somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইনসেপশনের কানাগলি

২৫ শে মে, ২০১২ রাত ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দার্শনিক রেনে দেকার্টের মেডিটেশন অন ফার্স্ট ফিলোসফি বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৬৮৫ সালে। আর দর্শকপ্রিয় ইনসেপশন চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০১০ সালে। এই মুভির গল্পকার, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক ও পরিচালক ক্রিস্টোফার। তার ইনসেপশনে দর্শক যা দেখছেন সেরকম কিছু দেকার্ট তিনশ’ বছর আগে তার সেই বইয়ে হাজির করেছিলেন। সেই সিলসিলার অনুসন্ধান ইনসেপশনেও শেষ পর্যন্ত ঝাপসা। যদিও পুবের চিন্তকদের (ফকির লালন) জীবনের বাস্তবতা নিয়ে এই গ্যাঁড়াকল নেই।

ডম কভ (ডি ক্যাপ্রিও) এবং তার পার্টনার আর্থার (যোসেপ গর্ডন লেভিট) স্বপ্নের মাধ্যমে বড় ব্যবসায়ীদের মনে ঢুকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করে। যাদের এ স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় তারা শক বা স্বপ্নের মধ্যে মারা যাওয়ার মাধ্যমে আবার সত্যিকার জীবনে ফিরে আসে। কভ এবং আর্থারের কাছে একটি করে টোটেম (লাটিম) থাকে যেগুলো তাদের এই গুপ্তচরবৃত্তি অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখে। কভের সমস্যা হলো স্বপ্নের ভেতর তার মৃত স্ত্রী হাজির হয়। আবার স্ত্রীকে মেরে ফেলার দায়ে আমেরিকায় সন্তানদের কাছে যেতেও পারছে না।

সাইটো নামের এক ব্যবসায়ী তাদের একটা কাজের দায়িত্ব দেয়। একটা তথ্য সাইটোর প্রতিযোগী মরিস ফিশারের ছেলে রবার্ট ফিশারের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। প্রতিদানে কভ স্ত্রী হত্যার দায় থেকে মুক্ত হয়ে আমেরিকায় সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে পারবে।
মরিস ফিশারের লাশ প্লেনে করে সিডনি থেকে লস এঞ্জেলেসে নিয়ে যাচ্ছিল রবার্ট ফিশার। সেখানেই রবার্ট ফিশারকে স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কভের সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দেয়। শেষ পর্যন্ত কাজ সফলভাবে শেষ হয়। স্বপ্নে স্ত্রী মলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তার আত্মহত্যার সত্য খোলাসা হয়। মি. সাইটো তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। কভ নির্বিঘ্নে আমেরিকায় ঢুকে পড়ে। বাস্তবেই কি তার ছেলেদের কাছে ফিরে যেতে পেরেছিল নাকি সব কিছুই স্বপ্নের মধ্যে লিম্বো পর্যায়ে ঘটছে! সেটা পরীক্ষা করতে তার টোটেমকে ঘুরিয়ে দেখছিল কিন্তু তার আগেই সন্তানদের সঙ্গে দেখা হয়। তখনও টোটেম ঘুরছিল। এখানে মুভিটি শেষ হয়।

এখানে ইনসেপশন হলো কারও অজ্ঞাতে তার মনে কোন আইডিয়া পুঁতে দেয়া। যার মনে পুঁততে হবে সে যদি গভীর ঘুমে থাকে তবে পুঁতে দেয়া চিন্তাকে নিজের মনে করবে। এখানে স্বপ্নের জগতে দু’জন মানুষ বা একাধিক মানুষ থাকে। তাদের পক্ষ দুটি। এক পক্ষ স্বপ্ন রোপণ করে, অপর পক্ষ নিজের চিন্তা মনে করে প্রতারিত হয়।

দেকার্টের প্রশ্ন—আপনি কি করে জেনেছেন আপনি স্বপ্নের মধ্যে নেই? এটা বলতে পারেন যদি দেখাতে পারেন আপনি এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন—এখন জেগে আছেন। সব সন্দেহকে দূর করে দেকার্ট নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন আমরা জেগে আছি না স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু নানা কারণে সংশয় থেকেই যদি কোনো খারাপ দানো বা দেবতা (জিনে ধরা) আমাদের ঘুম পাড়িয়ে অবাস্তব জগতকে সত্য বলে দেখায় তাহলে দুনিয়া আসলে কী রকম অথবা আমার বাস্তব হাল কী, তা কখনও জানতে পারব না। এই চিন্তা তার অস্তিত্বকেও নাড়িয়ে দেয়—আসলে কি আমি আছি! এসব চিন্তার মাঝে দেকার্ট দেখতে পান যতই ভুল করি না কেন অথবা প্রবঞ্চিত হই—দেখা যাচ্ছে আমিই পুরো বিষয়টা (বাস্তবে/স্বপ্নে আছি) চিন্তা করছি। যদি ব্যাপারটা তাই হয় তাহলে চিন্তাকারীকেও চিন্তা করার জন্য থাকতে হবে। আমি স্বপ্ন দেখছি এটা নিশ্চিত হতে হলে আমাকে জাগতে হবে। সে স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে আলাদা করে বলবে—আমি স্বপ্ন দেখছি না। কিন্তু ইনসেপশন কি সেই পথে হেঁটেছে!

কিছু জায়গা ছাড়া ইনসেপশন দেকার্টের স্বপ্ন সমস্যার সমাধানের যুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছে। ডম কভ স্বপ্ন দেখছে এবং সে স্বপ্নের মধ্যেই সচেতন—স্বপ্ন দেখছে। সুতরাং এটা বলা অসম্ভব যে, আপনি কখন স্বপ্ন দেখছেন আর কখন দেখছেন না। যেহেতু স্বপ্ন দেখলেও আপনি সচেতন। এই সচেতনতা কি বাস্তবতা নয়? এখানে আপনি অদ্ভুত অসম্ভব সব সিঁড়ি দেখতে পাবেন, যেগুলো ৯০ ডিগ্রি বরাবর খাড়া এবং একের পর এক চক্রাকারে উঠে গেছে। আবার দেখা যায়, মানুষ একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব তো শেষ হওয়ার না!

দেকার্টের মতে, যা আমরা দেখি নাই তা স্বপ্নে আসতে পারে না। এই চলচ্চিত্রে স্বপ্নের দুনিয়া নির্মিত হয় পরিচিত জগতের উপাদান দিয়ে। দার্শনিক ডেভিড হিউম তার এন ইনকুয়ারি কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং (১৭৪৮) বইয়ে বলছেন, যা আমাদের চিন্তার মধ্যে নেই, সেরকম বিশুদ্ধ কিছু আমরা বানাতে পারি না। এগুলো আমাদের অভিজ্ঞতা আর ধারণার যোগাযোগ মাত্র। আমরা সোনার পাহাড়ের কথা বলতে পারি, যা স্রেফ আমার অভিজ্ঞতার স্বর্ণ আর পাহাড়ের যোগফল। একইভাবে ইনসেপশনে বাস্তবের শহর, বাড়িঘর; এমনকি ল্যাম্পপোস্ট, পুরানো প্রতিবেশী দিয়ে স্বপ্ন নির্মাণ করে। দেকার্ট ও ইনসেপশনের এই মিল সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নোলান আর দেকার্টের মধ্যে একটা বড়সড় ব্যতিক্রম আছে। সেটা হলো খোদার জ্ঞান। দেকার্ট সংশয় হতে বের হওয়ার জন্য খোদাকে ব্যবহার করেন। তিনি বলছেন, খোদার জ্ঞান মানুষের সহজাত। তাই বলছেন, আমি সমাধান পেয়েছি। অন্যদিকে ইনসেপশন স্বপ্নের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে।

কভ নিজের স্ত্রীর ওপর এই ইনসেপশন প্রয়োগ করেছিল। একটা স্বপ্নে—যেখানে চেতনের জগতের মিনিট বা সেকেন্ডের সমান দৈর্ঘ্যে একেকটা দিন কেটে যাচ্ছিল। এক ছুটির দিনে কভ ও তার স্ত্রী এমন স্বপ্নে আটকে গেলেন। স্বপ্নের জগতে পঞ্চাশ বছর কেটে গেল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কভ ও তার স্ত্রী মল যখন স্বপ্ন থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এল, মল বিশ্বাস করল এই জগত বাস্তব নয়। এই স্বপ্ন ভেঙে বাস্তবে ফিরে যেতে হলে নিজেকে খুন করতে হবে। মল আত্মহত্যা করে। কিন্তু কভের স্বপ্নের জগতে সে সব সময় ওঁত্ পেতে থাকে।

ইনসেপশনের ঘটনা কি বাস্তবে সম্ভব? যখন কেউ ঘুমিয়ে থাকে তাদের মনে কি এভাবে ধারণা পুঁতে দেয়া সম্ভব? আমরা জেগে থাকলেও আমাদের মনে বিভিন্ন আইডিয়া পুঁতে দেয়া সম্ভব। যেমন—বিভিন্ন মার্কেটিং কোম্পানি যেভাবে জিনিসপত্র গোছিয়ে দেয়। আমরা জেগে থাকলে যা সম্ভব সেটা ঘুমন্ত অবস্থায় সম্ভব হবে না কেন? যদি ঘুমন্ত কেউ আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, তবে আপনি তখন তাকে যে কথা বলবেন সেটা তার স্বপ্নের অংশ হয়ে যাবে। কিন্তু এই চলচ্চিত্র যেভাবে বলে সেভাবে নয়। কেননা এই চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে এসে আবার সন্দেহ করতে হয় কভ বাস্তবে বা স্বপ্নে আছে। কভ যখন তার ঘরের মধ্যে টোটেম ঘুরাচ্ছিল, ঘুরতে থাকা অবস্থায় সে বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু সে যদি স্বপ্নে থাকে তাহলে টোটেম ঘুরতেই থাকবে। টোটেম ঘুরছে এমন দৃশ্যের মধ্যেই মুভিটি শেষ হয়ে যায়। আমরা জানতে পারি না টোটেমটি এভাবে চিরকাল ঘুরতে থাকবে না পড়ে যাবে। এমনকি এই দৃশ্যে লাটিমটি ঘোরা বন্ধ করার স্বপ্ন দেখছিল—এটা বলাও অসম্ভব।

কেউ কেউ বলবেন, এটা সেই চিরন্তন চিন্তা মানুষ সবসময় যার অনুসন্ধানের মধ্যে বিরাজ করে। বিষয়টিকে এমন মহিমা দেয়া যেতে পারে। অথবা দারুণ বিনোদন। কিন্তু শেষ বিচারে তো সেই কানাগলিতে ঘুরপাক খাওয়া। নোলান এভাবে মন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হাত দিয়েছেন পশ্চিমা চিন্তার গোড়ার জায়গায়।

> আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১২ সকাল ১০:২০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×