somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যপ্রাচ্যে আকস্মিক উত্তাপে নতুন শঙ্কা

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাসুমুর রহমান খলিলী
ক্যালিফোর্নিয়ার ইহুদিবাদী পরিচালক নাকুলা বাসিলের ইসলাম ও মহানবী সা:-এর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ ও তা সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার রক্তক্ষয়ী প্রতিক্রিয়া নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ইনোসেন্স অব মুসলিমস নামে রহস্যপূর্ণ এ চলচ্চিত্র যে মুসলিম বিশ্বে বেশ খানিকটা স্থিতিশীল হয়ে আসা উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে উসকে দেয়ার জন্য করা হয়েছে তাতে এখন কেউ সন্দেহ পোষণ করছেন না। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জমজমাট প্রচারণার প্রাক্কালে দেশটির রাষ্ট্রদূতসহ চার নাগরিক বেনগাজিতে নিহত হওয়ার ঘটনার প্রভাব বেশ খানিকটা সুদূরপ্রসারি হতে পারে। পশ্চিমা ও মুসলিম বিশ্বের নেতারা পরিস্থিতিকে ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে না নিতে পারলে নতুন নতুন সঙ্ঘাত পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হবে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা।
রহস্যময় সিনেমা : আমেরিকায় বসবাসরত ইহুদি ব্যবসায়ীদের অর্থানুকূল্যে ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মিত ছবিটি বেশ রহস্যজনক। সিনেমাটি ক্যালিফোর্নিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতিতে তৈরি হয়নি। ডেজার্ট ওয়ারিয়র নামে একটি সিনেমার জন্য অনুমোদন নেয়া হয়েছিল, যার ক্রেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছিল স্যাম। এটি এক দিনের মতো দেখানো হয়েছিল সেখানে। এ সিনেমাটির নির্মাতা নাকুলা বাসিল এর আগেই ইসলামকে ক্যান্সার বলে উল্লেখ করে উসকানিমূলক রাজনৈতিক বিবৃতি দেন।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবী সা:কে নিয়ে অবমাননাকর এই চলচ্চিত্র তৈরির জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হওয়া সত্ত্বেও এই ছায়াছবির ইহুদিবাদী নির্মাতা নাকুলা বাসিলে (Nakoula Basseley Nakoula) বলেছেন, তিনি এই ভিডিও তৈরির জন্য দুঃখিত নন। বাসিল আমেরিকার আরবিভাষী রেডিও সাওয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘না, আমি দুঃখিত নই। বরং লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়ায় আমি দুঃখিত, কিন্তু এই ভিডিও নির্মাণের জন্য অনুতপ্ত নই আমি। আমিই ১৪ মিনিটের এই ভিডিও প্রকাশ করেছি এবং তা ইন্টারনেটে দিয়েছি। আমি পুরো ছায়াছবিটি প্রকাশের চিন্তাভাবনা করছি। ’
নাকুলা বাসিলের ভিডিও প্রকাশের ফলে মার্কিন নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দেখা দেয়ায় নিজেকে অপরাধী মনে করছেন কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে বাসিলে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি নিজেকে অপরাধী মনে করছি এ ব্যাপারে। এ বিষয়ের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই।’
পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবী সা:কে নিয়ে অবমাননাকর চলচ্চিত্র তৈরির পর সারা বিশ্ব বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠার পর গাঢাকা দিয়েছেন চলচ্চিত্রের ইহুদিবাদী নির্মাতা স্যাম বাসিলে। অজ্ঞাত স্থান থেকে বাসিলে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘এটা একটা রাজনৈতিক সিনেমা। ইরাক ও আফগান যুদ্ধে আমেরিকা বহু জীবন ও সম্পদ নষ্ট করেছে, আমরা এখন আদর্শিক যুদ্ধ করছি। আমার দুই ঘণ্টার সিনেমায় ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করতে চেয়েছি।’
যুক্তরাষ্ট্রে মিসরীয় বংশোদ্ভূত কট্টরপন্থী এক খ্রিষ্টান এ সিনেমাটিকে আরবিতে ডাবিং করে ইউটিউবে দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা দেন। এর আগে ২০১০ সালে আমেরিকান যে যাজক কুরআন পোড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই টেরি জোনসেরও যোগসূত্র পাওয়া যায় এতে।
সিনেমাটিতে যেভাবে মহানবী সা:-এর জীবনের ওপর কলঙ্ক লেপনের উদ্যত দেখানো হয়েছে তা মোটেই কাকতালীয় নয়। যারা এর পেছনে কাজ করেছেন তারা একটি পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই এটি করেছেন বলে মনে হয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাস ও অসহিষ্ণুতাকে ইসলাম ও মুসলিমদের ভাবমর্যাদার সাথে একাকার করে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানো হয়। এর পরবর্তী এক যুগে আফগানিস্তান দখল, ইরাকে অভিযানসহ আরো বিভিন্ন ঘটনা ঘটে, যার প্রভাব বিশ্বপরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে পড়ে। এসব ঘটনায় ইসলাম ও মুসলিমদের সন্ত্রাসী ও অসহিষ্ণু হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় ব্যত্যয় ঘটতে থাকে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের মার্কিননীতির কৌশলও কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়ে। আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের ওপর ইসরাইলি কট্টরপন্থী চিন্তার প্রভাব কমতে থাকে। এটিকে উল্টোমুখী করতে উসকানিমূলক সিনেমাটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়ে থাকতে পারে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমারেখা : ইনোসেন্স অব মুসলিস নামে সহিংসতায় উসকানি দেয়ার মতো সিনেমার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে বড় যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে। বাস্তবে দেখা যায় আমেরিকায় যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে তা একেবারেই সীমারেখার বাইরে নয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার তাত্ত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী একজনের স্বাধীনতা যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের অধিকারকে আঘাত না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা ভোগ করা যাবে। অন্যের মাথায় আঘাত করার অধিকার ব্যক্তিস্বাধীনতায় দেয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের অস্তিত্বের বিপক্ষে কথা বলার ওপর আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে। এটাকে বলা হয়েছে ঘৃণা ছড়ানো। বাসিলের সিনামাটি মোটেই মত প্রকাশের বিষয় ছিল না। এটি ছিল ঘৃণা ছড়ানোর একটি অপচেষ্টা। বিশ্বের দেড় শ’ কোটি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুসরণের কেন্দ্রবিন্দু হজরত মোহাম্মদ সা:-এর জীবনে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে কলঙ্কলেপন করে সহিংসতা সৃষ্টিকে আইনের আওতায় আনতে অপারগতা প্রকাশ প্রশ্নসাপেক্ষ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন সিনেমাটিকে একটি জঘন্য কাজ বলে উল্লেখ করলেও একই সাথে তিনি আমেরিকার মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি দেশকে অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার পাশাপাশি বৈশ্বিক বাস্তবতাও বিবেচনায় আনতে হয়। অথচ এই বিষয়টি আমেরিকান নীতিনির্ধারণে অনেক সময় অনুপস্থিত দেখা যায়।
টার্গেট মধ্যপ্রাচ্য : ডেনমার্কের কার্টুন, যাজক জোনসের পবিত্র কুরআন পোড়ানোর হুমকি এবং সব শেষে সিনেমাটি তৈরির পেছনে মূল লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে। মধ্যপ্রাচ্যের তাৎপর্যপূর্ণ কিছু উন্নয়ন রয়েছে বিগত কয়েক বছরের। এর পেছনে মার্কিন নীতির কিছুটা প্রভাবও রয়েছে। আমেরিকান নীতি এক সময় ছিল আমেরিকার স্বার্থের জন্য সহায়ক হলে রাজা সামরিক বা রাজনৈতিক একনায়কদের সহায়তা করা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের একনায়কত্ব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থাভাজন হয় না। তারা নিজেদের সর্বাত্মকবাদী শাসন কায়েম রাখতে বিভিন্ন ধরনের জুলুম নিপীড়ন করেন। এসব রাষ্ট্রনায়কের পৃষ্ঠপোষকতার সাথে সাথে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক হিসেবে টিকিয়ে রাখার মতো করে আমেরিকা তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিন্যাস করে। কিন্তু এই নীতি মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে ক্ষোভের কারণ হয়।
এসব কিছুর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিনবিরোধী প্রান্তিক জঙ্গি চিন্তা দানা বেঁধে ওঠে। উল্লেখযোগ্য মানুষ এ ধরনের প্রান্তিক চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। এতে আল কায়েদার মতো সংগঠনের সৃষ্টি হয়। এ গোষ্ঠীকে আমেরিকা আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ে পৃষ্ঠপোষকতাও প্রদান করে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোন্যাল্ড রিগ্যানের সাথে আলকায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের আলোচনার ছবিও দেখা যায়। কিন্তু পরে আলকায়েদা নেটওয়ার্কের সাথে মার্কিন স্বার্থের প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাত দেখা দেয়। টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে আফগানিস্তান দখলের পর এ লড়াই হয় সর্বব্যাপী। প্রান্তিক চিন্তা এবং প্রতিশোধের জন্য সন্ত্রাসে বিশ্বাসী সংগঠনগুলোকে আলকায়েদা অভিন্ন নেটওয়ার্কে আনতে সহায়তা করে। মার্কিন নীতিতে বিক্ষুব্ধ ও দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে এ ধরনের সংগঠনের রিক্রুটমেন্ট সহজ হয়।
টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী ঘটনার পর আমেরিকান নেতৃত্বাধীন অভিযানের দু’টি প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। এক দিকে এই অভিযান আফগানিস্তান-পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু অঞ্চলে মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করে, অন্য দিকে আমেরিকান যুদ্ধ ও নিরাপত্তা ব্যয় এবং সেনাক্ষয় অত্যধিকভাবে বেড়ে যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সর্বাধিক আমেরিকানের মৃত্যু হয় আফগান-ইরাক যুদ্ধে। অন্য দিকে ইরাকি তেল ও আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে যুদ্ধ ব্যয়ের একটি অংশ তুলে নেয়ার চিন্তা সেভাবে বাস্তবে রূপ নেয়নি। এ কারণে আমেরিকান অর্থনীতিতে মন্দা ও শ্লথগতি দেখা দেয়। সেনাবাহিনীর লোকক্ষয় ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা চাপে ফেলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের। মুসলিম বিশ্ব নিয়ে বিকল্প চিন্তা শুরু হয় ওয়াশিংটনে। আমেরিকান কংগ্রেস বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা এবং সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন না করার নীতি পাস করে। একই সাথে কথিত উদারপন্থী ও সেকুলার ধারার পরিবর্তে মুসলিম বিশ্বের মূল ধারার সাথে কাজ করার বিকল্প নীতি সামনে রাখা হয়।
বুশ প্রশাসন ও নিওকনদের বিপরীতে এ ধারা ওবামা প্রশাসনে প্রাধান্য লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের পরিবর্তিত ভূমিকার পেছনে আমেরিকান পরিস্থিতি ও উদার নীতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কট্টরপন্থী ইসরাইলি নেতৃত্ব মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে গণবিপ্লব চলেছে তাতে আমেরিকান নীরবতা অথবা সমর্থনের বিপক্ষে ছিল। কট্টরপন্থী ইসরাইলিরা মনে করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে শক্তি দিয়েই টিকে থাকতে হবে, সমঝোতার মাধ্যমে নয়। তাদের ধারণা, ব্রাদারহুড ধারার নেতৃত্ব মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সংহত হলে ইসরাইল অনেক বেশি চাপে পড়বে। ডেমোক্র্যাট রিপাবলিকান নির্বিশেষে সব মার্কিন সরকার ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য শক্তি ও সংলাপের ভারসাম্য প্রয়োজন বলে মনে করে ডেমোক্র্যাটরা। এ কারণে ইসরাইলের সাথে ক্যাম্পডেভিট শান্তিচুক্তিসহ প্রায় সব শান্তি আলোচনা ও চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ডেমোক্র্যাটদের আমলে। বারাক ওবামা ইসরাইলের স্বার্থের বিরুদ্ধে তার চার বছরের শাসনামলে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ না নিলেও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধানের জন্য। ইসরাইলের কট্টরপন্থী নেতৃত্ব এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বারবার বাধা তৈরি করেছে। এর অংশ হিসেবে ইরানের পরমাণু ইস্যুটিকে বয়কট অবরোধের পর্যায় থেকে বেরিয়ে যুদ্ধ ও আক্রমণের পর্যায়ে নিতে নেতানিয়াহু ও এহুদ বারাক অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজ ভালো করেই জানে এ মুহূর্তে ইরান আক্রমণের ঘটনা ঘটলে তা মধ্যপ্রাচ্য, বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত করবে।
এ ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টির জন্য ইসরাইলি কট্টরপন্থীরা বেছে নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়টিকে। নেতানিয়াহু ও ইসরাইলি নেটওয়ার্ক ইরান আক্রমণের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং এর ফলে মধ্যপন্থী ইসলামি দলগুলোর ক্ষমতারোহণের প্রক্রিয়াকে উল্টোমুখী করতে চাপ সৃষ্টি করেছে ওবামা প্রশাসনের ওপর। এ চাপ সৃষ্টি করতে গিয়ে ওবামার সাথে দূরত্বও তৈরি হয় নেতানিয়াহু চক্রের।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির প্রতি সরাসরি সমর্থন জানান নেতানিয়াহু।
ক্যালিফোর্নিয়ায় ইসলাম ও মহানবী সা:-এর প্রতি কুরুচিপূর্ণ বিদ্বেষ সংবলিত সিনেমা সৃষ্টি করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার সাথে এর প্রত্যক্ষ যোগসূত্র রয়েছে। সিনেমাটি নির্মাণকারী বাসিল নিজেই বলেছেন, এটি ধর্মকেন্দ্রিক সিনেমা নয়, এই হলো রাজনৈতিক সিনেমা। এ ধরনের উত্তেজনাকর সিনেমা ওয়েবসাইটে ছেড়ে দেয়ার প্রতিক্রিয়া কী হবে তা হিসাব নিকাশ করেই নেয়া হয়েছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপগুলো। বেনগাজিতে আমেরিকান মিশনে হামলা এবং সেখানে রাষ্ট্রদূতের নিহত হওয়ার বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নিহত মার্কিন রাষ্ট্রদূত দেশটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকদের একজন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটনের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। আমেরিকান গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রদূত অল্প সময়ের মধ্যে অন্য কূটনৈতিক দায়িত্ব গ্র্রহণের জন্য লিবিয়া ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি বেনগাজি আসার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় দেশ সফর করেছেন। লিবিয়ার বিপ্লবে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কাদের সাথে আমেরিকানদের যোগাযোগ ছিল সেসব নথিপত্র তার ওয়াশিংটনে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের বিদায় প্রস্তুতি ও স্পর্শকাতর দায়িত্ব সম্পাদনের বিষয়টি খুব বেশি মানুষের জানা থাকার কথা নয়।
দৃশ্যত বেনগাজির মার্কিন মিশনে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বাসিলের ঘৃণা ছড়ানো ছবিতে বিক্ষুব্ধরা। কিন্তু সেখানে গুলাগুলির ঘটনা ঘটিয়েছে ত্রিপোলি থেকে আসা মার্কিন উদ্ধার অভিযান পরিচালনকারীরা। এসব তথ্য আমেরিকান কিছু কিছু গণমাধ্যমে এখন আসছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী রাষ্ট্রদূতের মৃত্যু ঘটেছে আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে, গুলিতে নয়। আর রাষ্ট্রদূতকে বেনগাজির হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার জানতেন না আহত ব্যক্তি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত।
বলা হচ্ছে, বেনগাজিতে মার্কিন মিশনে হামলা এবং রাষ্ট্রদূতের নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে দু’টি পক্ষ জড়িত থাকতে পারে। একটি হলো মধ্যপ্রাচ্যের মাগরেব অঞ্চলের আলকায়েদা, যাদের ড্রোন হামলার মাধ্যমে আমেরিকানরা হত্যা করছে। প্রতিশোধের সুযোগ হিসেবে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সন্দেহের অন্য গ্রুপ হলো গাদ্দাফি অনুগত যোদ্ধারা। তারা গাদ্দাফির পতনে আমেরিকার সংশ্লিষ্টতার প্রতিশোধ নিতে এটি করেছে। কিন্তু এর বাইরে তৃতীয় যে বিষয়টি সামনে আসছে সেটাকে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এটি হলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় ওবামা প্রশাসনের যে ভূমিকা সেটিকে উল্টোমুখী করা।
বাসিলের সিনেমা তৈরি থেকে শুরু করে এ ঘটনার জন্য দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে মুসলিম বিশ্বে মার্কিনবিরোধী সহিংস বিক্ষোভ উসকে দেয়া আর পাশ্চাত্যে মুসলিম মানে অসহিষ্ণু ও সন্ত্রাসী- এসব প্রচারণা জোরদার করার ক্ষেত্রে নিউকন-ইসরাইলি লবির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় ভেবে দেখার মতো। একটি হলো বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাককেইনের বেনগাজি সফরের সময় সেখানে তার সাথে যাদের দেখা গিয়েছিল তাদের কাউকে কাউকে বেনগাজির মার্কিন মিশনে হামলার ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট মনে করা হচ্ছে। অন্য দিকে এবারের রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি বলেছেন, বেনগাজিতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়ার পরপরই এ ঘটনার বিচার না চেয়ে হামলাকারীদের প্রতি সহানুভূতিই প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তব্যে বেশি প্রকাশিত হয়েছে। এতে একটি সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে, বাসিলের সিনেমা বেনগাজির মার্কিন মিশনে হামলা ও রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ওবামা-নেতানিয়াহুর মধ্যকার দূরত্বের একটি ভূমিকা রয়েছে। আর আমেরিকান মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টার সাথেও এর একটি সম্পর্ক থাকতে পারে।
পুরো ঘটনার ব্যাপারে তুরস্ক ও মিসরীয় নেতাদের বক্তব্য আর প্রতিক্রিয়াও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল, প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়ব এরদোগান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ দেবুগ্লু, ধর্মবিষয়ক ডাইরেক্টরেটের প্রধান অধ্যাপক মেহমেট গোরমেজ মার্কিন মিসনে হামলার নিন্দা করেছেন। উসকানিমূলক ও ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ সিনেমা বা অন্য কোনো কিছুকেই সহিংসতার জন্য যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা যাবে না উল্লেখ করে তুর্কি নেতারা বলেছেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ঘৃণা ছড়ানোর স্বাধীনতা এক হতে পারে না। তারা বাসিলের সিনেমার ব্যাপারে প্রতিবাদ বিক্ষোভের বিষয়টিকে স্বাগত জানান, কিন্তু দূতাবাসে হামলার মতো সহিংসতাকে নয়। এ ব্যাপারে তুর্কি ইসলামি পণ্ডিত ফেতুল্লাহ গুলেনের বক্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি নিহত রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন ও অন্য তিন আমেরিকানের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন, তারা ছিলেন লিবিয়ার অতিথি। যারাই হামলা করে থাকুক না কেন এ ধরনের সন্ত্রাস সহিংসতা নিন্দনীয়। তিনি উল্লেখ করেন, নিরপরাধ মানুষদের বাঁচানোর কথা বলে তাদের সন্ত্রাসের শিকার বানানো ইসলামের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। মিসরীয় প্রেসিডেন্ট মুরসির বক্তব্যেও একই কথা এসেছে। তিনি বিদ্বেষ ছড়ানো সহিংসতা উসকে দেয়ার এ সিনেমার ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের প্রতি দুঃখ প্রকাশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু বিদেশী কূটনীতিকদের তার দেশের মেহমান বলে উল্লেখ করে বলেছেন সেখানে সহিংসতা সমর্থনযোগ্য নয়।
বাসিলের সিনেমা ও তা থেকে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ইরানে হামলা চালাতে ওবামা প্রশাসনে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে ইহুদি লবির পক্ষ থেকে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নাইন-ইলেভেনের পরে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতিকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচারণা নতুন করে শুরুর প্রেক্ষিত তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কট্টরপন্থী ইহুদিপন্থীদের দ্বারা। এ প্রচেষ্টা সফল হলে মুসলিম বিশ্বে চলমান অনেক কিছুর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×