somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বান্দার চোখের পানি আল্লাহর কাছে প্রিয়

২১ শে এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আল্লাহ তা’আলার কাছে বান্দার চোখের পানির দাম দুনিয়ার যাবতীয় নিয়ামতের চেয়ে বড় দামী। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার ভয়ে কান্নাকাটি করে হাদীসের ঘোষণায় তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়। এক ফোঁটা পানি দিয়ে গোটা জীবনের সব গুনাহ ধুয়ে-মুছে সাফ করে ফেলা সম্ভব। আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয়ে মুমিনের হৃদয়ের আকাশ ভেদ করে যে অশ্রুকণা নয়নের কোণে এসে গড়িয়ে পড়ে, সেই পানির মতো শক্তিশালী পৃথিবীতে আর কিছু নেই। এই অশ্রু বান্দাকে প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়তা করে। মহান আল্লাহর ক্রোধ থেকে বান্দার মুক্ত হওয়ার পথকে সুগম করে। কঠিন বিপদ থেকে বান্দাকে মুক্ত করে। পৃথিবীর সব পানি দিয়ে যেখানে জাহান্নামের একটি অগ্নিকণা নেভানো সম্ভব নয়, সেখানে মাত্র এক ফোঁটা অশ্রুজলেই জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনকে মুহূর্তে নিভিয়ে ফেলা সম্ভব। যে চোখ মহান আল্লাহর ভয়ে কাঁদে সে চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে গিয়ে যেমন শরীরের তাজা রক্তের বিনিময়ে জান্নাত কেনা যায়, তেমনি মহান আল্লাহর দরবারে এক ফোঁটা অশ্রু ঢেলেও জান্নাত কেনা যায়। আমরা অনেকে মনে করি, আমরা পাপের সাগরে ডুবে গেছি, আল্লাহ আমাদের হয়তো ক্ষমা করবেন না, আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করবেন না; এগুলো ভুল ধারণা। আল্লাহ রহমানুর রহিম। তিনি দয়ার সাগর। বান্দার এক বিন্দু অনুশোচনার অশ্রু তিনি সহ্য করতে পারেন না। তাই এক ফোঁটা অশ্রু দিয়েই তিনি বান্দার গুনাহ ধুয়ে মুছে সাফ করে দেন। বান্দার জন্য ওয়াজিব হয়ে থাকা জাহান্নামকে তার জন্য চিরতরে হারাম করে দেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) মত নবী পত্নী দিবারাত্রি ইবাদতে মশগুল থাকা সত্ত্বেও আখেরাতের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাননি বরং রীতিমত কাঁদতেন। অথচ তাঁর জীবন এতই পুতঃপবিত্র ছিল যে, স্বয়ং আল্লাহ তার কাছে সালাম পাঠিয়েছেন এবং তার ব্যাপারেই কুরআনের দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। বুঝা গেল দোযখের আগুনের ভায়বহতার কথা স্মরণ করে অশ্রুসজল হওয়া স্বতন্ত্র একটি আমল। এটি আল্লাহর অধিক পছন্দনীয় আমল।
কুরআনের ভাষ্যঃ
১. আল্লাহ পাক কুরআন পাকে বলেন, “যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে , তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি ? তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে , অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” (হাদিদ : ১৬)
২. আল্লাহ পাক কুরআন পাকে বলেন, “যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ারদেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে।” (আনফাল : ২)
৩. কুরআনে কারীমের আল্লাহ তা’আলা বলেন, যারা তাদের রবের কাছে ফিরে যাবে এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত কম্পিত হৃদয়ে, তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী থাকে। (মু’মিনূন : ৬০-৬১)
৪. পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এরাই তারা, নবীদের মধ্যে যাদের আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন আদমের বংশ থেকে এবং যাদের আমি নুহের সঙ্গে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম; ইবরাহিম ও ইসমাইলের বংশোদ্ভূত এবং যাদের আমি পথনির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম, তাদের কাছে দয়াময়ের আয়াত তিলাওয়াত করা হলে তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ত কাঁদতে কাঁদতে।’ (মারইয়াম : ৫৮)
৫. কুরআনে বর্ণিত, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাকে জাহান্নাম অতিক্রম করতে হবে না। এটা তোমার পালনকর্তার অনিবার্য ফয়সালা”। (মারইয়াম : ৭১)
৬. মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ, এর পূর্বে যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন তা পাঠ করা হয়, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। তারা বলে, আমাদের প্রতিপালকই পবিত্রতম, আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই কার্যকরী হবে। তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে (সিজদায়) পড়ে এবং কান্নার শব্দ শুনে তাদের নিবিড় আনুগত্য আরো বৃদ্ধি পায় । (ইসরা : ১০৭-১০৯)
৭. মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় কথা শুনে আশ্চর্য হচ্ছ, হাসছ অথচ কাঁদছ না? আর গান-বাজনায় মত্ত হয়ে এসব এড়িয়ে যাচ্ছ। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ধুলায় লুটিয়ে পড় এবং তাঁর ইবাদতে মগ্ন হও”। (নাজম : ৫৯-৬২)
৮. তোমার প্রতিপালক বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি (তোমাদের ডাকে) সাড়া দেব। যারা অহংকারবশে আমার ‘ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে , নিশ্চিতই তারা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে”। (মু’মিন : ৬০)
৯. আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা বিনীতভাবে (কাকুতি-মিনতি সহকারে) ও সংগোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক, নিশ্চয় তিনি সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না”। (আরাফ: ৫৫)
১০. আল্লাহপাক বলেন, “আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, সশংকচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়। আর উদাসীনদের অন্তভুক্ত হবেন না। ”(আরাফ : ২০৫)
হাদীসের ভাষ্যঃ
১. হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি; তিনি বলেছেন, ‘দুটি চোখকে দোজখের আগুন স্পর্শ করবে না; প্রথম হলো সেই চোখ যা
আল্লাহর ভয়ে কাঁদে। আর দ্বিতীয় হলো সেই চোখ; যা আল্লাহর পথে (জিহাদে) পাহারায় রাতযাপন করে। (তিরমিযী, মিশকাত, আত-তারগীব )
২. হযরত আবু ওমামা বাহেলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘দুটি ফোঁটা ও দুটি চিহ্নের চেয়ে অধিক প্রিয় আল্লাহর কাছে অন্য আর কিছু নেই। (এক) আল্লাহর ভয়ে নিঃসৃত অশ্রু ফোঁটা। (দুই) আল্লাহর পথে নির্গত রক্তের ফোঁটা। আর চিহ্ন দুটি হলো আল্লাহর পথে জখমের চিহ্ন এবং আল্লাহর ফরয আদায় করতে করতে পায়ে বা কপালের চিহ্ন’। (তিরমিযী, আত-তারগীব)।
৩. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা সেদিন তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন; যেদিন তার ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে ওই ব্যক্তি একজন, যে নির্জনে আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ করে; আর তার চোখ থেকে পানি ঝরে।’ (বুখারী, মুসলিম,)
৪. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, যখন এ আয়াতটি নাজিল হয়। অর্থাৎ ‘তবে কি তোমরা এ কথায় বিস্ময়বোধ করছ? হাসছ এবং কান্না করছ না?!’ তখন আহলে সুফফার (একদল সাহাবা) সবাই ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলে কাঁদতে লাগলেন এবং তাদের চোখের পানি গাল বেয়ে বইতে লাগলো। তাঁদের কান্নার শব্দ শুনে প্রিয়নবি (সাঃ) ও কাঁদতে লাগলেন। তাঁর কান্না দেখে আমরাও কাঁদতে লাগলাম। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে কাঁদে; ওই ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। (তাফসিরে কুরতুবি)
৫. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ও আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাঃ) একদা এমন খুৎবা দিলেন, যার মত খুৎবা আমি কখনো শুনিনি। যদি তোমরা জানতে যা আমি জানি। তবে কম হাসতে আর বেশী কাঁদতে। তখন রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীগণ তাদের মুখ নিচু করে নিলেন এবং নীরবে কাঁদতে লাগলেন’। (বুখারী, সুনানে তিরমিজি,তারগীব)
৬. হযরত আবু জর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আমি যা দেখি তোমরা তা দেখো না। আর আমি যা শুনতে পাই তোমরা তা শুনতে পাও না। আসমান তো চড়চড় শব্দ করছে। আর সে এই শব্দ করার যোগ্য। তাতে এমন চার আঙুল পরিমাণ জায়গাও নেই, যেখানে কোনো ফেরেশতা আল্লাহর জন্য সেজদারত নেই। আল্লাহর শপথ! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহলে তোমরা খুব কম হাসতে, বেশি কাঁদতে এবং বিছানায় স্ত্রীদের উপভোগ করতে না। বাড়িঘর ছেড়ে পথে-প্রান্তরে বেরিয়ে পড়তে এবং চিৎকার করে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে যে, আল্লাহর শপথ! হায়, আমি যদি একটি গাছ হতাম এবং তা কেটে ফেলা হতো! ’। (ইবনে মাজাহ)
৭. হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর জাহান্নামে যাওয়া এরূপ অসম্ভব যেরূপ দোহনকৃত দুধ পুনরায় পালানে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। আর আল্লাহর পথের ধুলা ও জাহান্নামের ধোঁয়া কখনও একত্রিত হবে না’। (তিরমিযী, নাসায়ী, সুনানে আবু দাউদ, মিশকাত)
৮. হযরত কায়েস বিন আবু হাযেম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) স্বীয় স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে হঠাৎ কাঁদতে লাগলেন, তার সাথে তার স্ত্রীও কাঁদতে লাগলেন। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন কাঁদছ? স্ত্রী বললেন, তোমাকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না চলে এসেছে। স্বামী বললেন, (কান্নার কারণ হল) আমার আল্লাহর এ বাণীটি স্মরণ হল যে, (অর্থ) ‘তোমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই, যে জাহান্নামের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে না (মারইয়াম : ৭১) আর আমার জানা নেই যে, জাহান্নামের উপর স্থাপন করা পুলসিরাত অতিক্রম করার সময় আমি (দোযখ থেকে) রক্ষা পাব না পাব না।’(মুস্তাদরাকে হাকিম )
৯. ইরবাজ ইবনে সারিয়াহ (রহ.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার ফজর নামাজের পর আমাদের মর্মস্পর্শী ওয়াজ শোনালেন, যাতে আমাদের সবার চোখে পানি চলে এলো এবং অন্তর কেঁপে উঠল। এক ব্যক্তি বলল, এটা তো বিদায়ী ব্যক্তির নসিহতের মতো মনে হচ্ছে। হে আল্লাহর রাসূল! এখন আপনি আমাদের কী উপদেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন, আমি তোমাদের আল্লাহভীতির এবং (আমিরের আদেশ) শ্রবণ ও মান্য করার উপদেশ দিচ্ছি। (তিরমিজি ও আবু দাউদ)।
১০. হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি একবার দোযখের কথা স্মরণ করে কাঁদতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, কে তোমাকে কাঁদাল? আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমি দোযখের ভয়ে কাঁদছি। আপনি কি কেয়ামতের দিন আপনার পরিবারের কথা স্মরণ রাখবেন? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তিনটি স্থানে কেউ কাউকে স্মরণ রাখতে পারবে না- (এক) মীযানের (আমল পরিমাপক যন্ত্র) নিকট যতক্ষণ না জানতে পারবে যে, তার নেকীর পাল্লা ভারী হয়েছে না হালকা, (দুই) আমলনামা পেশ করার সময়, যখন বলা হবে আস তোমার আমলনামা পাঠ কর, যতক্ষণ না জানতে পারবে যে, তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হচ্ছে না পিঠের পিছন থেকে বাম হাতে। (তিন) পুলসিরাতের উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় যখন তা জাহান্নামের উপর স্থাপন করা হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ)
১১. একদা একজন আনসারী সাহাবী (রাঃ) তাহাজ্জুদের নামাযে খুব কেঁদে বলেছিলেন, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। তাঁর কথা শুনে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তুমি আজ ফেরেশতাদেরও কাঁদিয়ে ফেলেছ।
১২. হযরত মু‘আবিয়া ইবনু হায়দা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যাদের চক্ষু জাহান্নাম দেখবে না। (এক) যারা আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দেয়। (দুই) যারা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে। (তিন) যারা বেগানা নারীকে দেখে চক্ষু নীচু করে’। (আত-তারগীব)
১৩. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তিনজনের তৃতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! যদি তুমি জান যে, আমি এক দিনের জন্য একজন দিন মজুর নিয়েছিলাম। সে আমার অর্ধ দিন কাজ করেছিল। আমি তাকে মজুরি দিলাম। সে অসন্তুষ্ট হল এবং পারিশ্রমিক গ্রহণ করল না। আমি সে পয়সাকে বাড়ালাম। শেষ পর্যন্ত তা প্রচুর সম্পদে পরিণত হল। তারপর হঠাৎ একদিন এসে সে তার পারিশ্রমিক চাইল। আমি বললাম, এসব সম্পদ তুমি নিয়ে নাও। আমি ইচ্ছা করলে শুধু সেদিনের পারিশ্রমিক দিতে পারতাম। তুমি যদি মনে কর আমি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টির আশায় এবং তোমার শাস্তির ভয়ে করেছি, তাহলে তুমি আমাদের এ গর্তের মুখ থেকে পাথর সরিয়ে দাও। আল্লাহ পাথর সরিয়ে দিলেন এবং তারা বের হয়ে চলতে লাগল’ (বুখারী, আত-তারগীব)।
১৪. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে সে রাতে ইবাদত করে আর যে রাতে ইবাদত করে সে তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যায়। মনে রেখ নিশ্চয়ই আল্লাহর সম্পদ দামী। মনে রেখ নিশ্চয়ই আল্লাহর সম্পদ হচ্ছে জান্নাত’। (তিরমিযী, আত-তারগীব)
১৫. আল্লামা ইবনু কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘যখন চোখ আল্লাহর ভয়ে বিগলিত হয় না, তখন জেনে রেখো, হৃদয়ের কঠোরতার কারণে তা শুকিয়ে গেছে। আর কঠোর হৃদয় আল্লাহর থেকে সবচেয়ে দূরে।’ (বাদায়িউল ফাওয়াইদ)
১৬. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হৃদয়ের কঠোরতা থেকে মুক্তি চেয়ে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে, যা কোনো উপকারে আসে না; এমন হৃদয় থেকে, যা ভীত হয় না; এমন আত্মা থেকে, যা তৃপ্ত হয় না এবং এমন আহ্বান থেকে, যাতে সাড়া দেওয়া হয় না।’ (সহীহ মুসলিম)
১৭. একদা ইবনে উমার (রাঃ) সূরা মুত্বাফফিফীন পাঠ করলেন। তিনি যখন এই আয়াতে পৌঁছলে (অর্থাৎ, যেদিন সমস্ত মানুষ বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালকের সম্মুখে দণ্ডায়মান হবে।) তখন কাঁদতে লাগলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। অতঃপর অবশিষ্ট সূরা পড়া হতে বিরত থাকলেন। (কাইফা নাঈশু রামাযান)
১৮. উকবাহ্ ইবনু আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলামঃ (হে আল্লাহর রসূল!) মুক্তির উপায় কি? তিনি (সাঃ) বললেনঃ তুমি নিজের জিহ্বাকে আয়ত্তে রাখো, নিজের ঘরে পড়ে থাকো এবং নিজের পাপের জন্য ক্রন্দন করো। (জামে তিরমিজি)
১৯. হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেন, মানুষের অন্তর শক্ত হলে চোখ অশ্রুহীন হয়ে যায় আর অন্তর শক্ত হয় অধিক পরিমাণে গোনাহ করার কারণে।
২০. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা’আলার ভয়ে কান্না করা আমার নিকট এক হাজার দিরহাম সদকা করার চেয়েও অতি প্রিয়।
২১. হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, তোমরা ক্রন্দন কর, যদি ক্রন্দন না আসে তবে অন্তত উহার ভান কর। তোমরা যদি এর হাকিকত অবগত হতে, তবে এমনভাবে চিৎকার করতে যে, তোমাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো।
২২. হযরত আবু সুলাইমান দারানী (রাঃ) বলেন,কারো চোখ যদি অশ্রুতে পুর্ন হয়ে যায়,তবে কিয়ামতের দিন তার চেহারা অপমানিত হবে না।আর চোখের অশ্রু যদি গড়িয়ে পড়ে, তবে উহার প্রথম বিন্দু দ্বারাই বহু অগ্নি সমুদ্র শীতল হয়ে যাবে। অনুরুপভাবে কোন ব্যক্তি যদি কোন জামাতের সাথে ক্রন্দন করে তবে সেই জামাতের লোকদের কোন আজাব হবে না। তিনি আরো বলেন, কান্না আসে ভয়ের কারনে এবং আশা হয় শওকের কারনে।
২৩. হযরত কাব আহবার বলেন আল্লাহর শপথ! আমি একটি স্বর্নের পাহাড় দান করে দেয়া অপেক্ষা উত্তম মনে করি আল্লাহর ভয়ে এমনভাবে ক্রন্দন করাকে যেন চোখের পানি আমার চেহারাতে গড়িয়ে পড়ে।
২৪. হযরত আবু হাজেম রহিমাহুল্লাহ বলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবীজীর নিকট এসে একজনকে ক্রন্দরত দেখলেন। জিবরাঈল রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন সে কে? রাসূল (সাঃ) উত্তর দিলেন সে অমুক। তারপর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম বলেন আমরা ফেরেশতাকুল আদম সন্তানের সকল আমল পরিমাপ করতে পারি কান্না ব্যতীত। কারণ আল্লাহ তা’আলা এক ফোঁটা অশ্রুর কারণে জাহান্নামের আগুনের সাগর নিভিয়ে দেন। (তাফসিরে কুরতুবী)
২৫. ইবনু কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন আপনি আল্লাহর ভয়ে অনায়াসে কান্না করতে পারবেন, তখন বুঝবেন আপনার অন্তর ঠিক আছে। মন এখনো নরম,শক্ত ও রুক্ষ হয়নি। আর যদি কান্না না করতে পারেন বুঝে নিবেন আপনার অন্তর শক্ত হয়ে গেছে, মন মরে গেছে। কেননা হাদিসের ভাষ্যমতে শক্ত ও রুক্ষ অন্তরের মানুষ আল্লাহর থেকে সবচে বেশি দূরবর্তী।
২৬. বিখ্যাত বুযুর্গ হযরত ফোযায়েল (রহঃ) বলেন আল্লাহর ভয় যাবতীয় নেক কর্মের দিক নির্দেশ করে। হযরত শিবলী (রহঃ) এর কথা কে না জানে তিনি বলেন, আমি যখনই আল্লাহকে ভয় করেছি তখনই আমার ইলমও হিকমাতের এমন দ্বার খূলে গিয়েছে যা ইতিপূর্বে কখনো খোলেনি। হাদীস শরীফে বর্নিত আছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি বান্দার উপর দুটি ভয় একত্রে দিই না এবং একই সময়ে দুটি বিষয়ে নিশ্চিন্ত করিনা।বান্দা যদি দুনিয়াতে আমার বিষয়ে উদাসীন থাকে , তাহলে আখিরাতে আমি তাকে ভয়ের সম্মুখীন করব। আর যদি দুনিয়াতে আমাকে ভয় করতে থাকে, তাহলে আখিরাতে তাকে আমি নিশ্চিন্ত রাখব। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, প্রত্যেক বস্তু তাকে ভয় করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ভয় করে, প্রত্যেক বস্তু তাকে ভয় প্রদর্শন করে। ইয়াহইয়া ইবনে মোয়ায (রাঃ) বলেন, হতভাগা মানুষ যদি জাহান্নামকে এতটুকু ভয় করত যতটুকু দারিদ্রকে ভয় করে, তাহলে সোজা জান্নাতে প্রবেশ করত। তাহলে কেন আমরা আল্লাহর ভয়ে আজকে কাঁদি না ? আমরা কাঁদতে পারি না শক্ত হৃদয় এবং দুনিয়ার প্রতি আমাদের অন্তরের আসক্তি থাকার কারনে। তাই আমাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেছে এবং আমাদের চোখগুলো শুকিয়ে গেছে। আমরা আমাদের রব থেকে দূরে সরে গেছি। আল্লাহর স্মরণে অন্তর কখনো কঠিন হয় না। তাই যার এক সপ্তাহ চলে যায় এক ফোঁটা পানি চোখ থেকে ঝরে না তাকে এটা নিয়ে বসা উচিৎ, এটা নিয়া চিন্তা করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করা এবং নিজেকে বিনম্র করা উচিত। হয়ত তার অন্তর বিগলিত হবে এবং তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াবে। এবং যদি অন্তর সিক্ত না হয় তাহলে কুরআন খুলে এর আয়াতসমুহ বুঝে বুঝে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে পড়া উচিত। ফলে সে কাঁদবে,তার অন্তরে আল্লাহর ভয় আসবে এবং তার আত্মা বিনম্র হবে, তবেই তো সফলতা এবং এভাবেও যদি তার অন্তর আগের কঠিন অবস্থায় থাকে,তাহলে তার একটা অন্ধকার রুমে গিয়ে চিৎকার করে কান্না করা উচিৎ তার মরে যাওয়া অন্তরের জন্য।
২৭. বর্ণিত আছে যে,একজন পয়গম্বর (আঃ) একটি ক্ষীণকায় পাথরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ছোট্ট এ পাথরটি থেকে বিপুল পানির ধারা প্রবাহিত হতে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। আল্লাহ পাক তখনি পাথরটিকে বাকশক্তিমান করে দিলেন। পাথরটি বললো, যেদিন থেকে আমি এ আয়াতখানা শুনেছিঃ জাহান্নামের জ্বালানি হবে মানুষ এবং পাথর। (বাকারা : ২৪) সেই দিন হতে ভয়ে আল্লাহর দরবারে রোনাজারী করতেছি। এ কথা শুনে উক্ত পয়গম্বর (আঃ) পাথরটিকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দানের জন্য আল্লাহ পাকের কাছে দু’আ করলেন। আল্লাহ পাক স্বীয় পয়গম্বরের দু’আ কবুল করে পাথরটিকে মুক্তিদান করলেন।
উক্ত পয়গম্বর (আঃ) বেশ কিছুদিন পর আবার সেদিকে অতিক্রমের সময় দেখিলেন, এইবার পূর্বাপেক্ষা বেশী পরিমানে ঐ পাথর হতে অশ্রুধারা নির্গত হচ্ছে, পয়গম্বর আরজ করলেন, হে পাথর! এখন আবার কান্না কেন? পাথর বললো, হে আল্লাহর পয়গম্বর (আঃ)! ঐ দিন যে আপনি আমাকে কাঁদতে দেখেছিলেন,আমার সে কান্না ছিল আল্লাহ পাকের ভয়ে এবং আমার নিজের চিন্তায়। কিন্তু আজ আমার এ কান্না হলো কৃতজ্ঞতা ও আনন্দের কান্না। বস্ততঃ মানুষের দিলও পাথরের মত, বরং তদাপেক্ষা কঠিন। এ কাঠিন্য তখনি দূর হয় যখন বান্দা ভয়ের হালতে ভয়ের কান্নাও কাঁদে আবার কৃতজ্ঞতার হালতে শোকরের কান্নাও কাঁদে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে শোকরগুযারী বান্দা হিসাবে কবুল করুন। ( মুকাশাফাতুল-ক্বুলূব/গুনিয়াতুত্-ত্বলিবীন)
মানুষের চোখের পানির মর্যাদা আল্লাহ তা’আলার নিকট অনেক বেশি। তাই আমাদের উচিত, সুযোগ পেলেই মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা। আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে আমাদেরকে তাঁর সব বিধিবিধান মেনে চলার পাশাপাশি তাঁর ভয়ে বেশি বেশি কান্নাকাটির করার তাওফিক দিন।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১:২২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×