল ও গ্রেনেড চালনায় অভিজ্ঞ। সে আত্দঘাতী দলের সদস্য। আর নান্নু মিয়া ওরফে বিল্লাল ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে আইসি বিমান ছিনতাই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারও হয়েছিল। ভারতে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। ঢাকায় তাদের দলনেতা সুকন্যা টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাটের মালিক জনৈক মহিউদ্দিন। এই মহিউদ্দিন এখনো পলাতক। মহিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে ভয়ংকর হিসেবে চিহ্নিত আরো বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে সূত্র থেকে জানা গেছে।
এ ছাড়া গত ৭ এপ্রিল চানখাঁরপুল থেকে লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা পাকিস্তানি নাগরিক যে মুবাশ্বের ওরফে মুবিন ওরফে ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেও যেকোনো আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা-গ্রেনেড পরিচালনায় দক্ষ। তাকে বলা হয় 'রেইড অ্যান্ড অ্যামবুশ এক্সপার্ট'। এই চক্রের আরো তিন পাকিস্তানি নাগরিক আদিল, জাওয়াদ ও আলী ঘন ঘন বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে। এ ছাড়া কদমতলী থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেডগুলো কেন রাখা হয়েছিল, এ নিয়েও এখন ভাবা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, জঙ্গিরা যেভাবে আবার একত্র হচ্ছে, তাতে যেকোনো বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা তাঁরাও করছেন। মাঝে কিছুদিন তাদের তৎপরতা কম ছিল। এখন মনে হচ্ছে, ওই সময় তারা নিজেদের সুসংগঠিত করার কাজে লাগিয়েছে। জঙ্গি নিয়ে তাঁরাও খোঁজখবর রাখছেন বলে কর্মকর্তারা জানান।
র্যাবের মহাপরিচালক খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের জন্য বা তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখার জন্য র্যাবে পৃথক একটি শাখাই রয়েছে। জঙ্গিদের চেয়ে র্যাবের নেটওয়ার্কও দুর্বল নয় বলে তিনি জানান।
র্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক বিশাল এবং সহিংসতার আশঙ্কা অমূলক নয়। তবে তাদের চেয়েও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে র্যাবে। নিহত বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের স্ত্রীসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও গোয়েন্দাদের নজরদারি রয়েছে। তারা সবাই হয় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জঙ্গি সম্পৃক্ত।
র্যাব সদর দপ্তর সূত্রমতে, ২০০৫ সাল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৫৮২ জঙ্গিকে তারা গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে ২০০৬ ও ২০০৭ সালেই গ্রেপ্তার হয়েছে বেশি। তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনের ফাঁসি হয়েছে। তবে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কতজন জামিনে আছে বা কতজন এখনো কারারুদ্ধ, সে হিসাব নেই র্যাবের কাছে।
একই সূত্রমতে, শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি নেতাদের মধ্যে বাংলা ভাই, পল্টু, নাদিম ও বোমারু মিজানের স্ত্রী কারারুদ্ধ। এ ছাড়া বাকি প্রায় সবার স্ত্রীই এখন বাইরে। তবে কিছুদিন আগে উত্তরায় নিহত জঙ্গি ইমাম রাশেদুলের স্ত্রীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই মেয়ে নিজে, তার দুই খালু, এক মামা ও নানিও জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। জঙ্গিরা সাধারণত নিজেদের মধ্যে ছাড়া বাইরের কারো সঙ্গে আত্দীয়তা করে না। এর নেপথ্য কারণ হচ্ছে অতি সতর্কতা।