somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুহাসাবা তথা আত্নসমালোচনা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনা করে

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভূমিকা
মানবজাতিকে আল্লাহ তা‘আলা আশরাফুল মাখলূক্বাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। দিয়েছেন স্বাধীন চিন্তাশক্তি। মানুষকে স্বাধীন চিন্তা শক্তি দেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে চার ধরনের নফসের সম্মিলন ঘটেছে। ১. নফসে আম্বারাহ (প্রতারক আত্মা)। অর্থাৎ যে নফস মানুষকে কুপ্রবৃত্তি ও জৈবিক কামনার দিকে আকৃষ্ট করে। ২. নফসে লাওয়ামাহ (অনুশোচনাকারী আত্মা)। যে নফস অন্যায় করার পর মানুষের হৃদয়ে অনুশোচনার উদ্রেক করে। ৩. নফসে মুতামায়িন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা)। যে নফস সকল কালিমা থেকে মুক্ত এবং যাবতীয় মহৎ ভাবনায় পরিতৃপ্ত। ৪. নফসে মুলহিমাহঃ এই প্রকৃতির নফসকে আল্লাহ্‌ আযযা ওয়া জাল্লা ভাল মন্দের ইলহাম করে তার নফস তুলনামূলক ভাবে নফসে লাওয়্যামার চেয়ে ভাল। এর মধ্যে নফসে আম্মারাহ বা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে জৈবিক কামনা-বাসনা ও দুনিয়ার লোভ-লালসার দিকে আকৃষ্ট করে তাকে মন্দ কাজের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ। কিন্তু সে মন নয়, আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন’ (ইউসুফ : ৫৩)। অধিক হারে মন্দকাজ বান্দার অন্তরকে কঠিন করে তোলে ও ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘যখন বান্দা কোন পাপ করে তখন তার অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। যখন সে তওবা করে তখন সেটা তুলে নেওয়া হয়। আর ইস্তেগফারের মাধ্যমে অন্তরকে পরিষ্কার করা হয়। আর যদি পাপ বাড়তেই থাকে তাহলে দাগও বাড়তে থাকে। আর এটাই হল মরিচা। (তিরমিযী : ৩৩৩৪; মিশকাত : ২৩৪২)
যেমন আল্লাহ বলেন, ‘বরং তাদের কৃতকর্মের ফলেই মনের উপর মরিচা জমে গেছে’ (মুতাফফিফীন : ১৪)। দুনিয়াতে প্রতিটি মানবসত্তাই মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। তাই তা থেকে বেঁচে থাকার জন্য আত্মসমালোচনা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদিন মানুষ নিজেই নিজের পাপের হিসাব নেওয়ার মাধ্যমে পুনরায় ঐ পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। এছাড়া ব্যক্তির মাঝে যে পাপবোধ সৃষ্টি হয় আত্মসমালোচনা তাকে ক্ষমা লাভের উপযুক্ত করে তোলে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হল। একমাত্র আত্মসমালোচনার দ্বারাই নিজের কুপ্রবৃত্তি দমন করা সম্ভব।
‘মুহাসাবাতুন নাফস’ বা আত্মসমালোচনা নিজেকে শুধরে নেওয়া ও বদলে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়। দুই চোখ দিয়ে মানুষ অন্যকে এবং অন্যের দোষ-ত্রুটি দেখতে পায়। কিন্তু অন্তরের চোখে নিজের আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়। পরকালীন জবাবদিহিতার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া করার নাম আত্মসমালোচনা।
নিন্দাসূচক সমালোচনা করা আমাদের এমন একটি নিয়মিত অভ্যাস যা থেকে বেঁচে থাকতে পারেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে খুবই কম। মজার ব্যাপার যে, এই আমাদেরই একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি নিজের সমালোচনা শুনতে আগ্রহী। অথচ জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমরা প্রতিনিয়তই অন্যের সমালোচনা করি, আবার নিজেরাও একইভাবে অন্যের সমালোচনার শিকার হই। প্রাত্যহিক জীবনে সামান্য অবসর পেলেই আমরা তা অন্যের সমালোচনা বা নিন্দায় অতিবাহিত করার সুযোগ হাতছাড়া করি না। অথচ আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনের সূরা হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে যে কোন গীবত তথা নিন্দাবাচক সমালোচনা থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতিপয় ধারণা গুনাহ এবং তোমরা গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্ত্ততঃ তোমরা একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু’ (হুজুরাত : ১২)।

আত্মসমালোচনার পরিচয়
আগে জানতে হবে এই আত্মসমালোচনাটা কী? আত্মসমালোচনার অর্থ নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সমালোচনা করা। নিজের কর্মের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করা। অর্থাৎ আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত থেকে উন্নততর স্তরের নিয়ে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া তার নামই হল আত্মসমালোচনা। অন্যের সমালোচনা করা কাজটা যত সহজ, নিজের সমালোচনা করা কিন্তু ততটা সহজ নয়। ব্যক্তিগতভাবে ‘আত্মসমালোচনা’ আমার কাছে আয়নার মতো মনে হয়। আয়নায় আমরা যেমন আমাদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, আমাদের শরীরে, মুখে কোথায় কী আছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখি, ঠিক তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক কার্যাবলি ঠিক না বেঠিক তা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারি।
আভিধানিক অর্থে আত্মসমালোচনা হল নিজের সম্পর্কে সমালোচনা করা। একে আরবীতে বলা হয়, ‘মুহাসাবাতুন নাফস’ অর্থাৎ স্বীয় আত্মার হিসাব গ্রহণ করা।
লিসানুল আরব অভিধানে বলা হয়েছে, ‘মুহাসাবা’র শাব্দিক অর্থ হল গণনা করা বা হিসাব করা। সুতরাং ‘মুহাসাবাতুন নাফস’-এর অর্থ হচ্ছে আত্মার হিসাব গ্রহণ করা। ইংরেজীতে একে বলা হয়, self-criticism বা self-accountability অর্থাৎ আত্মসমালোচনা।
পারিভাষিক অর্থে আত্মসমালোচনা বলতে বুঝায়, সচেতনভাবে কোন কাজ সম্পন্ন করা বা পরিত্যাগ করা, যাতে কৃতকর্ম সম্পর্কে নিজের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। সুতরাং যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ হয়, তবে তা নিষ্ঠার সাথে পালন করা। আর যদি তা আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কাজ হয় তবে তা থেকে সর্বতোভাবে বিরত থাকা। সাথে সাথে নিজেকে সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ তথা ইবাদতে মশগুল রাখা।
‘মুহাসাবা’ হলো যখন মুসলিম ব্যক্তি এ জীবনে রাতদিন এমনভাবে আমল করে, যা তাকে পরকালে সৌভাগ্যবান করবে, আখিরাতে সম্মান ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে সম্ভব করে তুলবে এবং দুনিয়া হবে তার মৌসুম বা সময়কাল, তখন তার উচিত হলো তার উপর আবশ্যকীয় ফরয ও ওয়াজিব বিষয়গুলোর প্রতি এমনভাবে নজর দেওয়া, যেমনিভাবে একজন ব্যবসায়ী তার মূলধনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে; আর নফল বিষয়গুলোর প্রতি এমনভাবে নজর দেওয়া, যেমনিভাবে একজন ব্যবসায়ী মূলধনের উপর অতিরিক্ত লাভের দিকে দৃষ্টি রাখে; আর অবাধ্যতা ও অপরাধের দিকে দৃষ্টি রাখবে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার মত করে; অতঃপর প্রত্যেক দিনের শেষে নিরিবিলে নির্জনে একটি সময় করে তাতে তার সেদিনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করবে; তারপর সে যদি দেখে ফরযসমূহ পালনে কোনো ঘাটতি বা ত্রুটি হয়েছে, তাহলে সে স্বীয় নাফসকে তিরস্কার করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা সংশোধন করার জন্য পদক্ষেপ নেবে। সুতরাং তা যদি কাযা আদায় করার মত কোনো বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে কাযা করে নেবে; আর কাযা আদায় করার মত বিষয় না হলে বেশি করে নফল আদায় করার মাধ্যমে তার ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করবে; আর যদি সে নফলের ব্যাপারে ঘাটতি দেখে, তাহলে ঘাটতি পূরণ করে নেবে এবং তা সংশোধন করবে। আর যদি সে নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হওয়ার কারণে কোনো ক্ষতির বিষয় লক্ষ্য করে, তাহলে সে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, অনুতপ্ত হবে, তাওবা করবে এবং এমন ভালো কাজ করবে, যাকে সে তার অন্যায়ের পরিপূরক মনে করবে।
১. ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) আত্মসমালোচনা সম্পর্কে চমৎকার একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ করো, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার আগেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার আগেই। কেননা, আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামী দিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (তিরমিজি-২৪৫৯, সনদ মওকুফ সহীহ)
২. আত্মসমালোচনা সম্পর্কে হাসান বসরি (রহ:) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার পরিচালক হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করবে, কিয়ামতের দিন অবশ্যই তাদের হিসাব হালকা হবে। আর যারা এ থেকে বিরত থাকবে, কিয়ামতের দিন তাদের হিসাব কঠিন হবে।’ (ইগাছাতুল লাহফান (মাকতাবাতুল মা’আরিফ, তাবি ১/৭৯)
৩. আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, আত্মসমালোচনার অর্থ হচ্ছে- নিজের করণীয় এবং বর্জনীয় পৃথক করে ফেলা। অতঃপর সর্বদা ফরয ও নফল কতর্ব্যসমূহ আদায়ের জন্য প্রস্ত্তত থাকা এবং হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার উপর সুদৃঢ় থাকা। তিনি আরো বলেন, আত্মসমালোচনার অর্থ হল প্রতিটি কাজে সর্বপ্রথম আল্লাহর হক্ব সমূহের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া; অতঃপর সে হক্বগুলো যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কি-না সেদিকে লক্ষ্য রাখা (আল-ফাওয়ায়েদ)।
আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের দোষ-ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল-ত্রুটি জানতে পারে। ফলে তার হৃদয় ভালো কাজের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে। আত্মসমালোচনা দ্বীনের ওপর দৃঢ়তা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকরি মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামতসমূহ, অধিকারসমূহ জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নিয়ামত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
আত্নসমালোচনার উদ্দেশ্যে
আত্মসমালোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো ‘নাফস’ তথা আত্মাকে সংস্কার, সংশোধন, পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করা।
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা আগামী কালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।”
(আল-হাশর : ১৮)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার বাণী : ওয়ালতানজুর নাফসুম মা কাদ্দামাত লিগাদ”-এর মধ্যে ব্যক্তিকে প্রতিক্ষিত আগামী দিন তথা পরকালোর জন্য কী আমল করা হয়েছে, সে বিষয়ে আত্মসমালোচনা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
২. আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: “তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে আস, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”(সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩১)
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “(কখনও কখনও) আমার অন্তরের উপর পর্দা ফেলা হয়; আর আমি দৈনিক একশতবার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি।” (মুসলিম : ৭০৩৩)
৪. হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন : “তোমরা হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বেই তোমাদের নিজেদের হিসাব নিজেরা নিয়ে নাও।” (আর এই অর্থে ইমাম তিরমিযী রহ. ‘হাসান’ সনদে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: “বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে তার নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে; আর দুর্বল ঐ ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছেও আশা-আকাঙ্খা রাখে।” (তিরমিজি : ২৪৫৯)। আর যখন রাতের আগমন ঘটত, তখন হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দোর্রা বা লাঠি দিয়ে তাঁর দু’পায়ে পিটাতেন এবং নিজেকে প্রশ্ন করে বলতেন: তুমি আজকে কী কাজ করেছ? (উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২১)
৫. হযরত আবূ তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে যখন তাঁর বাগান তাঁর সালাত আদায় করার বিষয়টিকে ভুলিয়ে রাখল, তখন তিনি বাগানের অংশবিশেষ আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে সাদকা করে দিলেন; সুতরাং তিনি এ কাজটি করেছিলেন শুধু তাঁর আত্মসমালোচনার কারণেই এবং নিজকে তিরস্কার স্বরূপ ও আত্ম-সংশোধনের জন্য।(বর্ণনাটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত (উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২১ )
৬. আহনাফ ইবন কায়েস সম্পর্কে বর্ণিত আছে : তিনি চেরাগের নিকট আসতেন, তারপর তিনি তাঁর আঙুল চেরাগের মধ্যে ধরে রাখতেন ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তিনি আগুনের উত্তাপ অনুভব করতেন; অতঃপর তিনি নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলতেন: হে হুনায়েফ! অমুক দিন তুমি যে কাজ করেছ, তা করতে তোমাকে কিসে উদ্বুদ্ধ করেছে? অমুক দিন তুমি যে কাজ করেছ, তা করতে তোমাকে কিসে উত্তেজিত করেছে? (উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২১)
৭. বর্ণিত আছে: জনৈক সৎব্যক্তি যোদ্ধা ছিলেন; এক মহিলা তার উদ্দেশ্যে নগ্ন হয়ে গেল; তারপর তিনি তার দিকে তাকালেন; অতঃপর তিনি তাঁর হাত উঠায়ে তাঁর চোখে থাপ্পর মারলেন এবং তাঁর চোখ উপড়িয়ে ফেললেন; আর বললেন: নিশ্চয়ই তুমি তা দেখতে পাচ্ছ, সে যে ক্ষতি তোমার করেছে! (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২২)
৮. কোনো এক ভালো মানুষ একটি কক্ষের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমতাবস্থায় তিনি বললেন: এ কক্ষটি কখন বানানো হয়েছে? অতঃপর তিনি আত্মসমালোচনায় মনোযোগ দিলেন এবং বললেন: তুমি আমাকে এমন এক প্রশ্ন করলে, যা তোমার কোনো প্রয়োজন ছিল না; আমি তোমাকে শাস্তি দিব এক বছর সাওম পালন করার মাধ্যমে, তারপর তিনি এক বছর সাওম পালন করলেন। (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২২)
৯. আরও বর্ণিত আছে: কোনো এক সৎ মানুষ উত্তপ্ত ভূমির দিকে গেলেন, অতঃপর তিনি তাতে গড়াগড়ি দিতে থাকলেন এবং নিজেকে নিজে বলতে লাগলেন: মজা ভোগ কর, জাহান্নামের আগুন আরও অনেক বেশি উত্তপ্ত; তুমি কি রাতের বেলায় নোংরা বা পঙ্কিল এবং দিনের বেলায় বীর? (প্রাগুক্ত)
১০. আরও বর্ণিত আছে: সৎ ব্যক্তিগণের কোনো একজন একদিন ছাদের দিকে তাঁর মাথা উঠালেন এবং এক নারীকে দেখলেন; তারপর তিনি তার দিকে তাকালেন; অতঃপর তিনি নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি যতদিন জীবনে বেঁচে থাকবেন কোনো দিন আকাশের দিকে তাকাবেন না। (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২২)
এভাবেই এ উম্মতের সৎকর্মশীল বান্দাগণ নিজেদের অবহেলার ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করতেন, ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে নিজে তিরস্কার করতেন, নিজের ‘নাফস’-এর জন্য তাকওয়ার বিষয়টিকে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে ধারণ করতেন এবং তাকে নিজের খেয়াল-খুশি মত চলা থেকে বিরত রাখতেন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর যে তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজকে বিরত রাখে; জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।” (আন-নাযি‘আত : ৪০– ৪১)

আত্নসমালোচনার পদ্ধতি
আত্মসমালোচনা করার পদ্ধতি হলো-
(ক) আল্লাহর আদেশ সমূহ আদায়ের ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করা : আমাদের উপর নির্দেশিত ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফলগুলি পর্যালোচনা করা। নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে, আমি কি আমার উপর আরোপিত ফরযগুলি আদায় করেছি? আদায় করলে সাথে সাথে নফল বা মুস্তাহাবগুলি কতটুকু আদায় করেছি? কারণ ফরযের কোন অপূর্ণতা হ’লে নফলগুলি সেটা পূরণ করে দেয়। (আবু দাঊদ, মিশকাত : ১৩৩০ সনদ সহীহ)সাথে সাথে খেয়াল করতে হবে যে, উক্ত ইবাদতসমূহে আল্লাহর হক্ব পরিপূর্ণ আদায় করা হয়েছে কি-না? উল্লেখ্য যে, ইবাদতে আল্লাহর হক্ব ছয়টি-
১. আমলের মধ্যে খুলূছিয়াত থাকা,
২. তার মাঝে আল্লাহর জন্য নছীহত থাকা (আল্লাহর একত্বের প্রতি সঠিক বিশ্বাস পোষণ করা), ৩. রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি আনুগত্য থাকা,
৪. একাগ্রতা থাকা,
৫. নিজের উপর আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পূর্ণ উপলব্ধি থাকা,
৬. অতঃপর এ সকল বিষয়াদির প্রতিটিতে নিজের ত্রুটি হচ্ছে- এই অনুতপ্তভাব থাকা। (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ৪/৩৯৪)
এ সকল হক্ব পূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে কি-না আমল সম্পন্ন করার পর তা চিন্তা করতে হবে।
(খ) অপ্রয়োজনীয় কাজ পরিত্যাগ করা : দ্বীনী দৃষ্টিকোণে যে হালাল কাজ করার চেয়ে না করাই বেশী উত্তম মনে হয়, তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। কোন নির্দোষ কিন্তু গুরুত্বহীন কাজ করে থাকলে তা থেকেও নিজেকে সাধ্যমত নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ আগামীতে কেন এটা করব? এর দ্বারা কি আমি আল্লাহর পথে আরো অগ্রসর হতে পারব? এর দ্বারা কি দুনিয়াবী ও পরকালীন জীবনে আমার বা মানবসমাজের কোন লাভ হবে? তা অন্য কোন লাভজনক কাজ থেকে আমাকে বিরত করছে কি? ইত্যাদি প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পেলে সে পথে আর অগ্রসর না হওয়া। (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ৪/৩৯৪)
(গ) ক্ষমা প্রার্থনা করা ও সৎআমল করা : পূর্ণ সতর্কতার পরও যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন পাপ হয়ে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তওবা করা। সাথে সাথে সৎআমল দ্বারা এই অপরাধের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই ভালকাজ মন্দকাজকে দূর করে দেয়, আর এটা স্মরণকারীদের জন্য স্মরণ’ (হূদ : ১১৪)। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর। কোন পাপ কাজ সংঘটিত হয়ে গেলে সাথে সাথে সৎআমল কর যাতে তা মিটে যায়’। (তিরমিযী, মিশকাত : ৫০৮৩)
আত্নসমালোচনর হুকুম
‘মুহাসাবাতুন নাফস’ বা আত্মসমালোচনাকে প্রতিটি মুমিনের জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করে আল্লাহ সূরা হাশরের ১৮ নং আয়াতে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিৎ- আগামী কালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কি প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন (অর্থাৎ তারা কোন কাজটি ভাল, কোনটি মন্দ তা বাছাই করা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে)। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক (হাশর : ১৮)।
ইবনুল কাইয়িম বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল আলামীন প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। যেন আল্লাহ বলছেন, তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করা কর্তব্য যে, আগামী দিনের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, না কি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? (মাদারিজুস সালেকীন, ১/১৭০ পৃঃ)। রাসূল (সাঃ)-এর বহু হাদীছ থেকে আত্মসমালোচনার গুরুত্ব স্পষ্ট বোঝা যায়।
আত্মসমালোচনাকারীদের প্রশংসা করে পবিত্র কোরআনের অপর একটি অংশে আল্লাহ বলেছেন, ‘যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে, তাদের ওপর শয়তানের আগমন ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে।’ (আল আ’রাফ : ২০১)। আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)–এর নির্দেশনা হতে হযরত ওমর (রাঃ) বলেছিলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯, সনদ মওকুফ সহীহ)।
হযরত ওমর (রাঃ)–এর এই বাণী থেকে এখানে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মসমালোচনা করে নিজেদের দোষ ও ভুলগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং নিজেকে সংশোধন করে নিতে হবে। আমরা যদি আত্মভোলা হয়ে যাই, তাহলে পথভ্রষ্ট হয়ে আমরা ভুল পথে পা বাড়িয়ে দেব। নিজের ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে দ্বিধাহীন পাপকর্মে লিপ্ত হব। যার কারণে পরকালে পেতে হবে কঠিন শাস্তি। আমরা আমাদের চিন্তা শক্তি দিয়ে নিজেদের প্রতিটি কাজের ভালো-মন্দের বিচার করার ক্ষমতা রাখি। তাই আত্মসমালোচনা করা কোনো কঠিন কাজ নয় বরং আত্মসমালোচনায় ইহকাল হবে সুন্দর ও পরকালের হিসাব-নিকাশ একদম সহজ হয়ে যাবে।
আমরা কোনো কাজের সংকল্প করার আগেই সে কাজটি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে যে, কাজটি ইহকাল ও পরকালের জীবনের জন্য উত্তম না ক্ষতিকর? কাজটি কি হারাম, না হালাল? কাজটিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে, না অসন্তুষ্টি? অতঃপর যখন কাজটি উত্তম হবে, তখন আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে কাজে নেমে পড়তে হবে। আর কাজটি খারাপ হলে একইভাবে পূর্ণ একনিষ্ঠতা ও তাওয়াক্কুলের সঙ্গে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিদিন সকালে আন্তরিকভাবে প্রত্যয় দীপ্ত হতে হবে, যেন সারা দিন সৎ আমলের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে অসৎ আমল থেকে বিরত থাকা যায়। আবার দিন শেষে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারা দিনের সব কাজকর্মের ওপর আলোকপাত করতে হবে। যদি কোনো কথা বা কাজে কোনো ভুল বা দোষ থাকে, তার জন্য আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে অনুতপ্ত হতে হবে। ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ হতে বিরত থাকার প্রত্যয় রেখে তওবা করতে হবে। কারও সঙ্গে কোনো অন্যায় করলে, তার কাছে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। এভাবেই চলতে পারলেই নিজেকে সংশোধন করে পাপকর্ম হতে বিরত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে।
অনুরূপভাবে ইমাম শাফেঈ বলেন, ‘সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি সে-ই যে দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে দুনিয়া তাকে পরিত্যাগ করার পূর্বেই, কবরকে আলোকিত করে কবরে বসবাস করার পূর্বেই, স্বীয় প্রভুকে সন্তুষ্ট করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎলাভের পূর্বেই, জামা‘আতে সালাত আদায় করে তার উপর জামা‘আতে সালাত (অর্থাৎ জানাযার সালাত ) পঠিত হবার পূর্বেই, নিজের হিসাবে নিজেই গ্রহণ করে হিসাব দিবসে তার হিসাব গৃহীত হবার পূর্বেই’।

আত্নসমালোচনার গুরুত্ব
আত্ম সংশোধনের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল, আত্মসমালোচনা বা আত্মপর্যালোচনা। অর্থাৎ কেউ যদি নির্জনে-একান্ত একাকীত্বে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য, করণীয়-বর্জনীয়, সফলতা-ব্যর্থতা এবং দোষত্রুটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও হিসাব-নিকাশ করে তাহলে তার কাছে তার নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়বে। আল্লাহ তা’আলা প্রতিটি মানুষকে বিবেক নামক এটি আয়না দিয়েছেন। মানুষ যদি সে আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করায় তাহলে তার মধ্যে কোথায় কী সমস্যা আছে তা সে পরিষ্কার দেখতে পায়।
আরবিতে একটা প্রবাদ আছে: “সবচেয়ে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বা বিচক্ষণ মানুষ হল ঐ ব্যক্তি যে নিজের দোষ-ত্রুটি দেখে।” তাই আমাদের কর্তব্য, নিজেদের দোষগুলো অনুসন্ধান করা এবং মৃত্যু দূত আমাদের দরজায় করাঘাত করার পূর্বে তওবা করে নিজেদেরকে সংশোধন করা। কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনায় আত্মসমালোনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয় সুস্পষ্ট। দুনিয়া ও পরকালীন জীবনের সফলতায় আত্মসমালোচনার বিকল্প নেই।
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা মানুষকে নিজের কাজে প্রতি সতর্ক থাকার বিষয়টি একাধিক আয়াতে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন-
১. আল্লাহ তাআলা বলেন: “বরং মানুষ নিজেই নিজের ব্যাপারে খুব ভালো জানে।” (কিয়ামাহ: ১৪)
২. ‘মুহাসাবাতুন নাফস’ বা আত্মসমালোচনাকে প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَلاَ تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিত আগামী কালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কি প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক’ (হাশর : ১৮)।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল আলামীন প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলছেন, তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা কর্তব্য যে, আগামী দিনের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, না-কি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? (ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কিতাব আল- আরাবিইয়াহ, ৩য় প্রকাশ, ১৯৯৬), ১/১৮৭ পৃঃ)
৩. অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আত্মসমালোচনাকারীদের প্রসংশা করে বলেন, ‘যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে, তাদের উপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে’। (আ‘রাফ : ২০১)
৪. ‘পাঠ কর; তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা)। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট।’ (সুরা বনি-ইসরাঈল : ১৪)
৫. ‘বরং মানুষ নিজেই নিজের ব্যাপারে খুব ভালো জানে।’ (কেয়ামাহ : ১৪)
৬. সে দিন তোমাদেরকে (আল্লাহর সামনে হিসাব-নিকাশ ও প্রতিদান প্রদানের জন্য) পেশ করা হবে, তখন তোমাদের কোনো কিছুই গোপন থাকবে না।’ (আল-হাক্কাহ : ১৮)
আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে ওমর (রাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হবার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না’। (তিরমিযী : ২৪৫৯, সনদ মওকূফ সহীহ)
অনুরূপভাবে হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার পরিচালক হিসাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করবে, ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই তাদের হিসাব হালকা হবে। আর যারা এ থেকে বিরত থাকবে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের হিসাব কঠিন হবে। (ইগাছাতুল লাহফান (মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, তাবি : ১/৭৯)
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি সে-ই যে দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে দুনিয়া তাকে পরিত্যাগ করার পূর্বেই। কবরকে আলোকিত করে কবরে বসবাস করার পূর্বেই। স্বীয় প্রভুকে সন্তুষ্ট করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভের পূর্বেই, জামা‘আতে সালাত আদায় করে তার উপর জামা‘আতে সালাত (অর্থাৎ জানাযার সালাত ) পঠিত হবার পূর্বেই। নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করে হিসাব দিবসে তার হিসাব গ্রহণ করার পূর্বেই’।
মালেক বিন দীনার (রহঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর রহম ঐ বান্দার প্রতি যে তার নফসকে (কোন মন্দ কাজের পর) বলে, তুমি কি এর সাথী নও? তুমি কি এর সঙ্গী নও? অতঃপর তাকে নিন্দা করে, অতঃপর তার লাগাম টেনে ধরে, অতঃপর আল্লাহর কিতাবের উপরে তাকে আটকে রাখে তখন সে হয় তার পরিচালক’। (ইগাছাতুল লাহফান ১/৭৯)
মাইমুন বিন মিহরান বলেন , ‘কোন বান্দা প্রকৃত মুত্তাক্বী হতে পারে না, যতক্ষণ না অন্তরের হিসাব করে, এমনকি অংশীদারের চেয়েও বেশী শক্ত করে হিসাব করে’। (তদেব)
১. দ্বীনের উপর ইস্তিকামাত অর্জন : আত্মসমালোচনা দ্বীনের প্রতি ইস্তিক্বামাত অর্জন করা তথা অটল থাকার সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিছ বান্দাদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। ইমাম গাযালী বলেন, ‘মুহাসাবাকারী ব্যক্তির উদাহরণ হল একজন ব্যবসায়ীর মত, যে পরকালীন জীবনের জন্য ব্যবসা করে। এ ব্যবসায় দুনিয়াবী মুনাফা হিসাবে সে পেতে পারে আত্মিক পরিশুদ্ধি আর পরকালীন মুনাফা হিসাবে পেতে পারে জান্নাতুল ফেরদাউস এবং সিদরাতুল মুনতাহায় আম্বিয়ায়ে কেরামসহ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের চিরন্তন সাহচর্য। তাই দুনিয়াবী ব্যবসায় সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের চেয়ে পরকালীন ব্যবসার সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ করা বহু বহু গুণ বেশী গুরুত্বপূর্ণ’ । (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/৩৯৪ পৃঃ)
২. পরকালীন জওয়াবদিহিতা সৃষ্টি : আত্মসমালোচনার সবচেয়ে বড় উপকার হল- এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে পরকালীন জওয়াবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি হয়। যে ব্যক্তি তার প্রতিটি কর্মে আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করার অনুভূতি রাখে, সে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর একজন মুখলিছ ও মুত্তাকী বান্দায় পরিণত হয়। উমর (রাঃ) রাত হলে মাটিতে আক্ষেপের সাথে পদাঘাত করে নিজেকে বলতেন, ‘বল! আজ তুমি কি করেছ?’। মাইমুন বিন মেহরান বলতেন, ‘মুত্তাকী ব্যক্তি সেই যে নিজের জওয়াবদিহিতা এমন কঠোরভাবে গ্রহণ করে যেন সে একজন অত্যাচারী শাসক’। (ইহয়াউ উলূম ৩/৩৯৫)
৩. দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি : আত্মসমালোচনা মানুষকে নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। ফলে সে নিজের পারিবারিক ও সামাজিক কর্তব্যসমূহ পালনে বহুগুণ বেশী তৎপর হতে পারে।
৪. তওবার সুযোগ লাভ : আত্মসমালোচনা পাপ থেকে তওবা করার সর্বোত্তম মাধ্যম। যে ব্যক্তি নিজের সমালোচনা করতে জানে সে আল্লাহর হক্ব আদায়ে যেসব ত্রুটি করেছে, তা তার সামনে যখনই প্রকাশিত হয় তখনই সে তওবা করার সুযোগ পায়।
৫. ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন : আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের ত্রুটিগুলো ধরা যায়। ফলে আত্মসংশোধনের মাধ্যমে নিজেকে ভবিষ্যতে আরো উন্নতরূপে গড়ে তোলা সম্ভব হয়। জীবনের প্রতিটি স্তরে আত্মসমালোচনা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা অবলম্বন করার অর্থ স্বীয় ভবিষ্যতকে অর্থপূর্ণ করে তোলা এবং জীবনের উদ্দেশ্যকে সুষ্ঠু ও সফলভাবে বাস্তবায়ন করা। যা তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে বিজয়লাভ অনিবার্য করে তোলে।
৬. নিয়তের পরিশুদ্ধি : আত্মসমালোচনা এমন একটি অভ্যাস যা বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার একটি গোপন লেনদেনের মত। ফলে তাতে আত্মার পবিত্রতা ও নিয়তের পরিশুদ্ধি অর্জিত হয় এবং অন্তর শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই ইখলাছপূর্ণ হয়ে ওঠে।
৭. জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি : আত্মসমালোচনা জীবনের লক্ষ্যকে সবসময় সজীব করে রাখে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে আমরা অনুভব করতে পারি আমাদেরকে এই পৃথিবীর বুকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। পার্থিব জীবন শুধু খাওয়া-দাওয়া, হাসি-ঠাট্টার নয়, এ জীবনের পরবর্তী যে অনন্ত এক জীবন, তার জন্য যে আমাদের সবসময় প্রস্ত্তত থাকতে হবে- আত্মসমালোচনা আমাদেরকে সর্বক্ষণ তা স্মরণ করায়।
৮. আমলনামায় সমৃদ্ধি অর্জন : সারাদিন অনাহারে থেকে সিয়াম পালন, রাতের ঘুম পরিত্যাগ করে তাহাজ্জুদ আদায়, কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় ইত্যাদি ফরয ও নফল ইবাদত মুহাসাবার এক একটি মহৎ ফলাফল। ইমাম গাযালী বলেন, ‘ফজরের সালাত আদায়ের পর মানুষের উচিৎ নিজের অন্তরের উপর ব্যবসায়ীদের মত শর্তারোপ করা এবং বলা যে- হে অন্তর! আমার একমাত্র পুঁজি আমার বয়স। বয়স যতই অতিক্রান্ত হচ্ছে ততই আমার পুঁজি নিঃশেষ হয়ে আসছে। আর তার সাথে ফিকে হয়ে আসছে অধিক লাভের আশাও। আজ আরো একটি নতুন দিন, আল্লাহ আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আমার ব্যবসায় অধিক উন্নতি সাধনের জন্য। যদি আল্লাহ আজ আমার মৃত্যু দান করেন তবে তাঁর কাছে আমার কামনা থাকবে একটি দিনের জন্য হলেও দুনিয়ায় ফেরৎ যাওয়ার, যেন আমার আমলনামা আরও সমৃদ্ধ করতে পারি। সুতরাং আমার আত্মা! তুমি আপন হিসাব গ্রহণ কর, কেননা তোমার মৃত্যু হবেই, তারপর হবে পুনরুজ্জীবন। তাই সাবধান! আবারো সাবধান! দিনটি তুমি নষ্ট করো না(ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/৩৯৪ পৃঃ)।
৯. ছোট ও বড় পাপ থেকে রক্ষা পাওয়া : মুহাসাবার ফলে কোন পাপ দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি করতে গেলে বিবেকে বাধা দেয়। ফলে পাপের কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।
১০. দুনিয়াবী জীবনের চাহিদা হ্রাস : মুহাসাবার ফলে তাক্বদীরের প্রতি সুস্থির বিশ্বাস জন্ম নেয়। ফলে দুনিয়াবী যিন্দেগীর দৈনন্দিন অভাব- অভিযোগ আমাদেরকে বেকায়দায় ফেলতে পারে না। কোন অলীক কামনা-বাসনা আমাদের বিচলিত করে না। ফলে দুনিয়াবী ধন-সম্পদ, পদবী- মর্যাদা লাভের জন্য আর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ারও প্রয়োজন অনুভূত হয় না।

আত্নসমালোচনার উপকারিতা
১. নিজের দোষ-ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল-ত্রুটি জানতে পারে। ফলে তার হৃদয় ভাল কাজের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে।
২. আত্মসমালোচনা দ্বীনের উপর দৃঢ়তা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিছ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে।
৩. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নেয়ামতসমূহ, অধিকারসমূহ জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নেয়ামত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
৪. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে পরকালীন জওয়াবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি হয়। মাইমুন বিন মিহরান বলতেন, ‘মুত্তাক্বী ব্যক্তি সেই, যে নিজের জওয়াবদিহিতা এমন কঠোরভাবে গ্রহণ করে যেন সে একজন অত্যাচারী শাসক’। (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন : ৩/৩৯৫)
৫. আত্মসমালোচনা জীবনের লক্ষ্যকে সবসময় সজীব করে রাখে। এর মাধ্যমে আমরা অনুভব করতে পারি আমাদেরকে এই পৃথিবীর বুকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। পার্থিব জীবন শুধু খাওয়া-দাওয়া, হাসি-ঠাট্টার নয়, এ জীবনের পরবর্তী যে অনন্ত এক জীবন, তার জন্য যে আমাদের সবসময় প্রস্ত্তত থাকতে হবে, আত্মসমালোচনা আমাদেরকে সর্বক্ষণ তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
৬. মুহাসাবার ফলে কোন পাপ দ্বিতীয়বার করতে গেলে বিবেকে বাধা দেয়। ফলে পাপের কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।
আত্নসমালোচনা না করার ফলাফল
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, মুহাসাবা পরিত্যাগ করার অর্থ কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলা। এতে মানুষের অন্তর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ মুহাসাবা পরিত্যাগ করার ফলে দ্বীনের প্রতি তার শিথিলতা চলে আসে, যা তাকে নিশ্চিতভাবেই দুনিয়াবী জীবন ও পরকালীন জীবনে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কেবলমাত্র আত্মগর্বী, প্রতারিত আত্মাই মুহাসাবা পরিত্যাগ করতে পারে। ফলশ্রুতিতে সে কোন কিছুর পরিণাম চিন্তা করে না। সমস্ত পাপ তার কাছে অত্যন্ত সহজ বিষয় হয়ে যায়। অবশেষে একসময় পাপ থেকে বেরিয়ে আসাটা তার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কখনো যদি সে সৎপথের সন্ধান পায়ও, তবুও সে তার অন্যায় অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করে। (ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান ১/৮২)

সালাফে সালেহীনের আত্নসমালোচনার দৃষ্টান্ত
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, অর্থাৎ ‘আমি একবার ওমর (রাঃ)-এর সাথে বের হ’লাম। পথিমধ্যে তিনি একটি বাগানে ঢুকলেন। এমতাবস্থায় আমার ও তাঁর মধ্যে বাগানের একটি দেয়াল আড়াল হয়েছিল। আমি তাঁকে বলতে শুনলাম, তিনি নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব! আমীরুল মুমিনীন সাবাস! সাবাস! আল্লাহর শপথ! হে ইবনুল খাত্তাব! অবশ্যই তোমাকে আল্লাহর ভয়ে ভীত হতে হবে। অন্যথা তিনি তোমাকে শাস্তি দিবেন’। (মুওয়াত্ত্বা মালেক : ৩৬৩৮, আল-বিদায়াহ : ৭/১৩৫)
হযরত ওসমান (রাঃ) যখন কোন কবরের নিকট দাঁড়াতেন তখন তিনি কাঁদতেন। যাতে তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাকে বলা হল জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনায় আপনি কাঁদেন না, অথচ কবর দেখলে আপনি কাঁদেন কেন? জবাবে তিনি বললেন, রাসূল (ছঃ) বলেছেন যে, ‘কবর হল পরকালের পথের প্রথম মনযিল। যদি এখানে কেউ মুক্তি পায় তাহলে পরের মনযিলগুলি তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর যদি এখানে মুক্তি না পায় তাহলে পরেরগুলি আরও কঠিন হয়ে যায়’। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আমি কবরের চাইতে ভয়ংকর কোন দৃশ্য আর দেখিনি’। (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত : ১৩২, ’কবরের আযাবের প্রমাণ’ অনুচ্ছেদ)
হযরত বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। হঠাৎ তিনি একদল লোককে দেখতে পেয়ে বললেন, ওরা কি উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে? একজন বললেন, এরা একটি কবর খুড়ছে। রাবী বলেন, একথা শুনে রাসূল (সাঃ) আতংকিত হয়ে পড়লেন এবং সঙ্গী-সাথীদের আগে দ্রুতবেগে কবরের নিকটে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসলেন। রাবী বলেন, তিনি কি করছেন তা দেখার জন্য আমি তাঁর মুখোমুখি বসলাম। তিনি কেঁদে ফেললেন, এমনকি অশ্রুতে মাটি ভিজে গেল। অতঃপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে বসে বললেন, হে ভাইয়েরা! এ রকম দিবসের জন্য রসদ প্রস্ত্তত রেখো’। (আহমাদ, সিলসিলা ছহীহাহ : ১৭৫১)
হযরত হানযালা আল-উসাইদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা তিনি কাঁদতে কাঁদতে আবুবকর (রাঃ)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে হানযালা! তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেন, হে আবু বকর! হানাযালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে। আমরা যখন রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে অবস্থান করি এবং তিনি আমাদের জান্নাত-জাহান্নাম স্মরণে নছীহত করেন, তখন মনে হয় যেন আমরা সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে দেখছি। কিন্তু বাড়ী ফিরে আসার পর স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং অনেক কিছুই ভুলে যাই। হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমাদেরও তো একই অবস্থা! চল আমরা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে যাই। অতঃপর আমরা সেদিকে রওয়ানা হলাম। রাসূল (সাঃ) তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হানযালা! কি খবর? তখন উত্তরে তিনি অনুরূপ বক্তব্যই পেশ করলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, আমার নিকট থেকে তোমরা যে অবস্থায় প্রস্থান কর, সর্বদা যদি সেই অবস্থায় থাকতে তাহলে ফেরেশতারা অবশ্যই তোমাদের মজলিসে, বিছানায় এবং পথে-ঘাটে তোমাদের সাথে মুছাফাহা করত। হে হানযালা! সেই অবস্থা তো সময় সময় হয়েই থাকে’।(মুসলিম হা/২৭৫০, মিশকাত : ২২৬৮)
উপরোক্ত হাদীসগুলি থেকে আত্মসমালোচনায় গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় এবং পরকালের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণের আবশ্যকতা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।
আত্নসমালোচনা করতে ব্যথ হওয়ার কারণ
আত্মসমালোচনা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণসমূহ:
১. পাপ : কবীরা গুনাহ করা অথবা কোন ছগীরা গুনাহের উপর অভ্যস্ত থাকার কারণে মানুষের অন্তরে মরিচা পড়ে যায়। পাপের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পায় অন্তরের মরিচাও তত বিস্তৃত হয়। ফলে মুহাসাবা তথা আত্মসমালোচনার অনুভূতি মানুষের মন থেকে উঠে যেতে থাকে। একপর্যায়ে এমনকি কোন আমলটি খারাপ আর কোন আমলটি ভাল তা পার্থক্য করার প্রয়োজনীয়তাও সে হারিয়ে ফেলে।
২. দুনিয়াবী ব্যস্ততা : যে হালাল ও মুবাহ কাজ মানুষকে দুনিয়াবী যিন্দেগীতে বেশী ব্যস্ত রাখে এবং পরকালীন জীবনে নজর দেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয় সেই কাজ তার আত্মসমালোচনার অনুভূতিও কমিয়ে দেয়।
৩. আল্লাহর বড়ত্ব ও তার প্রতি আনুগত্যের মাহাত্ম্য বুঝতে ব্যর্থ হওয়া : যদি আমরা তা যথার্থভাবে বুঝতে পারতাম, তবে অবশ্যই আমাদের প্রতি আল্লাহর অপরিসীম নেয়ামত ও তার বিপরীতে আমাদের চরম অকৃতজ্ঞতার লজ্জাকর অবস্থান তুলনা করতে পারতাম। তুলনা করতে পারতাম- আমাদের প্রতি আল্লাহর হক্ব কী কী আর তার কতটুকু আমরা প্রতিপালন করছি এবং আখেরাতের জন্য সঞ্চয় করছি।
৪. নিজের প্রতি সুধারণা রাখা : একজন মুমিনের জন্য এটা এক বড় ধরনের ঘাতক রোগ। কেননা নিজের প্রতি সুধারণা আপন ত্রুটিসমূহ থেকে মানুষকে বেখেয়াল করে দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন করে তোলে। যদি সে নিজের ত্রুটি ধরতেই না পারে তবে কিভাবে সে তার চিকিৎসা করবে? এজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘তুমি সারারাত ঘুমিয়ে যদি অনুতপ্ত অবস্থায় সকাল কর এটাই অধিক ভাল তার থেকে, যদি তুমি সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় কর আর আত্মগর্ব নিয়ে সকাল কর।
৫. আখেরাতকে স্মরণ না করা : দুনিয়াবী মাল- সম্পদ আর পদমর্যাদার লোভে আখেরাতের অনন্ত যিন্দেগীকে ভুলে থাকার কারণে মানুষ মুহাসাবার অভ্যাস হারিয়ে ফেলে।
আত্নসমালোচনায় অভ্যস্থ হওয়ার উপায়
বাস্তবে কিভাবে আত্মসমালোচনা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে, সে প্রসঙ্গে ইসলামি স্কলাররা বলেন, মুমিন ব্যক্তিকে এমন চিন্তা বা ধারণা প্রলুব্ধ করতে পারে, ‘আল্লাহর কসম, এই কাজটা তো চমৎকার। আমি করতে চাই। কিন্তু না, কক্ষনো না। মন্দ কাজ, দূর হও! মন্দ কিছু করা যে আমার জন্য হারাম। ’ এটা আত্মসমালোচনা এবং কাজ করে ফেলার আগের দরকারি ভাবনা।
কোনো ঈমানদার অসাবধানতাবশত কিছু একটা করে ফেলতে পারেন। তখন তিনি নিজেকে বলেন, ‘তুমি এটা কী করলে? আল্লাহর কসম, এ কাজের কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছি না। আমি ইনশাআল্লাহ আর কখনও এটা করব না। ’ এটাও আত্মসমালোচনা এবং এটা কাজ করার পরের মূল্যায়ন।
১. তাক্বওয়ার অনুভূতি জাগ্রত করা : আত্মসমালোচনার জন্য সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল আল্লাহভীতি অর্জন করা। আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা, তাঁর মহত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, সর্বোপরি সর্বময় ক্ষমতার প্রতি ভীতির সাথে অবনত হওয়া পাপপ্রবণ আত্মাকে যেমন প্রশান্ত করে, তেমনি বিবেকের শাসনকে করে প্রবল। তাই জনৈক মনীষী বলেন, ‘তোমার পাপকাজটি কত ছোট সে চিন্তা করো না, বরং চিন্তা করো তুমি কত বড় ও কত মহান একজন সত্তার অবাধ্যতা করেছ।’
২. আমলনামার হিসাব প্রদানের অনুভূতি জাগ্রত করা : এই অনুভূতি নিজের মধ্যে জাগ্রত করা যে, যদি আমার আমলনামা দুনিয়াতেই আমি হিসাব করে নেই তবে কিয়ামতের দিন আমার হিসাব প্রদান সহজ হয়ে যাবে; আর যদি আত্মসমালোচনায় অবহেলা করি তার অর্থ হবে- কিয়ামত দিবসের হিসাব কঠিন হয়ে যাওয়া। ইবনুল কাইয়িম বলেন, ‘তোমার আত্মাকে ক্রয় কর আজই, কেননা আজ বাজার সচল, দামও আয়ত্বের মধ্যে, পণ্য-সামগ্রী অনেক সস্তা। অচিরেই এই বাজার ও এই পণ্যসামগ্রীর উপর এমন দিন আসছে যেদিন সেখান থেকে ক্রয়ের আর কোনই সুযোগ পাবে না। কেননা সেদিন হল হালখাতার দিন’ (লাভ-ক্ষতি হিসাবের দিন) (আল-ফাওয়ায়েদ, পৃঃ ৪৯)।
৩. জান্নাত ও জাহান্নামকে স্মরণ : মুহাসাবা করার অর্থ জান্নাতপ্রাপ্তি এবং আল্লাহর নৈকট্যলাভের সৌভাগ্য অর্জন আর মুহাসাবা না করার অর্থ জাহান্নামের রাস্তায় ধাবমান হওয়া এবং আল্লাহর নৈকট্য থেকে বঞ্চিত হওয়া- এই উপলব্ধি অন্তরের গভীরে বদ্ধমূল করে রাখতে হবে। আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলতেন, ‘তুমি যখন সন্ধ্যা করবে তখন সকাল করার আশা করো না এবং যখন তুমি সকাল করবে তখন সন্ধা করার আশা করো না। অতএব অসুস্থতার পূর্বে তুমি তোমার সুস্থতার সুযোগ গ্রহণ কর এবং মৃত্যু আসার পূর্বেই জীবনটাকে সুযোগ হিসাবে নাও’ (বুখারী)।
৪. আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের জীবনী অধ্যয়ন করা : আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং সালাফে ছালেহীন মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁদের মহত্তম জীবনাদর্শ আমাদেরকে সবসময় চেতনাদীপ্ত করে তোলে। তাঁরাই আমাদের চেতনার বাতিঘর। তাই তাঁদের জীবনেতিহাস জানতে হবে এবং তাদের জীবনাদর্শকে আমাদের জন্য একমাত্র আদর্শ মনে করতে হবে। আর এর মাধ্যমেই নিজেকে ক্রমাগত উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় আমরা মুহাসাবায় অভ্যস্ত হতে পারি। তাছাড়া মুহাসাবাকারী ব্যক্তির সাহচর্যে থাকাও মুহাসাবা করার জন্য খুব সহায়ক।
৫. আত্মা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা : অর্থাৎ নফসের গতি-প্রকৃতি, নফসের পাতানো ফাঁদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা। নফস যে সামান্য সুযোগ পেলেই অকল্যাণ ও অনৈতিক কাজে প্ররোচিত করে তা যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি তবে নফসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মানসিক শক্তি তৈরী হয়।
৬. দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন : শরী‘আতের বিধি-বিধান তথা হক্ব-বাতিল, ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা।
৭. নিজ সম্পর্কে সুধারণা পরিত্যাগ করা : এ ভয়াবহ রোগটির বিষময় ফলাফল এমনই যে, নিজের ভাল কাজকেই খারাপ আর খারাপ কাজকেই ভাল মনে হতে শুরু করে। এজন্য ইবনুল কাইয়িম বলেন, ‘নিজের প্রতি যে ব্যক্তি সুধারণা রাখে মূলতঃ সে নিজ সম্পর্কে অজ্ঞতম ব্যক্তি’। তাই নিজেকে সঠিক ও উঁচুস্তরের লোক মনে করে আত্মতৃপ্তি বোধ করা যাবে না। নতুবা নিজেকে অগ্রগামী করার তো সুযোগ থাকবেই না, বরং অচিরেই অনিবার্য ব্যর্থতার মুখোমখি হতে হবে।
৮. নিজের আমলনামা পরিমাপ করা : নিজের সৎআমল ও অসৎ আমলকে ছওয়াব ও পাপের মাপকাঠিতে পরিমাপ করা এবং কোনটির ওজন ও প্রকৃতি কেমন তা যাচাই করা। এর ফলে মুহাসাবার অনুভূতি বিশেষভাবে জাগ্রত হবে। সবসময় মনে রাখতে হবে হাশরের ময়দানে আমাদের কৃত অণু পরিমাণ পুণ্য এবং অণু পরিমাণ পাপও আমাদের আমলনামায় প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে। (যিলযাল : ৭-৮)

উপসংহার
পরিশেষে বলব, আত্মসমালোচনা আমাদের পার্থিব জীবনে দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে, পরকালীন জওয়াবদিহিতার চিন্তা বৃদ্ধি করে এবং বিবেককে শাণিত করে। করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সাহায্য করে। সর্বোপরি জীবনের উচ্চতম লক্ষ্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠার কাজে সর্বদা প্রহরীর মত দায়িত্ব পালন করে।
আত্মসমালোচনা, অন্যের ত্রুটি ধরার পূর্বে নিজের ত্রুটি ধরতে আমাদের শিক্ষা দেয়। অন্যের নিন্দা করার পূর্বে নিজের মধ্যে বিদ্যমান খারাপ দূর করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর দ্বারা আমরা নিজেদেরকে যেমন সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারব, তেমনি অন্যের মাঝে ভুল দেখতে পেলে ভালবাসা ও স্নেহের সাথে তাকেও শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারব। এভাবে সমাজ পরিণত হবে পারস্পরিক সহযোগিতা, ভালবাসা ও সৌহার্দ্যে পূর্ণ এক শান্তিময় সমাজ।
অতএব আসুন! আমরা নিজেদেরকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসাবে, প্রকৃত মুসলমান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে ফেলি। নিজেকে সচ্চরিত্রবান, নীতিবান ও আদর্শবান হিসাবে গড়ে তুলি। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত, সারা দিনের কার্য শেষে রাত্রিতে যখন ঘুমাতে যাই, তখন কিছুটা সময় নিজেকে নিজে দেই, আত্মসমালোচনা করি। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, আজ সারা দিন আমি কী কী করেছি? নামাজ কাজা করেছি কি না? কয়টা মিথ্যা কথা বলেছি? আল্লাহকে কয়বার স্মরণ করেছি? কারো সাথে অন্যায় করেছি কি? কয়টা ভালো কাজ করেছি? আর কয়টা মন্দ কাজ করেছি? মুমিন মুসলমানের উচিত, প্রতিদিন নিয়মিত নিজের আমল-ইবাদত ও কাজ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা তথা আত্মসমালোচনা চালিয়ে যাওয়া। এটি মানুষকে সঠিক পথের দিকে নিয়ে যাবে। সঠিকভাবে আত্মসমালোচনা করতে পারলে নিশ্চিতভাবে আশা যায় যে, তার দুনিয়ার জীবন যেমন সুন্দর হবে ঠিক তেমনি আখিরাতের জীবন হবে আরও বেশি সাফল্যমণ্ডিত। তাই আসুন দুনিয়াকে পরিত্যাগ করি দুনিয়া আপনাকে পরিত্যাগ করার আগে, কবরকে আলোকিত করি কবরে বসবাস করার পূর্বে, স্বীয় প্রভূকে সন্তুষ্ট করি তার সাথে সাক্ষাৎ করার পূর্বে, জামায়াতে নামাজ আদায় করি আপনার উপর জায়নামাজ আদায় করার পূর্বে, নিজের হিসাব নিজেই গ্রহন করি হিসাব দিবসে হিসাব গ্রহণ করার পূর্বে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নিজেদের দোষ-ত্রুটি ও ভুলগুলো থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। নিজেদের ভুলগুলো খুঁজে বের করে তা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। সবাইকে সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সবসময় মনে রাখুন রাসূল (সাঃ)-এর সেই অবিস্মরণীয় বাণী- ‘তুমি দুনিয়ার বুকে এমনভাবে বসবাস কর যেন তুমি একজন মুসাফির অথবা পথচারী’ (বুখারী, মিশকাত : ৫২৭৪)।





সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১২:১৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×