somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দশ মিনিটে গোলাপের কথা-- (আবদুশ শাকুর)

১৬ ই অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গোলাপ নিয়ে গল্পের শেষ নেই।
এক গল্প বলে : প্রেমিকা ভিনাস তাঁর প্রেমাস্পদ অ্যাডোনিসের সঙ্গে মিলিত হবার কামনায় অধীর পদে অভিসারে যাচ্ছিলেন এক কণ্টকারণ্যের বন্ধুর পথে। কাঁটাবনের ভেতর দিয়ে আনমনে হাঁটার সময় ঝোপের কাঁটার ঘায়ে তাঁর পা থেকে রক্ত ঝরে। সে রক্তই হয়ে ওঠে লালগোলাপ।
অপর উপাখ্যানে আছে এর বিপরীত ভাষ্য : অ্যাডোনিসকে শিকারীর বেশে অরণ্যে ঘুরতে দেখে গ্রীকভিনাস আফ্রোদিতি তাঁর প্রেমে পড়েন এবং প্রেমাস্পদের সঙ্গলাভের উদ্দেশ্যে স্বর্গলোক ছেড়ে মর্ত্যলোকের বনে বনে ঘুরতে থাকেন। ঘটনাটা আফ্রোদিতির অপর প্রণয়ী রণদেবতা অ্যারেসের কানে গেলে জেলাস অ্যারেস একদিন বুনোশূকরের বেশে অ্যাডোনিসকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। তবিত অ্যাডোনিসের দেহনিঃসৃত রক্ত থেকে জন্ম নেয় লালগোলাপ।
আরেক গল্প বলে : সিবিল ভিনাসের সৌন্দর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে গোলাপসুন্দরীকে সৃষ্টি করেন।
কেউ বলেন প্রেমের দেবতা কিউপিডের হাসির মূর্তরূপই হল গোলাপ।
আবার কেউ বলেন ঊষাদেবী অরোরার কেশবিন্যাসের সময় ঝরে পড়ে গোলাপ।
আরেক গল্পমতে গোলাপের আবির্ভাব হয় এক কুমারীর প্রার্থনায়। বেথেলহেমে তাঁকে অন্যায়ভাবে জীবন্ত দাহ করতে গেলে তিনি বিধাতার কাছে প্রার্থনায় রত হন। প্রার্থনা গৃহীত হলে বিধাতা লেলিহান কাষ্ঠখণ্ডগুলোকে লালগোলাপে এবং অপ্রজ্জ্বলিতগুলোকে সাদাগোলাপে পরিণত করেন।



ইতিকথা ছেড়ে এবার ইতিহাসে যাই। বলা হয় মানুষের আবির্ভাব দশ ল বছর আগে। আর গোলাপের সূচনা ধরা হয় তিনশত থেকে ছয়শত ল বৎসর পূর্বে। সময়সীমার এই বিশাল হেরফেরটা ঘটে নিত্যনব আবিষ্কৃত ফসিল কিংবা জীবাশ্মের আধুনিক থেকে আধুনিকতর প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ মারফত প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে। প্রাকৃতিক গোলাপ জন্মে পশ্চিম এশিয়ার ফ্রিজিয়ায়, যার ভৌগোলিক অবস্থান বর্তমান ইরাক-তুরস্কের সীমান্তের দুইপাশ জুড়ে। আর আধুনিক গোলাপের জন্ম ফ্রান্সের দণিাঞ্চলে।
ফলে গোলাপের ইতিহাসও প্রমাণ করে : এশিয়া শিল্পী, ইউরোপ কারিগর। এশিয়া গোলাপ পেয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে। জহুরী জহর চিনেছে, স্থান দিয়েছে মুদ্রার পিঠে, পতাকার গায়ে, কদর করেছে এমনি আরো নানান উপায়ে। তবে ওই পর্যন্তই। প্রতিপে ইউরোপ এশিয়ার কাছ থেকে গোলাপটি পেয়ে নিজের প্রকৃতিযোগে তাকে পরিণত করেছে অনিন্দ্যসুন্দর আধুনিক গোলাপে।
গোলাপ প্রথমে যায় ইউরোপভূখণ্ডের গ্রীসে এবং স্থান পায় গ্রীকদের হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে। সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কবি সাফোর কবিতায় পুষ্পরানির অভিধা পায় সে। গ্রীক নিসর্গবিদ্ থিওফ্রেস্টাস (খ্রি.পূ. ৩৭২-২৮৭) গোলাপের বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন ইতিহাসে প্রথম এবং এর সম্প্রসারণ বিষয়েও অনেক অভ্রান্ত কথা বলেন সময়ের বহু পূর্বে-- যেমন বীজের চেয়ে কাটিঙের প্রক্রিয়াই শ্রেয়। প্রাচীন হেলাসের সর্বত্রই গোলাপের প্রচলন ছিল। উপনিবেশিক গ্রীকগণই পুষ্পটিকে প্রথমে সিসিলিতে নেন এবং পরে সেখান থেকে আফ্রিকায় প্রবর্তন করেন।
এরপর গোলাপ যায় রোমে এবং স্থান পায় তাঁদের বাগানে, দৈনন্দিনের জীবনে। কোনো কিছুকেই মনেপ্রাণে ভালবাসতে রোমকগণ অভ্যস্ত নন। তাঁরা ভালবাসেন দেহেমনে। গোলাপের প্রতি তাঁদের আসক্তির শারীরিক দিকটি ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাই এটিকে বিশ্বের পুষ্পোদ্যানবিষয়ক বেস্ট-সেলার ডক্টর ডেভ্ হেসায়ন সঠিক নাম দিয়েছেন-- রোমের রোজ ম্যানিয়া। রোমের বিত্তবান নাগরিকগণ গোলাপের ওপর হাঁটতেন, বসতেন, শুতেন, সঙ্গম করতেন এবং ঘুমাতেন। এমনকি গোলাপ তাঁরা খেতেনও-- গোলাপের মধু, গোলাপের পুডিং, পিঠেপুলি, হালুয়ারুটি। পান করতেন গোলাপের সুরা, স্নান করতেন গোলাপের জলে। গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তাঁদের বালিশের খোল পর্যন্ত পূর্ণ হত।


ভোজোৎসবের হলঘরে মেজেতে থাকত গোলাপপাপড়ির এক ইঞ্চি পুরু স্তর। এই ফুলেল মেজের পরতের পুরুত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল পদমর্যাদার প্রতীক। এসব ব্যাপারে যথারীতি সবার ওপর টেক্কা দিয়েছেন সম্রাট নিরো, মতান্তরে, হেলিওগাবালুস্। এক রাজকীয় ভোজোৎসবে অতিথিশালার চাল থেকে নেমে-আসা গোলাপের পাপড়িপ্রপাতে অনেক অতিথি ‘গোলাপসমাধি’ বরণ করেন। সম্ভবত করুণ দৃশ্যটি রচনায় সহযোগিতা করেছিল তাঁদের বেসামাল মাত্রার গোলাপাসব পান।
গোলাপপাপড়ি সুযোগ্য রোমকদের গলার হার হত, রোগে ওষুধের কাজ করত এবং ভাসত তাদের সুরার পাত্রে। রোমানরা ম্যাস্কারা হিসাবে ব্যবহার করতেন গোলাপপাপড়িরই ছাই। (গোলাপের পাপড়িবন্দনা অবশ্য মরমী কবি রুমীও করেছেন : গোলাপ ছিঁড়িয়া কেহ কি পেরেছে হাসি তার কেড়ে নিতে ? / ধুলোয় পড়েও হাসি ফোটে তার পাপড়িতে পাপড়িতে।)
তাজা গোলাপের ব্যবহার ছিল কামোদ্দীপকরূপে। রোমক ভদ্রলোক গোলাপজলে স্নান করে, গোলাপাসব পান করে, গোলাপঘটিত পিঠেপুলি-হালুয়ারুটি খেতেও ভালোবাসতেন। একটি রোমান রন্ধনব্যবস্থাপত্র ছিল এরকম : এক পাউন্ড গোলাপপাপড়ি চালনি দিয়ে চেলে হামানদিস্তার হামানে ঢেলে নিন, চার কাপ মগজ, আটটি ডিম, দেড় গ্লাস উত্তম দ্রাাসব, কয়েক চামচ তেল যোগ করুন, নিয়ম মতো নুন-মরিচ দিয়ে আভেনে সেঁকে নিন এবং মজা চেখে দেখুন।
এই গোলাপভজনায় বীরপুঙ্গব রোমানদের কোনো মেয়েলিপনা ছিল না। গোলাপমালা গলায় পরে সৈন্যগণ যুদ্ধে যেতেন, রোমে ফেরার সময় যুদ্ধবিজয়ী রথ থাকত গোলাপসজ্জিত। স্পষ্টতই, এত সব বিপরীতধর্মী চাহিদা মেটাতে রোমের গোলাপবাগানগুলি কুলিয়ে উঠত না। ফলে চাষীসাধারণ অধিকতর লাভজনক গোলাপচাষে এতো বেশি ঝুঁকে পড়লেন যে, উপেতি হল কুঞ্জবন আর ফলবাগান। সঙ্কুচিত হল শস্যভূমি।
শীতে গোলাপগুলি ন্যাড়া হয়ে গেলে সকলেরই গোলাপপ্রীতি থিতিয়ে আসে। ব্যতিক্রম শুধু রোমকগণ। তাঁরা বাষ্পীয় তাপের গ্রীনহাউসে গোলাপচাষ অব্যাহত রাখতেন। এই অভিনব ধারণা একেবারে অধুনা ছাড়া ইতিহাসে আর দেখা যায় না। তবুও গোলাপবিলাসী রোমানদের চাহিদা মতো গোলাপের জোগান পাওয়া সম্ভব হত না।
গোলাপপাপড়ি নৌকায় আমদানি করা হত ঈজিপ্ট থেকে। স্বভাবতই আমদানিটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কথিত আছে যে বিলাসপণ্যটির একটি চালানের জন্যে সেকালে সম্রাট নিরো মূল্য বাবত ব্যয় করেছিলেন এক টন স্বর্ণ-- একালে যার দাম হবে প্রায় দেড় ল মার্কিন ডলার। অবয়ের যুগে রোমীয় জীবনে গোলাপ সন্দেহজনক বিষয়ের প্রতীকও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিষয় ছিল প্রেম থেকে ষড়। অনেক ষড়যন্ত্রের প্রয়োজনীয় গোপন বিনিময় সম্পন্ন হতো ‘সাব্ রোজা’, মানে গোলাপতলে-- অর্থাৎ গৃহের একান্তে যেখানটায় শিরোপরে ঝোলানো থাকত এক গুচ্ছ গোলাপ, ঝাড়লণ্ঠনের মতো।
বিশেষ গোপনীয়তার সেই রোমীয় অভিব্যক্তি 'ংঁন ৎড়ংধ' সবিশেষ গোপনীয়তার অর্থে আজও প্রচলিত।
রোমের পতনের সঙ্গেই খতম হয়ে গেল এইসমস্ত আদিখ্যেতা, এমনকি সামগ্রিক গোলাপপ্রীতিও। আয়েশী ধনিকশ্রেণীর বিলুপ্তির সঙ্গে গোলাপবাগানেও সুপ্তি নামে। ফের বন্যই হয়ে যায় বনের গোলাপ। খ্রিস্টসভ্যতার ওই অরুণ প্রভাতে পুষ্পরানির শুধু লালয়িতার আকালই নয়, গ্রহীতার সঙ্কটও দেখা দিয়েছিল। কারণ, প্রতিষ্ঠার সেই নাজুক পর্বে খ্রিস্টান গির্জা অখ্রিস্টান রোমানদের যাবতীয় পাপের একক প্রতীক জ্ঞান করে সুন্দরের দ্যোতক গোলাপকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
অতঃপর খ্রিস্টসভ্যতা জয় করতে গোলাপের সময় লেগে যায় প্রায় চার শত বৎসর। তার পরে কালে কালে একসময় লালগোলাপ সম্মানিত হয় যীশুর শোণিতের প্রতীকরূপে, আর সাদাগোলাপ মেরীর কুমারীত্বের। এমনকি খ্রিস্টান চার্চের আশ্রয়েই মধ্যযুগের দুর্দিন কাটিয়ে গোলাপ তার আধুনিক লালয়িতাদের সাাত পায় এবং তাঁদের সাধনায় নবজন্মও লাভ করে।
ইংরেজ-ফরাসির গোলাপপ্রীতির বৈশিষ্ট্য রোমানদের বিপরীত। সে এক গভীর ভালোবাসা, অপার শ্রদ্ধামিশ্রিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় : সম্রাট নাপোলেওঁর (১৭৬৯-১৮২১) আমলে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের কালে অধিকৃত ফরাসী নৌবহরে প্রাপ্ত গোলাপচারাগুলিকে বৃটিশবাহিনী বিশ্বস্ততার সঙ্গে পাঠিয়ে দিত তাদের যথাঠিকানায়-- মানে শত্র“সেনাপতির পতœী সম্রাজ্ঞী জোসেফিনের মালমেজোঁ-প্রাসাদের গোলাপবাগানে। ঘনঘোর যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখনও ফরাসি সম্রাজ্ঞী তাঁর বিশেষ গোলাপের বিশেষ চারাটি বিশেষ ছাড়পত্রের ছত্রছায়ায় পেয়ে যেতেন ইংল্যান্ডের বিশেষ নার্সারি কিংবা বিশেষ সংগ্রাহকের কাছ থেকে।
তাঁরই উদ্যোগ ও প্রেরণার ফলে উনবিংশ শতকের ফ্রান্স বিশ্বের গোলাপরাজধানীর খ্যাতি লাভ করে। এবং সে সূত্রেই আধুনিক গোলাপের জন্মও হয় সেখানেই, ১৮৬৭ সালে। সঙ্গত কারণেই ফুলটির নামও রাখা হয় ‘লা ফ্রঁস’। গোলাপের ইতিহাসে ব্যক্তিবিশেষের অবদানের বিচারে গোলাপের এই নিষ্ঠাবতী প্রেমিকা এককথায় তুলনাহীনা। গোলাপ যদি হয় ফুলের রানি, জোসেফিন তবে গোলাপের রানি।
এবার এশিয়ায় ফেরা যাক। ভারতবর্ষে গোলাপ আনেন প্রথম মোগলসম্রাট জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবর (১৪৮৩-১৫৩০) ইরাকের বসরা থেকেই। ভারতবর্ষীয়দের উদ্যানরচনাও শেখান এই শিল্পীসম্রাট। এমনকি গোলাপের জন্য আলাদা বাগান করার ধারণাও তাঁরই প্রবর্তনা। তবে ধারণাটি ব্যাপকভাবে বাস্তবায়িত হয় চতুর্থ মোগলসম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে (১৬০৫-২৭), গোলাপপ্রেমী সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসা নূরজাহানের উৎসাহে।
তাঁর উদ্যোগে ও প্রেরণায় গোলাপচর্চা ছড়িয়ে পড়ে আমীর ওমরাহ এবং অন্যান্য রাজন্যবর্গের মধ্যে। স্থাপিত হয় শালিমার, নিশাতবাগ প্রভৃতি গোলাপোদ্যান-- দিল্লি আগ্রা লাহোর কাশ্মীরসহ বিভিন্ন গোলাপানুকূল অঞ্চলে। তবে গোলাপি আতর উৎপাদনের নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের কৃতিত্বটি সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৫৬৯-১৬২৭) তাঁর আত্মজীবনী ‘তুজুকে জাহাঙ্গীরী’তে স্ত্রী নূরজাহানের বদলে শাশুড়ী সালিমা সুলতান বেগমকেই দেন।
বঙ্গদেশে গোলাপ আসে ব্রিটিশ যুগে, উপনিবেশনের সূত্রে। উপনিবেশক জাতিটি ছিল গোলাপপ্রেমীরও অধিক, অর্থাৎ গোলাপপাগলই। কোটের বোতামঘরে বাটনহোলস্বরূপ গোলাপ পরতেন পণ্ডিত নেহরুও সর্বদাই। কিন্তু ব্রিটিশবাবুরা পিন মেরে ল্যাপেলের পেছনে লুকিয়ে ‘বাটনহোল-জলাধার’ও পরিধান করতেন। আড়ালে থেকে জলভরা নলটি গোলাপের বৃন্তটিকে জলে ডুবিয়ে রেখে ফুলটির সজীবতার আয়ু বাড়াত।
উদ্যাপিত পুষ্প-লেখক ডক্টর ডেভ্ হেসায়ন তাঁর ‘দ্য আর্মচেয়ার বুক অফ দ্য গার্ডেন’-নামক বিখ্যাত পুস্তকে জানাচ্ছেন যে যুক্তরাজ্যের বিশ মিলিয়ন পরিবারের মধ্যে সতেরো মিলিয়ন পরিবারেরই একটি বাগান আছে। তার মধ্যে শতকরা পঁচাশি ভাগ বাগানেই গড়ে এগারোটি গোলাপগুল্ম আছে। শতকরা ষাট জন ব্রিটিশ নারীপুরুষই স্বহস্তে উদ্যানচর্যা করেন। তাদের শহরগুলিতে নাগরিকদের জন্য বরাদ্দকৃত সবজিচাষের প্লটের কিনারে এক মিটার চওড়া কেয়ারিতে গোলাপ ফোটানো নাকি বাধ্যতামূলক।
এদেশের সূর্যকরোজ্জ্বল প্রকৃতির বুকে ইংরেজদের গোলাপচর্চার আগ্রহ আরেক ধাপ বেড়ে যায়, বিশেষত শৈলশহরগুলিতে। রাজধানী কলকাতা হয়ে যায় উপনিবেশকদের পুষ্পচর্চার পেশাগত কেন্দ্র। সেখানে গড়ে ওঠে এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া। পার্শ্ববর্তী হাওড়াতে বটানিক্ গার্ডেন স্থাপিত হয় ১৮২০ সালে। অবশ্য শিবপুরের এই বাগানটি অষ্টাদশ শতাব্দীতেই শুরু হয়েছিল অন্য নামে।
এইসব তৎপরতার ফলে বাংলা-বিহারের সীমান্ত এলাকা জুড়ে ব্যাপকভাবেই গোলাপের চাষ হতে থাকে এবং বিদেশীদের মধ্যে কাটা-ফুলের ব্যাপক চাহিদার কারণে সেখানে ইউরোপ থেকে আধুনিক গোলাপের নতুন ভ্যারাইটিগুলিও চটজলদি আসতে থাকে।
বাণিজ্যতন্ত্রী জাতিটির বাণিজ্যজাহাজের নাবিকেরা দূরপ্রাচ্যের সাংহাই-ক্যান্টন বন্দরনগরীগুলির বাগানে নতুন গোলাপ দেখামাত্র দেশে পাঠানোর জন্য চারা সংগ্রহ করত। একটানা সুদীর্ঘ সমুদ্রসফরে মরে যাবে বলে যাত্রাবিরতি ঘটিয়ে চারাগুলিকে শিবপুরের বটানিক্যাল গার্ডেনে কিছুকাল লালনপালন করা হত। সেই সুবাদে কিছু কিছু চারা এখানে থেকে যেত (হয়তো অবৈধভাবেই) এবং আশেপাশে ছড়িয়েও পড়ত। কারণ কলকাতা ও তার আশেপাশে তখন গিজগিজ করত ইউরোপীয় পুষ্পপ্রেমী সম্প্রদায়। তাদের বাগানে কাজ করত দেশী মালী।
এই মালীদের মাধ্যমেই বাঙালি অভিজাত মহলে তথা সমতল বাংলায় পৌঁছে যায় গোলাপ। এবং দেশি-বিদেশি গোলাপের বিচিত্র সমাহারে এ ব্যাপারে বঙ্গদেশ ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সমৃদ্ধতরও হয়ে ওঠে। ফলে বাংলাতেই লেখা হয় গোলাপচর্চার প্রথম ভারতীয় বই (প্রবোধচন্দ্র দে প্রণীত ও ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ‘গোলাপ বাড়ী’)। প্রথম তিনজন ভারতীয় গোলাপ-সংকরায়কও ছিলেন বাঙালি (বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য, বিজয় রায়চৌধুরী, শিবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এদেশ হয়ে চাইনিজ স্পিশিসগুলি ইউরোপে পৌঁছে সেখানকার স্পিশিসগুলির সঙ্গে মিলিত হয়েই জন্ম দেয় আধুনিক গোলাপের। নবজাত প্রথম আধুনিক গোলাপ ‘লা ফ্রঁস’ও অনতিবিলম্বেই বঙ্গে চলে আসে ব্রিটিশদের মাধ্যমে এবং বেশ জনপ্রিয়তাও লাভ করে এদেশে। এদিক থেকে দেখলে মনে হবে আজকের চোখধাঁধানো আধুনিক গোলাপের সৃষ্টিকর্মে বঙ্গদেশও একটা ঐতিহাসিক অবদান রেখেছিল।
প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে ১৮৬৭ সালে জাত সত্যিকারের প্রথম হাইব্রিড-টী ‘লা ফ্রঁসে’র জনপ্রিয়তা এদেশে টেকেনি, যেমন টিকেছে ১৮৬৯ সালে জাত হাইব্রিড-পারপিচ্যুয়াল শ্রেণীর গোলাপ ‘পল নেরঁ’। বস্তুত শ্রেষ্ঠতম আধুনিক গোলাপ হাইব্রিড-টী সত্যিকারের প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ‘সোলেই দর’-নামক পেরনেতিয়ানা-গোলাপটির সঙ্গে মিলনের পর থেকে-- যে-বরবর্ণিনী তার সম্পূর্ণ বর্ণালীটিই বিলিয়ে দিয়েছে মিলনসঙ্গী হাইব্রিডটী-কে।
আধুনিক গোলাপ বাংলাদেশে আসে স্বাধীনতার পরপরই। দ্রুততম গতিতে গোলাপের উন্নততম মানের বংশবৃদ্ধির চাবিকাঠিই হল বাডিং কিংবা চোখকলমপদ্ধতি। এখানে প্রক্রিয়াটি ১৯৭২ সালেই আয়ত্ত করেন বিশিষ্ট হর্টিকালচারিস্ট এ. এস. এম. কামালউদ্দীন। কিন্তু বিদ্যাটি তিনি বিতরণ করেননি। ১৯৭৩ সালে বটানিক্যাল গার্ডেনে কর্মরত তদানীন্তন ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার গোলাম সাত্তার চৌধুরী বাডিং-বিষয়টি সার্বিকভাবে শিখে নিয়ে বিপুল উৎসাহে শেখাতে থাকেন পেশাদার মালাকর এবং অ্যামেচার রোজারিয়ানদের। এই গোলাপপ্রেমী ফরেস্টারের হাতেই সত্তর দশকের প্রথমভাগে গড়ে ওঠে বটানিক্যাল গার্ডেনের গোলাপবাগানটি।
তাঁরই পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে একই দশকের শেষভাগে বাংলাদেশ রাইফেল্সের গোলাপবাগানটিও যাত্রা শুরু করে। ইনি বাংলাদেশে নতুন গোলাপের প্রথম সংকরায়কও। ১৯৭৫ সালে প্রাপ্ত গোলাপটিকে তিনি প্রেরণাদাত্রী স্ত্রীর সম্মানে ‘ফাতেমা সাত্তার’-নামে জনসমে আনেন। এতসব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বাংলাদেশ জাতীয় গোলাপ সমিতি ১৯৮৯ সালের গোলাপ প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী উপলে ‘গোলাপপিতা’সম বলে একটি মানপত্র দান করে।
বাংলাদেশ রাইফেল্স-এর গোলাপবাগানটি চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করে আশির দশকের প্রথমভাগে-- বাগানের নির্বাহীদায়িত্বপালনকারী তদানীন্তন নায়েক-সুবেদার মীর হামিদুর রহমানের হাতে। এই গোলাপপ্রেমীও একটি গোলাপ প্রজনন করে নিজের স্ত্রীর নামে নাম রাখেন ‘রাহেলা হামিদ’। সুবেদার রহমানও তাঁর লব্ধ গোলাপলালনবিদ্যা দেশময় ছড়িয়ে দেন-- বিশেষত দুটি জাতীয় ওয়ার্কশপের মাধ্যমে।
তবে গোলাপচর্চা এদেশে আন্দোলনের রূপ নেয় যে-দুজন গোলাপবিশেষজ্ঞের উদ্যোগে ও শ্রমে তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ডক্টর মাহবুবুর রহমান খান এবং তাঁর পতœী বদরুন্নেসা সরকারী কলেজের বটানির তদানীন্তন বিভাগীয় প্রধান মুফ্তি নুরুন্নেছা খাতুন। তাঁদের আন্তরিক চেষ্টায় ও নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠায় ‘বাংলাদেশ জাতীয় গোলাপ সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে এবং ১৯৮৩ সাল থেকেই প্রবর্তিত হয় গোলাপ প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর সাড়ম্বর বাৎসরিক অনুষ্ঠান। রূপরসগন্ধবর্ণমণ্ডিত সেই অনুষ্ঠানটির ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ এদেশের গোলাপচর্চাকে এক অভূতপূর্ব গতি দান করে এবং তুঙ্গে তুলে রাখে প্রায় দেড় দশক ধরে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে গোলাপপ্রেমী এই দম্পতিও সংকরায়ণের মাধ্যমে একটি উল্লেখযোগ্য গোলাপ সৃষ্টি করেন। তাঁদের অকালপ্রয়াত পুত্র ‘শিবলি’র নামে অভিহিত সেই গোলাপটি ‘ইনট্রোডিউস্ড’ না-হলেও তার শত পাপড়ির ম্যাজেন্টা রঙটি আমার স্মৃতিতে পূর্ণবিভায় জেগে রয়েছে আজও। গোলাপচর্চার সেই স্বর্ণযুগেই ‘মাওলানা ভাসানী’-নামী বসরাই গোলাপের স্মৃতিজাগানিয়া গভীর গোলাপি রঙের অনেক পাপড়ি সংবলিত অতীব সুগন্ধী একটি প্রচুরপ্রজ গোলাপ উপহার দেন বটানিক্যাল গার্ডেনের বটানিস্ট মোহাম্মদ সামছুল হক।
আধুনিকগোলাপে সুগন্ধ থাকে না কথাটা উনিশ শত ষাটের দশকের পরে আর চলে না। যদিও তার আগেও ‘ক্রিমসন গ্লোরি’ ‘মিরান্ডি’ ‘এনা হার্কনেস’ প্রভৃতির মতো সুগন্ধী গোলাপ ছিল, তবে সংখ্যায় কম। বিলম্বে হলেও, সুরভির প্রতি গবেষকদের দৃষ্টি অবশেষে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হবার ফলে ষাটের দশকের শুরু থেকেই প্রচুর সুগন্ধ গোলাপের সৃষ্টি হতে থাকে-- যেমন ‘পাপা মেইয়ঁ’ ‘মিস্টার লিঙ্কন’ ‘ফ্রেগ্র্যান্ট কাউড’ ‘ডাবল ডিলাইট’ ইত্যাদি।
তবে জৈবসারপ্রসূত প্রাচীন বাগানগোলাপের বিশিষ্ট সুগন্ধটি রাসায়নিকসারজনিত আধুনিক গোলাপের বিচিত্র সুগন্ধে লভ্য না-ও হতে পারে। বটানিক্যাল গার্ডেন ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘সিটি অফ ঢাকা’ নামেও গোলাপ বের করেছিল। তবে সঙ্করায়ণে বিশেষ সাফল্যের স্বার রেখেছিলেন তরুণ রোজারিয়ান মির্জা শোয়েব। তাঁর সৃষ্ট ‘বায়ান্ন’ ‘একুশে’ ‘সূর্যোদয়’ ‘হেমন্ত’ ‘আনন্দ’ প্রভৃতি আধুনিক গোলাপ উল্লেখের দাবি রাখে।
তবে গোলাপ নিয়ে আনন্দ আমাদের ব্যাহত হতে থাকে নব্বইয়ের দশক থেকেই। গোলাপচর্চার অভিযান প্রায় থেমেই যায় দশকটির মাঝামাঝি নাগাদ। কারণ একাধিক। এখানে আমি কেবল একটি বলেই শেষ করব।
আমার মতে শহরেনগরে গোলাপের দ্রুতপদে পিছু হটার বড় কারণ হল বহুতলভবনের লাগাম দিয়ে ছুটে চলা। মাটি হারিয়ে গোলাপ আশ্রয় নেয় দ্বিতল দালানের ছাদে অথবা ত্রিতল প্রাসাদের চাতালে। সেগুলিও গুঁড়িয়ে মাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিবিধ্বংসী নভোগামী ইমারতের অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তার ঘাতক ক্যান্সারের রূপ নিলে-- রোদপিয়াসী গোলাপ পালিয়ে বাঁচতে চায় এক চিলতে বারান্দায়। সেখানেও যদি অভাগিনীর কপালগুণে, কর্কটক্রান্তীয় রোদের বদলে, দেিণর রৌদ্রটুকু মেলে-- তবেই কেবল নগরীর শেষ গোলাপটি রা পেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১:২৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×