somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাইলাতুল ক্বদরের ফযিলত ও আমল সমূহ

০৩ রা মে, ২০২১ বিকাল ৩:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লাইলাতুল ক্বদরঃ
পবিত্র রামাদানে নাজাতের দশদিন গণনা শুরু হচ্ছে। আর সে সাথে লাইলাতুল ক্বদর গণনাও শুরু হয়ে যায়। যে রাতে পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছে, সে রাতই লাইলাতুল ক্বদর। ‘শবে ক্বদর’ কথাটি ফারসি শব্দ। আরবিতে লাইলাতুল ক্বদর। ‘লাইলাতুন’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘ক্বদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হলো-ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাযিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ ক্বদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় ক্বদর রজনী কী? মহিমান্বিত ক্বদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সে রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত। (ক্বদরঃ ১-৫) ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দি নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি ‘শবে ক্বদর’ নামেই সমধিক পরিচিত।
শবে ক্বদর কোন রাত?
আল-কোরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল ক্বদর কোন রাত। তবে কোরআনের ভাষ্য হলো লাইলাতুল ক্বদর রামাদান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রামাদান মাসে লাইলাতুল ক্বদর অব্যাহত থাকবে এবং বুখারী ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত হাদীসের আলোকে বলা যায়, শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে শবে ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রামাদান মাস পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস। শবে ক্বদর কোরআন নাজিলের রাত। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার হেরা পর্বতের গুহায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের সরদার হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ হয়।
১. আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘রামাদান মাস! যে মাসে কোরআন নাযিল হয়েছে। (বাকারাঃ ১৮৫)।
২. আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে। (দুখানঃ ৩)
৩. আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাযিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ ক্বদর রজনীতে। (ক্বদরঃ ১)
শবে ক্বদর রামাদানের মধ্যেই। রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেনঃ ‘তোমরা রামাদানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে ক্বদরকে সন্ধান করো। (বুখারী ও মুসলিম)। এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিজি কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে- হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, ‘ক্বদরের রাতকে রামাদানের শেষ দশ রাতের কোন বেজোড় রাতে খোঁজ করো।’ হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত আবব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকেও এই একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো ইসলামী মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যামে রামাদানের ২৭ তারিখের রাতে (অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে) শবে ক্বদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি; বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন।
অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হলো রামাদান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হল পঁচিশ তারিখ। তৃতীয় হল ঊনত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হল একুশ তারিখ। পঞ্চম হল তেইশ তারিখ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফযিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে। কাজেই শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদতে মশগুল হতে হবে। প্রতিটি রাতকেই লাইলাতুল ক্বদর মনে করতে হবে। তা হলে লাইলাতুল ক্বদর আল্লাহর মেহেরবানিতে হাতছাড়া হবে না ইনশাআল্লাহ। হাদীসের আলোকে আরও জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন এর তারিখ ভুলিয়ে দেওয়া হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, সম্ভবত এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে। অর্থাৎ যদি এ রাত নির্দিষ্ট করে দেওয়া হতো, তবে অনেক অলস প্রকৃতির মানুষ শুধু এ রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত হতো। অবশিষ্ট সারা বছর ইবাদত–বন্দেগি না করে আল্লাহ তা’আলার রহমত হতে বঞ্চিত থাকত। দ্বিতীয়ত, এ রাত নির্দিষ্ট করা হলে কোনো ব্যক্তি ঘটনাক্রমে রাতটিতে ইবাদত করতে না পারলে সে দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশ করতে করতে অনেক সময় নষ্ট করে দিত। এতে সে মাহে রামাদানের বরকত থেকে বঞ্চিত হয়ে যেত। এ রাত যেহেতু নির্দিষ্ট করা হয়নি, সে জন্য এ রাতের সন্ধানে আল্লাহর সব বান্দা প্রতি রাতে ইবাদত–বন্দেগি করে থাকেন এবং প্রত্যেক রাতের জন্য পৃথক পৃথক পুণ্য অর্জন করতে থাকেন।
শবে ক্বদরের গুরুত্ব ও ফযিলত
পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘শবে বরাত’ ও শবে বরাতের হাদীসগুলোর বর্ণনা নিয়ে হাদীস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহদের মধ্যে যে সংশয় রয়েছে। লাইলাতুল ক্বদরের ব্যাপারে তার কোনোই অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন, নির্ভরযোগ্য হাদীস ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর লাইলাতুল ক্বদরের জন্য গৃহীত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে-
১. আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘ রামাদান মাস! যে মাসে কোরআন নাযিল হয়েছে মানবের দিশারি ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনরূপে।’ (বাকারাঃ ১৮৫)।
২. পবিত্র কোরআনে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ নিজেই। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসূল প্রেরণকারী। তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যিনি আসমানসমূহ, জমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব; যদি তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকারী হও। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃ পুরুষদের রব। (দুখানঃ ৩-৮)
৩. আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাযিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ ক্বদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় ক্বদর রজনী কী? মহিমান্বিত ক্বদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সে রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত। (ক্বদরঃ ১-৫)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমান সহকারে সওয়াবের আশায় নিয়ে লাইলাতুল ক্বদরের কিয়াম (রাতে জেগে ইবাদাত) পালন করে তার বিগত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
হযরত ওবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ক্বদরের রাত্রের অন্বেষণে সেই রাত নামায পড়ে এবং তা পেয়ে যায়। তার অতীতের ও ভবিষ্যতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট রামাদান মাস উপস্থিত। এটা এক অত্যন্ত বারাকাতময় মাস। আল্লাহ তা’আলা এ মাসে তোমাদের প্রতি সাওম ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় শয়তানগুলোকে আটক রাখা হয়। আল্লাহর জন্যে এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহা কল্যাণলাভ হতে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি। (সুনানে নাসায়ী) এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না । (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)
এ রাত পাওয়াটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের তুলনায় রামাদানের শেষ দশ দিনে অধিক হারে পরিশ্রম করতেন’’ (সহীহ মুসলিমঃ ১১৭৫) হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রামাদান মাসের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রামাদানের শেষ ১০ রাতে শবেক্বদর সন্ধান করো। (সহীহ বোখারী ও মুসলিম) নবী করিম (সাঃ) আরও বলেছেন, মাহে রামাদানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে ক্বদর সন্ধান করো। (সহীহ বোখারী)
এ রাতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে। মানবজাতির এই বিরাট নিয়ামতের কারণেই এ রাতের এত মর্যাদা ও ফযিলত। এই কুরআনকে ধারণ করলেই মানুষ সম্মানিত হবে, একটি দেশ ও জাতি মর্যাদাবান হবে; গোটা জাতির ভাগ্য বদলে যাবে। কাজেই এ রাতে অর্থ বুঝে কুরআন পড়তে হবে। কুরআনের শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে হবে। বাছাইকৃত কিছু আয়াত এ রাতে মুখস্থও করা যেতে পারে। যাদের কুরআনের ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে তারা এ রাতে একটি দারসও প্রস্তুত করতে পারেন। কুরআনের এ গভীর অধ্যয়ন আমাদের সৌভগ্যের দ্বার খুলে দেবে। হাদীস থেকে জানা যায়, রাতে এক ঘণ্টা গবেষণামূলক ইসলামী গ্রন্থ অধ্যয়ন সারা রাত জেগে ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। এর মর্তবা হলো- সাধারণ রাতের জন্য আর এ পবিত্র রজনীতে কুরআন অধ্যয়নের ফযিলত কল্পনা করাই কঠিন।
শবে ক্বদরে উম্মতের বৈশিষ্ট্যঃ
শবে ক্বদর উম্মতের জন্য আল্লাহ পাকের মহান দান। এটা কেবল এ উম্মতেরই বৈশিষ্ট্য। হযরত আনাস (রাঃ)থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা শবে ক্বদর আমার উম্মতকেই দান করেছেন; পূর্ববর্তী উম্মতকে নয়।
ইমাম মালিক (রহ.) সূত্রে বর্ণিত আছে, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ দেওয়া হলো যে, আপনার উম্মতের বয়স অন্যান্য উম্মতের তুলনায় কম হবে, তখন তিনি আল্লাহর সমীপে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ! তাহলে তো পূর্ববর্তী উম্মতগণ দীর্ঘ জীবন পেয়ে ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে যে স্তরে উপনীত হয়েছে, আমার উম্মত সে স্তর লাভ করতে পারবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লাইলাতুল ক্বদর দান করেন এবং এটাকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ঘোষণা দেন।
লায়লাতুল ক্বদরের আলামতঃ
যে রাতটি লাইলাতুল ক্দর হবে সেটি বুঝার কিছু আলামত হাদীসে বর্ণিত আছে। সেগুলো হলো-
১. এ রাত বেশি ঠাণ্ডাও হয় না, বেশি গরমও হয় না, বরং তা হয় উজ্জ্বল হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে লায়লাতুল ক্বদর দেখানো হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এ রাত হলো রামাদানের শেষ দশদিনের রাতগুলোয়। এ রাত হলো মুক্ত ও উজ্জ্বল, যা ঠাণ্ডাও না গরমও না।’(তিরমিযী)
২. লায়লাতুল ক্বদর শেষে সকালের সূর্য আলোকরশ্মি ব্যতীত সাদা হয়ে উদিত হয়। হযরত উবায় ইবনে কা’ব (রাঃ) কে যখন লায়লাতুল ক্বদরের আলামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি বলেছেন,‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নিদর্শনের কথা বলেছেন, তার দ্বারা আমরা লায়লাতুল ক্বদর চিনতে পারি, অর্থাৎ ওইদিন সূর্যোদয় হয় রশ্মিবিহীন আকারে।’ (বর্ণনায় ইবনে খুযায়মাহ)
৩. এ রাতটি রামাদান মাসে। আর এ রাতের ফযিলত কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে।
৪. এ রাতটি রামাদানের শেষ দশকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, রামাদানের শেষ দশদিনে তোমরা ক্বদরের রাত তালাশ কর। (সহীহ বোখারী)
৫. আর এটি রামাদানের বেজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা রামাদানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে ক্বদরের রাত খোঁজ কর। (সহীহ বোখার)
৬. এ রাত রামাদানের শেষ সাত দিনে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) অন্বেষণ করতে চায়, সে যেন রামাদানের শেষ সাত রাতের মধ্য তা অন্বেষণ করে।’
৭. রামাদানের ২৭ শে রজনী লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
ক. হাদীসে আছে, উবাই ইবনে কাব হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে যে রজনীকে ক্বদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা’হল রামাদানের ২৭ তম রাত। (সহীহ মুসলিম)
খ. হযরত আবদুল্লাহ বিন উমার থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রামাদানের ২৭ রজনীতে অনুসন্ধান করে। (আহমাদ)
গ. ক্বদরের রাত হওয়ার ব্যাপারে সম্ভাবনার দিক থেকে পরবর্তী দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল ২৫ তারিখ, তৃতীয় হল ২৯ তারিখে। চতুর্থ হল ২১ তারিখ। পঞ্চম হল ২৩ তারিখের রজনী।
৮. সর্বশেষ আরেকটি মত হলো- মহিমান্বিত এ রজনীটি স্থানান্তরশীল। অর্থাৎ প্রতি বৎসর একই তারিখে বা একই রজনীতে তা হয় না এবং শুধুমাত্র ২৭ তারিখেই এ রাতটি আসবে তা নির্ধারিত নয়। আল্লাহর হিকমত ও তার ইচ্ছায় কোনো বছর তা ২৫ তারিখে, কোনো বছর ২৩ তারিখে, কোনো বছর ২১ তারিখে, আবার কোনো বছর ২৯ তারিখেও হয়ে থাকে।
৯. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
১০. মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
১১. সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
১২. ওই রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
লাইলাতুল ক্বদর উপলক্ষে আমাদের আমল হলোঃ
ক. নফল নামাজঃ ১. তাহিয়্যাতুল অজু, ২. দুখুলিল মাসজিদ, ৩. আউওয়াবিন, ৪. তাহাজ্জুদ, ৫. সালাতুত তাসবিহ ৬. তাওবার নামাজ, ৭. সালাতুল হাজাত, ৮. সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া।
খ. নামাজে কিরাত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। শবে ক্বদরে নফল নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। নফল নামাজ পড়ার কারণে বান্দার পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (তাফসিরে রুহুল বয়ান, ১০ম খণ্ড, ৪৮০ পৃষ্ঠা)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শবে ক্বদরে সওয়াবের নিয়তে (নফল নামাজের জন্য) দণ্ডায়মান থাকে, তার অতীত সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)।
গ. কোরআন শরিফঃ ১. সূরা ক্বদর, এ প্রসঙ্গে আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী মুরতাজা শেরে খোদা (রাঃ) বলেন, ‘যে কেউ শবে ক্বদরে সূরা ক্বদর সাতবার পড়বেন আল্লাহ তা’আলা তাকে প্রত্যেক বালা মুসিবত থেকে রক্ষা করেন। আর সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জান্নাত পাবার জন্য দোয়া করেন…। (নুজহাতুল মাজালিস, ১ম খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা)। ২. সূরা দুখান, ৩. সূরা মুয্যাম্মিল, ৪. সূরা মুদ্দাচ্ছির, ৫. ইয়া-সিন, ৬. সূরা ত-হা, ৭. সূরা আর রহমান ও অন্যান্য ফজিলতের সূরাসমূহ তিলাওয়াত করা;
ঘ. দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া;
ঙ. তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা;
কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই এ রাতে অন্তরকে নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে খাঁটি দিলে তওবা ইস্তেগফার করতে হয়। খাঁটি তওবার চারটি শর্তঃ
১. পূর্বের গুনাহ থেকে ফিরে আসা বা গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে;
২. গুনাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি;
৩. ভবিষ্যতে ওই গুনাহ আর করবো না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে;
৪. বান্দাহর কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে।
চ. দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার ইত্যাদি করা;
ছ. কবর জিয়ারত করা;
জ. নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনায় দোয়া করা।
উক্ত আমলগুলো শুধু ২৭ রামাদান নয় বরং রামাদানের শেষ দশ দিনের প্রত্যেক বেজোড় রাতে শবেক্বদর তালাশ করতে হবে। এজন্য মহানবী (সাঃ) রামাদানের শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করতেন। আর উম্মতের জন্য শরীয়তে ইতেকাফের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে গিয়েছেন যেন তারা ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটি বেজোড় রাতে এবাদত করতে পারেন। আল্লাহ তা’আলা লাইলাতুল ক্বদরে কোরআন নাযিল করেন। এ রাত বছরে একবার আসে আর চলে যায়। কিন্তু এ রাতের মহান নিয়ামত কোরআন মানব সমাজেই বিরাজমান থাকে চিরদিন। মানব জীবনে সাফল্য এই কোরআনের আমলের উপরই নির্ভরশীল। এই রাতের মর্যাদা মূল্যায়ন তখনই যথার্থ হবে। যখন আমরা কোরআনের নির্দেশিত পথে চলবো, আর কোরআনের বাহক মুহম্মদ (সাঃ) এর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করবো। এ রাতের সর্বাপেক্ষা মহৎ প্রাপ্তি হলো কোরআনের হক আদায় করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে কোরআন প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত করা।
লাইলাতুল ক্বদরের দোয়াঃ
শবে ক্বদরের রাতে ফেরেশতারা ও তাঁদের নেতা জিবরাঈল পৃথিবীতে অবতরণ করে উপাসনারত সব মানুষের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতে থাকেন। হাদীস শরিফে বর্ণিত আছে, শবে ক্বদরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাযহারি)
শবে ক্বদর এমন একটি মহিমান্বিত রাত যে রাত সম্পর্কে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, হাদীসে আছে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর নেতৃত্বে ফেরেশতারা পৃথিবীতে চলে আসেন। প্রত্যেকের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন, যারা দাঁড়িয়ে কিংবা বসে এবাদত করে থাকেন। (জিয়াউল কোরআন, ৫ম খণ্ড)।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি বলুন, যদি আমি (ভাগ্যক্রমে) শবে ক্বদর জেনে নিই, তাহলে তাতে কোন (দোয়া) পড়ব? তিনি বললেন, এই দোয়া, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নী।” অর্থাৎ হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা ভালবাসো। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিযি, ইবন মাজাহ)
এ রাতে কাদের দোয়া কুবল হবেনাঃ
এই রাতকে মহান আল্লাহ তা`আলা নিজেই হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। এ রাতকে যে কাজে লাগাতে পারেনি আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সাঃ) তাকে বড় হতভাগা বলেছেন।
উম্মতগণ চাইলে এ রাতকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেন। এ রাতের প্রত্যেকটি আমল আল্লাহর দরবারে গৃহিত হয়। কেবল কয়েক শ্রেণির মানুষ ছাড়া বাকী সবার দোয়া কবুল হয়। মাত্র একরাতের আমল দিয়ে নিজেকে জান্নাতি বানানোর সুযোগ করে দিয়েছে শবে ক্বদর।
শবে ক্বদরে চার শ্রেণির মানুষকে ক্ষমা করা হবে না, তাদের কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না যতক্ষণ না তারা এসব অপকর্ম থেকে সংশোধন হবে। এই চার শ্রেণির মানুষ হলো-
এক- মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি;
দুই- মাতাপিতার অবাধ্য সন্তান;
তিন- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী;
চার- হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী ও সম্পর্কছিন্নকারী। (শুয়াবুল ঈমান, ৩য় খণ্ড, ৩৩৬ পৃষ্ঠা)।
পবিত্র ও মহিমান্বিত রাতে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে যারা বঞ্চিত থাকবেঃ
এক- মদখোর,
দুই- মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ী;
তিন- মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান;
চার- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী;
পাঁচ- ইচ্ছাকৃত নামাজ ভঙ্গকারী;
ছয়- বিনা কারণে অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকারী। (তাফসিরে কাশফুল আসরার, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ৫৬৪)।
উপরোক্ত দোষে যারা দোষী এ রাতের বরকত পাওয়ার জন্য প্রথমেই তাদের তওবা করতে হবে। তাদের তওবা আল্লাহ কবুল করার পরই তারা এই রাতের ফযিলত লাভ করবে। এ রাতে যারা নিজের অপরাধ ক্ষমা চেয়ে এবং আল্লাহর রহমত কামনা করে কাঁদবে, তাদের দোয়া কবুল হবে। শুধু নামাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এ রাতে তিলাওয়াতে কোরআন, জিকির, ইস্তিগফার, তাসবিহ পাঠ, বেশি বেশি দরুদ শরিফ পড়া একান্ত করণীয়।
কিয়ামুল লাইলঃ
কিয়ামুল লাইল’ অর্থ হলো রাত্রি জাগরণ। মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বেচ্ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের একটি গুণ। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- ‘তারা রাত্রি যাপন করে রবের উদ্দেশে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে’ (ফুরকানঃ ৬৪)।‘তাদের পার্শ দেশ বিছানা থেকে পৃথক থাকে (অর্থাৎ তারা শয্যা গ্রহণ করে না; বরং এবাদতে মশগুল থাকে)। তারা গজবের ভয়ে এবং রহমতের আশায় তাদের রবকে ডাকতে থাকে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে দান করে থাকে। কেউ জানে না। তাদের আমালের পুরস্কারস্বরূপ (আখিরাতে) তাদের জন্য কী জিনিস গোপনে রাখা হয়েছে’ (সিজদাঃ ১৬-১৭)।
আল্লাহর প্রিয় বান্দাহরা গোটা জীবনই এভাবে কাটান। আমাদের সে জীবনে প্রবেশ করতে হলে দরকার অধ্যবসায়। পবিত্র রামাদান, বিশেষ করে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে। মুসনাদে আহমেদ গ্রন্থে হযরত ওবায়দা ইবনে সামেত বর্ণিত হাসিসে উদ্ধৃত হয়েছে- ’নবী করিম (সাঃ) বলেছেন-‘ক্বদরের রাত রামাদান মাসের শেষ দশ রাতে রয়েছে। যে ব্যক্তি এর শুভফল লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, আল্লাহ তার আগের ও পেছনের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ রাসূল (সাঃ) রামাদানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। কাজেই আমরা কোনো একটা বিশেষ রাতকে নির্দিষ্ট না করে হাদীস অনুযায়ী অন্তত রামাদানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদরের সৌভাগ্য লাভের আশায় ইবাদতে মশগুল হই। আমরা এতে অবহেলা করলে হাদীসের ভাষায় হতভাগ্য হিসেবে চিহ্নিত হবো। রাসূল (সাঃ) বলেন- ‘যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না’। (মিশকাত) এই মহান রজনীতে আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য গুনাহগারকে মাফ করেন, তওবা কবুল হয়। এ রাতে মাতা–পিতা ও আত্মীয়স্বজনের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে তাদের কবর জিয়ারত ও তাঁদের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করেন।
শেষ দশকের ইবাদাতঃ
শবেক্বদর লাভ করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হল শেষ দশকে ই’তিকাফ করা। রামাদানের শেষ দশদিন ই’তিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। ই‘তিকাফ অর্থ অবস্থান করা। অর্থাৎ মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইস্তেগফার ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা। এ ইবাদাতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রামাদানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদানের শেষ দশ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ ই‘তিকাফ করতেন। ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শবে ক্বদর প্রাপ্তি; রামাদানের শেষ দশক ইতিকাফ করলে শবে ক্বদর প্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। ইতিকাফের মূল কথা হলো সবকিছু ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়া।
হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ ‘‘প্রত্যেক রামাদানেই তিনি শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রামাদানে তিনি ই’তিকাফ করেছিলেন বিশ দিন’’। দশ দিন ই‘তেকাফ করা সুন্নাত। (সহীহ আল বুখারী)
হযরত আলী বিন হোসাইন নিজ পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেঃ যে ব্যক্তি রামাদানের শেষ দশ দিনের ইতেকাফ করে সে দুই হজ্জ ও দুই ওমরাহ করার সমান সওয়াব পায়।
হাদীস শরীফে এসেছে যে ব্যক্তি বিশ্বাসসহকারে ও সোয়াবের আশা নিয়ে ই’তিকাফ করবে আল্লাহ তা’আলা তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।
হাদীস শরীফে এসেছে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশে একদিন ই’তিকাফ করবে আল্লাহ তা’আলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও যমীনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (শুআবুল ঈমান)
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তু‘ষ্টি লাভের আশায় একদিন এতেকাফ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিনটি গহবর সৃষ্টি করবেন-যার দূরুত্ব আসমান ও যমীনের দূরত্বের চেয়েও অধিক হবে।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমান সহকারে সওয়াবের আশায় নিয়ে লাইলাতুল ক্বদরের কিয়াম (রাতে জেগে ইবাদাত) পালন করে তার বিগত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ আল বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
হযরত ওবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ক্বদরের রাত্রের অন্বেষণে সেই রাত নামায পড়ে এবং তা পেয়ে যায়। তার অতীতের ও ভবিষ্যতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট রামাদান মাস উপস্থিত। এটা এক অত্যন্ত বারাকাতময় মাস। আল্লাহ তা’আলা এ মাসে তোমাদের প্রতি সাওম ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় শয়তানগুলোকে আটক রাখা হয়। আল্লাহর জন্যে এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহা কল্যাণলাভ হতে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি। (সুনানে নাসায়ী)
এ রাত পাওয়াটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন ঃ ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের তুলনায় রামাদানের শেষ দশ দিনে অধিক হারে পরিশ্রম করতেন’’ (সহীহ মুসলিম)
এ রাতের আর একটি গুরুত্ব হলো- এ পবিত্র রাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে। আর এই কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। এ জন্য ক্বদরের আর একটি অর্থ হলো ভাগ্য। তা হলে লাইলাতুল ক্বদরের অর্থ হয় ভাগ্যরজনী। লাইলাতুল ক্বদরে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, সবকিছুর পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদেরকে লিখে দেওয়া হয়, এমনকি কে হজ্জ করবে, তাও লিখে দেওয়া হয়।
কোরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। কোরআনের সঙ্গে যার যতটুকু সম্পর্ক ও সংস্পর্শ থাকবে, তিনি ততটুকু সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী হবেন। প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোরআনওয়ালাই আল্লাহওয়ালা এবং তাঁর খাস ব্যক্তি। (বুখারী)। ‘যার অন্তরে কোরআনের সামান্যতম অংশও নেই, সে যেন এক বিরান বাড়ি।’ (বুখারী ও মুসলিম)
আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে শবে ক্বদরের কল্যাণ লাভ করার তাওফিক দিন, কোরআন পড়ার, কোরআন বোঝার, কোরআনমতো জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২১ বিকাল ৩:৪৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×