১. কুর'আন
কুরআন আল্লাহ্র কিতাব। এর রয়েছে নিজস্ব বাচনভঙ্গী যা মানবীয় বাচনভঙ্গী থেকে আলাদা। তাই এ কিতাব বার বার চ্যালেঞ্জ দিয়েছে এর অস্বীকারকারীদেরকে এরকম একটা কিতাব তৈরী করে আনতে। না পুরো কিতাব নয়, শুধু একটি সূরা। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ্ ছাড়া সব সাহায্যকারীর সাহায্য গ্রহন করতে বলা হয়েছে এর অস্বীকারকারীদের। আবার কুর'আনই বলে দিয়েছে এটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। "আমরা আমাদের বান্দার উপর যা নাজ়িল করেছি সে ব্যাপারে যদি তোমরা সন্দেহে ভোগ তাহলে নিয়ে এস এর সূরাগুলোর মত একটি, আর এ ব্যাপারে আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের আর সব সাহায্যকারীকে ডেকে নাও; যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। যদি তোমরা তা না পার, আর তোমরা কখনোই তা পারবেনা, তবে সে আগুনকে ভয় কর যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। একে (আগুন) তৈরী করা হয়েছে সত্য অস্বীকারকারীদের জন্য।" [2/23-24] এটা অননুকরণীয় এক কিতাব। কুর'আন পৃথিবীর আর কোন কিতাবের সাথে কোন সাজুয্য রাখেনা। এমনকি আরবীতে লিখা অন্য সব কিতাব থেকে এর বাচনভঙ্গী সম্পূর্ণ আলাদা। এর বর্ণনার ধরণ হাদীসের ভাষা থেকেও ভিন্ন। যারা আরবী ভাষা জানেন তারা এ পার্থক্যটা খুব সহজেই ধরতে পারেন।
কুর'আনের শব্দাবলী বিশ্বজাহানের স্রষ্টা নিজে চয়ন করেছেন। এজন্য মানবীয় ভাষায় এর অনুবাদে সবসময় থাকে সীমাবদ্ধতা। যার জন্য মুসলিমরা কখনোই অনুবাদকে কুর'আন মনে করেননা। কুর'আন হচ্ছে তা যা পড়া হয় আরবীতে। অনুবাদ্গুলো আমাদের মানবীয় প্রচেষ্টা কুর'আন বুঝার নিমিত্তে। এজন্য কুর'আনের কোন অনুবাদই পরিপূর্ণ নয়। অনেক অনুবাদ আবার ভাবানুবাদ, শাব্দিক নয়। কুর'আনের বাণী বুঝার জন্য আরো দরকার ক্লাসিক্যাল আরবী ভাষার উপর দক্ষতা। এজন্য ক্লাসিক্যাল আরবীর যথার্থ জ্ঞান ব্যতিরেকে শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে কুর'আনের সমালোচনা করা মূর্খতাপূর্ণ পণ্ডিতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
কুর'আনের সমালোচনার জন্য অন্য আরেকটি বিষয় পাঠককে জানতে হবে। তা হলো কুর'আনের আয়াতগুলো নাজ়িল হয়ার প্রেক্ষাপট। সাধারণত আমরা লিখিত কিতাবগুলোকে সুচী ও বিষয় অনুযায়ী অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে বিভক্ত ধারাবাহিকরূপে সাজানো দেখতে পাই। কিন্তু কুর'আন কোন লিখিত কিতাব হিসেবে একসাথে মুহাম্মদকে (আল্লাহ্র করুণা ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর) দেয়া হয়নি। বরং এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান ও পাত্রের উপলক্ষে নাজ়িল করা এক ভাষণের সমষ্টি। এজন্য প্রচলিত কিতাবের (বইয়ের) ধারণা এখানে পাওয়া যাবেনা। এর ভাষণগুলোর একটি সাধারণ প্রয়োগ থাকলেও এর প্রতিটি ভাষণের বিশেষ প্রয়োগও রয়েছে নাজ়িলের প্রেক্ষাপটের আলোকে।
২. নারী ও শস্যক্ষেত্র
কুর'আনের কিছু আয়াত উদ্ধৃত করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন কিছু ব্লগার। এরকম একটি কাজ করেছেন সম্প্রতি "সুশীল সমাজ" নিকধারী এক ব্লগার তাঁর এক পোস্টে। তিনি কুর'আনের সূরা আল-বাকারার ২২৩ নং আয়াতটির নিন্মোক্ত অনুবাদ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে ব্লগে তুলে ধরেছেনঃ "তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্য ক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর। আর নিজেদের জন্য আগামী দিনের ব্যবস্খা কর এবং আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক। আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, আল্লাহর সাথে তোমাদেরকে সাক্ষাত করতেই হবে| আর যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে দাও।" তাঁর বোল্ড করা অংশগুলোই তাঁর ইঙ্গিতের স্বরূপ। অনুবাদটি মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত মা'আরেফুল কুর'আনেও এভাবেই দেয়া হয়েছে। তিনি হয়তো প্রেক্ষাপট জানতেন বলে তাঁর কাছে এখানে কোন অসুন্দর ইঙ্গিত ধরা পড়েনি। এবার আসুন আমি একটি অনুবাদ পেশ করি। "তোমাদের স্ত্রীরা হল তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যখন ও যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যাও। আর নিজেদের জন্য ভবিষ্যতের ব্যবস্থা কর ও আল্লাহ্কে ভয় কর............।"
"ফা'তু হারসাকুম আন্না শি'তুম" এর অনুবাদ করা হয়েছে "তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর"। অথচ ফা'তু মানে "অতএব তোমরা গমন কর", হারসাকুম মানে "তোমাদের শস্যক্ষেত্র" আর আন্না শি'তুম মানে "তোমরা যেভাবে ইচ্ছা কর বা যখন ইচ্ছা কর।" যারা আয়াতটির পেছনের কারণ জানেন তাদের কাছে "তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর" অনুবাদটি শাব্দিকভাবে যথাযথ নাহলেও ভাবার্থের দিক দিয়ে মিলবে এবং তারা এতে কোন অস্বস্তিকর কিছু পাবেননা। কিন্তু যারা পুরো ব্যাপারটা জানেননা তারা এটাকে চরম অপমানকর একটা কথা মনে করবেন।
আসলে প্রকৃত ব্যাপারটা কী? ঘটনা হচ্ছে স্ত্রীদের সাথে সঙ্গমের আসন নিয়ে লোকেরা দ্বিধাদন্দ্বে পরে গিয়েছিল বিভিন্ন প্রচলিত আচারের কারণে। মদীনায় আসার পর মুসলমানদের মধ্যে এ নিয়ে বিভিন্ন সংশয়ের সৃষ্টি হয়। মক্কাবাসীরা সাধারণত তাদের স্ত্রীদের মুখোমুখি হয়ে মিলিত হত। মদীনাবাসী আনসাররা তাদের স্ত্রীদেরকে উপুর করে নিয়ে মিলিত হতেন। ওদিকে মদীনার ইহুদীরা এগুলো নিয়ে বলত যে এরকম হলে সন্তান বিকলাঙ্গ হবে। এ ছাড়াও তারা ঋতুকালীন সময়ে স্ত্রীদের থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকত, এমনকি তাদেরকে স্পর্শ পর্যন্ত করতনা। এ অবস্থায় লোকেরা প্রশ্ন করলে আল্লাহ্ তা'আলা এ আয়াতের মাধ্যমে এ সম্পর্কে সব ভুল ধারণার অবসান করেন। স্ত্রীদেরকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করে এবং তাদের কাছে যেভাবে ইচ্ছা যাওয়ার কথা বলে আল্লাহ্ তা'আলা যৌন সঙ্গমের সব আসনকে বৈধতা দিলেন এবং শুধুমাত্র স্ত্রীর যোনীতে সঙ্গমকে এলাউ করলেন। কারণ কৃষক বীজ জমিতেই বপন করে একে চাষ করে। এছাড়াও যৌন সঙ্গমের উদ্দেশ্য যে নিজের জন্য ভবিষ্যত প্রজন্ম রেখে যাওয়া তাও বলে দেয়া হয়েছে। আর স্ত্রীদের কাছে সবসময় যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ঋতুকালীন সময়ে তাদেরকে ত্যাগ করে থাকতে বলা হয়নি যেমন করত ইয়াহুদীরা। তবে তাদের সাথে সে সময়ে সঙ্গম করাকে হারাম করা হয়েছে যা এর আগের আয়াতে (২/২২২) উল্লেখ করা হয়েছে। এবং আল্লাহ্কে ভয় করতে বলে সেদিকেই মূলতঃ ইঙ্গিত করা হয়েছে।
কুর'আনে স্ত্রী-পুরূষের সম্পর্ক শুধু এ আয়াতেই বর্ণনা করা হয়নি। আমরা আরো দু'টি আয়াত দেখি। মহান আল্লাহ্ স্ত্রী-পুরূষের সম্পর্কঅকে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। সূরা বাকারাহ্র ১৮৭ নং আয়াতে তিনি এ অন্তরঙ্গ সম্পর্কের পরিচয় পেশ করেছেন এভাবেঃ "তারা তোমাদের পরিচ্ছদ স্বরূপ আর তোমরাও তাদের পরিচ্ছদ স্বরূপ।" তারা পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসার মূর্ত প্রতীক তাও আল্লাহ্ আমাদের জানিয়েছেন এভাবে, "আর তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে (একটি হলো এই যে) তিনি তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জুড়ি (স্বামী/স্ত্রী) সৃষ্টি করেছেন যাতে করে তোমরা তার কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পার। আর তিনি তোমাদের পরস্পরের মাঝে প্রেম-ভালবাসা ও দয়া-মমতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই এর মাঝে রয়েছে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য বিরাট নিদর্শন।"(৩০/২১)। এরচেয়েও সুন্দর করে কি আর কোথাও স্ত্রী-পুরূষের সম্পর্ককে বিবৃত করা হয়েছে?
৩. ইসলাম বিদ্বেষ
প্রিয় পাঠক, তাই বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভাবে কুর'আনের আয়াত নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। কুর'আনকে তার পূর্নাঙ্গরূপে নিয়েই অধ্যয়ন করতে হবে। তাহলে আপনার মনের সন্দেহ দূর হয়ে যাবে। কুর'আনকে একটি পূর্ণাঙ্গ বানী (Total Messege) হিসেবে নিতে হবে। তাহলে আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবেনা। কিন্তু বিদ্বেষ সৃষ্টিকারীরা বসে থাকবেনা। তারা কোনকালেই বসে ছিলনা। এই ব্লগে এর আগেও "নাস্তিকের ধর্মকথা" ও "ক্যাচাল" নিকধারী দু'ব্লগার বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন। আমার এক পোস্টে আমি নাস্তিকের ধর্মকথার আল্লাহ্র লিঙ্গ নিয়ে সৃষ্টি করা বিভ্রান্তির জবাব দিয়েছি আর ক্যাচালের ব্যাপারেও সাবধান করেছি। আরা কুর'আনএর আয়াতের অসঙ্গতি নিয়ে ক্যাচালের পোস্টের জবাব দিয়েছেন দ্বীপবালক। এরা অন্ধ বিদ্বেষী। কুর'আনকে ওরা নিরপেক্ষ মন নিয়ে পড়েনা। পড়ে নিজেদের পূর্ব ধারণার উপাদান খুঁজতে। এজন্য এর সম্পূর্ণ মেসেজ না নিয়ে তারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে কুর'আনের আয়াতগুলোকে কনটেক্সটের বাইরে নিয়ে উদ্ধৃত করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। তাদের ছড়ানো বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে নিজে উদ্যোগী হয়ে কুর'আন পড়তে হবে।
৪. আমার বিশেষ জ্ঞান
সুশীল সমাজ প্রশ্ন রেখেছিলেন "আবূসামীহা কি কোরান হাদিস রিসার্চ সেন্টার থেকে বেশী জ্ঞানী?" আমি কখনো বলিনি আমি সেরকম। আমি শুধু তাদেরকে অবজ্ঞা করেছি যারা আরবী ভাষার জ্ঞান ছাড়া ও কুর'আনের আয়াতগুলোর প্রেক্ষাপট জানা ব্যতিরেকে কুর'আনের বিরুদ্ধে অবজ্ঞা ছড়ানোর ধৃষ্টতা দেখায়। আমি বিশেষ কোন জ্ঞানী ব্যক্তি নই। তবে আলাহ্র কিতাবের পাঠক ও তাঁর অনুগ্রহের ফকীর।
প্রিয় মুসলিম বোন ও ভাইয়েরা! কুর'আনকে নিজে থেকে জানার উদ্যোগ গ্রহন করুন। তাহলে আপনাকে কেউ আর বিভ্রান্ত করতে পারবেনা। এ জন্য ভাল কিছু তাফসীরের সাহায্য গ্রহন করুন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে সহায়তা করবে হাফিয ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীরের যুগান্তকারী তাফসীর যা "তাফসীরে ইবনে কাসীর" হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলায় অনুদিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডঃ মুজীবুর রহমান। এছাড়া আমাদের সময়কালের দু'টো তাফসীর আপনার কুর'আন বুঝার সহায়ক হবে, যেগুলো হলঃ সাইয়েদ কুতুবের (শহীদ) "ফী জিলালিল কুর'আন" ও সাইয়েদ মওদূদীর "তাফহীমূল কুর'আন।" আসুন নিজেদের ঈমান হিফাজত করি, কুর'আনের পথে চলি আর আমাদের মহামহিম প্রভূর সন্তোষের লক্ষ্যে দ্রুত ধাবিত হই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১০:০৭