somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চট্টগ্রাম কি তবে স্মৃতির শহর হওয়ার পথে?

১৬ ই জুন, ২০১২ সকাল ৯:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভেবে দেখুন তো, আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর পর একজন পর্যটক চট্টগ্রাম বেড়াতে এলে ঠিক কি পরিচয়ে তার কাছে চট্টগ্রামকে চেনাবো ? একজন মানুষ যখন প্যারিস যায় সে এই শহরটিকে চিনতে পারে তার ভিন্নধর্মি ভাস্কর্য দিয়ে, যখন লন্ডন যায় শহরটিকে চিনতে পারে তার নিজস্ব স্থাপনা দেখে, যখন দিল্লিতে যায় তাকে চিনে তার মসজিদের অপূর্ব ও অনন্য শৈলী দেখে। কিন্তু একজন মানুষ যখন চট্টগ্রাম আসবে তাকে দেখানোর মত কিছু কি আসলেই আমাদের আছে? নিজেদের ঐতিহ্য ধ্বংসের উৎসবে যেভাবে আমরা মেতে উঠেছি, তথাকথিত আধুনিক মানুষ হওয়ার জন্য আমরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণকেই যখন বেছে নিচ্ছি, যখন একজন চাঁটগাইয়া হওয়ার চাইতে একজন আমেরিকান হওয়া আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন সুদূর ভবিষ্যতে অদৌ সত্যিকারের চট্টগ্রামের কোন অস্তিত্ব থাকবে কি?
খুব দুঃখ হচ্ছিল যখন চট্টগ্রাম নিয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম আমাদের পুরনো এবং গৌরবময় অধিকাংশ স্থাপনা এখন ধ্বংসের মুখে। একটি ব্রিটিশ ছেলে তার লন্ডন ব্রিজ নিয়ে গর্ব করে, একজন ফ্রেঞ্চ ছেলে তার লুভর মিউজিয়াম নিয়ে অহংকার করে কিন্তু কয়জন এই প্রজন্মের চাঁটগাইয়া ছেলে জানে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের অপূর্ব আদি নকশা সম্পর্কে। কয়জন জানে যে রঙ পাহাড় কোথায়, আর কর্ণফুলি নদীর অন্য প্রান্ত থেকে চট্টগ্রামের একমাত্র কোন স্থান দেখা যেত? কয়জন জানে চেরাগি পাহাড়ের নাম চেরাগি কেন? কয়জন জানে কদম মোবারক মসজিদে গেলে পাওয়া যাবে অপূর্ব একটি পায়ের ছাপ ও নকশা? কয়জন জানে পরীর পাহাড় কোনটি ? না, তারা জানে না, হয়তবা আর জানবেও না। কারণ আমরাই তাদের জানতে দেইনি। আমরা চাই আমাদের এই প্রজন্ম হোক ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাবুসাহেব প্রজন্ম ! তারা আরজেদের মত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বাংলা বলবে আর চাঁটগাইয়া ভাষা তো অনেক দূরের কথা! তারা হবে ডোরেমন প্রজন্ম যে হিন্দি শিখবে, কিন্তু তাও তাকে শত হস্তে দূরে রাখবো দেশাত্মবোধ আর নিজস্বতা থেকে। চট্টগ্রাম কি ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাসে আক্রান্ত হয়ে পাশ্চাত্যের কোন ব্যর্থ রেপ্লিকা শহরে পরিণত হতে যাচ্ছে?
এখন সময় অ্যাপার্টমেন্টের, এখন সময় বড় বড় শপিং সেন্টারের কিন্তু এগুলো সবগুলোই তো ইউরোপ আর আমেরিকার স্থাপনাকেই অনুকরণ করে, আমাদের নিজস্বতার ছায়া কি কোথাও আছে? যা কিছু চট্টগ্রামের, শত কিংবা হাজার বছরের পুরনো, বহন করে মুঘল কিংবা সেই বাদশাহি আমলের অপূর্ব নিদর্শন তার কোনটাই কি আমরা রক্ষা করেছি? সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিয়েছি? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর আমরা কি দিয়ে চেনাবো আমাদের চট্টগ্রাম শহরকে? সবকিছুই তো এখন পাশ্চাত্যের অনুকরণ, আমাদের নিজস্বতা কোথায় ?
ফ্রান্স কিংবা জাপানের একজন প্রত্যন্ত গ্রামের লোক পর্যন্ত একেবারেই তার নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, কারণ এটি তার নিজের ভাষা। আর আমরা? চাঁটগাইয়া ভাষা? এটা তো ওই পাড়ার নিচু মানুষের ভাষা, আমার সন্তানকে অন্তত এই ভাষা শেখানো যাবেনা। এই হল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই শহরের এই সময়ের আধুনিক মানুষেরা লজ্জাবোধ করেন সন্তানকে চাঁটগাইয়া ভাষা শিখতে দেখলে। কিন্তু আমাদের প্রশ্নের জায়গাটি হল, আমি যেমন একজন আন্তর্জাতিক মানুষ হিসেবে ইংরেজি জানবো, বিশুদ্ধ বাংলা জানবো, তেমনি চট্টগ্রামের ভাষা জানাটাও কি আমার নিজস্বতা নয়? এটি আমার অহংকার, আমাদেরই দায়িত্ব একে টিকিয়ে রাখা। যেখানে পৃথিবীতে ইতোমধ্যেই তিন হাজার ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার পথে সেখানে আমরা একবারও আমাদের চাঁটগাইয়া ভাষাকে টিকিয়ে রাখার কথা ভাবছিনা। মাঝে মাঝে আমাদেরও হুমায়ূন আজাদের মত মনে হয়, আমরা বেঁচে আছি অন্যদের সময়ে।
একটা সময় ছিল যখন আমরা অপেক্ষা করতাম, কখন আসবে ছুটির দিন। কখন পাব অসাধারণ সব পিঠার স্বাদ। লেদাপুলি, সাঝের পিঠা , ছাছ পাকন, ছাইন্না পিঠা , তাল পিঠা । সোনালি সেই দিনগুলো বোধহয় অনেক দূরে ফেলে এসেছি। এখন ছুটি মানেই কে এফ সি, পিতজা হাট আর ব্রোস্ট ক্যাফে । এই প্রজন্মের খুব কম ছেলেমেয়েই চিনে সেই পিঠার স্বাদ। কারণ আমরা তো তাদের এমেরিকান বানাতে চাই , তাই ফাস্টফুড ই হল তাদের নিয়মিত খাবার । এই যুগের মেয়েরা স্টার প্লাসের রান্নাকেই অনেক বেশি আকর্ষণীয় ভাবে। আমরা কি এভাবেই একে একে ধ্বংস করে দিচ্ছি নিজেদের সংস্কৃতির এক একটি স্তম্ভকে।
এখনই আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে । আয়োজন করা যেতে পারে ছাত্রদের জন্য নিয়মিত চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্থান ভ্রমণের, আকর্ষণীয় ও রুচিশীলভাবে চাঁটগাইয়া গান উপস্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে। চাঁটগাইয়া খাবার এর নিয়মিত প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো ধ্বংসের অপপ্রয়াস। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ইতিহাস, আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম আমাদের কখনই ক্ষমা করবে না।
-আদনান মান্নান, সুমন ভট্টাচার্য, নুরুদ্দিন মাহমুদ, অনুপম কুমার দাশ, নাসরিন আকতার, অনুপম দাশগুপ্ত
লেখকবৃন্দ : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের তরুণ শিক্ষক।
(দৈনিক আজাদি তে প্রকাশিত ১৬।০৬।২০১২ এ- লিঙ্ক-
Click This Link)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১২ সকাল ৯:২৪
২৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×