ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -৮
উপরের আলোচনা থেকে আমাদের নিকট প্রতিভাত হয় যে, উপর্যুক্ত চারিটি বিষয়কে বাদ দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ও প্রসারের পিছনে কার্যকর অন্যান্য কারণ সন্ধান করা আমাদের প্রয়োজন। বস্তুত ইসলামের নামে সন্ত্রাসের উত্থানের পিছনে অনেক কারণ বিদ্যমান। কোনো বিষয় সন্ত্রাস উস্কে দিচ্ছে, কোনো কোনো বিষয় জঙ্গিবাদীরের প্রচারণা ইসলাম-প্রেমিক সরল-প্রাণ যুবক-যুবতীদের মধ্যে সাড়া জাগাতে পারছে। কারণগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির প্রতিকার করতে পারলে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে তা সহায়ক হবে বলে মনে হয়। এগুলির মধ্যে কিছু কারণ সৃষ্টি করেছেন অমুসলিমগণ এবং কিছু কারণ সৃষ্টি করেছেন মুসলিমগণ। মুসলিম সৃষ্ট কারণগুলির মধ্যে কিছু রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক এবং কিছু ধর্মীয়। এখানে এই জাতীয় কিছু সাম্ভব্য কারণ আলোচনা করছি।
(১) বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধন
ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রধান কারণ বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের উপর নির্বিচার অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ। ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, ইরাক, কাশ্মীর, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, চীন ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্বিচার জুলুম, অত্যাচার ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ (বঃযহরপ পষবধহংরহম) চলছে। এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের অদম্য আবেগই জঙ্গিবাদের জন্ম দিচ্ছে। মানুষ যখন নির্বিচার অত্যাচারের প্রতিবাদে আইনগতভাবে কিছুই করতে না পারে তখন বে-আইনীভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করে এবং তার বে-আইনী কর্মকে ‘আদর্শিক’ ছাপ দেয়। এছাড়া সারা বিশ্বের মুসলিম মানস এই নিধনযজ্ঞের অবসান ও মুসলিম সভ্যতার বিজয় কামনা করছে। জঙ্গিবাদীরা এদেরকে সহজেই বুঝাতে পারছে যে, তাদের পথই নিধনযজ্ঞের অবসানের ও বিজয়ের পথ। এক্ষেত্রে ইসলামী বিধি-বিধান বিচার, আলিমদের মতামত, ফলাফলের বিচার ইত্যাদির চেয়ে আবেগই বেশি কার্যকর।
মার্কিন সরকারের হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ গ্রহণ বা জুলুমের প্রতিকার করতে আবেগী যুবক সাধারণ মার্কিন নাগরিককে বা মার্কিনীদের সাথে সহযোগী বলে অন্য কোনো দেশ ও ধর্মের কোনো মানুষকে হত্যা করেন। এভাবে তিনি ইসলামের দৃষ্টিতে একটি কঠিন অন্যায় ও পাপের মধ্যে নিপতিত হন।
এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়: (১) ইসলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ অন্যায় পদ্ধতিতে করতে অনুমতি দেয় না। (২) ইসলাম একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি প্রদানের অনুমতি দেয় না, (৩) ইসলাম কোনো ব্যক্তি দল বা গোষ্ঠিকে বিচার বা শাস্তির দায়িত্ব নিজে গ্রহণের অনুমতি দেয় না। এজন্য প্রাজ্ঞ আলিমগণ এ সকল ক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে, শান্তিপূর্ণভাবে সহিংসতা বর্জন করে প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপনের উৎসাহ দেন। কিন্তু আবেগী যুবকের কাছে তাদের মত দুর্বলতা বা দালালি বলে মনে হয়। এই পরিস্থিতিতে ‘আধুনিক অর্ধ-আলিম ধর্মগুরুদের’ ‘ফাতওয়া’ তাদের কাছে যুগোপযোগী, সঠিক ও দ্রুত ফললাভের সহায়ক বলে মনে হয়। এভাবেই জঙ্গিবাদের উত্থান ও প্রসার ঘটতে থাকে।
(২) বেকারত্ব ও হতাশা
উপরের ক্ষোভ সকল মুসলিম দেশে বিদ্যমান থাকলেও জঙ্গিবাদী কার্যক্রম সকল দেশে সমানভাবে বিস্তার লাভ করেনি। ইন্দোনেশিয়ায় যেরূপ সন্ত্রাসী কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়, মালয়েশিয়াতে তা পাওয়া যায় না, অথচ ইসলামী শিক্ষার বিস্তার, মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য এবং আমেরিকা ও পাশ্চাত্য বিরোধী মনোভাবে মালয়েশিয়াতে বেশি। এর বড় কারণ সম্ভবত মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পাশ্চাত্য আগ্রাসনের বিরুদ্বে রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের সুস্পষ্ট মতামত। কর্মব্যস্ত ও পরিতৃপ্ত মানুষের মনে ক্ষোভ বা আবেগ বেশি স্থান পায় না। এছাড়া রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে তাদের মনের আবেগ প্রতিধ্বণিত হয়। ফলে তা প্রকাশের জন্য বিকৃত পথের সন্ধান করে না। পক্ষান্তরে বেকার, সামাজিক বৈষম্য বা প্রশাসনিক অনাচারের শিকার মানুষের মনের ক্ষোভ ও হতাশাকে এ সকল আবেগ আরো উস্কে দেয়। এছাড়া এইরূপ মানুষকে সহজেই বুঝানো যায় যে, এভাবে দুই-চারিটি বোমা মারলে বা মানুষ খুন করলেই তোমর মত অগণিত মানুষের বেকারত্ব বা অত্যাচার শেষ হয়ে শান্তির দিন এসে যাবে।
(৩) আধুনিক অর্ধ-আলিম ধর্মগুরুদের উত্থান
কুরআনের পরিপূর্ণ অধ্যয়ন, বিশাল হাদীস ভাণ্ডারের )-এর সহচর-সাহাবীগণের কর্ম, চিন্তা, মতামত ওসকল হাদীস অধ্যয়ন, রাসূলুল্লাহ ( কুরআন-হাদীস ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া অধ্যয়ন ও সমস্যা সমাধানে সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর নেতৃস্থানীয় আলিম, ফকীহ ও ইমামদের মতামত ও কর্মধারা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভের পরেই একজন মানুষ প্রকৃত আলিম ও ফকীহ বলে গণ্য হন এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রিয় সমস্যার ক্ষেত্রে ইসলামী ‘ফাতওয়া’ বা সিদ্ধান্ত ও সমাধান দানের যোগ্যতা অর্জন করেন। যুগে যুগে এরূপ আলিমগণই মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। স্বভাবতই এরূপ আলিমদের সংখ্যা সমাজে কম থাকে। এজন্য মুসলিম উম্মাহর আলিমগণের রীতি হলো, জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে সমকালীন প্রাজ্ঞ আলিমগণের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি পূর্ববর্তী প্রখ্যাত আলিমগণের মতামতের অনুসন্ধান ও তাদের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত প্রদান।
ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস কুরআন ও হাদীস। যে কোনো ব্যক্তি কুরআন-হাদীস পাঠ করলে ইসলাম সম্পর্কে অনেক জ্ঞান লাভ করবেন। ইসলাম সকলকেই এভাবে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করতে নির্দেশ ও উৎসাহ প্রদান করে। কিন্তু কখনোই সকলেই ‘ফাতওয়া’ বা সিদ্ধান্ত প্রদানের অনুমতি দেয় না। শুধু কুরআনের কিছু আয়াত বা কিছু হাদীস পাঠ করে নিজের বুদ্ধি ও আবেগের রঙে রঞ্জিত করে ‘ফাতওয়া’, সিদ্ধান্ত বা সমাধান প্রদান করার প্রবণতা ভয়ঙ্কর।
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম জঙ্গিবাদী ঘটনার মূল কারণ ছিল এই প্রবণতা। ৩৫ হিজরী সালে (৬৫৬ খৃ) ইসলামী রাষ্ট্্েরর খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধান হযরত উসমান ইবনু আফ্ফান (রা) কতিপয় বিদ্রোহীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। বিদ্রোহীদের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার মত কেউ ছিল না। তাঁরা রাজধানী মদীনার সাহাবীগণকে এ বিষয়ে চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে হযরত আলী (রা) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুসলিম রাষ্ট্রের সেনাপতি ও গভর্নররগণ আলীর আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু হযরত উসমান (রা) নিযুক্ত সিরিয়ার গভর্নর হযরত মু‘আবিয় (রা) আলীর আনুগত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি দাবি জানান যে, আগে খলীফা উসমানের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। আলী দাবি জানান যে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পূর্বে বিদ্রোহীদের বিচার শুরু করলে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেতে পারে, কাজেই আগে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি ঘোরালো হয়ে গৃহ যুদ্ধে রূপান্তারিত হয়। সিফ্ফীনের যুদ্ধে উভয়পক্ষে হতাহত হতে থাকে। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য একটি সালিসী মজলিস গঠন করেন।
এই পর্যায়ে আলীর (রা) অনুসারীগণের মধ্য থেকে কয়েক হাজার মানুষ আলীর পক্ষ ত্যাগ করেন। এদেরকে ‘খারিজী’ বলা হয়। এরা সকলেই ছিল অত্যন্ত ধার্মিক, রাতদিন কুরআন পাঠকারী ও রাতভর তাহাজ্জুদ ) ইন্তেকালের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।আদায়কারী আবেগী মুসলমান, যারা রাসূলুল্লাহর ( এরা দাবি করেন যে, একমাত্র আল্লাহর হুকুম ও বিধান ছাড়া কিছুই চলবে না। আল্লাহর বিধান হলো, ইসলামের শত্র“দের সাথে লড়তে হবে। কাজেই এ বিষয়ে মানুষকে সালিস করার ক্ষমতা প্রদান অবৈধ। এ কারণে তারা আলী, মু‘আবিয় ও তাদের সঙ্গী সাহাবীগণসহ সকল মুসলমানকে কাফির ঘোষণা দিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে। তাঁরা তাঁদের মতের পক্ষে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস উদ্ধৃত করতে থাকেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) ও অন্যান্য সাহাবী তাদেরকে এই মর্মে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, কুরআন ও হাদীস )-এর আজীবনের সহচর সাহাবীগণ।বুঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পারঙ্গম হলেন রাসূলুল্লাহ ( কুরআন ও হাদীসের তোমরা যে অর্থ বুঝেছ তা সঠিক নয়, বরং সাহাবীদের ব্যাখ্যাই সঠিক। এতে কিছু মানুষ উগ্রতা ত্যাগ করলেও বাকিরা তাদের মতকেই সঠিক বলে দাবি করেন। তারা সাহাবীদেরকে দালাল, আপোষকামী, অন্যায়ের সহযোগী ইত্যাদি মনে করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।
মুলঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া