somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবাসী তারুণ্যের ভাবনা...একদিন ভোর হবে আমাদের চেতনার ঘরে।।

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আদনান মান্নান, মুশতাক ইবনে আয়ুব, নাসরিন জাহান, শুভাশিস চক্রবর্তী ও ইমতিয়াজ হাসান)
সেদিন ভীষণ বরফ পড়ছিল নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে। হঠাৎ একদল ছেলেমেয়ে সেই বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। সবাই মিলে গাইতে শুরু করল জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাজ করছিল এক বাঙালি ছেলে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। হঠাৎ সে ব্যাগ থেকে বের করল একটা প্রদীপ, গবেষণাগারের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সবাইকে শোনাল বাংলাদেশের গল্প। এক অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষক এসে বাংলাদেশের জন্য আলো জ্বালালেন। কানাডার ক্যালগারিতে সেদিন ছিল হাড়কনকনে শীত। এর মধ্যেই উন্মুক্ত চত্বরে এসে হাজির হলো একদল বাঙালি। সবাই নিশ্চুপ। কারণ, তারা তিন মিনিট নীরবতা পালন করছে।
খণ্ড খণ্ড এই ঘটনাগুলো একেবারেই কোনো কল্পনা নয়। বাংলাদেশের বাইরে থেকেও আমরা যারা অস্তিত্বের প্রতিটি কণিকায় বাংলাদেশকে অনুভব করি, যাদের শিরায় প্রবাহিত হয় বাংলাদেশের স্পন্দন, আমাদেরই এই সময়ের কিছু ঘটনা বলছি।
শাহবাগ আন্দোলন এখন শুধু আন্দোলন নয়, এটি একটি চেতনা, একটি নতুন যাত্রা। শাহবাগের সেই মিছিলগুলোয় হয়তো আমরা নেই, লাখ লাখ মানুষের প্রদীপের ভিড়ে হয়তো আমাদের প্রদীপটি নেই, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের হূদয় এখন একেকটি শাহবাগ। আমরাও শাহবাগের আগুনে উত্তপ্ত হই।
যারা দেশের বাইরে আছি, আমাদের কাছে শাহবাগের এই আন্দোলন কীভাবে আসছে? আমরা কী ভাবছি? আমরা কী দেখছি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে?
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত গণমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশন দেখে বোঝার উপায় নেই শাহবাগের আন্দোলনের ব্যাপ্তি, প্রভাব ও গভীরতা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আজ তরুণ প্রজন্মের প্রাণের দাবি। এর ব্যাপ্তি বোঝা যায়, যখন সমগ্র জাতি তিন মিনিট থমকে দাঁড়ায় এবং সারা দেশ একই সঙ্গে আলোকিত হয় কোটি কোটি মোমবাতির শিখায়। আর এ আন্দোলনের গভীরতা আমাদের পৌঁছে দেয় একাত্তরের ঠিকানায়। বিবিসি, সিএনএনের মতো মাধ্যমগুলোয় আমাদের চোখ সব সময় আঠার মতো লেগে ছিল বাংলাদেশের নামটা দেখব বলে। কিন্তু কখনো সেই সংবাদগুলো বিছিন্ন ঘটনা হিসেবে, কখনো বিতর্কিত একটি জাগরণ হিসেবে, আবার কখনো এল বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আন্দোলন হিসেবে। সত্যিকারের তথ্য পাওয়ার জন্য এসব মাধ্যমের কাছে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বিশ্ব গণমাধ্যমের এমন হতাশাজনক পরিবেশনার মধ্যেও আশার আলো হচ্ছে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ইন্টারনেট। আমরা মুহূর্তের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছি আসল কাহিনি। এর কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে না। আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে থাকি একেকটি বিজয়ের খবর পাওয়ার জন্য। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি হচ্ছে, এই আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষণের খবর পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে ফেসবুক, ইউটিউব আর টুইটারের মাধ্যমে। তথ্য পরিবেশনের জন্য আমাদের দেশে এখন শক্তিশালী একটি মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও ব্লগিং সাইটগুলো।
এই আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, পাশ্চাত্যে যেসব দর্শনের কথা উচ্চারিত হয়, তার বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় বাংলাদেশে। দেরিদা কিংবা ফ্রাঙ্ক ফাঁনের মতো দার্শনিকেরা অনেক আগেই পোস্টমডার্নিজম তত্ত্বে বলে গিয়েছিলেন, এই শতাব্দীর একটা সময়ে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতৃত্ব ছাড়াই মানুষ জেগে উঠবে এবং নাগরিক ইস্যুগুলোয় নিজেরাই নিজেদের নেতৃত্ব দেবে। শাহবাগ দেখিয়ে দিল আমাদের প্রাণের দাবির জায়গাটা কোথায় এবং আমরা কীভাবে কোনো প্রভাব ছাড়াই এক হতে পারি।
এবারের আন্দোলনের অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ওপর যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যে তরুণ কি-বোর্ড ফেলে রাস্তায় নেমে এসেছে, রাতের পর রাত, দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে সেখানে, স্লোগানে মুখরিত করেছে হূদয় ও প্রাঙ্গণ, তার একটা স্বপ্ন আছে আন্দোলনকে ঘিরে। এ স্বপ্নের একটা সফল ও যৌক্তিক বাস্তবায়ন তাকে দেখানো দরকার। এটা তরুণদের আত্মবিশ্বাসের আন্দোলন। তাই এ আন্দোলনকে ঘিরে প্রবল আশার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও থাকছে। এ আন্দোলন থেকে ইতিবাচক কোনো ফল না এলে তা অনেক বছর ধরে তরুণদের বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হয়ে থাকবে। একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার, যে ইস্যুকে ঘিরে এ আন্দোলনের সূত্রপাত—যুদ্ধাপরাধের সমুচিত বিচার—তার একটা শেষ এবারই হওয়া চাই। এ ইস্যুকে জিইয়ে রেখে আর ভোটের রাজনীতির অংশ করার সুযোগ নেই।
শাহবাগের বর্তমানকে আমরা দেখি একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ হিসেবে। গণজাগরণের মঞ্চের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, আমাদের এই ঐক্য হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ইতিহাস বলে, যতবার বাঙালি এক হয়েছে, ততবার বিজয় এসেছে নিশ্চিত। আমাদের প্রজন্ম জেনে গেছে, কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে ভূখণ্ডকে মুক্ত করে গেছেন, তা গড়ার দায়িত্ব আমাদের। দেশের জন্য কিছু করতে হলে দলীয় রাজনীতি করতেই হবে—এই পুরোনো বিশ্বাস এখন আর কেউ লালন করে না। যে ছেলেটি লিখতে জানে, সে তার লেখনী দিয়ে রাজনীতি করছে। যে মেয়েটি আঁকতে জানে, তার রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ তার তুলিতে। যার কণ্ঠ আছে, সে রাজনীতি করছে স্লোগানে। যে ছেলেটি কম্পিউটার বিষয়ে দক্ষ, রাজনীতি জুড়ে গেছে তার পেশায়। যার যা দক্ষতা আছে, সে তার সবটুকু জুড়ে দিয়েছে রাজনীতিতে। রাজনীতি ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। এখন স্থান-কালের প্রয়োজন হয় না। দেশের জন্য করতে হলে দেশে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে—এমনও নয় বিষয়টি এখন। কিছুদিন আগেও হয়তো আমরা চিন্তা করতে পারিনি, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমরা সব বাঙালি একই সময়ে, একইভাবে তিন মিনিটের জন্য একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যাব। সময়ের দূরত্ব এভাবে অতিক্রান্ত হবে, কে জানত।
দেশের এমন সন্ধিক্ষণে থাকতে না পারার কষ্ট আছে সব সময়। কিন্তু হাজার মাইলের দূরত্বে সব বাধা অতিক্রম করে একাত্মতা ঘোষণা করার এই বিরল অনুভূতির মূল্যটাও আমাদের কাছে কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এ প্রজন্ম বিশ্বের কাছে নিজের দেশকে উপস্থাপন করাটা তার অন্যতম দায়িত্ব মনে করে, যে দায়িত্ব পালন করতে কেউ তাকে বাধ্য করেনি। সে নিজেই এই দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
শেষ কথা একটিই, আমাদের স্বভাবজাত প্রবণতা হলো সবকিছুকে বিতর্কিত করা। যেমনটা করি স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে, নোবেল পুরস্কার নিয়ে, এমনকি এভারেস্ট বিজয়ীকে নিয়েও। এই আন্দোলনকে কোনোভাবেই বিতর্কিত হতে দেওয়া যাবে না। এর উদ্দেশ্য ও কর্মধারা পুরোপুরি পরিষ্কার রাখতে হবে দেশবাসীর কাছে, পুরো বিশ্বের কাছে।
নিজের স্বার্থের সঙ্গে যখন দেশের চিন্তা একাত্ম হয়ে যাবে, তখন আসলে আলাদাভাবে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। শাহবাগ এবং আমাদের প্রজন্মকে আমরা দেখি একটি যোগসূত্রের মতো, যেখানে হাজারটা আলো জ্বালানোর জন্য একটি শলাকাই যথেষ্ট।
আমরা আশাবাদী, আমাদের এই ঐক্য নিরবচ্ছিন্ন হবে, আমাদের জয় হবেই। একদিন ভোর হবে আমাদের চেতনার ঘরে, একদিন ভোর হবে আমাদের বাঁধভাঙা স্বরে।
লেখকগণ বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর অধ্যয়নে নিয়োজিত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী।
(অস্ট্রেলিয়া (কার্টিন) , যুক্তরাজ্য (অক্সফর্ড), যুক্তরাষ্ট্র (লং আইল্যান্ড), কানাডার কালগেরি ও জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন তরুন পি এইচ ডি গবেষকের প্রচেষ্টা )
(প্রথম আলো তে প্রকাশিত ২৮।০২।২০১৩ তারিখে-
Click This Link)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:০৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×