somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুহূর্তের মহাকাল

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পণ্ডিত ভীমসেন জোশী বাড়ি পালিয়েছিলেন। কৈশোরেই। ঘর পালানো ছেলে। পকেটে ফুটো পয়সা নেই। তায় আবার ট্রেনে চড়ে বসা! টিকিট চেকারের কানমলা খেয়ে, বারংবার লক-আপে বন্দী হয়েও ভূত নামেনি। শ্রীঘর থেকে ছাড়া পেয়ে আবারো ট্রেনে চেপেছে। গ্বলিয়রে উস্তাদ হাফিজ আলীর কাছে যাবে বলে।

আবার চেকার ধরেছে। চেকারের মন গলানোর জন্য করিম খান সাহেবের গান গেয়ে শুনিয়েছে ছোট্ট ভীমসেন, ট্রেনেই। কাজ হয়নি। গলা ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু হাল সে ছাড়েনি। এভাবেই, গলাধাক্কা খেতে-খেতেই একদিন নিজের তীর্থ— উস্তাদ হাফিজ আলীর কাছে— সে পৌঁছে যায়।

অমন কিশোরের এমন দরদ ভরা স্বর শুনে উস্তাদজী এ ছেলেকে শীস্যত্ব তো দিলেনই, সাথে থাকা-খাওয়ারো একটা হিল্লে হয়।

এখানেই শেষ নয়। পাগলামো আরো আছে। পরবর্তীতে পাহাড়ী স্যান্নালের কাছে গানের তালিম নেবার খায়েশ হল ভীমসেনের। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো বন্দোবস্ত করতে না পেরে শেষে পাহাড়ী স্যান্নালের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবেই নকরী নিয়ে নিলেন। টিফিন কেরিয়ারে করে স্যান্নাল সাহেবকে দুপুরে খাবার পৌঁছে দিতেন সিনেমার সেটে আর চুরি করে-করে তার গান শিখতেন নিমগ্ন ভীমসেন।

শুধু ভীমসেনের কথাই বা বলি কেন! আজকের দুনিয়া কাঁপানো ব্রিটিশ তরুণ এড শেরনের কথা জানেন তো!

বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের বুলিং সইতে-সইতে এক রকম মূক জীবন সে বেছে নিয়েছিল। এইসব আর নিতে না পেরে সব ছেড়ে-ছুড়ে একদিন বেরিয়ে পড়লো গানের টানে। কিন্তু দশা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে, রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও নেই। লাঞ্চ আর ডিনারের জন্য খাবারও জুটলো না কত দুপুর ও সন্ধ্যে। ট্রেনের সিটেই ঘুমিয়ে পাড় করে দিয়েছে কত নিশি। কিন্তু সেই আঁধার রাতেও গানের স্বপ্নটা তার সাথে ছিল। তারপর? বাকিটা তো ইতিহাস। একদিন দুনিয়া মুখরিত হয়ে উঠলো এড শেরনেরই গানে। যেনো হলো ও হেনরীর ‘কুৎচ্ছিত হাঁসের ছানা’ গল্পের মঞ্চায়ন।

আর আমাদের হক সাহেবের কাহিনী জানেন তো! হক! সৈয়দ শামসুল হক! না জানলে তার আত্মজীবনী ‘তিন পয়সার জোছনা’ গ্রন্থটা পড়ে দেখতে পারেন। প্রেম আর পাগলামো তার জীবনে একেবারে চিনি আর জলের মতন একাকার হয়ে গেছে।

শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা, গান— সবই প্রেম। প্রেম মানে পূর্ণ মনোযোগ; পূর্ণ নিবেদন। মানে ‘যাহা চাই প্রাণপনে চাই’। এই চাওয়ারই আরেক নাম প্যাশন; আরেক নাম পাগলামো; আরেক নাম নিজেকে উজাড় করে দেয়া।

নিজেকে উজাড় করে দেয়ার এই লড়াইটিকে ময়দানের ঘোড়দৌড় হিসেবে দেখি না আমি। এই লড়াই নিজের সাথে নিজের। নিজের সাথে বাজি ধরাই এই লড়াইয়ের একমাত্র নিয়ম। প্রতিপক্ষহীণ এই লড়াইকে কবীর সুমনের গানের কথা ধার করে বলা যেতে পারে “পাগল, সাপলুডু খেলছে বিধাতার সঙ্গে”।

আক্ষরিক অর্থে কবিতার শরীরি অবয়বের সাথে আমার প্রথম এনকাউন্টার ঘটে ১৯৯৬ সালে। ততদিনে আমি পরপর দুই ক্লাশে— সিক্স ও সেভেন— দুইবার ফেল করা কমবয়সী আদু ভাই। ৯৬ সালে দ্বিতীয় বারের মতন পড়ছি সেভেনে। তখন প্রথম কবিতা লেখা। কবিতার নাম দু:খ। তার বহু আগে থেকেই অবশ্য মুখে-মুখে কয়েক পঙক্তি করে রচনা করতাম। গুনগুনিয়ে সুরও দিতাম তাতে। সেই সুর গুনগুন করতাম সারা দুপুর, সারা বিকেল। বুঁদ হয়ে থাকতাম। নিজের মধ্যে নিজে। একা-একা ঘুরতাম। দোয়েল পাখির শিস নকল করতাম। ছোটো-ছোটো ঝোপের ভেতর পাখি খুঁজে বেড়াতাম। ভর দুপুরে, মাথা ভন-ভন করা রোদের মধ্যে রোদাসক্ত হয়ে ঘুরতাম উদ্দেশ্যহীন; ঘন্টার পর ঘন্টা; একা; বনে-বাঁদাড়ে; নরসুন্দার পাড়ে; নরসুন্দার বুকে রোদের ছ’টা লেগে ঢেউয়ের মাথায় কেমন ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি করে হাজার প্রদীপ জ্বলে তাই দেখতাম; দেখে-দেখে নেশাতুর হয়ে থাকতাম; বাড়ির পিছনের পতিত ক্ষেতের ঘাসে সবুজ হয়ে থাকা জমিনে রোদের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকতাম সময় ভুলে, রোদাসক্ত।

ছিলাম মুখচোরা। ছিলাম ছোটো-খাটো গড়নের। খেলার মাঠে সমবয়সীদের সাথে দৌড়ে পারতাম না। বউচি খেলতে গেলে দমে হেরে যেতাম। সাঁতারেও গতি ছিল না। পিছনে পড়ে থাকতাম। ডাকা-বুকো ছিলাম না। মারামারিতে যেতাম না। গোল্লাছুটে যে দলে থাকতাম সেই দলের নেতা ধরেই নিত যে, আমাকে খেয়ে ফেলবে প্রতিপক্ষ। ফলে আমি একটা লস প্রজেক্ট। হারু পার্টি।

হারুপার্টি হতে কারই-বা ভালো লাগে! আমারো লাগেনি। তাই হয়তো দলবদ্ধ খেলা বা শক্তি, শৌর্য ও দক্ষতা প্রদর্শনের খেলাগুলোতে আমার অংশ নেয়ার আগ্রহ ছিল না। হয়তো, না-পারা থেকেই আমি একাকী হয়ে নিজের মধ্যে নিজে আনন্দ খুঁজে নিয়েছি। অথবা হয়তো আমার মধ্যে আমি একটা আনন্দের ফল্গুধারা পেয়েছিলাম বলেই শৌর্য দেখানোর খেলায় কোনোদিন দক্ষতা অর্জনের বাসনারা মরিয়া হয়ে ওঠেনি।

কিন্তু কী করে যেনো ফেল্টুস, মুখচোরা, শৌর্যহীন আমি একদিন একটা কবিতা লিখে ফেললাম। কী করে লিখলাম, জানি না। তারপর আরো লিখলাম। আরো। আরো অনেক। ৯৭ সাল থেকে আমার পড়ার টেবিলের এক পাশে জমে উঠতে থাকলো লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-বেগুনী রঙের হোয়াইট প্রিন্টের রোলটানা বাংলা বা রোলটানা ছাড়া সাদা অংক খাতা।

ক্লাশ টেন পর্যন্ত আমাদের বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না। আমার রুমে সারারাত একটা হারিকেন জ্বলতো। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে পরে সবাই শুয়ে পড়তাম। আমি যেহেতু ভালো ছাত্রী ছিলাম না, তাই বেশি রাত অব্দি পড়ালেখা করার ঝামেলা আমার ছিল না। সন্ধ্যে বেলায় পড়তে বসেছি, আর শব্দ করে আমার মা শুনতে পায় মতন কিছু একটা পড়েছি— এই বাঁধা দায়িত্বটুকু সারতে পারলেই আমি ঝারা হাত-পা। তারপর খেয়ে-দেয়ে বিছানায়।

আমার রুমে আমি একা। ছিলাম একটা ভিতুর ডিম। তাই বিছানায় আমার দুই পাশে থাকতো দুইটা বালিশ। চৈত্রের গরমেও আমার গায়ে থাকতো কাঁথা। ভূত যেনো আমাকে খুঁজেও না পায় সেজন্য, সেই কাঁথা টেনে পা-মাথা মুড়ি দিয়ে লাশের মতন শুয়ে পড়তাম আমি। কিন্তু ঘুমিয়ে যাবার আগে প্রতিরাতে হারিকেনটা খাটের মাথার কাছে আলো কমিয়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখতাম। আর খাটের মাথার কাছের নকশা করা কাঠে হেলান দেয়া বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে ভাঁজ করা হাঁটুর উপর রোলটানা খাতা রেখে আলোর দিকে খানিক ঝুঁকে পড়ে আধো আলো-আঁধারিতে লিখতাম কবিতা। প্রতিরাতে। প্রতিরাতে। মাসের পর মাস। সেই সব কবিতার ছন্দ বেশির ভাগই না-মেলা। সেই সব কবিতার ভাষা রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল প্রভাবিত। সেই সব কবিতায় ব্যবহৃত কঠিণ-কঠিণ শব্দের বেশির ভাগই অভিধান থেকে সদ্য শেখা।

এইসব কবিতার কথা কী-করে যেনো রটে গেলো। কী করে যে রটলো, জানি না। কবিতার খবর রটায় একদিন আমাকে দেখতে এলো নজরুল নামের আমাদের পরিচিত একজন। তিনি তখন সদ্য উকিল হয়েছেন। এসে বললেন, “কীরে! তুই নাকি কবি হইয়া গেছঅস! তোর কবিতা দেখতে আসলাম”।

সেই প্রথম কেউ অনাগ্রহ ও অবিশ্বাস ভরা চোখে আমাকে পরখ করতে এসে কবি বলে অনিচ্ছাতেই একটা স্বীকৃতি দিয়ে গেলো।

তারপর সেই কথা আরো চাউর হলো। কবিতার কথা। একদিন আমার এক আত্মীয়— বাবুল ভাই— এসে বললো, তুই যে কবিতা লেখঅছ এইটা আমি আমার এক বন্ধুরে বলছি। সে-ও কবি। কবিতা লেখে। তাদের একটা বড় সংগঠন আছে। প্রতি শুক্রবারে তারা কবিতা পড়ে। সে বলছে, একদিন তোর কবিতা দেখতে আসবে।

একদিন, ১৯৯৮ সালে, সে সত্যিই আমার কবিতা দেখতে আসলো। সন্ধ্যায়। খায়রুল নামের সেই কবি সাথে করে আনলো অনেকগুলো লজেন্স। কবিতা পড়ে অনেক উৎসাহ দিয়ে গেলো। বলে গেলো, সামনের কোনো একটা শুক্কুরবারে তাদের আড্ডায় গিয়ে হাজির হতে।

কিছুদিন পর, এক শুক্রবারে আমাদের এক পড়শী আপার হাজবেন্ড— নয়ন ভাই— আমাকে নিয়ে গেলেন সেই সাহিত্য আড্ডা স্থলে। দুরুদুরু বুকে আমি একাকী আড্ডায় প্রবেশ করলাম। সেটি ছিল সম্ভবত ৯৯ সাল। কিশোরগঞ্জের দৈনিক আজকের দেশ পত্রিকার সাপ্তাহিক আড্ডা ছিল সেটি।

সেই আড্ডায় সবুজ ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই, বাঁধন দা, ঝুনু আপু, জোনাকী আপু, খাইরুল ভাই, মেহেদী ভাই, বাসির ভাই, খোকন ভাই, প্রবীন ডাক্তার আব্দুল বারী মাস্টার ও দ্বীপসহ থোকায়-থোকায় ছিল উজ্জ্বল সব মুখ।

সময় গড়ায়! কিন্তু ফেল্টুস তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। মানে এসএসসি পরীক্ষায় আমি ডাব্বা মেরেছিলাম। পরীক্ষার সময় আমার হাম হয়েছিল। আসলে, হামটা ছিল শাপে বর। না হলে আর আমার ফেলের অজুহাত হতো কী!

তারপর কী করে যেনো একটা জাদু ঘটে গেলো আমার জীবনে। ফেল করার পর, ঝুনু আপু আমাকে খুব দরদ ভরা গলায় একদিন বোঝালো, তুমি যদি মন দিয়ে পড়ালেখা করে ভালো একটা রেজাল্ট করো, তাহলে ভালো একটা কলেজে পড়বে এবং আরো বড় একটা দুনিয়ার সাথে পরিচয় হবে তোমার। তখন আরো অনেক কবিতা লেখার সুযোগ পাবে তুমি।

কবিতাই কি তখন এই ফেল্টুসের জীবনে একটা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছিল? জানি না।

তবে, আমার ফেল্টুস দশা কাটাতে আমার মা কোচিং-এ ভর্তি করালেন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে তার এক নিকাটাত্মীয়— আমাদের মুকুল মামা— যিনি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধেয় একজন পীর, তাঁর থেকে আমাকে অনেক সুরা-কালাম লেখা এনে দিলেন। প্লেটে লেখা সুরা একটানা সাত দিন সকালে পানি দিয়ে ধুয়ে সেই পানি খাওয়ালেন।

হয়তো সেই পানির বরে, হয়তো আমার মায়ের প্রানান্ত চেষ্টার জোরে অথবা হয়তোবা কবিতার ঘোরে আমার জীবনে একটা জাদু ঘটে গেলো।

ফেল করার পর হঠাৎ করেই আমি গণিতে ভালো হয়ে উঠলাম। ইংরেজীতে খুব ভালো হয়ে উঠলাম। আমার ভূতের ভয়ও দূর হয়ে গেলো। এরপর একদিন কলেজে ভর্তি হলাম। আরো বড় গণ্ডির সাথে পরিচয় হলো। ডায়রীতে যোগ হতে থাকলো আরো কবিতা।

শতাব্দীর কণ্ঠ, আজকের দেশসহ কিশোরগঞ্জের প্রতিটি পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রায় প্রতি সপ্তাহে বা সপ্তাহ অন্তর-অন্তর ছাপা হতে থাকলো আমার কবিতা। সেই সব কবিতার পত্রিকার সংগ্রহ জমতে-জমতে আমার টেবিল উপচে, বইয়ের তাক উপচে উঠলো। উপচানো পত্রিকার সংরক্ষণের জন্য আমার মা ঝকঝকে সাদা একটা প্লাস্টিকের বস্তার ভেতর পত্রিকাগুলো জমাতে থাকলো।

এক বস্তায় কুলোয়নি। দু’টো লেগেছিল। আমি ঢাকা চলে আসার পরো, সেই বস্তাগুলো মুখ আঁটা অবস্থায় বহু বছর ধরে যতনে সংরক্ষণ করেছেন আমার মা। বস্তাবন্দী কবিতাদের বহু বছর পেরিয়ে গেলে পরে, একদিন আমার মা সেগুলোকে কাগজের মণ্ড বানিয়ে তার সদ্য শেখা শিল্পকর্ম কাগজ-গলিয়ে-ফুলদানি বানিয়ে ঘরে সাজিয়ে রাখেন। কবিতা এভাবেই ফুলদানি হয়ে যায়। সেই ফুলদানির আত্নকাহিনী অন্যত্র কোথাও বলা যাবে। আপাতত ফেরা যাক, ফ্ল্যাশব্যাকে; কিশোরগঞ্জে; থরোথরো কবিতার দিনে।

নিয়ম করে কবিতার কত-শত অনুষ্ঠানে যাই। মাথায় কবিতার নেশা নিয়ে ঘুরি। রাত জেগে কবিতা লেখি। আমার বাবারো রাত জাগা স্বভাব ছিল। রাত জেগে কবিতা লেখা হলে তরতাজা কবিতা আমার বাবাকে শোনাই। বাবা শোনেন। কিছু বলেন না। কিন্তু কবিতার বাতিক যখন নিরাময় অযোগ্য অসুখে পরিণত হলো বাবা তখন আর তার শংকা চেপে রাখতে পারলেন না। একদিন মাঝরাতে কবিতা পড়ে শোনানো শেষে বড্ড চিন্তিত মুখে বললেন, “পুত! তোমার এইসব কবিতার ভবিষ্যত কী! কবিতা লেইখ্যা কী হবে! তুমি কি রবীন্দ্রনাথ হইবা না-কি মধুসূদন হইবা!”

আমার বাবা আমাকে বেশির ভাগ সময়েই ‘পুত’ বলে সম্বোধন করতেন।

সেই মাঝরাতে বাপে-ঝিয়ে তুমুল আলাপ। আলাপ না বলে তর্ক বলাই ভালো। “কী হবে কবিতা লিখে”! এই প্রশ্নকে মাঝখানে রেখে আমরা দুইজন দুই তীরে লড়ে যাই। আব্বি আমাকে একে-একে ভাগ্য বিড়ম্বিত কবিদের কাহিনী শোনায়। নজরুলের, মুধুসূদনের। এমনকি তিনি এই ভয়-ও পান যে, ‘তুমি না-জানি শেষে মধুসূদনের মতন না খাইয়া মরবা’!

সকল দায় চাপে কবিতার কাঁধে। আমার বাবার মুখ দুশ্চিন্তায় চুন হতে থাকে।
বাবার দুশ্চিন্তা কিছুটা কমলো ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট দেখে। ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্টে মানবিক শাখা থেকে কলেজে প্রথম হলাম। পরে শুনেছিলাম, এই রেজাল্টই হলো মানবিক শাখায় কিশোরগঞ্জ সদরে সেরা রেজাল্ট।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। প্রথম দুই বছর খুব মন দিয়ে পড়লাম। ফার্স্টক্লাশ ফোর্থ হলাম। রেজাল্টের বহর দেখে বাবা হয়তো মনে ভেবেছিলেন, যা হোক, মেয়ে তার অন্তত ভাতে মরবে না।

কিন্তু ধীরে-ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় আগ্রহ কমে গেলো। মনে হতে লাগলো, আরে! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী হবে! আমি তো সংসারে কবি হতে এসেছি!

ধীরে-ধীরে ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ডাব্বা মারলাম। ফার্স্টক্লাশ শিকেয় উঠলো। কবিতার সুখ ও অসুখ বুকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর ঝোঁপের ফাঁকে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে সিগেরেট ফুঁকতে-ফুঁকতে কত বিকেল-সন্ধ্যা পাড় হয়ে গেছে পাখিদের কলরব শুনে সেসবের স্বাক্ষী ছিল সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা সোহরাওয়ার্দীর কাক-পক্ষীর দল।

যখন ঢাকায় পড়তে এলাম, কিশোরগঞ্জে আমার পরিচিতেরা কেউ ভেবেছিল আমি থিয়েটারে থিতু হবো। কেউ ভেবেছিল বিরাট বিতার্কিক বা আবৃত্তিকার হবো বুঝি। অনেকেই ভেবেছিল, আমি হবো বামরাজনীতির তুখোড় কর্মী।

না। কিছুই হওয়া হয়নি। অমলকান্তি হওয়াই ছিল আমার ভবিতব্য।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পরপরই, একদিন এক শুভাকাঙ্ক্ষী এসে জোর করে নিয়ে গেলেন এক থিয়েটারে নাম লেখাতে। সেদিন থিয়েটার থেকে ফিরে এসে ফাইনালি নাম লেখাতে যাবার আগে অনেক ভেবেছি। মন কী চায়?

মন কবিতা চেয়েছে। থিয়েটারের খাতায় আর নাম তুলিনি আমি। হলে বিতর্কের ক্লাব থেকেও ধীরে-ধীরে নিজেকে মুছে দিয়েছি। আমার তীর্থ অন্যখানে। ছাত্ররাজনীতির খাতা থেকে ইরেজারে তোলা পেন্সিলের দাগের মত হাপিস হয়ে গেছি। স্বেচ্ছায়। আলগোছে। কেউ কিচ্ছু জানে না। জানে শুধু একটা পাগল, অহর্নিষ যে ‘সাপলুডু খেলছে বিধাতার সঙ্গে’।

কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কবিতার সাথে নাটক বা রাজনীতির বিরোধ কী ছিল? না। কোনো বিরোধ ছিল না। আমি একসাথে অনেকখানে ছড়িয়ে পড়তে পারি না। তাই, নিজের সীমিত সামর্থের পুরোটা একসাথে জড়ো করে একখানেই হতে চেয়েছি নিবেদিত। ষাষ্ঠাঙ্গে এক দেবতাকেই করতে চেয়েছি প্রণিপাত।

কাউকে দেখানোর কিছু নেই। কারো কাছ থেকে স্বীকৃতির কিছু নেই। নিজেকে উজার করে দিয়ে কোনো প্রত্যাশা ব্যতিরেকে এই খেলা খেলতে হয়। বাজি ধরে ফতুর হয়ে গেলেও দোষারোপ করবার কেউ থাকে না এইখানে। এখানেই অমলকান্তিদের সাথে মহাভারতের চরিত্রদের ফারাক। যুথিষ্ঠির বাজি ধরে রাজ্য খোয়ালেও নিজের দোষ তিনি চালিয়ে দিতে পারেন অন্যের প্ররোচনার নামে। অমলকান্তিরা যুথিষ্ঠিরদের চেয়েও সৎ ও সাহসী। বাজির দানে হেরে যাবার সকল দায় তারা তুলে নেন নিজের কাঁধে।

‘রক্তগোলাপ’ নামে সৈয়দ হকের একটি গল্প আছে। গল্পের মূল চরিত্র আল্লারাখা। সার্কাসে খেলা দেখায়। তার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। গোলাপ ফোটানোর অলৌকিক ক্ষমতা। নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ফোটাতে হতো সেই ফুল। নিজেকে খরচ করেও ফুল ফোটাতে তার বড় ভালো লাগতো।

আমারো নিজেকে আল্লারাখা মনে হয়। নিজেকে ক্ষয় করে ফুল ফোটানোই নেশা; আনন্দ। এই ফুল দেখে কারো ভালো লাগলে, রঙের বিভায় ঝলমলিয়ে উঠলে কারো চোখের মণি, সেটি আল্লারাখার বাড়তি পাওনা বটে। কিন্তু এই খেলায় আর কারো কাছ কোনো চাওয়া নেই। আল্লারাখাদের যত চাওয়া, নিজেরই কাছে।

অতএব, কাঠ-খড় পোড়ানোর গল্প ফেঁদে বসে কারো করুণা বা বাহবা পাবার মতি নেই। রোদ্দুর হতে চেয়ে অমলকান্তি কিছুই হতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া বেকুব বনে গিয়ে বিধাতার সাথে সাপলুডু খেলছে বলে কেউ-কেউ ভাবতে পারেন বটে। কিন্তু অন্যের চোখের মাপে অমলকান্তিরা বাঁচে না। বাঁচার জন্য অমলকান্তিদের একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী আছে।

কে কোন জায়গা থেকে, কোন দৃষ্টিভঙ্গি বা পার্সপেক্টিভ থেকে জগৎটাকে দেখছে সেখানেই ঘটে যত ফারাক। নিজের জীবনটাকে চিরকাল ঘোড়দৌড়ের মাঠ ভাবা রপ্ত করেছেন যে যুবরাজ তার সাথে রাজার ছেলে হলেও সিদ্ধার্থের জীবনের হিসেবটা মিলবে না।

অতএব আপনি— কেন্দ্র থেকে দূরে, প্রান্তের কোনো রাতে বসে হারিকেনের টিমটিমে আলোয় যিনি কবিতা করছেন রচনা— লোকের কথায় বিচলিত হবেন না। আপনার হাতে কলম ধরা ওই মুহূর্তই মহাকাল।

জেনে রাখবেন, পৃথিবীতে কেন্দ্র বা প্রান্ত বলে কিছু নেই। সবই দেখার ফারাক। ব্যাখ্যার ভেল্কি। কে কোন জায়গা থেকে দেখে তার উপরেই নির্ভর করে সব। ছোট্ট একটা বাসের ভেতর বসে থাকলে বাসটিকেই অনেক বড় মনে হয়। আর রকেটে চেপে মহাকাশের সুদূর দূরত্বে গিয়ে যদি মাতা ধরিত্রীকে দেখেন, তো দেখবেন গোলগাল এক নীলাভ গ্রহ মহাবিশ্বের অসীম শূন্যতার মাঝে ছোট্ট একটা মায়াবী বলের মতন কী অদ্ভুত কায়দার ঝুলছে।

মহার্ঘ এই নীল বল স্বর্গ-নরকের তাবৎ কাহিনী ও স্ক্রিপ্চারসহ একদিন সময়ের গহ্বরে লীন হয়ে যাবে। সময়ের কোনো ভূত-ভবিষ্যত নেই। সময়ের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যিনি গমন করেন, তিনিই নিজের সুবিধার্তে স্মৃতিতে টেনে দেন ভূত-ভবিষ্যতের ধারণা। আদতে ভবিষ্যত একটা ভ্রম; একটা মায়া।

তাই, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে কী পেলাম, কী পাবো, কী আমার ভবিষ্যত সেই হিসেবের ধারে-কাছে আমি আর নেই। আমি বরং রোজ করি আমার মুক্তি রচনা আমারই লেখায়-লেখায়। আমি বরং অনিত্য এই জীবনের মোহন মুহূর্তদের ভেতর পাই মহাকাল ধরে বেঁচে থাকার অপার আনন্দ।
___

দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাহিত্য আয়োজন 'কালের খেয়া'য় আজকে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। লিংকটিও রইলো।

মুহূর্তের মহাকাল
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:৩৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×