গতকাল ছিলো আমার সমাবর্তন অনুষ্ঠান। দুই বছরের মাস্টার্স কোর্সের অফিসিয়াল সমাপ্তি। আমি পড়াশোনা করেছি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব বন এবং ইউনাইটেড নেশনস ইউনিভার্সিটির অধীনে। সেজন্য বিদায় সংবর্ধনা দুটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পেয়েছি, অভিজ্ঞজনদের কথা, সহপাঠী, অগ্রজদের কথা, তাদের প্যারেন্টসদের ইন্সপায়ারেশন শুনতে শুনতে নিজের ফেলে আসা সংগ্রাম মাথায় বাড়ি দিচ্ছিলো।
ছোট শহরে বেড়ে ওঠা আমার। বাবা সরকারী চাকুরে, প্রথম শ্রেণীর হলেও নন ক্যাডার সার্ভিসে তেমন প্রতিপত্তি নেই। প্রচন্ড কর্মঠ, মিতব্যয়ী, পরপোকারী মানুষ আমার বাবা। একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত পরিবারের হাল ধরতে কঠিনতার লেবাস পরা একজন মানুষ, যিনি আমার শৈশব, কৈশোরের নায়ক। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে যখন জেন্ডার স্টাডিজ পড়তে গেলাম তিনি হয়ে গেলেন খল নায়ক। কিছুতেই ভর্তি হবার টাকা দিবেন না। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক কিছুরই টানাটানি ছিলো, কিন্তু লেখাপড়ার বিষয়ে সবকিছু চাইবার আগে পাওয়া যেত। সুতরাং ভর্তির টাকা বাবা দিবেন না এটা আমার জন্য পুরো অষ্টম আশ্চর্য এবং এই বাবাকে আমি চিনি না। মুসকিলে আসান হলেন আমার চাচা, টাকা দিলেন ভর্তি হবার। ভর্তি হলাম, আবার সব স্বাভাবিক। বাবা সামান্য টাকা পাঠাতেন নিয়ম করে, বাকিটা আমি নিজে টিউশনি করে ম্যানেজ করে নিতাম। জেন্ডার স্টাডিজ কেন পড়বো, এটা খায় না মাথায় দেয়, যেখানে সারা জীবন আম্মু বলে আসছে যে, পুরুষ লোকের বুদ্ধি বেশি, দুইটা মেয়েলোকের সমান, এইসব গোলযোগ হ্যান্ডেল করতে করতে ফার্স্ট সেমিস্টার পার করলাম। স্কোর, আউট অফ ফোরে, ফোর।
বাসায় তখনো মহা ক্যাচাল, এই সাবজেক্টের ভবিষ্যৎ পাঁচ হাজার টাকা বেতনের চাকুরি! ভাইয়া বললো যে অনার্স শেষ করে যেন একটা এম বি এ ডিগ্রি নেই। অন্তত খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবো। আমি যে ত্যাদোর, আমার কপালে শ্বশুরবাড়ি জুটবে না, আবার যদি বাপের বাড়িতে বসে যাই তাহলে তো মুশকিল! তখন আবার ভাই বিবাহিত, ছুটিতে বাসায় ফিরে একদিন ভাবি বললো আমাকে পাত্রস্থ করা হবে, লে হালুয়া!
এই সব কিছু যন্ত্রনা আমাকে সহ্য করতে হইছে শুধু একটা আনকনভেনশনাল সাবজেক্ট বেছে নেওয়ার জন্য। যাই হোক, রাত শেষ করে যেমন সূর্য উঠবেই, তেমন করে আমার ঢাবিতে মাস্টার্স শেষ হলে। শেষ করে কাজ পেয়ে গেলাম সুইসকন্টাক্ট এ, বেতন ভালোই। ঢাকার বাহিরে পোস্টিং, আবার বাসা থেকে যন্ত্রনা, কাজ করতে দেবে না এনজিও তে। সেই যুদ্ধ শেষে চাকুরি করতে গেলাম, বিয়ে করলাম নিজের পছন্দের মানুষকেই, এরপর আরো দুইটা অর্গানাইজেশনে কাজ করে বৃত্তি নিয়ে জার্মানি।
যেদিন বাসায় ফোন করে বৃত্তির খবর দিলাম, আমার আম্মা প্রথম প্রশ্ন করেছিলো যে, মেরাজের কোন সমস্যা আছে কিনা যদি আমি জার্মানিতে আসি! চিন্তা করলে এখনো আমার কষ্ট হয়, এতটা স্ট্রাগল করে এতটুকু সম্মান অর্জন করার পরেও ‘মেয়ে’ জন্য তারা ভরসা পায় না। পড়তে গেলে যদি বিয়ে ভেঙ্গে যায় তারচেয়ে বরং সংসার কর, এই হচ্ছে সারকথা। কি প্যাথেটিক একটা ব্যাপার!
আমি সবসময় বলি, মাই ইনলজ আর বিউটিফুল পিপল। এবং গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সত্যিই তাই। মেরাজকে আমি চিনি আমার বয়স যখন আঠারো তখন থেকে। সেই সময় থেকে আমার প্রত্যেকটা যুদ্ধে পাশে থেকে সমর্থন দেয়া এই মানুষটাকে আমি কখনো পুরো ক্রেডিট দিতে পারিনি। আমাকে আমার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ অসম্ভব ভালোবাসে, সেটা নিয়ে দ্বিধা নেই। কিন্তু আমার পড়াশোনার বিষয়, কাজ মেনে নিতে না পারাটা সবসময়ই একটা দেয়ালের মত কাজ করেছে। একটা সময় পরে আমি মেনে নিয়েছি যে আমার সবকিছু সবার ভালো লাগতে হবে তেমন কোন কথা নেই।
কিন্তু হতে পারতো, আমিও হয়তো এমন একটা সমাবর্তনে আমার কাছের মানুষরা আমাকে কিভাবে ইন্সপায়ার করেছে সেটা গুছিয়ে বলতে পারতাম! কিন্তু দুইটা মেয়েলোকের সমান একটা পুরুষলোকের বুদ্ধির আইডিয়া কে চ্যালেঞ্জ করতে করতে যার বেলা যায় তার পক্ষে লোক দেখানো ভালো কথা বলা সম্ভব না।
এই হাহাকারটা স্থায়ী হয় না, করতে পারি না, মেরাজের একার মলমে একটা সময় সেরে যায়, যেতে বাধ্য হয়।
মাই ডিয়ারেস্ট হাজবেন্ড, মাই সোর্স অফ স্রেংথ, জয়ির পাপা, এই অর্জনের অংশীদার তুমিও ! কংগ্রাচুলেশন্স টু আস!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০২৩ রাত ৩:৪০