একটি অচল নোট
সকাল থেকেই কাজে মন বসাতে পারছেন না ফারুক সাহেব। কাল তার স্ত্রীর জন্মদিন। ভাল একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু উপহারটা কী হতে পারে তিনি ঠিক করতে পারছেন না। ফারুক সাহেব তার জীবনের খুব কম সিদ্ধান্তই নিজে নিজে নিতে পেরেছেন। ছোট বড় সকল বিষয়েই তিনি বরাবরই পরমুখাপেক্ষী। সাধারণত প্রতিবারই কেউ না কেউ তার সমস্যায় নিজ থেকেই এগিয়ে আসে। কারণ তিনি সমস্যাটা কীভাবে তুলে ধরবেন সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিতে নিতেই সমস্যাটি প্রচারিত হয়ে যায়। ছোটবেলায় একবার তার মামার সাইকেল চালাতে গিয়ে ব্রেক শো ভেঙে গিয়েছিল। ছোট ফারুক সাহেব মহা চিন্তায় পড়লেন। অনেক অনুরোধের পর মামা রাজি হয়েছিলেন। এখন কীভাবে বলা যায় যে ব্রেক শো ভেঙে গেছে। নতুন ব্রেক শো লাগালেও তো বোঝা যাবে যে আগেরটা ভেঙে গেছে। মামার সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই বলা যাবেনা কথাটা। প্রথমে দু’একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলে প্রসঙ্গটাকে ব্রেকশো’র দিকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। মামার সঙ্গে দেখা হওয়ার সাথে সাথে মামার চোখ প্রথমেই গেল ব্রেক শোটার দিকে। তিনি হেসে বললেন ব্রেক শো ভেঙেছিস তো কী হয়েছে। পাড়ার মোড়ে রিক্সা সাইকেল মেরামতের দোকানে নিয়ে গেলেই হল। আরেকবার হল কি, ফারুক সাহেব চাকরির প্রথম দিনেই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়ে বসলেন। পরের দিন যে ছুটিতে থাকতেই হবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু প্রথম দিনেই কীভাবে ছুটির কথা বলা যায়। ফারুক সাহেব এর একটা বিহিত ভাবতে লাগলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। বড় সাহেব তাকে ডেকে পাঠালেন। ভেতরে যেতেই বললেন, একি আপনার চোখ তো ভীষণ লাল হয়ে আছে। বৃষ্টিতে পড়েছিলেন মনে হয়। এ শরীর নিয়ে অফিস করবেন কীভাবে, কাল ছুটিতে থাকেন।
ফারুক সাহেবের আজকের সমস্যাটি এমন যে এটি মুখ ফুটে না বললে আরেকজনের বোঝার কথা নয়। তিনি মনে মনে সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা করছেন। তার চিন্তিত মুখ দেখে এক সহকর্মী স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এলেন। ফারুক সাহেব হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক, এবার যা হোক একটা ভাল সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তার সহকর্মী তাকে পরামর্শ দিলেন উপহারটি এমন হওয়া চাই যা শুধুমাত্র শখের হবে না, কাজেও লাগবে। ফারুক সাহেব বার বার বললেন তেমন একটি উপহার সামগ্রীর নাম বলে দিতে। সহকর্মীটি বললেন যে সেটা তার স্ত্রীর প্রয়োজন এবং রুচি বিবেচনা করে তাকেই নির্বাচন করতে হবে। ফারুক সাহেব অনেক ভেবে চিন্তে তার স্ত্রীর জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটা স্ট্যাপলার কিনে নিয়ে গেলেন। সেই স্ট্যাপলার যখন র্যাতপিং এ মুড়িয়ে স্ত্রীকে দিলেন, ফারুক সাহেবের মনে হল বিয়ের পর স্ত্রীর প্রথম জন্মদিনে একটি অসাধারণ উপহার দিচ্ছেন।
ফারুক সাহেবের স্ত্রী জানতেনই না যে তার একটি জন্মদিন আছে, এটি একটি বিশেষ দিন এবং এই দিনে স্বামীর তরফ থেকে একটি উপহার আসতে পারে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল তার জন্মদিন তার স্বামী জানলেন কী করে। তিনি নিজেই তো তারিখটি জানেন না। তাই এই অপ্রত্যাশিত উপহারে তিনি বিহ্বল হয়ে থাকলেন। তিনি তার এই বয়সে প্রথম বারের মত একটি উপহার পেলেন। উপহারটি পেয়ে এতই আড়ষ্ট হয়ে গেলেন যে স্বামীর অনেক অনুরোধের পরও তার সামনে এটি খুলতে পারলেন না। স্বামী অফিসের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার পর রাবেয়া বেগম উপহারটি খুললেন। স্বামীর উপহার নির্বাচনের অপটুতায় তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে তার চোখ ভিজে এল।
ফারুক সাহেবের জন্মের পরপরই তার মা মারা যান। একমাত্র সন্তানকে শিক্ষিত করার ইচ্ছা ছিল তার বাবার। ফারুক সাহেব ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে মফস্বল থেকে পড়াশুনা করতে ঢাকা এসেছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর পড়াশুনা আর খুব একটা এগোয় নি। তার দেশের বাড়ির পৈতৃক ভিটা কালক্রমে বেদখল হয়ে যায়। একটা সরকারী অফিসের অফিস সহকারীর চাকরি পেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। তারপর স্ত্রীকে নিয়ে পুরনো ঢাকার স্যাঁতস্যাঁতে নোনা ধরা একটা বাড়িতে ওঠেন। রাবেয়া বেগমের ইতিহাসটি বেশ করুণ। নিজের বাবা মাকে তিনি দেখেন নি কখনো। বড় হয়েছেন একটা আশ্রয়কেন্দ্রে। একটা এনজিও’র উদ্যোগে তার বিবাহ।
এই বাসায় ওঠার আগে ফারুক সাহেব একটা মেসে থাকতেন। মেস থেকে নতুন বাসায় ওঠার সময় তার ট্রাংকে আচমকাই একটা এক শত টাকার নোট আবিষ্কার করেন। নোটটা কীভাবে যে তার ট্রাংকে এল তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। নোটটা নিয়ে ছুটে গেলেন মেসে। মেসের কেউই বলতে পারল না নোটটা কার। একজন বলল ফেলে দিন ভাই এটা অচল নোট। ফারুক সাহেব নোটটা ফেলে দিতে পারলেন না। শ্যাওলা রঙের এমন সুন্দর একটা নোট। কিন্তু এটা তার নিজের টাকা নয়। তাই রাখতেও কেমন উশখুশ লাগছে।
সে বছর বন্যায় সারা দেশ ভেসে গেল। হাজার হাজার মানুষ রোগাক্রান্ত হল। উপদ্রুত অঞ্চলে খাবার নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই। ফারুক সাহেব পত্রিকার পাতা ওল্টালেই এসব দেখেন আর কষ্ট পান। ওদের জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কী করা যায় আর কীভাবেই। ফারুক সাহেব ভাবেন আর তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এর মধ্যে পাড়ায় বন্যার্তদের সহায়তার জন্য একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। শুনে ফারুক সাহেব অত্যন্ত খুশি হয়ে ওঠেন। তিনি নিজ থেকেই কমিটিকে চাঁদা দিতে গেলেন। ফারুক সাহেব ভেবেছিলেন এবার নোটটার একটা গতি হবে। কিন্তু কমিটি নোটটা রাখল না। চাঁদা বাবদ ফারুক সাহেবকে আরেকটা বদলি নোট দিতে হল। বাসায় ফেরার পথে একটা চা-পান-সিগারেটের দোকান পড়ে। ফারুক সাহেব তেমন একটা পান খান না। তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু ইচ্ছে করে। যেমন আজও ইচ্ছে করল। আজ কেমন যেন একটু ভাল ভাল লাগছে। না, ঠিক আর্তদের সাহায্য করার কারণে নয়। ফারুক সাহেব ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারলেন না।
অফিসে একটা ঘটনা ঘটেছে। ফারুক সাহেবের মনটা কিছুটা খারাপ। তাদের একজন এমএলএসএসকে চুরির দায়ে চাকরিচ্যূত করা হয়েছে। আহা, বেচারা নিশ্চয়ই খুব বিপদে পড়ে চুরি করেছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কি এই বিষয়টা একটু বুঝবে না। একজনের ড্রয়ারে নাকি কিছু নগদ ছিল। সেটা গায়েব হয়ে গেছে। তল্লাশি করে সেই টাকা ওই এমএলএসএস এর কাছে পাওয়া গেছে। ফারুক সাহেব সেদিন একটু ক্ষুণ্ণ মনে বাসায় ফিরছিলেন। পথে হঠাত মনে হল সেই নোটটাও তো তিনি অফিসের ড্রয়ারেই রেখেছিলেন। নোটটা আছে তো ? তক্ষুণি অফিসের পথ ধরলেন। দু’একজন এখনো ওভারটাইম করছেন। কি ব্যাপার ফারুক সাহেব ? না, একটা জিনিস ফেলে গিয়েছিলাম। অনেক সময় নিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নোটটি তিনি পেলেন না। হঠাত করেই ফারুক সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। চিৎকার করে সেই এমএলএসএস এর বদনাম করতে লাগলেন। বলতে লাগলেন তাকে চাকরিচ্যুত করে কর্তৃপক্ষ একদম ঠিক কাজই করেছে। বদমাশ কোথাকার। কী হয়েছে ফারুক সাহেব আপনারো কিছু নিয়ে গেছে নাকি ? হ্যাঁ ভাই, আমারও ... ফারুক সাহেব থেমে গেলেন। নোটটা কি তার ? নাহ।
খুবই ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন ফারুক সাহেব। স্ত্রীকে বললেন সব কথা। রাবেয়া বেগম হেসে কুটিকুটি। নোটটা তো আপনি বাসায় রেখেছেন। ওহ তাই নাকি। আহা, বেচারা নির্দোষ একটা মানুষের প্রতি কত কথাই না বললাম। রাবেয়া বেগম আগেও কয়েকদিন খেয়াল করেছেন প্রথম প্রথম তার স্বামী এই নোটটা কীভাবে হাতছাড়া করা যায় তার ফিকির করতেন। কিন্তু ইদানিং এটা আর হাতছাড়া করতে চান না। লোকে বলে এটা নাকি সরকার অচল নোট বলে দিয়েছে। তিনি বুঝে উঠতে পারেন না একটা অচল নোটের জন্য এত মায়া কেন তার স্বামীর।
দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর যায়। অফিসের পুরনো চেহারা আস্তে আস্তে নতুন হয়। সহকর্মীদের চেহারাও সুন্দর হয়। কারো কারো স্বাস্থ্য বেশ সুঠাম হয়ে ওঠে। ফারুক সাহেবের এসব দেখে বেশ ভাল লাগে। অবশ্য তার নিজের স্বাস্থ্যে তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। বরং তার স্ত্রীর স্বাস্থ্য দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে। সন্তান লাভের চেষ্টায় অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও ফল হয় নি। রাবেয়া বেগম সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে একটা অভিযোগও করেন নি। ইদানিং তার শরীরটা যেন একটু বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডাক্তার দেখানো দরকার।
জুলাই এর শেষাশেষি। বর্ষার রাত। রাবেয়া বেগম তিনদিন ধরে জ্বরে শয্যাশায়ী। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছেন। ওষুধ কেনার জন্য ফারুক সাহেব বেতন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। কাল বেতন হবে। সে রাতে জ্বরের ঘোরে রাবেয়া বেগম অসংলগ্ন অনেক কথা বলতে লাগলেন। ফারুক সাহেব একটু ভয়ই পেয়ে গেলেন। হাতে মোটেই টাকা নেই। কী করা যায়। সেই এক শত টাকার নোটটা সম্বল করে ফারুক সাহেব বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে পড়লেন। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরও কোন অষুধের দোকানেই নোটটা নিল না। ফারুক সাহেব অত্যন্ত অসহায় বোধ করলেন। কী করা যায় বুঝে উঠতে পারলেন না। স্ত্রীর সাথে একটা পরামর্শ করতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু ও তো এখন কথা বলার মত অবস্থায় নেই। এসব ভাবতে ভাবতে ফারুক সাহেব শেষ পর্যন্ত বাসার পথই ধরলেন। পৌঁছতে পৌঁছতে বাড়ির সামনে ভীড় জমে গেল।