ছয় বছর আগে ঠিক মত প্রোপোজ করতে না পারা একটা ছেলে হাত ধরে মনে মনে বলেছিলো, হাতটা ছাড়িস না প্লিজ। হাত ছাড়িনি। সেই হাত ধরার গল্পে কোন গল্প ছিলো না, কোন নাটকীয়তা ছিলো না, কোন বাহাদুরী ছিলো না, খুব সাধারন একটা স্বপ্ন ছিলো, একসাথে বাকি জীবনটা হাঁটবো। সময়ের সাথে সেই স্বপ্নের জল হাঁড়ি থেকে কলসিতে, কলসি থেকে পুকুড়ে, সেখান থেকে ঝিলে, নদীতে শেষে বঙ্গোপসাগরে মিশতে যাচ্ছে। এই সময়টা আমরা যে শুধু একপা দু পা হেটেছি, তা না মাঝে মাঝে দৌড়াতে হয়েছে, মাঝে মাঝে পা পিছলে পরে গেছি, মাঝে মাঝে হাত ছেড়েছি, নিরবচ্ছিন্ন হাত ধরে থাকা হয়নি কখনোই। আপ অ্যান্ড ডাউন ছিলো সেখানে অজস্র। নিজেদের বিকৃত স্বরূপটাও দেখেছি অনেকবারই। তারপরেও একসাথে থাকা যায় বলেই সম্মত হয়েছি, আমাদের অন্য কোন অপশন নেই, সে জন্য না, খুউউউউউউউউউব “ভালোবাসি” সে জন্যও না, উভয় পক্ষের (বাসা) সম্মতি আছে সে জন্যও না, তোমাকে ছাড়া বাঁচিনা, অন্য কিছু ভাবতে পারি না এই টাইপ ডায়ালগের জন্যও না বরং আমরা জানি যে একসাথে চললে চলতে পারবো, জীবনটা সুস্থ্য স্বাভাবিকভাবে যাপন করতে পারবো !
কিন্তু বিষয় হলো সেখানে বিবাহ নামক শর্ত এখন আমাদের পূর্ণ করতে হবে। আপত্তি নাই বিবাহে, আপত্তি আছে চাপিয়ে দেয়া বিবাহে ! বলা ভালো ভীতি আছে।
শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে এখন আমি যুবতী, মনে না হলেও শরীরে; শরীর যেহেতু পরিনত, সুতরাং বিবাহ করা উচিৎ এই কথাটা আমি চারপাশ থেকে অজস্রবার শুনি। শুনতে শুনতে বিশ্বাসও করে ফেলি যে বিবাহ করা উচিৎ এবং এক্ষুনি; দেরী হয়ে গেলে আইবুড়ো হয়ে যাবো, তখন প্রেমিকও উড়াল দেবে, আমাকে কেউ বিবাহ করবে না! তো, আমার উচিৎ সব কিছু বাদ দিয়ে বিবাহ করে ফেলা, এবং সন্তানের জন্ম দিয়ে আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে হলেও ভালো মা হিসেবে, বউ হিসেবে, বৌমা হিসেবে, ভাবী হিসেবে ব্লা ব্লা ব্লা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং শেষ জীবনে আমি এইটা হতে পারতাম, ওইটা হতে পারতাম বলে হা হুতাস করা! কপালের উপর কপাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে আরশিতে দেখা।
বিয়ে কথাটা আমার সামনে বললেই আমি, “এই কি সেই আমি” টাইপ ডায়ালগ দেয়া, “আমি তো এমন জীবন চাইনি” এইসব বলে আক্ষেপ করা আর “তিন বেলা রান্নার পর খাওয়া, আর খাওয়ার পর রান্নার প্রস্তুতি নেয়া” এইসব ভাবতে শুরু করি, জানি বিবাহিত জীবনের একটা সুন্দর দিকও ও আছে, কিন্তু কেন যেন রোমান্টিক ভাবনার বদলে এইসব কদর্য ভাবনা বেশি মাথায় আসে! এত বছর একটা মানুষকে চিনি, (আত্মীয় স্বজনের ভাষ্য, পাত্র যখন রেডি তখন দেরি করে লাভ কি) কিন্তু আসলে কি চিনি? অনেকে হয়তো ভাববেন, এমা একি কথা! এটাই কথা, যাকে আমি ভালোবাসি তাকে বন্ধু হিসেবে চিনি, জানি, প্রেমিক হিসেবে চিনি জানি কিন্তু মানুষ হিসেবে কতটুকু জানি সেটা প্রশ্নের বিষয়। যখন বন্ধু ছিলো তখন সে একরকম, যখন প্রেমিক তখন সে অন্য একরকম ! আবার বিবাহিত জীবনটা অন্যরকম, কারন তখন আমাকে তার অন্য রকম আরেকটা পার্ট দেখতে হবে, সে পার্টে তার বাবা মা আছে, ভাই বোন আছে, আমার বাবা মা আছে, ভাই বোন আছে ! স্বাভাবিক সেই পার্টটা আমার খুব অজানা, অবশ্যই তোমারো! প্রেম করার সময় এইসব নিয়ে কেউ ভাবে না, বিয়ে করার সময় ও না, কখনো এই কারনেই বিবাহিত জীবনটা খুব বিষাক্ত হয়ে যায় বা হতে পারে। বিয়ের আগে প্রেম করা দম্পতি বা নব্য বিবাহিত সময়টুকু পেড়িয়ে গেছে এমন দম্পতি আমি অনেক চিনি এবং জানি, এমন কাউকে পাই নি যে বলেছে “ও না ঠিক আগের মতোই আছে”।
অনেক বিবাহিত দম্পতি এর ধাক্কা না সামলাতে পেরে ডিভোর্স নিয়ে নেয়! আমাকে বিয়ের আগে এইগুলো নিয়ে ভাবার সময় দেন। বিয়ে শুধু একটা নারী এবং পুরুষের মধ্যকার বন্ধন না, বরং জড়িয়ে থাকে দুইটি পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয়। চাইলেই আপনি দুম করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, দুম করে কিছু করে বসা সেখানে খুব কঠিন !
সদ্য মাস্টার্স শেষ করে চাকুরী শুরু করা তারপর বিয়ে করে সংসার করা এইসব ভাবলে আমার জ্বর আসে। এই কথা একজন পূর্ণ যুবতী বললে, ন্যাকামী অনেকের কাছেই লাগে কিন্তু বিষয় হলো একটা সুস্থ্য স্বাভাবিক সম্পর্কের জন্য সময় নিয়ে ভাবা অনেক জরুরী। সেটা সময়টা এক এক জনের কাছে এক এক রকম হতে পারে, কিন্তু সময় নেয়া আসলেই জরুরী। সেখানে এখনই বিবাহ করো, প্রেমিক ভন্ড না প্রতারক সে প্রমান কই, বিবাহের কাবিন এত টাকা হতে হবে, এত লোক আসবে, অমুকখানে বিবাহ করো এইসব সামাজিক অত্যাচার কাহাতক ভালো লাগে! মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি, সারাজীবন হাতে টাকা ধরে রেখে খরচ করার বিদ্যা রপ্ত করতে হয়েছে, চাকুরী করে যাদি উড়িয়ে খরচ করতে মন চায় সেখানে তুমি বাবা কে বাদ সাধার !
থাকি না হয় দু এক বছর একা,
করি না হয় নিজের ইচ্ছে মত খরচ,
গেলাম না হয় থাইল্যান্ড আমেরিকা নিজের কামানো টাকায়, তোমার কি ভাই তাতে?
আমি তোমার খাই না পরি যে তোমায় আমার হিসেব হবে দিতে?
দেন ভাই ক্ষ্যান্ত এবার গিট্টু গুলো খুলে !
এইগুলাতো গেলো সামাজিক হিসাব, আসেন এবার দেখি তত্ত্বে কি দেখি !
নারীবাদের তত্ত্বকথায় টেকনোপ্যাট্রিয়ারকাল অ্যাটেম্প বলে একটা কথা আছে, যার মূল কথা হলো জন্ম নিয়ন্ত্রনকারী সামগ্রীর ব্যবহারে বাধ্য করে নারীর রিপ্রোডাকটিভ রাইটসকে রাষ্ট্র এবং টেকনোলজি কিভাবে নারীকে আবারো পিতৃতান্ত্রিক বলয়ে থাকতে বাধ্য করে ! এই প্রত্যয়টি সামনে আনার কারন হলো, বিবাহ সংক্রান্ত চিন্তা ধারা যখন আমার মাথায় খেলা করে তখন এই প্রত্যয়টি আমার সাবকন্সিয়াস মাইন্ডে খেলা করে। এইটার কারন হলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপতে এসেনসিয়াল মাদারহুড খুব জনপ্রিয় একটা কনসেপ্ট! সেই সাথে গুড মাদার। আর তোমাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপানো বলয়ের মধ্য দিয়ে যেতেই হবে!
সোজা কথা হইলো, বিবাহ তোমাকে করতেই হবে, সাথে বাচ্চা ফ্রি, সাথে তুমি ভালো মা না হইলে তোমার খবর আছে। আমি নারীবাদে বিভাজন টানার বিরোধী কেননা একই সাথে আমি উদারনৈতিক একই সাথে উত্তরাধুনিক, একই সাথে রেডিকাল ! মাতৃত্বের বিরোধী আমি নই, বিবাহের বিরোধী আমি নই কিন্তু আমার জীবনটা ফুটবলখেলার মাঠের বল বানাতে আমি রাজি না। আমি মাঠের বল না যে, এই পা ওই পা ঘুরে আমাকে গোলপোষ্টের সীমানায় যেতে হবে।
এই খানে আবার অতি নারীদের কথা আসে, তারা ঘর করে, বাচ্চা সামলায়, বিসিএস দেয়, অমুক করে তমুক করে, ছক্কা মারে, গোল দেয়। আমি এত কিছু পারি না ভাই, আমার ছোট্ট চাকুরী, অগভীর পড়াশোনার আগ্রহ, দিনশেষে নিজেকে সময় দেব সেই সময়টাও থাকতে চায় না! ছক্কা মারার আগ্রহ থাকলেও টাইমের টানাটানি, মাঝে মধ্যে মা এসে সেই টানাটানি সময় টেনে লম্বা করে (হেসেলে ঢুকতে আমি ভয় পাই না, কিতু বড্ডো টাইম কজিউমিং)।
সো, আই নিড টাইম। আমার মনের বয়স হয় নি এত কিছু নিয়ে ভাববার, জাস্ট নাউ আই ওয়ান্ট টু লিভ মাই ওউন লাইফ, আমি আইবুড়ো হইলে হইছি তাও ভীতি দূর না করে বিবাহ করতে আমি আগ্রহী না! যখন মনে চাইবে, মন বলবে আমি রেডি তখন আমি রেডি, আর মাঝখানের সময়টুকু উড়াল দিতে চাই আকাশে !!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:৩৫