somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সালাম মীরা নায়ার

১০ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সালাম বম্বে (১৯৮৮) ‘কৃষ্ণা’ নামের এক বালকের কাহিনী। কৃষ্ণার মতে, বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই তার উপর দাদাগিরি ফলাতে থাকে। একদিন রাগ করে বড় ভাইয়ের মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে সে। ভাইকে ক্ষতিপূরণ পাচঁশ রুপী দেবার জন্য মা তাকে এপোলো সাকার্সের কাজে লাগিয়ে দেন। কৃষ্ণার স্বপ্ন পাচঁশ টাকা জমিয়ে বাড়ি ফেরা। তার যে বাড়ি ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সে চলে আসে তখনকার বম্বে বা এখনকার মুম্বাই শহরে। কৃষ্ণার সেই বম্বে আমাদের দেখা রঙ্গিন ঝলমলে বম্বে নয়। সেখানে আলো ঝালকানি আছে বটে। সেই ঝলকানিতে কৃষ্ণার চোখ ঝ্লসে যায়। সেই ঝলকানি তাকে কোন স্বপ্ন দেখায় না। আছে মায়াবী আলো-ছায়া। সেই আলো-ছায়ায় চলে মাংসের বিকিকিনি। কৃষ্ণা সেই শহরের চা-বালক। ঘরহীন আরো অনেক শিশু-কিশোরের সাথে ঠাই হয় ফুটপাতে। চায়ের স্টলে কাজ করায় কৃষ্ণা থেকে হয়ে যায় চাপিয়ু। তার আশে পাশে থাকা চরিত্রগুলো হলো এলাকা মাদক ডিলার বাবা, মাদক বিক্রেতা চিলিম, রেড এরিয়ায় কাজ করতে না চাওয়া নতুন মেয়ে সুইট সিক্সটিন বা ষোল সাল, বেশ্যা রেখা ও তার মেয়ে মঞ্জুসহ আরো অনেকে। এইসব মানুষের মিছিলে কৃষ্ণা জড়িয়ে গেলেও তার স্বপ্ন সেই পাচঁশ রুপি। কৃষ্ণা মায়ের কাছে ফিরে যাবে। কৃষ্ণার এই ফিরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে আরো অনেক মানুষের বাড়ি ফেরার স্বপ্ন নিয়ে এই মুভি। আসলে কেউ কি ফিরতে পারে?

পরিচালক হিসেবে এটি মীরা নায়ারের প্রথম মুভি। এর আগে শর্ট ফিল্ম বানিয়ে হাত পাকিয়েছিলেন। এই মুভির কাহিনী ও প্রযোজনায় মীরা নায়ার। চিত্রনাট্যে তার সাথে কাজ করেছে সোনি তারাপোরেভেলা, যিনি বরাবরই মীরা কাজে থাকেন। মুভির মিউজিক করেছেন কর্নাটক ঘরানার বিখ্যাত বাদক ড. এল. সুব্রামানিয়াম। সুব্রামানিয়াম মুভির কাজ করেছেন মাত্র চারটি। বাকি কটি হলো মীরার মিসিসিপি মাসালা (১৯৯১), বানার্ডো বার্তুচ্চির লিটল বুদ্ধা (১৯৯৩)এবং ঈসমাইল মার্চেন্টের কটন মেরি (১৯৯৯)।

সালাম বম্বে বিদেশি ভাষায় অস্কার মনোনয়নে শামিল হওয়া দ্বিতীয় ইন্ডিয়ান মুভি। এই মুভি নিউইয়র্ক টাইমসের ‘দি বেষ্ট ওয়ান থাউজেন্ড মুভি এভার মেড’-এ স্থান পেয়েছে। এই মুভিতে ইন্ডিয়ান বাণিজ্যিক মুভির কিছু ক্লিপ আছে। আরো আছে এর পাত্রপাত্রীদের মুখে সেইসব মুভির গান। দুটো জগতের আলাদা আলাদা চিত্র। অথচ দুটো একই শাইনিং ইন্ডিয়ান। ভালো লাগা এই মুভির কেন্দ্র ভূমি বম্বের এক রেল স্টেশন, তার চারপাশ ও রেড লাইট এরিয়া। এই এরিয়ার মেয়েরা রুম নাম্বার দিয়ে পরিচিত, নাম দিয়ে নয়। এই মুভিতে কোন গ্ল্যামারাস কোন চরিত্র নাই। সব অভিনেতা অভিনেত্রীর গায়ের রং ময়লা। একজন ধবধবে সাদা মানুষকেও দেখা গেল না। যেমন দেখা যায় মূলধারার মুভিতে। এই মুভিতে আছে সত্যের অনুসরণ। সেই অনুসরণ ধরে নির্মিত কাহিনীর গতিশীলতা ও টানটান অভিনয় পর্দা থেকে মুখ ফেরাতে দেয় না।

এই মুভিতে গরীব মানুষের বিপরীতে মীরা কোন জুলুমবাজ ধনী মানুষ বা শ্রেনী তুলে ধরেন নাই। প্রচ্ছন্নভাবেও না। জীবন যাত্রার তুলনা এসেছে মাত্র একটা জায়গায়- তা মাত্র মিনিট দুয়েক। ফলে কাহিনীর আলাদা কোন মারপ্যাচ নাই। বরং, এই এলাকার মানুষগুলোর সম্পর্ক কোন ছাঁচে তৈরি হয়, তার বয়ান মুখ্য। যা এই মুভিকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করেছে।

এই মুভিতে কৃষ্ণার বাড়ি ফেরার আকুতি হলো এক ধরণের প্রাকৃতিক আহ্বান। সেখানে ভাইয়ের অত্যাচার আছে, আছে লাঞ্চনা। এটাকে আমরা প্রতিকীভাবে নিতে পারি। না নিলেও সমস্যা নাই। মূলকথা হলো ফেরার মতো একান্ত নিজের কিছু একটা থাকা। কৃষ্ণার মুখে যতবার ‘মুলুক’ শব্দটা শুনেছি- অদ্ভুত লেগেছে। দর্শক হয়তো নিজেও ভাবে সেও মুলুকে গিয়ে পৌছবে। কৃষ্ণার এই বাড়ি নিছক ইট-কাঠ বা শন-টিনের বাড়ি ফেরা না। তার চেয়ে বেশি কিছু। যা কিছু সুন্দর- যেখানে আমরা কিছূ অসুন্দর আন্তরিকভাবে মেনে নিই তা কি আমাদের বাড়ি নয়! তাই কৃষ্ণার বাড়ির কল্পনা আমরা ইচ্ছে মতো বাড়িয়ে নিতে পারি।

নিসন্দেহে সালাম বম্বে একটি অবাণিজ্যিক ধারার মুভি। এই মুভি আমাদেরকে সরাসরি চিন্তা দেয়। আলাদা করে ভাবতে হয় না। কিন্তু এটাকে সরাসরি শিক্ষামূলক করে তোলার কোন চেষ্টা নাই। বরং, এক ধরণের সরল ও আপাত সত্য বয়ান দিয়ে এগিয়ে চলা কাহিনী আপনাকে হাসাবে – কাদাঁবে। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গা দাড়িয়ে ভাবছিলাম আমাদের দেশের কথিত শিল্পমান বা বিকল্প ধারা এই ধরণের ভাব কেন জাগাতে পারে না। অনেক সময় অতি তেলায়িত ভাব থাকে- সেখানে তেলায়িত না হলে প্রেস্টিজ থাকে না। এইখানে আমার একটা অনুমান আছে। সালাম বম্বে আর কিছুই নয়, মূলধারা বাণিজ্যিক মুভির পরিপূরক । সেই সব মুভি মানুষের জীবনের সত্যকে যতটুকু কেড়ে নেয়- সালাম বম্বে-র মতো মুভি তার কিছুটা ফেরত দেয়।

এই মুভিগুলোর নির্মাণের পেছনের আরেকটা নির্মাণ হলো পেশাদারি মনোভাব। সেই পেশাদারীত্বে শিল্পের দীক্ষা আছে। একই লোকগুলো আবার মূলধারার মুভিতেও কাজ করে। সেই অনুমান থেকে বলি মূলধারা বা বাণিজ্যিক ধারার ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে না উঠলে পেশাদারি কাজ সম্ভব না। শুধুমাত্র নন্দনবোধ আর দেশ উদ্ধার দিয়ে কোন শিল্প মাধ্যম টিকে থাকতে পারে না। একই সাথে সেই সম্ভাবনা তৈরী না হলে সালাম বম্বে তৈরি সম্ভব না। আমার অনুমানের সাথে কেউ দ্বিমত করলেও সমস্যা নাই।

বাস্তব লোকেশনে নির্মিত এই মুভিতে দারুন অভিনয় করেছে কৃষ্ণা চরিত্রের শফিক সাইয়েদ । বাবা গিলাব চরিত্রে আছে শক্তিমান নানা পাটেকর। তাকে ভালো-মন্দ মিশেল একটা চরিত্র দেয়া হয়েছে। যিনি মাদক বিক্রি ও পতিতালয়ের সাথে জড়িত থাকলেও এক পতিতাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নেন। তিনি খুব বাস্তব কারণে তাকে স্ত্রীর মতো করে রাখতে পারেন না। তার জীবনের ট্রাজেডী পাঠকদের না জানায়। সেখানে বদলে গেছে কৃষ্ণার জীবন। মীরা নায়ার সেটা খোলাসা না করেই খুব হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য দিয়ে মুভিটি শেষ করেন। এখানেও আমার একটা অনুমান আছে। যা আমি বিশ্বাস করি না- তারপরও কৃষ্ণাই হয়তো একদিন বাবা হয়ে উঠবে। রাঘুবীর যাদব বরাবরেই মতো প্রাণবন্ত। কৃষ্ণার টাকা চুরি করা সত্ত্বেও তার মৃত্যু দর্শকদের কাদাঁবে। দুই মিনিটের দৃশ্যে আছেন ইরফান খান। এটি তার অভিনীত প্রথম মুভি। রেখা চরিত্রে অনিতা কানওয়ারের অভিনয় অনবদ্য।

শফিক সাইয়েদ-সহ সব’কটি শিশু চরিত্র বাস্তব জীবনের পথ শিশু। শফিক সাইয়েদ এই মুভির জন্য শিশু শিল্পী ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরষ্কার জিতেন। বর্তমানে তিনি ব্যাঙ্গালোরে অটো রিকশা চালান। নিয়া মীরা নায়ার এই মুভির পথশিশুদের তিনি গড়েছেন সালাম বালক ট্রাস্ট । যা এখনো টিকে আছে। এই মুভি অস্কার না জিতলেও অনেকগুলো দেশি-বিদেশি পুরষ্কার জিতে নিয়েছে। সেই লিষ্টি নিচে দেয়া হলো:

পুরষ্কার

জিতেছে:

1988: Audience Award, Cannes Film Festival
1988: Golden Camera, Cannes Film Festival
1988: National Film Award for Best Feature Film in Hindi
1988: National Film Award for Best Child Artist: Shafiq Syed
1988: National Board of Review Awards: Top Foreign Film
1988 : Lilian Gish Award Excellence in Feature Film, Los Angeles Women in Film Festival (tied with Elysium)
1988: Jury Prize, Montréal World Film Festival (tied with The Dawning)
1988: Most Popular Film, Montréal World Film Festival
1988: Prize of the Ecumenical Jury, Montréal World Film Festival

মনোনয়ন:

1989: Academy Award for Best Foreign Language Film
1990: BAFTA Film Award Best Film not in the English Language
1989: César Award for Best Foreign Film (Meilleur film étranger)
1990: Filmfare Best Director Award
1989: Golden Globe Award for Best Foreign Language Film

> ব্যবহৃত তথ্য ও ফটো: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
> আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×