somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়া দান করবেন

০১ লা মার্চ, ২০২১ সকাল ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন : সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তায়ালা (কিয়ামতের দিন) তার আরশের ছায়ায় স্থান দান করবেন। সেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না।
১. ন্যায় পরায়ন নেতা।
২. ঐ যুবক যে তার যৌবন কাল আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন।
৩. এমন (মুসলিম) ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লটকানো থাকে, একবার মসজিদ থেকে বের হলে পুনরায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ব্যাকুল থাকে।
৪. এমন দু’ব্যক্তি যারা কেবল আল্লাহর মহব্বতে পরস্পর মিলিত হয় এবং পৃথক হয়।
৫. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর ভয়ে অশ্রæফেলে।
৬. যে ব্যক্তিকে কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী রমনী ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আহবান জানায় আর ঐ ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়েই বিরত থাকে।
৭. যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে তার ডান হাত কি দান করলো বাম হাতও জানলো না। (বুখারী ও মুসলিম)
ভুমিকা ঃ
হাশরের ময়দানে সব মানুষের বিচার হবে। সবার জন্য শেষ ও চূড়ান্ত বিচার হবে সেখানে। সেদিন অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হবে যে, সূর্য মানুষের মাথার ওপরে আসবে। আর পায়ের নিচের মাটি হবে জ্বলন্ত তামার। গরমের তীব্রতায় মানুষের মাথার মগজ টগবগ করবে, যেমন চুলায় হাঁড়ির পানি টগবগ করে। এই কঠিন এবং ভয়াবহ অবস্থায় মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় সাত প্রকারের বান্দাকে নিজের আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মাঝে রহমতের শীতল চাদর বিছিয়ে দেবেন। দাউ দাউ করা দাবানলের গ্রাস থেকে প্রিয় বান্দাদের রক্ষা করবেন। সেই সৌভাগ্যবান সাত শ্রেণির ব্যক্তি সম্পর্কে হাদীসে বর্ণনা এসেছে। প্রতিটি মাখলুককেই কাল কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কিয়ামতের ময়দানের সেই কঠিন মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেন, কিয়ামতের দিন মানবমÐলীকে লাল শ্বেত মিশ্রিত এমন এক সমতল ভূমিতে একত্র করা হবে, যেন তা পরিচ্ছন্ন আটার রুটির মতো। ওই জমিনে কারো (বাড়িঘরের বা অন্য কিছুর) চিহ্ন থাকবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
রাবী’র পরিচয় ঃ
নাম : তার নাম সম্পর্কে ৩৫টি অভিমত পাওয়া যায়। বিশুদ্ধতম অভিমত হলো -ইসলাম গ্রহণের পূর্বে : নাম ছিল। ১. আবদুস শাসছ, ২. আবদু আমর, ৩. আবদুল ওযযা। ইসলাম গ্রহণ করার পর ঃ ৪. আব্দুল্লাহ ইবনে সাখর। ৫. আবদুর রহমান ইবনে সাখর, ৬. ওমায়েক ইবনে আমের। উপনাম ঃ আবু হুরায়রা। পিতার নাম ঃ সাখর। মাতার নাম ঃ উম্মিয়া বিনতে সাফীহ। অথবা মাইমুনা।
আবু হুরায়রা নামে প্রসিদ্ধির কারণ ঃ
আবু হুরায়রা শব্দের অর্থ বিড়াল ছানার পিতা। (আবু=পিতা; হুরায়রা=বিড়াল ছানা) একদা তিনি তার জামার আস্তিনের নিচে একটা বিড়াল ছানা নিয়ে রাসূল (সাঃ) এর দরবারে হাজির হন। হঠাৎ বিড়ালটি সকলের সামনে বেরিয়ে পড়ে। তখন রাসূল (সাঃ) রসিকতা করে বলে উঠলেন- “হে বিড়ালের পিতা” তখন থেকে তিনি নিজের জন্য এ নামটি পছন্দ করে নেন এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
ইসলাম গ্রহণ ঃ তিন ৭ম হিজরী মোতবেক ৬২৯ খৃস্টাব্দে খায়বার যুদ্ধের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল বিন আমর আদ-দাওসীর হাতে ইসলামে দীক্ষিত হন।
হাদীস বর্ণনা ঃ সর্বপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনাকারী। বর্ণিত হাদীস ৫,৩৭৪ টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম শরীফে ৪১৮টি।
মৃত্যু ঃ ৭৮ বছর বয়সে মদীনার অদূরে কাসবা নামক স্থানে।
ওলামাদের নিকট হাদীসটির মর্যদা ঃ
ইমাম যাহাবী (রহঃ) বলেন: আরশের ছায়া সম্পর্কিত এমন সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পোঁছে। (মুখতাসারুল উলু : ১০৫ পৃষ্ঠা)
আল্লামা ইবনু আবদিল বার (রহঃ) বলেন: আমলের ফযিলতের ক্ষেত্রে বর্ণিত হাদীস সমুহের মধ্যে এই হাদীসটি সর্বাপেক্ষা উত্তম, ব্যপক ও বিশুদ্ধ। মর্যাদার জন্য ইহাই যথেষ্ট। কেননা এ কথা সর্বজ্ঞাত যে, কিয়ামতের দিন যে ব্যক্তি আল্লাহর আরশের নিচে স্থান পাবে সে কিয়ামতের দিন ভয়াবহ উপবিষ্টতার স্বীকার হবেনা। (আত্তামহীদ,খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৮২ )
মূল আলোচ্য বিষয় ঃ
এখানে কিয়ামতের এক ভীষণ চিত্রের কথা তুলে মানুষের মনে প্রথমে ভীতি জাগানো হয়েছে। এরপর সেই ভীতি বা শাস্তি থেকে যে শ্রেণীর লোক রক্ষা পাবে তার বর্ণনা দিয়ে মূলত মানুষকে সেইসব গুনে গুনান্বিত হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছে।
১. প্রথম ব্যক্তি: ন্যায় পরায়ন নেতা বা শাসক ঃ
কিয়ামতের কঠিন মূহুর্তে আল্লাহ আরশের নীচে ছায়াপ্রাপ্ত সাত ব্যক্তির প্রথম ব্যক্তি হলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক। মুসলিম সমাজকে বিভিন্নভাবে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হতে পারে। কিন্তু অত্র হাদীসে এককভাবে (ইমামে আদেল) ন্যায়পরায়ণ শাসক উল্লেখের কিছু কারণ রয়েছে: তা হলো-
(১) তার ন্যায় প্রতিষ্ঠার সুফল সকল মানুষকে শামিল করে।
(২) তিনি সমাজ থেকে অত্যাচার বিতাড়িত করেন।
(৩) তিনি তাঁর ন্যয়পরায়ণতার মাধ্যমে সমাজে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেন।
মূলত এখানে নেতা বলতে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বোঝানে হয়েছে। তা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা কোন দলের নেতা যাই হোক না কেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন-“সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী ও মুসলিম) নেতৃত্বের ব্যাপারে ন্যায় ও ইনসাফ হলো বড় বিষয়।
ইনসাফ ভিত্তিক নেতৃত্ব না হলে তা অধিনস্তদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের প্রতি অনীহা সৃষ্টির ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিশৃংখলা দেখা দেয়। রাসূল (সাঃ) বলেন “যে ব্যক্তি মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার পর তাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তারা এমন লোক যাদেরকে আমি যমিনে ক্ষমতা দান করলে নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে বাধা দেবে। আর সব বিষয়ের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে।” (হজ্জ : ৪১)
আল্লাহ আরো বলেন “আমি তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছিলাম তারা আমার বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে পথ প্রদর্শন করে। আমি ওহীর মাধ্যমে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করা আদেশ করেছি, তারা খাটিভাবে আমার ইবাদত করত।” (আম্বিয়া : ৭৩)
উল্লেখিত সূরাদ্বয়ে বিচারে ন্যায় পরায়ন নেতার বা রাষ্ট্র প্রধানের ৪ দফা কাজ হলো-
১. নামাজ কায়েম করা, ২. যাকাত আদায় করা, ৩. সৎ কাজের আদেশ করা, ৪. অসৎ কাজে নিষেধ/বাধা দেয়া।
অন্যায়ের অশুভ পরিণিতি: হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন : যে ব্যক্তি অন্তত দশজনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে কিয়ামতের দিবসে সে শিকলের বেড়ীতে আবদ্ধ অবস্থায় উপবিষ্ট হবে। যদি ন্যায়পরায়ণ হয় তাহলে বেড়ী থেকে মুক্তি পাবে, আর অন্যায়কারী হলে এই বেড়ীই তাকে ধ্বংস করবে। (বায়হাকী, হাসান)

২. দ্বিতীয় ব্যক্তি: ঐ যুবক যে তার যৌবন কাল আল্লাহর ইবাদাতে কাটিয়েছে ঃ
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন : “নিশ্চয় তোমার রব এমন যুবকের ব্যাপারে আর্শ্চযান্বিত হন (তাকে সওয়াব দান করেন অধিকতর), যার প্রবৃত্তির প্রতি ঝোঁক নেই।” অর্থাৎ: যে যুবক প্রবৃত্তির তাড়নায় অন্যায় কাজে লিপ্ত হয় না। যৌবন কালে আমলের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন: কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়া ব্যতীরেকে কোন বনী আদম এক কদমও পা সরাতে পারবে না। (সে পাঁচটি বিষয় হলো) তার জীবন সে কোথায় অতিবাহিত করেছে, তার যৌবন কোথায় সে কাটিয়েছে, তার সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে। আর তার জ্ঞান অনুযায়ী কতটুকু সে আমল করেছে। (তিরমিযী)
ইসলামের সূচনালগ্নে যুবকের অবদান :
যে মুমিন কাফেলাটি দারুল আরকামে অবস্থান করেছে, যাদের হাতে দ্বীন বিজয়ী হয়েছে এবং দ্বীনের পতাকা উড্ডীন হয়েছে সে কাফেলার সবাই ছিল যুবক। দ্বীনের পথে প্রথম আহবানকারী বিশ্ব শ্রেষ্ঠ মানব রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বয়স ছিল চল্লিশ বছর। আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর বয়স সাইত্রিশ বছর। ওমর ফারুক (রাঃ) এর বয়স ছাবিবশ বছর, আলীর (রাঃ) বয়স ছিল আঠার বছর। হযরত উসমানের (রাঃ) বয়স ছিল বিশ বছর, স’াদ বিন আবি ওয়াক্কাসের (রাঃ) বয়স ছিল সতের বছর, সুহাইব আর রুমীর বয়স উনিশ বছর, যায়িদ বিন হারিসার বয়স বিশ বছর, আবু উবায়দা ইবনুল র্জারাহ এর বয়স সাতাইশ, আবদুর রহমান ইবনে আউফের বয়স বিশ বছর, বিলাল ইবনে রাবাহের বয়স ত্রিশ বছর, আরকাম ইবনে আবিল আরাকামের বয়স ছিল এগার বছর। তার বাড়ীতেই ইসলামের সর্বপ্রথম বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
যুবকের আদর্শ :
১. আল্লাহর এক প্রিয় যুবক আলী (রাঃ)। তার জন্য জান্নাত ছিল আকুল। রাসূল (সাঃ) বলেন: নিশ্চয়ই জান্নাত তিন ব্যক্তির জন্য আকুল, তারা হলেন আলী, আম্মার এবং সালমান (রাঃ)। (তিরমিযী) আলী তো সেই যুবক নামাজ অবস্থায় যার তীর খুলে ফেলল অথচ তিনি টের ফেলেন না।
২. আরেক যুবক ছিল ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রাঃ), একুশ বছর বয়সে তিনি হাদীসের পাঠ দান করার জন্য বসতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে শরীয়তের সমাধান তথা ফতোয়া প্রদান করতেন।
৩. ইমাম শাফেয়ী (রঃ) পনের বছর বয়সে তাঁর উস্তাদ মুসলিম ইবনে খালিদ আয্ যানজীর অনুমতিক্রমে পাঠদান করতেন এবং ফতোয়া দিতেন।
৪. ইমাম বুখারী নিজেই বলেন : ষোল বছর বয়সে আমি ইবনুল মোবারক ও ওয়াকী এর সকল কিতাব মুখস্থ করি। আঠার বছর বয়সে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীদের বিভিন্ন বিষয়ে রচনা করি।
আল্লাহর প্রিয় যুবকদের থেকে আমরা কোথায় :
আমরা কোথায় আজ সে সকল যুবকদের থেকে? আমরা কি বয়সে ও শারিরিক অবয়বে তাদের মত নই? হ্যাঁ, অবশ্যই তাদের মত। কিন্তু জ্ঞানে ও গুণে কি তাদের মত হতে পেরেছি? তাহলে কোথায় ব্যয় করছি আমাদের মহামূল্যবান এই যৌবন? আল্লাহর ইবাদাতে কি ব্যয় করতে পেরেছি? আমার যৌবন থেকে কি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সন্তুষ্ট? যদি এমন না হয়, তাহলে আজই সেই মহান প্রভূর দিকে ফিরে যাই।

৩. তৃতীয় ব্যক্তি : এমন মুসল্লী যার হৃদয় সদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত ঃ
অন্তকরণ মসজিদের সাথে ঝুলানো থাকে এর অর্থ আল্লাহর সাথে সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারে তার ব্যাকুলতা বুঝানো হয়েছে। বিশেষ করে দৈনিক পাচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে পড়ার জন্য ব্যাকুলতা। এক ওয়াক্ত নামাজের পর অন্য ওয়াক্তের সময় আসার পূর্ব পযর্ন্ত মন যেন মসজিদের ফেরার জন্য উতলা হয়ে থাকে। রাসূর (সাঃ) বলেছেনে, নামায মূমিনদের জন্য মেরাজ স্বরুপ। আমরা জানি একাকী নামাজ পড়ার চেয়ে জামায়াতে নামাজ আদায় করলে ২৭গুন বেশি নেকি হাসিল হয়।
মসজিদে জামায়াতে নামায পড়ার গুরুত্ব :
হযরত আবুদ্ দারদা (রাঃ) তার ছেলেকে লক্ষ্য করে বলেন: হে প্রিয় বৎস মসজিদই হবে তোমার ঘর। নিশ্চয় আমি রাসূলকে (সাঃ) বলতে শুনেছি, নিশ্চয় মসজিদ সমূহ হচ্ছে মুত্তাকীদের (আল্লাহভীরূদের) ঘর স্বরুপ। আর মসজিদ যার ঘর হবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য প্রশান্তি, করুণা ও পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। (জুহুদ,হান্নাদ বিন আস্ সারি )
মসজিদের সাথে অন্তরের সম্পৃক্ততার আলামত:
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে পড়তে অধিক আগ্রহী হওয়া।
২. ফজরের পর সালাতুদ্ দোহা পর্যন্ত নিজস্ব নামাজের স্থানে বসে অপেক্ষা করা।
৩. প্রথম তাকবীর (তাকবীরে উলা) এর সাথে জামাতে অংশ গ্রহণ কর।
৪. মসজিদে প্রবেশ করা মাত্র সালাতুত তাহিয়্যাহ পড়া। (মসজিদে প্রবেশ করলেই দু’রাকাত নামাজ পড়া সুন্নাত, এ নামাজকেই সালাতুত্ তাহিয়্যাহ বলা হয়)
৫. বিপদ সংকুল অবস্থাতেও মসজিদে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা।
৬. নামাজের সময়ের আগেই মসজিদে গিয়ে অপেক্ষা করা।
৭. এক নামাজের পর অপর নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।
৮. প্রথম সারিতে এবং ইমামের ডান পার্শ্বে দাড়ানো।
৯. বিশেষ কাজে ফজরের পর মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলে পুনরায় সালাতুদ্ দোহা আদায়ের জন্য মসজিদে যাওয়া।
উপরোক্ত গুণাবলীর প্রতি উৎসাহকল্পে হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আবু উমামা হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় ফরজ নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে (মসজিদের পানে) বের হল, তার প্রতিদান ইহরাম পরিধানকারী হজ্জ আদায় কারীর মত, যে ব্যক্তি একমাত্র সালাতুত দোহা (মুমিনের আমল ও মৃত্যুর পর তার রুহকে আরশের উপরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয়,তাই ইল্লিয়ীন) আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হল, অন্য কোন কারণে নয়, তার প্রতিদান ওমরা পালনকারীর মত। আর দু’নামাজের মধ্যখানে যদি কোন অনর্থক কথা বা কাজ না করা হয় তাহলে এর প্রতিদান ইল্লিয়ীনে লিপিবদ্ধ করা হবে। (আবু দাউদ)
যাদের হৃদয় মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত তাঁরা কেমন:
১. সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রাঃ) বলেন : চল্লিশ বছর যাবত আমি জামাত বর্জন করিনি।
২. ওয়াকী বিন র্জারাহ বলেন : আ’মাশ প্রায় সত্তর বছর যাবত তাকবীরে উলা বর্জন করেননি।
৩. নাফে বলেন : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর যদি কখনও জামাতে এশার নামাজ পড়তে না পারতেন তাহলে বাকী পুরো রাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করতেন। (হিলইয়াতুল আউলিয়া, খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩০৩)
মসজিদ থেকে আমরা কোথায় : যুগ যুগ ধরে যারা সফল হয়েছেন তাঁদের জীবনই ছিল এমন। আমরাও তাঁদের উত্তরসূরী হয়ে তেমন সফল হতে চাই। কিন্তু তাঁদের মত কি আমাদের জীবনকে কাটাতে পেরেছি? পাচ ওয়াক্ত নামাজ কি জামায়াতে আদায় করতে পেরেছি? মনটাকে কি মসজিদের সাথে ঝুলাতে পেরেছি? যদি ঝুলিয়েছি মনে করি তাহলে তার প্রমাণ কি আমাদের বর্তমান অবস্থা? না! আর দেরী না করে আরশের ছায়া লাভের আশায় এখনি মসজিদের পানে ছুটে যাই!

৪. চতুর্থ ব্যক্তি : আল্লাহর জন্য পরস্পর মিলিত হওয়া ও পৃথক হওয়া ঃ
মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্যই হওয়া উচিত। কোন কিছুকে ভালবাসলে তা আল্লাহর জন্য এবং পরিত্যাগ করলে তাও আল্লাহর জন্য হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “বলুন আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মরন সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য। (আন আম : ১৩২)
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, আবু উমামা (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে ব্যক্তির কাউকে ভালবাসা, ঘৃণা করা, দান করা ও দান না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার। (বুখারী) ঐ দু’ব্যক্তি যারা একে অপরকে ভালবাসে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে এবং পরস্পরে মিলিত হয় তাঁরই নিমিত্তে। ভ্রাতৃত্বের এই ভালবাসা মহান আল্লাহর অপর নিয়ামত। ইরশাদ হচ্ছে : “আল্লাহ তা’য়ালা মুমিনদের অন্তর পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। হে নবী! তুমি সারা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও এদের অন্তর জোড়া দিতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তুর জুড়ে দিয়েছেন। অবশ্যই তিনি বড়ই পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী।” (আনফাল : ৬৩)
ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার মর্যাদা:
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, উবাদাহ বিন সামিত থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন : “আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমার সন্তুষ্টির নিমিত্তে যারা পরস্পরে ভালবাসবে (কিয়ামতের দিন) তারা নুরের আলোকিত উঁচু মঞ্চে অবস্থান করবে। তাদের এই মর্যাদা দেখে নবী, সাহাবা, ও শহীদগণ (গিবতাহ) ঈর্ষা করবে।” (হাকেম)
ভালবাসার সংবাদ দেয়া :
হযরত আবু জর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন : যখন তোমাদের কেউ তার কোন সাথীকে ভালবাসে সে যেন তার বাড়ীতে গিয়ে জানিয়ে দেয় যে, সে তাকে ভালবাসে। (আহমদ)
আল্লাহর জন্য যারা ভালবাসেন তারা কেমন :
১. ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেন : আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে এক হাজার ভাইকে ভালবেসেছি। তাদের সবার নাম, পিতার নাম, গোত্রের নাম, বাড়ীর ঠিকানা আমি জানি।
২. মুজাহিদ বলেন : আবদুল্লাহ বিন আব্বাসের পাশ দিয়ে এক ব্যক্তি অতিক্রম করছিল। তখন তিনি বললেন, এই লোকটি আমাকে ভালবাসে। তাঁকে বলা হল, আপনি কিভাবে জানেন যে, সে আপনাকে ভালবাসে? জবাবে ইবনে আব্বাস বললেন (এর প্রমাণ হল) আমি তাকে ভালবাসি।

৫.পঞ্চম ব্যক্তি: এমন ব্যক্তি যে আল্লাহকে স্মরণ করে, নীরবে নিভৃতে অশ্রæ ঝরায় ঃ
নির্জনে আল্লাহর ভয়ে দু’কারণে অশ্রæবিসর্জন-
ক. আল্লাহর আজমত-জালালাত বা শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের জন্য।
খ. নিজের অপরাধ স্মরণ করে মুক্তিলাভের জন্য।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন : “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে অশ্রæপাত করেছে তার জাহান্নামে প্রবেশ করা তেমনি অসম্ভব যেমনি অসম্ভব দোহন করা দুধকে পুনরায় ওলানে প্রবেশ করোনো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার পথে জিহাদ করেছে সে ব্যক্তি আর জাহান্নামের ধোয়া একত্র হবে না।” (তিরমিযী)
রাসূল (সাঃ) বলেন : “দু’ধরনের চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।
১. ঐ চোখ যা আল্লাহর ভয়ে অশ্রæ বিসর্জন দেয়।
২. ঐ চোখ যা আল্লাহর পথে পাহারাদারীতে রাত জাগে।” (বুখারী)
যিকির আল্লাহর ভালবাসার এক সুদৃঢ় বন্ধন। যে তার রবকে স্মরণ করার নিয়ামত লাভ করে, তার সাথে রবের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর যে তাকে স্মরণ করে না, সে তার ভালবাসার পরশ থেকে বহুদূরে। মুমিনের হৃদয়ের খোরাক হচ্ছে এই যিকির। যিকির তথা আল্লাহ তা’য়ালার স্মরণের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন: “ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করো এবং সকাল সন্ধ্যায় তাঁর মহিমা ঘোষণা করতে থাকো। (আহযাব : ৪১, ৪২)
ইবনে আব্বাস বলেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের উপর নির্দিষ্ট সীমায় সকল ফরজ ইবাদাত আপতিত করেছেন, এবং অক্ষমতার (ওযরের) অবস্থাতে (ওযরকে) অক্ষমতাকে গ্রহণ করেছেন, শুধুমাত্র যিকির ব্যতীত। আল্লাহ তা’য়ালা এর জন্য কোন সীমা নির্ধারণ করেননি এবং আকল বিকৃত অবস্থা ব্যতীত অন্য কোন অবস্থাতে অক্ষমতাকে গ্রহণ করেননি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “তারপর তোমরা নামাজ শেষ করার পর দাড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আর মানসিক প্রশান্তি লাভ করার পর পুরো নামাজ পড়ে নাও। আসলে নামাজ নির্ধারিত সময়ে পড়ার জন্য মুমিনের উপর ফরজ করা হয়েছে।” (নিসা : ১০৩)
দিনে ও রাত্রিতে, জলে ও স্থলে, সফরে ও সাভাবিক অবস্থানে, প্রাচুর্যে ও অভাবে, সুস্থতায় ও অসুস্থতায়, গোপনে ও প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় যিকির করতে বলা হয়েছে। যখন তোমরা তা করবে তিনি তোমাদের উপর রহমতের বারি বর্ষণ করবেন এবং তাঁর ফিরিশতারা তোমাদের জন্য তাঁর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে। (তাফসীরে তাবারী: খন্ড: ২২, পৃষ্ঠা: ১৩)
মুয়াজ ইবনে যাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন : আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম আমল হচ্ছে, তাঁর স্মরণে (যিকির করতে করতে) জিহŸা সিক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। (ইবনে হিব্বান, তাবরানী ফিল কাবীর, বায়হাকী ফি শুয়াবিল ঈমান (হাসান)
হযরত ইয়াসিরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন : তোমাদের উপর তাসবীহ, তাহলীল, তাকদীস তথা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা কর্তব্য। আর তোমরা যিকিরের সময় আগুলের গিরা গুণে যিকির কর; কেননা (কিয়ামতের দিন) আগুল গুলোকে প্রশ্ন করা হবে এবং কথা বলতে বলা হবে। তোমরা আল্লাহর যিকির হতে গাফেল হয়ো না। তাহলে আল্লাহর রহমত তোমাদেরকে ভূলে যাবে। (তিরমিযী, হাকেম)
যিকিরের ব্যাপকতা :
যিকির সকল ইবাদাত হতে অধিকতর ব্যাপক। মহান আল্লাহর যিকির শুধু মৌখিক যিকিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং ইবাদাত ও আদত তথা দৈনন্দিন কাজ-কর্ম ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় ও সর্বদা যিকির করা মুমিনের কর্তব্য। সকল প্রকার ইবাদতেই যিকির রয়েছে। কোন একটি ইবাদতও যিকির থেকে খালি নয়।
প্রাত্যাহিক কাজ-কমে (আদতে) যিকির : একজন মুমিনের সকল কাজই মূলত আল্লাহর নামেই শুরু করতে হয়। তবেই তাতে বরকত আসে। পাশাপাশি প্রতিটি কাজেই আল্লাহকে স্মরণ করা উচিত এভাবে যে, কাজটি আল্লাহ তা’য়ালা হালাল করেছেন না হারাম, আর সকল কাজে এই অনুভূতি জাগ্রত করাই প্রকৃত যিকির। অন্যথায় শুধুমাত্র মৌখিক যিকির বান্দার কোন উপকারেই আসবে না। (সংক্ষিপ্তভাবে, তারতীবুল আফওয়াহ, খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৮৬-৮৯)
সাঈদ ইবনে যুবাইর (রাঃ) বলেন, যিকির হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। সুতরাং যে আল্লাহর (আদেশ নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে) আনুগত্য করল, সে আল্লাহকে স্মরণ করল। আর যে তাঁর আনুগত্য করল না, সে যিকিরকারী নয়; যদিও অধিক তাসবীহ পাঠ এবং কুরআন তিলাওয়াত করে।
যিকিরের প্রকারভেদ :
ইমাম নববী (রঃ) বলেন: জেনে রাখ! নিশ্চয় যিকিরের ফযিলত তাসবীহ,তাহলীল, তাহমীদ, তাকবীর, ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহর অনুগত প্রত্যেক ব্যক্তিই তাদের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর যিকির করে। (অর্থাৎ: তার আনুগত্যই আল্লাহর যিকির)।
যিকিরের প্রকারসমুহ :
১. আল কুরআন তিলাওয়াত, শিক্ষা দান, এর গবেষণা ও বাস্তবায়ন করা।
২. আল্লাহ তায়ালার নাম ও সিফাত (গুণবাচক নাম) সমূহ উল্লেখ করা।
৩. তাঁর প্রশংসা করা।
৪. আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।
৫. তাঁর আদেশ-নিষেধ আলোচনা করা ও শিক্ষা দেয়া।
৬. তার নিয়ামত রাজির স্মরণ করা।
৭. তার নিকট দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।
৮. এ কথা স্মরণ রাখা যে, আল্লাহ তায়ালা সর্বদা সাথে আছেন।

৬. ৬ষ্ঠ ব্যক্তি : কঠিন পরিস্থিতিতে চরিত্রের হেফাজত ঃ
যৌবনকালে নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের সান্নিধ্য চায়। সৃষ্টিগতভাবে এটা একটা স্বাভাবিক তাড়না। এ সময় কোন সম্ভ্রান্তÍ ঘরের সুন্দরী কোন রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত হবার প্রস্তাব করলে শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়েই তা থেকে বিরত থাকা যায়। এভাবে চরিত্রের হেফাজত করলে তবেই আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করা যাবে। আল্লাহ বলেন,“আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়োনা। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।” (ইসরাঈল : ৩২) আল্লাহ আরো বলেন, “লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে তার নিকটেও যেওনা, তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।” (আনআম : ১৫২) বিবাহের মাধ্যমে বৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটানো ইসলামের নির্দেশ। আল্লাহ আরো বলেন, এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (মুমিনুন-৫-৬)যে অশ্লীল কাজের আহবান প্রত্যাখান করে আল্লাহর ভয়ে : এমন লোক যাকে সম্ভ্রান্ত এক সুন্দরী নারী (অশ্নীলতার দিকে) আহবান জানালে জবাবে “আল্লাহকে ভয় করি” বলে বিরত থাকে।
অশ্নীলতা থেকে মুক্তির উপায় : আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম অশ্নীলতা ও অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে অনেকগুলো উপায় উল্লেখ করেন, (দেখুন : রাওদাতুল মুহিব্বীন: পৃষ্ঠা: ২৮২)

তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপায়গুলো হলো:
১.অপরাধ ত্যাগে দৃঢ় সংকল্প করা।
২.অপরাধ ত্যাগের তিক্ত মূহুর্তে ধৈর্য ধারণ করা।
৩.আল্লাহ ও মানুষের নিকট তার মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করা।
৪.পরিশুদ্ধতার স্বাদকে অপরাধে জড়ানোর স্বাদের উপর প্রাধান্য দেয়া।
৫.কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের অশুভ পরিণিতি ভেবে দেখা।
৬.অপরাধের পর কি অর্জন ও কি হারানো তা পূর্বেই ভেবে দেখা।
৭.অপরাধের ব্যাপারে নিজের দ্বীন ও বিবেককে প্রশ্ন করা।
৮.পরকালীন জাহান্নামকে ভয় করা।
৯. প্রবৃত্তির অনুসরণ আল্লাহর তাওফীককে বাধা দেয় এবং লাঞ্চনার দ্বার উম্মুক্ত করে, তা অনুধাবন করা।
১০. প্রবৃত্তির অনুসরণে আকল নষ্ট হয়ে যায় তা ভালভাবে অনুধাবন করা।
আরশের ছায়া যারা পাবেন তারা কেমন : সম্ভ্রান্ত ও সুন্দরী নারীর আহবান যারা প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে স্থান করে নিয়েছে তাদের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত আবু বকর আল মিসকী (রঃ)। তাকে তার সাথীবর্গ বলল: আমরা সর্বদা তোমার থেকে মিসকের ঘ্রাণ পাই। এর কারণ কি? অতপর তিনি বললেন: আল্লাহর শপথ! অনেক বছর যাবত মিস্ক ব্যবহার করি না। তবে এই সুঘ্রাণের কারণ হলো: একদা একটি নারী ফন্দি করে আমাকে তার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আর আমাকে প্রলোভন দিতে শুর করল। আমি বিষন্ন হয়ে উঠলাম, আমি কোন উপায় খুজে পাচ্ছি না। এরপর তাকে বললাম: আমার পবিত্রতা অর্জন করা প্রয়োজন। অতপর সে তার এক সেবিকাকে বলল আমাকে নিয়ে বাথরুমে যেতে। বালিকাটি আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। আমি বাথরুমে প্রবেশ করে সেখানকার ময়লা কর্দমা নিয়ে আমার সমস্ত শরীরে মেখে নিলাম। আর এই অবস্থায় আমি তার নিকট ফিরে আসি, সে আমাকে দেখে হতভম্ব হয়ে সাথে সাথে আমাকে বের করে দিতে নির্দেশ দিল। এভাবে আমি অশ্নীলতা থেকে মুক্তি পেয়ে যাই, অতপর গোসল সেরে পবিত্র হই। ঐ রাত্রিতে আমি স্বপ্ন দেখতে পেলাম: আমাকে কে যেন বলছে: তুমি এমন কাজ করেছ যা তুমি ব্যতীত কেউ করে নাই। অবশ্যই আমি তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সুগন্ধি দান করব। এরপর সকালে উঠে দেখি আমার দেহ থেকে মিসকের সুঘ্রাণ বের হচ্ছে। আর সেই সুঘ্রাণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। (আল মাওয়ায়েয ওয়াল মাযালেস- ইবনুল জাওযী, পৃষ্ঠা: ২২৪)

৭. সপ্তম ব্যক্তি: গোপনে দান করা ঃ
দান করতে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ সূরা মুনাফিকুনের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- “আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করো মৃত্যু আসার আগেই।” সূরা আল ইমরানের ৯২ নং আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন “তোমরা কিছুতেই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষন না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলিকে আল্লাহর পথে ব্যয় করবে।” (ইমরান ; ৯২)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হবে দান করার মূল লক্ষ্য। মনে অহংকার আসতে পারে এ ধরনের ভীতির কারণই হলো দানের এ পদ্ধতি উল্ল্যেখ করার কারণ।” রাসূর (সাঃ) “আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেননা বরং তোমাদের অন্তকরণ ও কাজের দিকে লক্ষ্য করেন।” (তিরমিজি)
যে ব্যক্তি সংগোপনে আল্লাহর পথে ব্যয় করে : ঐ ব্যক্তি যে অতি সংগোপনে আল্লাহর পথে ব্যয় করে,তার বাম হাতও টের পায় না ডান হাত যা ব্যয় করেছে। ইবনে হাযার আল আসকালানী (রঃ) বলেন: এর দ্বারা অতি গোপনে আল্লাহর পথে ব্যয় করাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। (ফি যিলালি আরশির রাহমান : পৃষ্ঠা: ১৭৬)
সদকার ব্যাপকতা :
শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের মধ্যে সদকা ও এর প্রতিদান সীমাবদ্ধ নয়; বরং একজন মুমিনের প্রতিটি কাজই সদকার সমতুল্য, যদি এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ কামনা করে। এমনিভাবে একজন মুমিনের সুন্দর একটি কথা, মুখের মুচকি হাসি, পরোপকার সবগুলোই সদকার অর্ন্তভূক্ত। হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন : প্রত্যেকটি ভাল কাজই সদকা। (মুসলিম, আহমদ, আবু দাউদ) হযরত আবু যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন : প্রতিদিনি সকালে তোমাদের শরীরের প্রত্যেক জোড়ার উপর সদকা আপতিত হয়। (আর আদায়ের পন্থা হলো) প্রতিটি তাসবীহ সদকা সমতুল্য, প্রতিটি হামদ, প্রতিটি তাহলীল, প্রতিটি তাকবীর সদকা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণ সদকা সমতুল্য। আর এই সবগুলোর জন্য যথেষ্ট হবে দু’রাকআত সালাতুত দোহা। (মুসলিম,আহমদ), (সুর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য মধ্যাকাশে আসার পূর্ব সময়ে দু’রাকআত কিংবা চার রাকআত নামাজ পড়া সুন্নাত। ইহাই সালাতুদ্ দোহা।
ভাগ্যবান এই সাত ব্যক্তি থেকে আমরা কোথায় : উক্ত হাদীসে উল্লেখিত সাত শ্রেণীর ব্যক্তি তাদের উল্লেখিত আমলের মাধ্যমে কিয়ামতের কঠিন মূহুর্তে মহান আল্লাহ তায়ালার আরশের ছায়ায় স্থান লাভের মাধ্যমে সে দিনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবেন, পরিশেষে জান্নাত লাভে হবেন ধন্য। কি মহৎ ছিল তাদের আমল! যারা পৃথিবীতে ক্ষমতা লাভের পর দাম্ভিকতা প্রদর্শন না করে প্রতিষ্ঠা করেছেন ন্যায়ের শাসন। যৌবনের উম্মাদনাকে পদ্দলিত করে যৌবনকে অতিক্রম করেছেন আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামীর মাধ্যমে, যাদের হৃদয় দুনিয়ার ব্যস্ততাকে এড়িয়ে ছুটে যেত মসজিদের পানে। যারা একে অপরকে ভালবাসতেন দুনিয়ার কোন স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়; বরং শুধুমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তেই। যাদেরকে সভ্রান্ত বংশের সুন্দরী নারী অশ্নীলতার দিকে আহবান জানালেও তাকে প্রত্যাখ্যান করে মহান রবের ভয়কে প্রাধান্য দেয়। যারা তাঁরই নিমিত্তে অতি সংগোপনে তার পথে দান করে। যারা তাকে অতি প্রেম ভরে স্মরণ করে এবং নিরবে নিভৃতে অশ্রæ ঝরায় দু’নয়নে। অথচ আমরা আজ কোথায়? আমরা কি তাদের মত হতে পেরেছি? আরশের ছায়াতলে কি আমার স্থান মিলবে? কোন সে আমল আমি তার জন্য করেছি? উক্ত সাতটি আমলের কোন একটিও কি আমি পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করতে পেরেছি? আমি কি এখনও অপরাধের সময় আমার রবকে স্মরণ করে পরিত্যাগ করি। যদি তাই না হয় তাহলে এখনি তওবা করে নেই। বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার দিকে সকল প্রকার অপরাধ বর্জন করে ফিরে যাই। তাহলে তাঁর আরশের ছায়ায় আশা করা স্বার্থক হবে।
শিক্ষা ঃ-
১. সর্ব পর্যায়ে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কোরআনে বর্ণিত নেতার কাজ প্রতিষ্ঠার যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের হাতে নেতৃত্ব দিতে হবে।
২. যৌবনের সকল চেষ্টা সামর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করতে হবে।
৩. সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায কায়েম করতে হবে ও নামাযের পূর্ণ পাবন্দী করতে হবে।
৪. সমস্ত তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
যাবতীয় চেষ্টার পর জ্ঞাত বা অজ্ঞাত দোষক্রটির জন্য ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মহাপ্রলয় সৃষ্টিকারী কিয়ামত দিবসে নিরাপত্তা পেতে হলে উপরোক্ত সাতটি গুণে গুণান্বিত হওয়ার বিকল্প নেই। বিশেষত: সাতটির যে কোন একটিও যদি উল্লেখযোগ্যভাবে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে আশা করা যায়, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরশের ছায়াতলে নিরাপদে অবস্থান করা সম্ভব হবে। বস্তুত: এই সাতটি গুণের প্রতিটি গুণই ছিল উল্লেখিত সাত ব্যক্তির বিশেষ আমল, যার ওয়াসিলায় আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাতবাসী করবেন। সুতরাং প্রতিটি মুমিনের সকল সৎ আমলের পাশাপাশি একটি বিশেষ আমল থাকা অবশ্যই জরুরী, যা হবে একশতভাগ ইখলাস সহকারে। আর সেই গুণ যদি হয় উপরোক্ত গুণাবলীর একটি তবেই কিয়ামতের ভয়াল চিত্রের সম্মুখীন হতে হবে না; বরং আল্লাহ তায়ালা তাঁর আরশের নীচে ছায়া দানের মাধ্যমে সকল প্রকার ভয় থেকে নিরাপত্তা দান করবেন এবং পরিশেষে জান্নাত দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সেই সাতশ্রেণীর অর্ন্তুভুক্ত করুন। আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২১ সকাল ৯:৩১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×