ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -৯
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য এদের সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। এদের ধার্মিকতা ও সততা ছিল অতুলনীয়। পাশাপাশি এদের হিংস্রতা ও সন্ত্রাস ছিল ভয়ঙ্কর। অনেক নিরপরাধ অযোদ্ধাসহ হাজার হাজার মুসলিমের প্রাণ নষ্ট হয় তাদের হিংস্রতা ও সন্ত্রাসের কারণে। আর এ সককিছুর মূল কারণ ছিল ইসলাম বুঝার ক্ষেত্রে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদের বুঝকেই চূড়ান্ত মনে করা এবং অধিকতর অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ আলিমদের মতামতকে অবজ্ঞা করা।
সকল যুগেই এরূপ আবেগ তাড়িত ‘ধার্মিক’ ও ‘ধর্মগুরু’ বিদ্যমান ছিলেন। তবে সাধারণ মুসলিম সমাজে এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। কিন্তু গত অর্ধ-শতাব্দী যাবত এক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ‘আলিম’ বা ‘ট্রেডিশনাল উলামা’র পরিবর্তে ‘আধুনিক শিক্ষিত ধর্মীয় নেতাদের’ আকর্ষণীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বিভিন্ন মুসলিম সমাজে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় কার্যকর:
(ক) অনেক আধুনিক শিক্ষিত শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা সাধারণ মানুষ জীবনের মাঝপথে এসে ধর্ম বিমুখতা থেকে ধার্মিকতার দিকে ফিরেন। এ পর্যায়ে তাঁরা কুরআন, হাদীস ও ইসলামের ইতিহাস চর্চা শুরু করেন। এরা মূলত মেধাবী। এক সময়ে এদের অনেকে তাঁদের মেধা, মনন ও বুদ্ধি দিয়ে কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও ‘ফাতওয়া’ দিতে শুরু করেন। স্বভাবতই তাঁরা বিশাল হাদীস ভাণ্ডার, সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি ও পূর্ববর্তী আলিমগণের মতামত কিছুই জানেন বা জানার গুরুত্বও অনুভব করেন না। মূলত তাঁদের জানা কুরআনের আয়াতগুলি এবং সীমিত কিছু হাদীসের শাব্দিক অর্থের সাথে নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও মননশীলতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদান করতে থাকেন। তাঁদের বাগ্মিতা, আধুনিক জগত ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের গভীর জ্ঞান ইত্যাদি সাধারণ মুসলিমদেরকে আকৃষ্ট করে।
(খ) গত প্রায় অর্ধ-সহস্র বৎসর যাবৎ মুসলিম উম্মাহর সকল দেশেই ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক মানগত অবনতি ঘটেছে। বিশেষত উপনিবেশাধীন সমাজে এবং এর পরে ‘ইসলামী শিক্ষার’ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মাদ্রাসগুলির শিক্ষার মান কমেছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমর্থনের অভাব, মেধাবী শিক্ষার্থীর অভাব, গবেষণা উপকরণ ও গবেষণা পরিবেশের অভাব ইত্যাদি কারণে এ সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া অধিকাংশেরই ইসলামী জ্ঞানের গভীরতা খুবই কম। এদের অনেকেই উপর্যুক্ত ‘আধুনিক মুফতীদের’ চেয়ে ইসলামী জ্ঞানে অনেক দুর্বল। অনেক সময় এইরূপ ‘মাদ্রাসা শিক্ষিত’ মানুষরাও উপর্যুক্ত ‘আধুনিক মুফতীগণের’ সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হন।
(গ) গত প্রায় শতাব্দীকাল ধরে মুসলিম দেশগুলি উপনিবেশ ও উপনিবেশ-উত্তর অনাচার, ইসলাম বিরোধী প্রচার প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডের মুখোমুখি। তদুপরি গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধন ও মুসলিমদের উপর অত্যাচারের বিষয়টি উপরে আলোচনা করেছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম-প্রিয় আবেগী যুবমানস এ সকল জুলুম, অনাচার ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের ত্বরিত প্রতিশোধ বা অবসান চায় এবং এজন্য সঠিক ইসলামী সিদ্ধান্ত তালাশ করে। এক্ষেত্রে এ সকল ‘অর্ধ-আলিম’ পণ্ডিতগণ ‘গরম’ ও ‘ত্বরিত’ সমাধানের পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। পক্ষান্তরে ট্রেডিশনাল আলিমগণ এক্ষেত্রে নরম সমাধান প্রদান করেন। এজন্য সাধারণত আবেগী যুবকগণ এ সকল আলিমকে আপোষকামী, দালাল বা অনভিজ্ঞ এবং আধুনিক মুফতীদের মতামতই সঠিক বলে মনে করেন।
(ঘ) উপরের বিষয়গুলির ভিত্তিতে ইসলামী দা’ওয়াত, আন্দোলনে লিপ্তদের মধ্যে একটি কথা গত অর্ধ-শতাব্দী যাবৎ মহাসত্যের রূপ পরিগ্রহন করেছে, তা হলো, মাদ্রাসা থেকে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা লাভ করা যায় না। বরং মাদ্রাসা না পড়া আধুনিক শিক্ষিত মানুষের অনুবাদ গ্রন্থাদি পাঠের মাধ্যমে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা লাভ করেন।
(ঙ) মাদ্রাসায় সাধারণত সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর সন্তানেরা লেখাপড়া করেন এবং তাঁরাই আলিম হন। এরা সাধারণত ‘নরম’ ও অতি বিনয়ী ও দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন। পক্ষান্তরে উপর্যুক্ত আধুনিক মুফতীগণ সাধারণত অত্যন্ত দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও বাগ্মিতার অধিকারী। ফলে বিভিন্ন ইসলামী দল ও ইসলামী কর্মের নেতৃত্ব থাকে মূলত দ্বিতীয় শ্রেণীর হাতে। এ সকল দলের ‘আলিমগণ’ মূলত এদের অনুসারী মাত্র।
বর্তমান বিশ্বের সকল দেশে প্রায় সকল ‘ইসলামী বুদ্ধিজীবী’ ও ইসলামী দলের নীতি নির্ধারকগণ এই প্রকারের আধুনিক শিক্ষিত ‘গুরু’। ইসলামী জঙ্গিবাদের সুপরিচিত নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই এই পর্যায়ের। এরাই এ সকল কর্মকাণ্ডের ‘তাত্ত্বিক গুরু’। এদের অনেকের ধার্মিকতা বা আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে এদের সীমাবদ্ধতা খুবই বেশি। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয় হলো, নামাযের সূরা পাঠ বা হাত তোলার মত বিষয়ে এ সকল আধুনিক নেতা প্রসিদ্ধ আলিম ও ইমামদের মতামতের উপর নির্ভর করেন ও সেগুলিকে গুরুত্ব দেন। কিন্তু কাউকে ধর্মত্যাগী, অমুসলিম বা ইসলামের শত্র“ বলে ঘোষণা করা, যুদ্ধ ঘোষণা, মানুষ হত্যা, অন্যের সম্পদ নষ্ট করা ইত্যাদি ভয়ঙ্কর ‘বান্দার হক্ক’ বা মানবাধিকারের সাথে জড়িত বিষয়ে তাঁরা কারো মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজেদের বুদ্ধিমত ফাতওয়া দেন। এক্ষেত্রে সুপরিচিত আলিমগণ ‘নরম’ মতামত প্রকাশ করলে তাদেরকে অজ্ঞ আপোষকামি বা দালাল বলে মনে করেন।
(৪) জিহাদ পরিভাষার বিকৃতি
জঙ্গিবাদের প্রসারের অন্যতম মাধ্যম হলো ‘জিহাদ’ শব্দের অপব্যবহার করে ইসলাম প্রেমিক মানুষদেরকে প্রতারিত করা। এজন্য বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
ক. জিহাদ ও কিতাল
‘জিহাদ’ অর্থ প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, শ্রম ব্যয় ইত্যাদি। আল্লাহর বিধান পালনের ও প্রতিষ্ঠার সকল প্রকার শ্রম বা প্রচেষ্টাকেই কুরআন ও হাদীসে ‘জিহাদ’ বলা হয়েছে। তবে ইসলামী পরিভাষায় ও ইসলামী ফিক্হে জিহাদ বলতে মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধকেই বুঝানো হয়। আর এই যুদ্ধেরই নাম হলো কিতাল। কুরআন ও হাদীসে জিহাদ ও কিতালের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কতল অর্থ হত্যা করা। আর কিতাল অর্থ পরস্পরে যুদ্ধ। এজন্য জিহাদ বা কিতালের মূল শর্ত হলো সামনাসামনি ‘যুদ্ধ’। পিছন থেকে হত্যা করা, না জানিয়ে হত্যা করা, গুপ্ত হত্যা করা এগুলি কখনোই )-এরইসলামী কিতাল বা জিহাদ নয়। মদীনার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাসূলুল্লাহ ( নেতৃত্বে মুসলিমগণ অনেক ‘কিতাল’ করেছেন। দুই-একটি ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে যথাসম্ভব কম রক্তপাতে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গোপন অভিযান পারিচালনা করা হলেও যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কাফিরদের দেশে যেয়ে গোপনে হত্যা, সন্ত্রাস, অগ্নি সংযোগ, বিষ প্রয়োগ ইত্যাদি কখনোই তিনি করেন নি বা করার অনুমতি প্রদান করেন নি। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও অযোদ্ধাকে আঘাত করতে তিনি নিষেধ করেছেন।
মুলঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া