somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

আফরোজা সোমা
আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

‘ফাগুন হাওয়ায়’ যত কথা মনে আসে

২১ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নির্মাতা তৌকির আহমেদকে ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করতে চাই। ফাগুন হাওয়ায় সিনেমাটি দেখলাম। পরিচালক হিসেবে তৌকির আহমেদকে শুধু সাবলীল নয়, বেশ ঋদ্ধ মনে হয়েছে। তবে, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই একটু দুরু-দুরু মন নিয়েই সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। কারণ এর আগে আগ্রহী হয়ে ‘হালদা’ দেখতে গিয়ে কিছুটা আশাহতই হয়েছিলাম। ‘জয়যাত্রা’ ও ‘অজ্ঞাতনামা’র পরিচালকের কাছে হয়তো প্রত্যাশা আরেকটু বেশিই ছিল।

সে যাই হোক, দর্শকের প্রত্যাশার ভার বহনে নির্মাতা ‘হালদা’য় কতখানি সফল হয়েছিলেন আজ আর সেই আলাপ নয়। আজ বরং সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নিয়েই কথা হোক।

পরিচালক হিসেবে তৌকির ইতোমধ্যেই এই বার্তা জানান দিয়েছেন যে, কেবলি ‘বিনোদন রচনা করা’ তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি বরং বিনোদনকে আশ্রয় করে বড় পর্দায় হাজির করার চেষ্টা করছেন সমাজ-বাস্তবতার গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রসঙ্গ। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘জয়যাত্রা’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ফাগুণ হাওয়ায়’ সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত।

ফাগুন হাওয়ায় চলচ্চিত্রটি কেবলি বিনোদনের উৎস নয়। সুনির্মিত এই সিনেমা আমার কাছে জরুরি হয়ে উঠেছে এর রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে। ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই কাহিনীচিত্রটি শুধু যে নিষ্পষণের বৃত্ত ভাঙার অতীতকে তুলে এনেছে তা নয়। বরং এই চলচ্চিত্রটি আজকের বাস্তবতাতেও ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক।

সিনেমার গল্পে যে থানার ওসিকে দেখানো হয়েছে তার জায়গায় আজকের বাংলাদেশের কোনো বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তাকে বসিয়ে দিয়ে তার ইংরেজী-প্রীতির গল্পটি আপনি অনায়াসে বলে দিতে পারবেন।

আজকের বাংলাদেশে ইংলিশায়নের চাপে পড়ে বাংলা যে তলে-তলে কতটা নমঃশূদ্রের ভাষায় পরিণত হয়েছে তা আপনারা অনেকেই জানেন ঠাহর করি। বিশেষত, সন্তানকে ‘সুমানুষ’ করার বাসনায় তাকে ‘সুশিক্ষা’ দেবার নিমিত্তে ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলোতে সন্তানকে ভর্তি করতে বাবা-মায়েরা যেভাবে প্রাণপাত করছেন তা দেখে এটি ভাবা মোটেও অবান্তর নয় যে, বাংলায় যথেষ্ট সুমানুষ হওয়া এবং সুশিক্ষা পাবার সুযোগ আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। মানে যার আর উপায়-অন্ত নেই সেই যাচ্ছে বাংলা-মিডিয়ামে। অর্থাৎ বাংলা এখন আর কোনো ‘চয়েস’ বা যেচে গিয়ে কোলে তুলে নেবার বিষয় নয়। বরং বাংলা হচ্ছে অগতির গতি ও নিরালম্বের অবলম্বন।

বাংলার করুণ চিত্র যদি আরো দেখতে চান তাহলে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকান। বাংলাদেশের ক’টা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও ভাষা পড়ানো হয় আর ক’টা-তে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়?

জানি, বাস্তবতা বড়ই পরিহাসময়। বাংলা সাহিত্য ও ভাষা একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই। কিন্তু ইংরেজী আছে। কারণ বাস্তবে কাজে-কর্মে-চাকরীতে-বাকরীতে ইংরজেী ভাষার কাটতি আছে। যে ভাষা জানলে লোকে ‘জাতে উঠা গেলো’ বলে ভাবে তার সাথে তো আর গরিবী ভাষার তুলনা চলে না!

তবে, এক্ষেত্রে এটি বলে রাখা দরকার যে পৃথিবীর সব ভাষাই অপরাপর ভাষা থেকে শব্দাবলী গ্রহণ করে। আর এভাবেই ভাষা প্রবাহমান নদীর মতন ক্রমাগত বয়ে যেতে থাকে বা সমৃদ্ধ হতে থাকে। সেই হিসেবে বাংলায় আরবী-ফার্সি-ইংরেজী-উর্দুসহ যত বিদেশী শব্দ আছে এবং যেগুলো বাংলায় আত্মীকরণ করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে আমি কোনো আপত্তি তুলছি না। আপত্তিটা অন্যখানে। মানে কোনো ভাষাকে শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ আর কোনো ভাষাকে গরিবী আরোপের প্রশ্নে।

ভাষা একটি হাতিয়ার। এই হাতিয়ার দিয়ে মানুষ চিন্তার অনুবাদ করে। ভাষা যেমন চিন্তার বাহক, তেমনি ভাষা একটি তীব্র রাজনৈতিক প্রসঙ্গও বটে। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেবে, ভাষা দিয়েই আলাদা হয়ে যায় শাসক ও শোষিতের শ্রেণী।

একসময় সংস্কৃত ছিল অভিজাতের ভাষা। এই ভাষায় চাঁড়ালের অধিকারকে মেনে নেয়নি ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ। অর্থাৎ ভাষারো আছে জাত পরিচয়। যেমন আছে রাজার ভাষা ও প্রজার ভাষা। মুসলিম শাসকদের হটিয়ে দিয়ে ইংরেজ বেনিয়ারা যখন রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন কেবল শাসকের পতন ঘটে না। ভাষারো পতন ঘটে। রাজভাষার মর্যাদা থেকে একদিন ফার্সির নাম কাটা যায়। নয়া শাসকের আগমনে রাজভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় ইংরেজী। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় যারা যত দ্রুত শাসকের ভাষা রপ্ত করতে পেরেছিল, তারাই তত দ্রুত যেতে পেরেছিল রাজ ক্ষমতার কাছাকাছি। ইংরেজরা বিতাড়িত হবার পর মসনদে অধিষ্ঠিত হয় নয়া শাসক পাকিস্তান। ইংরেজদের মতন তারাও এসে রাজভাষায় বদল ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই ক্ষেত্রে বদল মানে সংযোজন। মানে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ইংরেজী ভাষার বিলোপ তো ঘটানো হলোই না, তার উপরে বোঝার উপর শাকের আঁটি মতন এসে জুটলো উর্দু।

ফলে, অফিসিয়াল বা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গুরুত্বের কেন্দ্রে উঠে আসে উর্দু ও ইংরেজী। আর বাংলা হয়ে যায় ব্রাত্য।

ফলে, ভাষা আর নিছকই নিরীহ ভাষা হয়ে থাকে না। হয়ে থাকে না শুধুই মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। বরং ভাষা হয়ে উঠে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ। ভাষা হয়ে উঠে স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতীক। ভাষা হয়ে উঠে ক্ষমতা কাঠামোতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জারী রাখার উপায়।

আপনারা যারা ফ্রান্জ ফানোন-এর লেখনির সাথে পরিচিত তারা নিশ্চয়ই জানেন, ভাষার সাথে রাজনীতির ওতপ্রোত যে সম্পর্ক সেই বিষয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা করেছেন মার্ক্সবাদী এই পণ্ডিত ও মনোরোগ বিশ্লেষক। উপনিবেশিক শক্তিগুলো ভাষাকে উপজীব্য করে নয়া ক্ষমতা বলয় ও সংস্কৃতি গড়ে তুলে কীভাবে নিজেদের সুপ্রিমেসি বা শ্রেষ্ঠত্ব জারি রাখে তার দারুণ বিশ্লেষণ ফানোন দিয়েছেন।

ফানোন-এর যত কাজ আছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্কস’ গ্রন্থটিকে। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফানোন লিখেছিলেন এই বই। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত সেই পুস্তকে উপনিবেশিক শক্তির চরিত্রকে উন্মোচন করা হয়েছিলো দারুণ নৈপুণ্যে।

ভাষা কী করে মানুষের চিন্তা ও মননের উপনিবেশিকীকরণ ঘটায় এবং মনোজগতে এর কী প্রভাব পড়ে তা নিয়ে বিস্তারিত অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্কস’ বইয়ে। তাঁর এই গ্রন্থেই ছিল মনকে বি-উপনিবেশিকীকরণের ডাক। আলজেরিয়ার বুকে দখলদারিত্ব বজায় রাখা ফরাসী উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী যে বিপ্লবীরা লড়ছিলেন, এই গ্রন্থ সেই বিপ্লবীদেরকে আরো উস্কে দিয়েছিল।

এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়টি শুরুই হয়েছে নিগ্রো বা কালো মানুষদের উপরে উপনিবেশী শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের ভাষার প্রভুত্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিয়ে।

আগেই বলেছি, ভাষা হচ্ছে মানুষের চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম। তাই, মাধ্যমটি হুট করে কেড়ে নিলে এর ব্যাবহারকারীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দূর্বল হয়ে পড়ে। এর প্রমাণ পাবার জন্য আপনার ইতিহাসে ফেরত যাবার দরকার নেই। বর্তমান বাংলাদেশেই আপনি সেই উদাহরণ পাবেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে কয়েক ডজন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশের অফিসিয়াল বা দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজী। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ভাষাও ইংরেজী। অর্থাৎ ইংরেজীতে পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক। শহুরে ছেলে-মেয়েরা যারা অপেক্ষাকৃতভাবে ইংরেজীতে সাবলীল তারাই সাধারণত এই ইংরেজী-প্রধান পদ্ধতিতে পরীক্ষায় ভালো করে। আর যারা ইংরেজীতে ‘তত ভালো নয়’ তাদের জন্য ভালো ফল করা কঠিণ।

আমি নিজে বিভিন্ন সময়ে তিনটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যখনই একজন শিক্ষার্থীর মুখ থেকে তার মাতৃভাষা বাংলাকে কেড়ে নেয়া হয় তখন অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মানসিকভাবে চাপ বোধ করেন এবং অনেকে আত্মবিশ্বাসহীনতায় পড়েন। মানে সে তার জানা বিষয়টাও বলতে পারে না। কারণ তারা ‘ইংরেজীটা ঠিক মতন জানেন না’। ফলে, এখানে ইংরেজী জানা ও না-জানা বা ইংরেজী ভালো জানা ও কম জানার ভিত্তিতে গড়ে উঠে আরেকটি শ্রেনীভেদ।

বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকুরী দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দেয়া হয় ইংরেজী ভাষাকে। ফলে, যেই ছেলেটি বা মেয়েটি অপেক্ষাকৃত ‘চোস্ত ইংরেজী জানে’ তাকেই ‘যোগ্য’ বলে বিবেচনা করা হয়। এভাবেই আজকের বাংলাদেশেও আমাদের সামাজিক জীবনের সর্বস্তরে এখনো ভাষা প্রশ্নে বিভেদ বিরাজমান।

ফাগুন হাওয়ায় চলচ্চিত্রের কেন্দ্রে রয়েছে উর্দু বনাম বাংলার লড়াই। সেই লড়াইয়ে বাংলা জিতে গিয়েছিল। কিন্তু একবার জিতে গেলেই যে সেই জয় চিরস্থায়ী হয় না ইতিহাসে এই প্রমাণ ভুরি-ভুরি আছে। যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষাটা কোন ভাষায় এখনো সম্পন্ন হয় জানেন? ইংরেজীতে।

কর্তাদেরকে আমার প্রশ্ন করতে মন চায়, ইংরেজী জানার সঙ্গে জ্ঞানের কী সম্পর্ক? লালন বা সক্রেটিস ইংরেজী জানতেন না। কিন্তু তারা কি কম জ্ঞানী ছিলেন?

সেই সময়ে পাকিস্তানী শাসকেরা ছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া গেছে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যে অরাজক পরিস্থিতি চলছে সেখানে আপনি কার বিরুদ্ধে স্লোগান দেবেন? ভাষা আন্দোলনের ৭ দশক হয়ে গেলেও আজো আমাদের উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা হলো না। এই পরাজয় কার?

তৌকির আহমেদের ফাগুন হাওয়ায় দেখতে গিয়ে এইসব জরুরি প্রশ্নগুলো আরেকবার আমার মনে দোলা দিয়ে গেছে। তৌকিরের মতন নিজের দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গিকারাবদ্ধ পরিচালকদের আরো বেশি করে এগিয়ে আসা উচিত। রাষ্ট্রের ভেতরে এখনো অমিমাংসিত যে প্রশ্নগুলো রয়েছে সেইগুলো নিয়ে কথা বলা উচিত। কারণ শিল্প, সাহিত্য ও সিনেমার কল্পিত চরিত্রদের ভেতর দিয়ে কঠিণ সত্যটিও যত সহজে বলে দেয়া যায় বাস্তবে তা তত সহজ নয়।

আজকের বাংলাদেশে যেভাবে ইংলিশায়ন বা ইংরেজীকরণ হচ্ছে তা তো মহামারী বটেই! ক্রমবর্ধমান ইংলিশায়নের চাপে পড়ে আজকের বাংলাদেশেও সাধারণ মানুষজন কিভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে, সময় হয়েছে সেই গল্পগুলো তুলে আনার।

কেনিয়ার মতন দেশ ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ বা উপনিবেশিকতার খোয়ারি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেরা বহু ধরণের উদ্যোগ নিয়েছে। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর মতন লেখকেরা মনের বি-উপনিবেশীকরণ নিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বলয়ে আওয়াজ তুলেছেন। এমনকি উপনিবেশীক শিক্ষা পদ্ধতি পাল্টানোর তাগিদও তারা বোধ করেছেন। বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজীর উপরে অধিক গুরুত্বারোপ করার উপনিবেশিক রীতিকে তারা প্রশ্ন করেছেন।

আমাদের দেশ তথা ভারত থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হয়ে পাকিস্তানীরা এসে তারা-ও বিতাড়িত হলো। মানচিত্রে আমরা একটা স্বাধীন দেশ-ও পেলাম। কিন্তু আমাদের মনের বি-উপনিবেশীকিকরণ আজো হলো না। তার উদাহরণ চান?

যে উদাহরণটি এখন দেবো সেটি খানিকটা পরিহাসের মতন শোনাতে পারে।
যেই ফাগুণ হাওয়ায় চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে আমি উচ্ছসিত হয়ে লিখতে বসেছি সেই সিনেমার শুরুতে ও শেষে ভাষা আন্দোলনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন তারিখ ও তথ্য লিখিত আকারে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সেটি করা হয়েছে কোন ভাষায় জানেন? ইংরেজীতে।

এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা ভাষাভাষী দর্শকদের জন্য ইংরেজীতে পরিচালক তথ্যটি কেন তুলে ধরলেন? এর পেছনে কোন মানসিকতা কাজ করেছে? মনের অবচেতনেই ইংরেজীকে আমরা যে একটি সুপ্রিমেসি বা শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় বসিয়ে রেখেছি এটি কি নয় তারই অসচেতন বহি:প্রকাশ?

ইংরেজী পড়তে পারেন না এমন দর্শক কি এই সিনেমা দেখতে গিয়ে নিজেকে ‘এলিয়েনেটেড’ বা ‘বিচ্ছিন্ন’ ভাবতে পারেন না? বা তিনি নিজে ‘যথেষ্ট শিক্ষিত নন’ এমন হীনমন্যতার বোধে কি আক্রান্ত হতে পারেন না? যদি ধরে নিই যে, বাংলা পড়তে পারেন না এমন ভাষাভাষীদদের জন্য পরিচালক ইংরেজীতে বক্তব্যটি তুলে ধরেছেন তাতেও তো প্রশ্নের সমাধান আসে না। কারণ সেখানে তো বাংলায় কোনো টেক্সট বা লেখা ছিল না। অর্থাৎ বাংলাদেশের যে দর্শকেরা ইংরেজী পড়তে পারেন না, তাদের জন্য বাংলায় এই বক্তব্য উপস্থাপন করা হলো না কেন? কেন নির্বিকল্পভাবে কেবল ইংরেজীকেই রাখতে হলো? এটি দ্বিভাষিক হলে ক্ষতি কী ছিল?

এই ‘কেন’ এক জরুরি প্রশ্ন। এই জরুরি প্রশ্নগুলো উঠে আসা দরকার। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের রাজৈনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের অমিমাংসিত এই ‘কেন’গুলো গুরুত্ব দিয়ে তুলে আনতে হবে। আর তুলে আনার দায়িত্ব তৌকিরের মতন মেধাবী ও অঙ্গিকারাবদ্ধ মানুষদেরই।

শুধু ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বিরল। তাই, সেই বিবেচনায় তৌকিরের এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর বিষয়বস্তুর গুরুত্বকে একপাশে সরিয়ে রেখে যদি শুধু যে-কোনো একটি চলচ্চিত্র হিসেবেও ‘ফাগুণ হাওয়ায়’-কে বিবেচনা করা হয়, তাহলেও এটি একটি সফল নির্মাণ।

টিটু রহমানের ‘বউ কথা কও’ নামের যে ছোটো গল্পের অনুপ্রেরণায় এই কাহিনীচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে সেই গল্পটি নিজেই খুব হৃদয়গ্রাহী। আকর্ষণীয় গল্পের সাথে যোগ হয়েছে পাত্র-পাত্রীদের সহজাত-সাবলীল অভিনয়। ভারতীয় অভিনেতা যশপাল শর্মা তো রগচটা, উন্ন্যাসিক পাক-পুলিশ অফিসার হিসেবে দারুণ অভিনয় করেছেন। দিপ্তী চরিত্রে তিশা এবং উর্দু ভাষা শিক্ষাদানকারী হুজুর চরিত্রে অভিনয় করা ফারুক আহমেদ এবং সুইপার হিসেবে বাবু দারুণ অভিনয় করেছেন। আর বোবা মেয়েটির চরিত্রকে যিনি পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনিও ছিলেন বেশ সতস্ফূর্ত ও সপ্রতিভ। চলচ্চিত্রের দৃশায়নও ছিল দৃষ্টিনন্দন। বিশেষ করে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত এবং এরকম আরো কিছু প্রাসঙ্গিক দৃশ্য তো ছিল দারুন অভিঘাত সৃষ্টিকারী।

তবে, এখানে দু’য়েকটা প্রশ্ন না করে পারছি না। সেই ৫১ সালের খুলনার বাংলাদেশে মানুষ কি কথায়-কথায় ‘প্লিজ’ শব্দটি ব্যাবহার করতো? সিনেমার খুব গুরুত্বপূর্ণ দুইটি দৃশ্যে তিশার সংলাপে কয়েকবার ‘প্লিজ’ শব্দটি এসেছে। যা কানে খটকার মতন লাগে।

আরেকটি প্রশ্ন। এই সিনেমাটিতে বলা হয়েছে খুলনা অঞ্চলের একটি গল্প। কিন্তু পুরো চলচ্চিত্রটিতে খুলনার টানে কথা বলা একটা সংলাপও নেই। তা কী করে হয়! আজ থেকে ৭ দশক আগে কি খুলনার আপামর মানুষজন আজকের মান বাংলায় কথা বলতো?

তৌকির নিজেই স্থপতি। স্থপতি হিসেবে তার জানবার কথা, দিপ্তীর ঠাকুরদার নিবাস একটি উপনিবেশিক ভবন হওয়াই যৌক্তিক। কিন্তু চলচ্চিত্রে যে বাড়িটি দেখা যায়, সেটির বহিরাবরণ ইংরেজ আমলে নির্মিত বাড়ির মতন নয়। দিপ্তীর দাদা-বাড়ি হিসেবে যে বাড়িটিকে দেখানো হয়েছে, সেখানে বহুল চর্চিত আধুনিক স্টোন টাইলস (প্রচলিত পরিভাষা জানা নেই)-এর ব্যবহার দৃশ্যমান। যা কিছুতেই ইংরেজ আমলে নির্মিত স্থাপনার অনুভূতি দেয় না। কারণ সেই সময়ে এই স্টোন টাইলসের ব্যবহার ছিল না। তবে, বাড়ির ভেতরের আভ্যন্তরীন সজ্জায় পুরনো সময়ের আবহ ধরে রাখার চেষ্টা লক্ষ্যনীয়।

সিনেমায় নায়ক-নায়িকার যখন প্রেম হয়ে যায় সেটির প্রকাশার্থে একটি গানের ব্যবহার করা হয়েছে। সেটি নিয়েও একটি প্রশ্ন আছে। দীপ্তি ও নাসির যখন পরস্পরের কাছে নিজেদের হৃদয়ের কথা প্রকাশ করে সেই মুহূর্তে যে গানটি সংযোজন করা হয়েছে একটি একক গান হিসেবে এটি যথেষ্ট হৃদয়গ্রাহী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ‘৫১ সালের বাংলাদেশের দুই তরুণ-তরুনীর প্রেম বোঝাতে যে গানকে ব্যবহার করা হলো সেটিকে কি মনে হয় না একটু খাপছাড়াভাবে আরোপিত এবং অধুনা দোষে দুষ্ট? অর্থাৎ এই গানটির কথা বা সুরে কি কোনোভাবেই দর্শকের মনে হবে যে সে ৫১ সালের একটি দ্যোতনা পাচ্ছে?

ইতিহাস ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এইসব খুঁটিনাটি বিষয় আরো মনোযোগের দাবি রাখে। বিশেষ করে যে পরিচালক নিউইয়র্ক ফিল্ম অ্যাকাডেমি থেকে চলচ্চিত্রে পড়ালেখা করেছেন এবং লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার থেকে মঞ্চ নাটক পরিচালনার উপরে প্রশিক্ষন নিয়েছেন তার কাছে দর্শক হিসেবে আমার এই চাওয়া মোটেও অতি চাওয়া নয়।

‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবিটি তৌকির আহমেদের ষষ্ঠ সিনেমা। পরিচালনার পাশাপাশি ছবিটির সংলাপ ও চিত্রনাট্যও তৈরি করেছেন তিনি নিজেই। চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।

আপনাদের সকলকে আমি চলচ্চিত্রটি দেখার আহ্বান জানাই। আপনি একা নয়। আপনার ছোটো ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নি ও সন্তানকেও এই ছবি দেখতে নিয়ে আসুন। কারণ এই চলচ্চিত্রটি কেবলি বিনোদন নয়। এই সিনেমা দেখে ফিরে যাবার সময় তরুণ মন সাথে করে নিয়ে যাবে প্রতিবাদের প্রণোদনা। কে জানে! এই কিশোর-তরুণ দর্শকদের মধ্য থেকেই কেউ হয়তো একদিন আওয়াজ তুলবে: ‘ইংলিশায়ন মানি না; মানি না, মানব না। সর্বস্তরে বাংলা চাই; বাংলা চাই, বাংলা চাই। ইংলিশায়ন বন্ধ করো; বন্ধ করো, করতে হবে।


১৭ই মার্চ ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ২:৪৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×