somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাণ-চঞ্চল বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি ক্ষয়ে যাওয়া ভোরের গল্প

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আদনান মান্নান, সুমন ভট্টাচার্য, হায়দার আলী সায়েম, অলক বিশ্বাস, অনুপম দাশগুপ্ত, নুরুদ্দিন মাহমুদ,শান্ত বণিক

আমরা বিষণ্ন, আমরা শঙ্কিত, আকস্মিক ঝড়ে আমরা বাকরুদ্ধ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েট... একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঠের সবুজ ঘাস যখন রঞ্জিত হচ্ছিল ছাত্রদের রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিনের লাল রঙে, তখনো আমরা বিষণ্ন হলেও আমরা হতাশ হইনি। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ত্বরিত ও নতুন কর্মকাণ্ডে, দল মত নির্বিশেষে প্রতিটি শিক্ষকের নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা পৌঁছে যাচ্ছিলাম সেশনজট অবসানের যুগে। আমরা বিশ্বাস করছিলাম, এভাবে চলতে থাকলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই পৌঁছে যাবে অন্যরকম একটি উচ্চতায়। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মতো আমরাও স্বপ্ন দেখছিলাম “এবার হবে”। কিন্তু না! হঠাৎ স্বপ্নের আকাশে কালো মেঘ, অস্ত্রের হুঙ্কার, রক্তের কাফনে মোড়া বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা কি তবে একটি ক্ষয়ে যাওয়া ভোরের স্বপ্ন দেখছিলাম!

আমাদের শরীর থেকে এখনো ছাত্রত্বের গন্ধ যায়নি। মাত্র কয়েক বছর আগেই আমরা পাশ করে বের হলাম। আমাদের অনেকেই সেশনজটের দুষ্টচক্রে বন্দী ছিলাম। সে কারণেই আমরা জানি হাসপাতালের বারান্দায় ঝাড়ণ্ড দেয়া সেই সরল মহিলার অনেক কষ্টে বড় হওয়া ছেলেটি আমাদের ছাত্র, গ্রামের কৃষক পরিবারের সেই ছেলেটি যার প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় আসছে সপ্তাহ কিভাবে দুমুঠো ভাতের সংস্থান হবে সেও আমার ছাত্র, প্রত্যন্ত গ্রামের পিতৃহারা সেই ছেলেটি যে টিউশনি করে টাকা জমিয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়ায় সেও আমার ছাত্র। এই নিষ্পাপ ছেলেগুলোর কাছে সেশনজটের এক একটি দিন মানে স্বপ্ন ভঙ্গের একেকটি মুহূর্ত। তার কাছে একেকটি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়া মানে পরিবারের সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিক্ষা আরও বেশী দীর্ঘায়িত হওয়া। বাবার কাছে, মায়ের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাওয়া। এই সময়ের এই ছাত্ররাজনীতি আমাদের কি দিচ্ছে? একজন ছাত্রকে মাথানত হতে হয় পরিবারের কাছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পৌঁছে দিচ্ছে শ্মশানের দারপ্রান্তে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গোরস্তান!

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন কারণ উঠে এসেছে। কখনো তা কথা কাটাকাটি, কখনো তর্কবিতর্ক, কখনো তা নেতৃত্ব শূন্য অবস্থায় অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগ নেয়া। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো এর কোনটাই কি আদর্শগত ? আমাদের এই সময়ে ছাত্র রাজনীতির নামে কোন মরীচিকার পেছনে ছুটছে ছাত্ররা ? আমাদের কাছে ছাত্র রাজনীতি মানে দায়বদ্ধতার একটি স্থান, ভরসার একটি জায়গা, আদর্শের একটি স্তম্ভ । অস্বচ্ছ পরিমাপ ও অন্ধ মতাদর্শের মধ্যে থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতির এক বিভ্রান্তির ধূম্রজাল। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান থেকে ছাত্ররাজনীতির যে অধঃপতন, এর পেছনের কারণগুলো রয়ে গেছে আমাদের অন্তর্দৃষ্টির বাইরে। আদর্শের দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। কিন্তু সেটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেবে কেন ? এ ধরনের সংঘর্ষের ইতিহাস অনেক পুরানো। তবুও আশাবাদী হওয়া যায় এই ভেবে যে, সংঘর্ষে লিপ্ত ছাত্রদের সংখ্যাটা হিসেবে খুব বেশী না। এছাড়াও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ক্রটি থাকা সত্ত্বেও এর মাঝেও অনেক ছাত্র নিজেদের জীবন গড়ে নিচ্ছে। সে কারণেই সকল ছাত্রদের প্রতি আমাদের অনুরোধ ঃ ‘একবার ভেবে দেখ তোমার বাবা মা কি উদ্দেশে তোমাকে পাঠিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ? কোন অধিকারে তুমি সে স্বপ্নভঙ্গ ঘটাও ? একবার ভাবো পাশের বন্ধুটির কথা, চারপাশের প্রিয় মুখগুলোর কথা।’

আমাদেরও ভাবতে হবে, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পদ্ধতিতে আমরা কি তবে শিক্ষিত যন্ত্র তৈরি করছি ? আইনস্টাইন বলেছিলেন, “শুধু বিশেষায়িত শিক্ষা দিয়ে একজন মানুষ কখনো পরিপূর্ণ ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে না। হয়তোবা সে একটি প্রয়োজনীয় যন্ত্রে পরিণত হবে। যা কিছু সুন্দর ও নৈতিক জীবনবোধের উপলব্ধি তার মাঝে গড়ে তুলতে হবে”।

আমরা আরও হতবাক হয়ে যাই, যখন দেখি শিক্ষকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন, আহত হচ্ছেন। একজন শিক্ষক একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন আদর্শগত নেতা। তিনি যখন ছাত্রের চোখের তারায় অসীম কৌতূহল আর স্বপ্নকে খুঁজবেন, তখন তিনি ঘৃণা ও ক্রোধ কেন খুঁজে পাবেন? কেন একজন শিক্ষক একজন ছাত্রের হাতে লাঞ্ছিত হবেন? আমাদের বোধ হয় তা ভাবার সময় এসেছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এখনই সবাইকে নতুন পদক্ষেপের কথা চিন্তা করতে হবে। হতে পারে ক্লাসে মুক্ত বিতর্ক, হতে পারে অনেক বেশী সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, হতে পারে মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য নৈতিকতা নিয়ে একটি বিশেষ পাঠ্যসূচি। আমাদের ছাত্রদের মাঝে সহনশীলতা ও অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করতে শেখার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে।

একজন মানুষ তখনই মুক্ত মনের অধিকারী হয়, যখন সৃজনশীলতার চর্চা হয়। মুক্তবুদ্ধির মানুষ তৈরির সবচেয়ে বড় স্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের প্রস্তাব হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড আরো অনেক উৎসাহিত করা হোক। প্রতিটি ছাত্রকে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমে জড়িত করা হোক। তাহলেই রবীন্দ্রনাথের সেই কল্পনার বিশ্ববিদ্যালয় আমরা পাব যেখানে শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, জ্ঞান উৎপাদন হয়।

গত কয়েকদিন ধরে আমরা একটি অজানা আশঙ্কায় ভুগছি। ছাত্র রাজনীতি যেখানে একটি পরিবারকে করছে ক্ষতবিক্ষত, শিক্ষা ব্যবস্থাকে করছে পঙ্গু, সমাজকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ, অনেকটা গান্ধীর ভাষায়ণ্ড চোখের বদলে চোখ পুরো পৃথিবীকে অন্ধ করে দেয়। হয়তো বা আমাদের সন্তান ঠিক বিশ কিংবা পঁচিশ বছর পর আমাদেরকে অপরাধবোধের গ্লানিতে আক্রান্ত করে বলবে, “তোমাদের জন্যই শিক্ষা আজ পণ্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আজ গোরস্তান”। আমরা কি সেই দিকে এগোচ্ছি ? আমাদের ছাত্র রাজনীতি কি ভুল সময় আর ভুল দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ?
(লেখকবৃন্দ, চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের তরুন শিক্ষক)
দৈনিক আজাদি তে প্রকাশিত, ১৭।০২।২০১২
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:৩৯
১১টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×