সিগারেটে টান দিতে দিতে রিকশায় উঠে বসলাম। সবার শুনি শেষের দিকে সুখটান দিতে ভালো লাগে, আমার অর্ধেকের পরে তেতো লাগে। ফল হলো মুখটা এক্টু বিরক্ত হয়ে ছিলো। সেটা দেখেই কিনা জানিনা, রিকশাওয়ালা এসে বল্লো - স্যার, মনে কিছু নিয়েন না। চায়ের অর্ডার দিয়া দিসিলাম, তাই আপনারে বসায় রেখেই খালাম।
আমিঃ ঠিক আছে, চলেন এইবার।
তড়িঘড়ি সে রিকশা ছাড়লো। সিগারেটের শেষের তেতো টানটা দিয়ে দেখলাম ফিল্টার পুড়ি-পুড়ি করছে, তাই ফেলে দিলাম। মোবাইলটা বের করে দেখি প্রায় রাত সাড়ে দশটা বাজে।
আমিঃ আপনার রিকশায় বসতে খুব আরাম...
রিকশাঃ জি স্যার, কুমিল্লা বডি। ২৫ হাজার টাকা লাগসে বানাইতে। আজ ১ মাস হইলো ঢাকা নিয়া আসছি। সেই সকালে বারাইছি রিকশা নিয়ে।
আমিঃ এতো টাইম ধরে রিকশা চালান, তাইলেতো আপনার অনেক ইনকাম!
রিকশাঃ হে হে। সকালে বারাইছি, সারাদিন কিছু খাইনাই। এখন আর পারতেছিলাম না। তাই খালাম।
আমিঃ আপনার যে কাজ, ঠিক মতো না খাইলেতো পারবেন না।
রিকশাওয়ালা পেডেল মারে আর অনেকটা আপন মনেই বলতে থাকে - মা ডা অসুস্ত, টিউমার হয়েছে, পেডে পানি জমে। এইবার ঢাকা নিয়া আইসছি। ঢাকায় বড় বড় ডাক্তার, চিকিৎসা করালে ভালো হয়ে যাবে। দেশে গেসি, তা মা বলে, "বাবা আমারে ঢাকা নিয়া চিকিৎসা করা।" শুনছি টিউমার বেশি দিন থাকলে নাকি ক্যান্সার হয়া যায়, তখন লাখ টাকা লাগবে চিকিৎসা করতে। তাই মা ডারে নিয়া আইলাম।
এবারে সে কিছুটা সময় নীরবে রিকশা টানতে থাকে।
আমিঃ আপনার রিকশা কি নিজের?
রিকশাঃ জি স্যার।
আমিঃ কোথায় যাবেন এখন রিকশা নিয়ে? (হয়তো শুনতে পেলো না)
আমিঃ আপনি থাকেন কোথায়?
রিকশাঃ গোরান।
রিকশা চলছে, শীতের রাতে এই সাড়ে দশটাতেই সমস্ত রাস্তাঘাট শুনশান! চলতে চলতে ঠিক আগের সুরেই সে আবার বলতে শুরু করে-
মায়েরে একটা কিলিনিকে বর্তি করাইছি। দালাল ধরসি। অনেক বড় ডাক্তার দিয়া চিকিৎসা করাইতেছে। পরশু বলছে কালকের মধ্যে ৩ হাজার টাকা লাগবে। তাই সকাল সকাল রিকশা নিয়া বারাইছি। এখনো সাড়ে বারোশ টাকা লাগবে, তাই সারাদিন খাইনাই, এখন খালাম। টাকা না দিতে পারলে দালাল ভালো ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবেনা।
আহা! কথা গুলো শুনে এত খারাপ লাগলো! আবার এও মনে হলো - সিনেমাতে যা দেখি তা সবাই গল্প বলে, কিন্তু এর কথাতো সিনেমার মতোই। আবার এও ভাবলাম, মা কে সবাই কতইনা ভালবাসে! কিন্তু এর ব্যাপারতো একটু অন্যরকম - না খেয়ে আছে কিছু টাকা বাঁচাবে বলে!
রিকশাঃ মার চিকিৎসাটা ইনশাল্লা হলে সাথে সাথে আমার এই বাম পায়ের গোড়ালিটাতেও অপারেশেন করাব। (দেখি আসলেই ও যায়গাটা ফুলে আছে) পেডেল মারতে গেলে টান পড়ে। কাজ করেতো খেতে হবে।
আমিঃ আপনার পায়ের এই অবস্থা হলো কেমনে?
রিকশাঃ আরেক রিকশায় লেগে পা কাটি গেসিল। এই ফুলে ঢোল হয়ে গেসেলো। এখনো পেডেল মারতে টান লাগে। স্যার আমার মায়ের জন্যি দোয়া করেন। মা ডা সুস্ত হয়ে গেলে আর চিন্তা নাই ইনশাল্লা। আল্লাহ ভালই রাখবে।
আমিঃ আপনি কি আজকে আরো রিকশা চালাবেন?
রিকশাঃ সাড়ে বারোশ টাকা লাগবে, আর দুইটা ক্ষেপ মারব। কালকে আবার সকালে বারাব। বিকালে দালালরে টাকা দিতে হবে। মা ডা সুস্ত হয়ে গেলে চিন্তা নাই, আল্লা ভালই রাখবে ইনশাল্লা।
এতক্ষণে বাসায় এসে গেছি। মানি ব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে ভাড়া দিলাম। তারপর কি মনে করে ১শ টাকার একটা নোট বের করে হাতে দিয়ে বললাম - এটা আপনার মা'র জন্য।
টাকাটা হাতে পেয়ে তার যে অভিব্যক্তি দেখলাম, আর কিছুর সাথে তার তুলনা হয়না।
রিকশাঃ আমার মার জন্যে দোয়া করবেন স্যার। আর সাড়ে এগারশ টাকা লাগবে। (তার চোখ চক-চকে)
আমিঃ আমার জন্যও দোয়া করবেন।
একথা বলে কেন জানি না, চোরের মত দ্রুত পালিয়ে এলাম। নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হতে লাগলো - একশো টাকা দিলাম! আমি ওই লোকটাকে মাত্র একশো টাকা দিলাম! সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ১১০ টাকা দিয়ে বেন্সন কিনে সারাদিন শেষে বাসায় ফেরার সময় কিনে নেই আর পাঁচটা। ১৩০-১৪০ টাকা যেখানে ধোঁয়া করে উড়িয়ে দিচ্ছি প্রতিদিন!