সাদপন্থী এতায়েতীদের হিংস্রতাকে আমি অতি নিকট থেকে অবলোকন করেছি--মুফতি আব্দুল্লাহ মায়মূন
উলামা-তলাবার উপর নিকট অতীতের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের কথা যদি উঠানো হয়, তাহলে সর্বপ্রথম শাপলাচত্বরের কথা স্মরণ হয়।
কিন্তু বিভিন্ন দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, টঙ্গী ময়দানে উলামা-তলাবার উপর সাদপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হামলা হিংস্রতার দিক দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে শাপলাচত্বরকেও ছাড়িয়ে যায়।
.
উভয় বিপর্যয়ের তুলনামূলক কিছু পার্থক্য তুলে ধরি।
১- শাপলাচত্বরে তিন দিক থেকে যৌথবাহিনী হামলা করলেও এক দিকে পলায়নের রাস্তা বের করে দেয়।
কিন্তু টঙ্গী মাঠে হামলাটা চতুর্দিক থেকেই হয়েছিল, কিন্তু পলায়নের কোনো রাস্তাই ছিল না।
২- শাপলাচত্বরে বিভিন্ন চিপায়-চাপায় লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি এবং পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা ব্যক্তিকে কোনো ধরনের হামলা করা হয় নি। তাদেরকে নিরাপদে চলে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু টঙ্গী ময়দানে লুকিয়ে থাকা সাথী এবং আত্মসমর্পণ করা উস্তাদ-ছাত্রদেরকে দফায় দফায় আঘাত করে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দেয়।
.
নিম্নে কয়েকজন ব্যক্তিদের উপর হামলার বিবরণ তুলে ধরলে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!
.
১- মুফতি জাকির হোসাইন সাহেব। জামিয়া কারিমিয়া, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জের নায়েব মুহতামিম। নারায়ণগঞ্জ মারকাযের শুরার সদস্য ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর সাহেবের মেয়ের জামাই, তাবলীগে তিনি সাল লাগিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ মারকাযে মাঝেমধ্যে বয়ান ও হায়াতুস সাহাবার তালীম করেন। তিনি সেদিন তিন দিনের জন্যে টঙ্গীর ময়দানে ছিলেন। এতায়েতিরা তাঁকে মেহমানখানা থেকে ধরে নিয়ে আসে। এরপর প্রথমে একদল পিটায়, লাঠি-কাঠের টুকরা ইত্যাদি দিয়ে, এখান একটু যাওয়ার পর আরেকদল এসে পিটায়, এরা তাঁকে বলে, 'তুই নারায়ণঞ্জ মারকাযে বয়ান করিস না? তুই ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর সাহেবের মেয়ের জামাই না'? এই সব বলে তাঁকে আরো বেশি রক্তাক্ত করে। এভাবে তাঁর সারা শরীর, পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যায়। এতকিছুর পরেও তিনি পা টেনে টেনে কোনোভাবে বের হচ্ছিলেন। তখন পিছন থেকে এক বৃদ্ধ এসে উনার মাথায় আঘাত করে, তখন তিনি বসে পড়েন। তিনি আর উঠতে পারছেন না। তখন তারা তাঁকে ফরেন গেটের ওই দিকে কামারপাড়া স্কুলের দেয়াল থেকে নিচে ফেলে দেয়।
তখন তিনি উঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেন, চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। হুঁশ হারানোর উপক্রম। একপর্যায়ে স্কুলের ছাত্ররা ধরে উনাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়।
এখন তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। পুরো শরীর ক্ষত বিক্ষত, ব্যথায় কাতরাচ্ছেন, না পারেন ভালোভাবে বসতে, না পারেন ভালোভাবে শুইতে। ডাক্তার তাঁকে এক মাস রেষ্টের নির্দেশ দিয়েছে।
সাধারণ দীনদার স্কুল ছাত্রদের অন্তরে যেটুকু মানবতা ভেতরে ছিল, এইটুকু মানবতাও এই হিংস্র সাদপন্থীদের ভেতর দেখা যায় নি!
মাঝেমধ্যে পাথর থেকেও পানি বের হয়, কিন্তু এই পাষণ্ডদের অন্তর ছিল পাথরের চেয়েও কঠিন।
.
২- মাওলানা আবু ইউসুফ সাহেব দা.বা., কেরানীগঞ্জ সাতগাও মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম সাহেব। তিনি এলাকার সাথী ও ছাত্রদেরকে নিয়ে টঙ্গী ময়দানে আসেন। কিন্তু ময়দানে আসার পর দেখা গেল উনার সাথে আসা এলাকার সাথীরাই উনার উপর হামলা করে। এরা মিত্রের বেশে শত্রু, মুমিনের পোশাকে মুনাফিক। তারা তাঁকে এই পরিমাণ আঘাত করে যে তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। তিনি মারা গেছেন ভেবে তারা তাঁকে মাঠের বাহিরে ফেলে দেয়। সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন অবস্থায় নদীর পাশের বেঁদে নারীরা তাঁকে উদ্ধার করে।
এখন মাথায় দশটা সেলাই দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই আছেন।
বেঁদে নারীদের ভেতর যেটুকু মনুষত্ব আছে এটুকু মনুষত্ব কি নেই এই এতায়েতী হায়েনাদের?
.
৩- মুবারক হোসাইন, জামিয়া কারিমিয়া, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জের ইফতা বিভাগের ছাত্র। হামলার সময় সে আত্মরক্ষার জন্যে তিনতলার ছাদে আশ্রয় নেয়। হঠাৎ করে দেখে পাঁচজন এতায়েতী তাকে ঘিরে ফেলেছে। সে একজনকে জড়িয়ে ধরে, তার ধারণা ছিল তারা হয়তো তাকে ছাদ থেকে ফেলে দিতে পারে। এই আশঙ্কায় সে এই কৌশল অবলম্বন করে। সে ওই এতায়েতিকে জড়িয়ে ধরার পর বলে, 'তুমি আমার ভাই, আমাকে মারিও না'। কিন্তু অন্যরা তাকে আঘাত করা শুরু করে, এভাবে তারা মারতে মারতে নিচে আসে। তখন তারা জিজ্ঞেস করে, 'তুই কি মুসলমান? তাহলে কালেমা পড়'! সে কালেমা পড়ে! তারা জিজ্ঞেস করে, তোমার আমীর কে? সে জবাব দেয়, 'মাওলানা সাদ সাহেব'! জবাবে তারা বলে, 'হয় নি', বল, 'মাওলানা সাদ সাহেব 'দামাত বারাকাতুম'! সে তাই বলে।
তখন তারা বলে, 'দৌড় দে'! তখন সে বলে, 'আমি দৌড় দিতে পারবো না, পায়ে ব্যথা'
তখন তারা বলে, তাহলে আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে সামনের চল।
তখন সে হাটা শুরু করে, তখন পিছন থেকে তাদের একজন তার কোমরে লাথি মারে, সে তখন উপুড় হয়ে পড়ে যায়!
আহ! কী ভয়াবহ বর্বরতা...!
.
৪- যাকারিয়া হোসাইন, জামিয়া কারিমিয়ার উলুমুল হাদীস বিভাগের ছাত্র। সে তাদের হামলার ভয়ে তুরাগ নদী সাতার কেটে পাড়ি দেয়। পাড়ি দেওয়ার পর সে প্রচন্ড ঠান্ডায় বেহুঁশ হয়ে যায়। সে বলে, জাগ্রত হওয়ার পর আমি দেখি, আমিসহ আমার মত আরো অনেকেই কলোনীর মত কুড়ে ঘরে আছি। পড়ে জানলাম এই দরিদ্র লোকেরা আমাদেরকে উদ্ধার করে সেবা যত্নের জন্যে এখানে নিয়ে আসে।
.
৫- আশিক বিল্লাহ ইউসুফ। জামিয়া কারিমিয়া নারায়ণগঞ্জের ইফতার বিভাগের ছাত্র। সেও ওইদিন টঙ্গীতে ছিল, এতায়েতিরা তাকে পেয়ে প্রথমে তার পাঞ্জাবী খুলে ফেলে, তার গেঞ্জি খুলে ফেলে, তার মোবাইলটা ছিনিয়ে নেয়। এরপর উপর্যুপরি আঘাত করে তার হাত ভেঙ্গে দেয়। এখন গলার তার হাত ঝুলানো।
.
এভাবে ছাত্রদের জবান শোনা যায়, যে, যখন এতায়েতিরা এসব ছাত্রদের নির্দয়ভাবে আঘাত করা শুরু করে, তখন তাদের এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে ওই ছাত্ররা তাদের পায়ে ধরে বলে, 'আমি তোমার ছেলের মতো, নাতির মতো, আমাকে মারিওনা'।
তবুও সামান্য পরিমাণ দরদ জন্মে নি ওই জালিম পাষাণদের অন্তরে। এরা নাকি আবার নবীওয়ালা কাজের মূলধারার ধারক-বাহক! লানাতুল্লাহি আলাজ জালিমীন!!!!
.
ছাত্ররা আরো বলে, 'বাবার বয়েসি, দাদার বয়েসি বৃদ্ধদের দেখে আমরা হামলা করি নি, কিন্তু এই জাহিল এতায়েতিরা আমাদেরকে ছেলের বয়েসি ও নাতির বয়েসি দেখেও আমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণ দয়া দেখায় নি'।
আহ... ফিতনাবাজ সাদ মানুষকে যে কত নিষ্ঠুরই বানাল।
.
এত গেলো, ওইসব আহতদের বিবরণ, যারা অনেকটা কথা বলতে পারেন, কিন্তু এখনো এরকম অনেক আহত ব্যক্তিরা আছেন যারা এখন পর্যন্ত ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তারা সুস্থ হলে শোনা যাবে সাদপন্থীদের পরিচালিত নির্মম হামলার লোমহর্ষক দাস্তান!
বাংলাদেশ জন্মের পরে এক সাথে এত উলামা-তলাবাকে চতুর্দিকে অবরুদ্ধ করে এভাবে হয়তো আর কোথাও হামলা করা হয় নি!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৩৩