ইদানিং স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি আমি।
কিন্তু ছোটবেলায় অনেক স্বপ্ন দেখতাম। স্কুলে পড়তাম যখন, দেখতাম বন্ধুরা সুন্দর সুন্দর কেডস পরে ঘুরে বেড়াতো।পা মাটিতে স্পর্শ করলেই বাতি জ্বলে উঠতো সেই কেডসে।খুব ইচ্ছা হলো সেই কেডস পরার।বাসায় গিয়ে বাবার কাছে আবদার করলাম।কাষ্ঠ হেসে বাবা সায় দিলেন “কাল এনে দিবো” বলে।সেই “কাল” আর আসেইনা।ঈদ এলো।বাবা সুন্দর বাক্সে জুতা নিয়ে এলেন ঈদের আগের দিন। বাড়ির দিকে যেতে থাকা বাবার হাতে জুতার বাক্স দেখে মাঠ থেকে খেলা ফেলেই দৌড় দিলাম বাবার পিছুপিছু।কিন্তু হতাশ করে দিয়ে বাবা বললেন “ঈদের দিন দেখিস, এখন বের করলেই পুরনো হয়ে যাবে।” সারারাত জুতার কথা ভেবে আনন্দে ঘুমাতে পারিনা। সন্ধ্যাবেলা পরব, বন্ধুদের চমকে দেবো এই ভাবতে ভাবতেই বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি।পরেরদিন জুতার বাক্স খুলে দেখলাম বাবা যে জুতা আনলেন তাতে কোনো বাতিই নাই।খুব কান্নাকাটি করলাম। তখন কোলে তুলে নিয়ে আমার ব্যর্থ বাবা আমার চোখ মুছে দিয়ে বললেন “মন দিয়ে পড়াশোনা কর, একদিন বড় হয়ে তুইও এসব জুতা কিনতে পারবি।” এভাবেই বাবা একদিন শেখালেন কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়।
মানুষের বয়স বাড়ে, সাথে সাথে বয়স বাড়ে স্বপ্নেরও। এখন আর লাল-নীল বাতিওয়ালা জুতার স্বপ্ন দেখিনা।
তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। ঐ সময় আমাদের বয়সী ছেলেদের মধ্যে ব্যাগিজিন্স আর তার সাথে মেটালিকা-ফেটালিকা নামের বিভিন্ন ব্যান্ড-এর ছবিওয়ালা টি-শার্টের খুব ক্রেজ। বন্ধুদেরকে ব্যাগিজিন্স আর টি-শার্টে খুব সুন্দর লাগতো বলে আমারো মনে সাধ জাগে। মাকে গিয়ে আবদার করলাম। চুলার ধারে পাটশাক ভাজি করতে থাকা মা ধোঁয়া আর গরমের রাগটা যেনো সুযোগ পেয়ে আমার উপর ঝেড়ে দিলেন। খেঁকিয়ে উঠে বললেন-“ভাত খাইতে টানাটানি, আবার রংঢং করতে চাস ক্যান?”। খুব রাগ হয়েছিলো সেদিন মায়ের উপর। স্বার্থপরের মতন মনে হওয়া মায়ের উপর জেদ ধরে সেদিন মনে মনে বললাম “বৃত্তিটা পাইলেই সেই টাকায় শার্ট-প্যান্ট কিনে তোমারে দেখাইয়া দেখাইয়া ঘুরমু।” ব্যাগিজিন্সের স্বপ্নে বিভোর আমি একসময় বৃত্তিটাও পেয়ে গেলাম।ছয় মাসে ৭০০টাকা হারে বৃত্তির প্রথম কিস্তিটা হাতে পাওয়ার পরপরই বাজারে গেলাম জিন্স আর টি-শার্ট কিনতে।বাজারে গিয়ে দেখলাম জিন্সের দাম ৬০০টাকা আর টি-শার্ট ৪৫০টাকা।বাধ্য হয়ে অর্ধেক স্বপ্ন পূরণ করেই ক্ষান্তি দিলাম।বাসার দরজা খুলে মা যখন আমার হাতে কিসের প্যাকেট জিজ্ঞেস করলেন, তখন অহংকারী আমি কোনো কথা না বলেই ঘরে ঢুকে পড়ি।জিন্স পরে মায়ের সামনে ঘোরাঘুরি করি, চোখ মুছতে মুছতে মা বলেন “ রাজপুত্রের মত লাগতেসে তোরে, প্যান্টটা খুব ভালো মানাইছে।” তখন মনে মনে ভাবতাম আমার জেদের কাছে পরাজিত হওয়ার দুঃখে মা কাঁদছেন।পরেরদিন খুব ফুরফুরে ভাব নিয়ে বন্ধুদের আড্ডায় ব্যাগিজিন্স পরে যাই আমি।কিন্তু বন্ধুরা দেখি দূর থেকে আমাকে আসতে দেখেই হাসাহাসি করে।কাছে যেতেই রবিন নামে আমার বন্ধুমহলে সবচেয়ে স্মার্ট বলে পরিচিত বন্ধু বলে বসলো -“কিরকম লাগতেসে তোরে আয়নায় একবারও তাকাইয়া দেখসোস?? জিন্সের লগে কেউ ১৯৭৯ জমানার এই শার্ট পরে।শালা ক্ষ্যাত!!” প্রবল অপমানিত বোধ করলাম আমি সেদিন।বাসায় গিয়ে সেদিনই প্যান্টটা আলমিরায় তুলে রাখলাম।এভাবেই অনেক কষ্ট করে আধেক পূরণ হওয়া এক স্বপ্নকে আলমিরার অন্ধকারে তুলে রাখলাম।
কিন্তু এরপরওতো কত যে স্বপ্ন দেখেছি আমি।টাকা লাগেনা বলেই হয়ত একসময় স্বপ্ন দেখতাম শচীন টেন্ডুল্কার হয়েছি। কখনোবা সিনেমার নায়ক আবার কখনোবা সিল্কের স্যুট পরা কোনো বড় অফিসার হয়ে গেছি।
আমার মত হয়ত অনেকেই এমন স্বপ্ন দেখতো।স্বপ্ন দেখতো –সুন্দর সাজানো একটা দেশ।শুভ্র চেহারার কিছু নেতা যাদের হাত ধরে উত্থান এই দেশের।কর্মব্যস্ততায় মুখর অফুরান প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা মানুষের মুখ।মেধাবীদের প্রাণবন্ত আড্ডামুখর ক্যাম্পাস।স্কুলফেরত ছোট ছোট বাচ্চাদের মায়ের হাত ধরে টানাটানি করে মাঠে খেলতে যেতে দেওয়ার জন্যে বায়না করা।প্রভিনেন্ট ফান্ডের টাকা দিয়ে নির্মীয়মান বাড়িতে রাজমিস্ত্রির ইটের গাথুঁনি তদারকি করতে করতে আরামকেদারায় বসে ক্যালকুলেটর টিপতে থাকা কোনো বৃদ্ধপ্রায় মানুষের আনন্দমাখা মুখ।
এমনও একটা দেশের স্বপ্ন হয়তো দেখতো যেখানে চাকরির জন্যে কোনো যুবককে ঘুরতে হয়না মামা-চাচাদের পেছনে,পেনশনের টাকা তোলার জন্যে পিয়নের পিছন-পিছন ঘুরতে হয়না সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে।ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তির জন্যে ছাত্রছাত্রীদের ঘুরতে হয়না কোচিং কিংবা অমুক ভাই-তমুক স্যারদের বাসায় বাসায়।কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে লাঞ্ছিত হতে হয়না তাঁরই কোনো ছাত্রের কাছে, আবার খুন হতে হয়না কোনো বন্ধুকে ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়া আরেক বন্ধুর হাতে শুধু রাজনীতির অজুহাতে। হারানোর বেদনায় শোকাহত কোনো মায়ের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেনা বাতাস। জোরপূর্বক দাবি করা ভালোবাসাকে প্রত্যাখান করে ঝলসে যায়না কোনো বোনের মুখ কিংবা জামিনে বের হয়ে আসা দুর্বৃত্তদের আদালত ভবনের সামনে দিয়ে দম্ভভরা পদাঘাত।
রাস্তা দিয়ে হাটঁতে হাটঁতে ভাবি, পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলো হয়তোবা এখনো স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কেন যেনো অসাড় হয়ে যাওয়া আমি ইদানিং স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১:৩৮