আমার এক বন্ধু শিমুল। খুবি-তে আর্কিটেকচার-এ পড়ে। স্কুলে থাকতে সে ডা: লুৎফর রহমানের বই পড়তো। শুধু পড়া........ সে রীতিমতো ডা: লুৎফর রহমানের বাতলে দেয়া জীবন দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে পড়লো (এখন অবশ্য অনেক বদলে গেছে........তবুও কিছু রয়ে গেছে)।
ডা: সাহেবের ভুত তার মাথায় এমন চাপা চাপল যে, সবখানে তার নীতির প্রতিফলন। কাউকে কোন উল্টাপাল্টা করতে দেখলে তাকে দীর্ঘ বয়ান দিত "সৎ জীবন"-"মহৎ জীবন" মার্কা।শেষে তার অবস্থা "ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি" করে ছেড়ে দিত।
তার কিছু প্রিয় টার্গেট ছিল এই টার্গেট প্রাক্টিসে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল "অপ্রাপ্ত বয়স্ক ভিক্ষুক"। এই সব পোলাপাইন গুলা তার কাছে এসে খয়রাত চাইলেই হইছে, পিচ্চি তো বটেই আমাদেরও অবস্থা "ভিক্ষা চাইনা কুত্তা ঠেকা" হয়ে যেত। কখনও সখনও আমরাই এক-দুই টাকা দিয়ে পিচ্চিরে ভাগিয়ে দিয়েও রেহাই পেতাম না, তখন তার নীতি চর্চা শুরু হত আমাদের উপর, "কেন একজন কে অনৈতিক কাজে উৎসাহিত করলাম"।
বছর তিনেক আগের ঘটনা, বরাবরের মতো ঈদের আগের রাতে আমরা সবাই খুলনা নিউ মার্কেটে আড্ডা দিচ্ছিলাম (যারা খুলনা বাসী তারা সবাই জানেন ঈদের আগের রাতে মানে চাঁদ রাতে খুলনা নিউমর্কেট এক চমৎকার আড্ডাস্থলে পরিণত হয়,কেউ কিনতে আসে, কেউ দেখতে আসে, মোট কথা বেশিরভাগ বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়; সে এক অদ্ভুত মিলন মেলা)। এমন সময় স্বাভাবিক ভাবেই এক পিচ্চি আসলো ভিক্ষা নিতে, তাও শিমুলের কাছে (ওর দয়ালু চেহারা বোধহয় তাকে টেনেছিল)। ব্যাস্........ শুরূ হয়ে গেল শিমুলের নীতির চর্চা। আমরা সাথে সাথে খানিক দূরে সরে গেলাম আড্ডা দিতে (অবশ্য আমাদের এই ব্যবহারে সে অভ্যস্ত ছিল)।
দূর থেকেই মাঝে মাঝে কানে আসছিল তার "ভিক্ষার কুফল", "চারিত্রিক দৃঢ়তা", "লেখা পড়া করার সুফল", "নৈতিক দায়িত্ব" ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে বক্তৃতার অংশ বিশেষ। সে এই ভাষণ ইতিপূর্বে অনেককে দিয়েছে। অবশ্য কোন বারই কোন কাজ হয়নি। "আষাড়ে রোদণ" হয়েছে।
পরের বছর ঈদে, আমরা বরাবরের মতো আড্ডা দিচ্ছি। দেখি সেই পিচ্চি আবারো এসেছে। এসেই সোজা শিমুলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কেমন আছেন। আমরা আশু বয়ান থেকে রেহাই পেতে তাকে টাকা দিয়ে বিদায় করতে চাইলাম। সে সোজা না করে দিল। আমরা তো অবাক, কাহিনী কি? তো সে কাহিনী খোলাসা করে দিল।
সে ভিক্ষা করা ছেড়ে দিয়েছিল। সে পড়া লেখা করা শুরু করেছিল। সে এসেছিল তার আগেকার বন্ধুবান্ধব দের সাথে দেখা করতে যারা তখনও ভিক্ষুক। সে আয়ের উৎস হিসাবে অন্য কাজ শুরু করেছিল।
খুবই ভাল খুবই ভাল লেগেছিল। আমার বন্ধু শিমূল অন্তত একটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। আমার এমন একটি বন্ধু আছে বলে আমি গর্বিত, যে অন্তত একটি মানুষের জীবনে গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে পেরেছিল।
হতে পারে সে কয়েক শত লোক কে বলেছিল ভাল হতে, একজন তো হয়েছিল।
আমরা ব্যর্থ এই জন্য যে, আমাদের কথা শুনবে না এই ব্যর্থতার ভয়ে আমরা কাউকে ভাল হতে বলিনা।