এক.
আজ আমার খুব খুশির দিন। ঈদের দিনেও বোধহয় কারো এতটা আনন্দ হয়না। আনন্দে আমার চোখ বারবার ভিজে আসছে। দূরের গাছপালা-নদীর তীর সব ঝাপসা হয়ে আসছে।
পাঠকরা হয়তো ভাবছেন যে কি এমন খুশির দিন যে একদম চোখ ভিজে যাচ্ছে!
আজ আমার ছোটমেয়ে আমার সাথে বাড়ি যাবে। দীর্ঘ নয় বছর পর আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যাব। একজন বাবার কাছে এর থেকে বড় আনন্দের আর কি হতে পারে!
হঠাৎ বিকট শব্দে আমার কানে তালা লেগে গেল। লঞ্চ ঘাটে এসে পৌঁছেছে। আমার সাথে একগাদা জিনিসপত্র। এসব নিয়ে নামতে নামতে সময় লেগে যাবে। তাছাড়া একটা কুলিও বোধহয় লাগবে। এতকিছু নিয়ে একা নামা সম্ভব না। এতদিন পর মেয়ের শ্মশুর বাড়ি যাচ্ছি। এতকিছুওতো কম কম লাগছে চোখে।
দুই.
সিএনজি একটা ভাড়া করে নিয়েছি। সিএনজি ভাড়া যেই বেড়েছে তাতে মনে হচ্ছে সিএনজি চালানো শুরু করে দেওয়া উচিত। বড়লোক হয়ে যাওয়ার এর থেকে সহজ উপায় আর থাকতে পারেনা। অন্যসময় হলে সিএনজিওয়ালার সাথে বিশাল একটা ঝগড়া করতাম। আজকে তাকে একটা হাসি উপহার দিয়ে উঠে গেলাম সিএনজিতে। আজকে আমি কিচ্ছু কেয়ার করিনা। আজকে আমার সাথে আমার মেয়ে বাড়ি ফিরবে। আজকে সিএনজিওয়ালা যত্ত খুশি টাকা নিক। আমার সব টাকা রেখে দিক। কোন ব্যপার না।
আমার ছোট মেয়ে মিথিলা। টুকটুকে – চটপটে মিথিলা। যেই মেয়ে আগে সারাক্ষণ তার বাবার হাত ধরে সবজায়গায় যেত। বাবা বাড়ি থেকে একদিনের জন্যেও কোথাও গেলে কিছু খেতে পারতনা। রাতে ঘুমানোর সময় বাবার একটা শার্ট জড়িয়ে ঘুমাত। সেই মেয়ে কিনা নয় বছর তার বাবার বাড়ি যেতে পারেনি। কারণটা খুবই অদ্ভুত। তার প্রেম হয়ে গিয়েছিল। এবং হুট করে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। বড় বোনকে রেখে ছোট বোন এভাবে বিয়ে করে ফেললে তা আমাদের দেশে খুবই বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। সেই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ সে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। বিয়ের পর থেকে শ্মশুর বাড়িতেই আছে। তার একটা ফুটফুটে ছেলেও হয়েছে। শেষবার যখন তার সাথে দেখা করতে গেলাম ছেলেটা “নানাভাই নানাভাই” বলে সেই যে কোলে উঠল আর নামতেই চাইলনা। আসার সময় জোর করে নামাতে হল তাকে। এবার আর নামাতে হবেনা। আমার নানাভাই আমার সাথে যাবে। পুরো রোজাটা আমার মেয়ে আর আমার নানাভাই আমার সাথে থাকবে। ভাবতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল আমার। সিএনজির খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরো একবার আমার চোখ ভিজে গেল। আজ কি হল কে জানে! এতবার চোখ ভিজে যাচ্ছে কেন!
তিন.
ছোটমেয়ের আগে বিয়ে হলে যা হয় তাই হল। আমার বড়মেয়ের বিয়ে বার বার কারণে অকারণে ভেঙ্গে যেতে লাগল। কথাবার্তা সব এগুয়, শেষে গিয়ে যেন কি হয় আর হয়না। ছেলেপক্ষের কানে কারা যেন উলটাপালটা কথা শোনায়। “এ বাড়ির মেয়েরা ভালনা। ছোটমেয়ের কি হয়েছিল জানেন না আপনারা? পেট বাঁধিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। এখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরেনি।“
যাইহোক বড়মেয়ের কাহিণী এখানে আর বলবনা। সে এক লম্বা কাহিণী। খুব শিঘ্রই তার বিয়ে দিয়েছি। মেয়েকে অনেক পড়িয়েছি। ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিও শেষ করিয়েছি। মেয়ে আমার চাকরিও করত। কিন্তু এখন সে তার স্বামীর বাড়িতে থাকে। তার শ্মশুর বাড়ির কেউ চায়না সে চাকরি করুক। চাকরি করলে নাকি মেয়েদের ডানা গজিয়ে যায়। তাই চাকরি না করিয়ে বাসায় বসিয়ে রাখাটাই তাদের কাছে শ্রেয় মনে হয়েছে।
আমার ছোটমেয়ের গল্পে ফিরছি আবার। শেষ তার সাথে আমার দেখা হয় ৩ বছর আগে। তার শ্মশুর বাড়িতে একবার দেখা করতে এসেছিলাম। যাবার কালে মেয়ে আমার ১০০০ টাকা চেয়েছিল। আমার কাছে ছিল শুধু ৩০০ টাকা। মেয়ে আমার মুখ দেখেই বুঝে ফেলল যে তার বাবার কাছে অত টাকা নেই। হেসে বলল, “বাবা, আমি তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম। এখনো সেরকম কিপটে আছ। না টাকা-পয়সা দেবার হাত খুলেছে তোমার।“ তার রসিকতায় আমরা দুজনেই খুব হেসেছিলাম সেদিন। পরে আমার মনে হয়েছিল আমি কেমন বাবা! আমার আদরের ছোটমেয়ে আমার কাছে সামান্য কিছু টাকা চাইল আর আমি তা দিতে পারলাম না।
চার.
সিএনজি গিয়ে পাঁচতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে মালপত্র সব নিয়ে উপরে উঠে গেলাম। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে গেল। আমার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুচোখ ভরা পানি। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল ও। তারপর শুরু হল তার হাসি। এত বছর পরেও মেয়ে আমার এতটুকুও বদলায়নি।
পাঁচ.
“বেয়াই সাহেব, আপনার আক্কেলজ্ঞান দেখেতো আর বাঁচিনে। আপনি এসেছেন আপনার মেয়েকে নিতে? পুরো রোযা সে আপনার সাথে থাকবে?”
“জ্বী। সেরকমইতো কথা হয়েছিল। আপনিতো কথা দিয়েছিলেন।“
“শোনেন যখন আপনাকে বলেছিলাম তখন সময় অন্যরকম ছিল। এখন অন্যরকম। আপনার মেয়ে পুরো রোযা আপনার সাথে কাটালে আমাদের কি হবে?আমাদের বাসার কাজের মেয়েটাওতো নেই। বউমা না থাকলে সব কাজতো আমাকে করতে হবে। আপনি কি তাই চান যে রোযা রেখে এই বয়সে আমি সবকাজ করি?”
“না। তা চাইব কেন। আমি শুধু ভাবছিলাম…”
“এত ভাবাভাবির কিছু নেই। এখন আমি বউমাকে যাবার অনুমতি দিতে পারিনা। রোযা শেষ হোক পরে ভেবে দেখব।“
“আচ্ছা। আমি তাহলে আসি”
“না না সবে এসেছেন। এক-দুইদিন থাকেন।“
“না। বাড়িতে অনেক কাজ পরে আছে। আমাকে আজই যেতে হবে।“
ছয়.
লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। লঞ্চের একদম ছাদে বসে বাড়ি ফিরছি। বুকটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চারিদিকে আঁধার নামছে। দূরে কোথাও আযান দিচ্ছি। আমার আশেপাশের সবকিছু ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরেই একটা চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে। বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়াটা কোন কাজের কথা না।