somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়ামুকুরের কারসাজি

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবার দেখা যদি হল সখা’...

“লোহা লক্করের দোকানের আঁধার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক, ঠোঁটের ফাঁকের সিগারেটটায় এখনো আগুন ধরানো হয়নি। পাহারাওয়ালা কাছে আসতেই ওকে আশ্বাস দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল সে, ‘ঠিক আছে অফিসার। আমি শুধু এক বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছি। আজকে এখানে দেখা করার কথা হয়েছিল বিশ বছর আগে। হাস্যকর মনে হচ্ছে তোমার, তাই না? তোমার সন্দেহ দূর করার জন্যে বুঝিয়ে বলছি ব্যাপারটা। অনেক কাল আগে ঠিক এখানটায় একটা রেস্তোরাঁ ছিল— বুড়ো জো ব্র্যাডির রেস্তোরাঁ।’

‘পাঁচ বছর আগেও ছিল। তারপর উঠে যায়’, বলল পাহারাওয়ালা।

দরজায় দাঁড়ানো লোকটা দেশলাই ঠুকে সিগারেট ধরাল। তারই আলোয় দেখা গেল বিবর্ণ মুখ, চওড়া চিবুক, উজ্জ্বল চোখ আর ডান চোখের ভুরুর কাছাকাছি একটা কাটা দাগ। ওর স্কার্ফে লাগানো পিনে বড়সড় হিরে একটা—খাপছাড়াভাবে বসানো।

লোকটা আবারো বলল, বিশ বছর আগে এই রাতে আমি আর আমার সবচাইতে অন্তরঙ্গ বন্ধু জিমি ওয়েলস বুড়ো জো ব্র্যাডির দোকানে খেয়েছিলাম। ওর মত খাসা লোক হয় না। ও আর আমি জন্মেছি নিউইয়র্কে, বড় হয়েছি একসাথে, ভাইয়ের মতো। আমার বয়েস তখন আঠার আর জিমির কুড়ি। পরের দিন সকালবেলা সৌভাগ্যের সন্ধানে আমার পশ্চিমে যাবার কথা। জিমিকে কিছুতেই নিউইয়র্কের বাইরে নেয়া গেল না, তার মতে দুনিয়াতে এ-ই একমাত্র জায়গা। হ্যাঁ, আমরা ঠিক করলাম সেই তারিখ ও সময় থেকে ঠিক বিশ বছর পরে জো ব্র্যাডির দোকানে দেখা করব আমরা, তা আমাদের অবস্থা যা-ই থাক আর যতদূর থেকেই আসতে হোক। আন্দাজ করেছিলাম, যে-ভাবেই হোক এই বিশ বছরে আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে আর সুদিনের মুখও দেখব আমরা’।”

কুড়ি বছরের দূরত্ব পেরিয়ে আজ দুই বন্ধুর মোলাকাত। ভাগ্যজয়ী আগুন্তুককে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেয় পাহারাদার। দুই দশক দীর্ঘ সময়। ভাগ্যান্বেষনে যাবার পর দুই বন্ধুর বছরখানেক চিঠি চালাচালি হয়েছে মোটে। তারপর ববকে গিলে খায় বুনো পশ্চিম। শীতের রাত। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। অন্ধকার দরজায় দাঁড়ানো বব। মিনিট কুড়ি এভাবেই, অপেক্ষায়। অবশেষে জিমি আসে! উল্লসিত বব! দু’জনে কোথাও জমিয়ে গপ্পে বসবে বলে হাত ধরাধরি করে হাঁটে তারা। “মোড়ের মাথায় ড্রাগ স্টোরটার সামনে উজ্জ্বল বিজলি আলো। একসাথে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাইল ওরা। পশ্চিম থেকে আসা লোকটার হাত নেমে এল হঠাৎ করে।”

“তুমি জিমি ওয়েলস নও। বিশ বছর দীর্ঘ সময়, কিন্তু তাতে রোমান ধাঁচের নাক বদলে খ্যাঁদা হয়ে যায় না।”

এরপর? সহজ কথায়, গল্পের যবনিকা পাত। নাটকীয়ভাবে বললে, বিস্ময়ের ডালি নিয়ে জীবন এসে দাঁড়ায় ববের সামনে ।

ববের হাতে একটি চিরকুট তুলে দেয় সঙ্গের লোকটা। সেখানে লেখা: “বব। ঠিক সময় যথাস্থানে হাজির হয়েছিলাম। সিগার ধরাবার জন্যে যখন দেশলাই জ্বালালে তখনই চিনতে পারলাম, এই চেহারার লোকটিকেই শিকাগো পুলিশ খুঁজছে। কাজটা নিজের হাতে করতে পারলাম না, তাই ছদ্মবেশী গোয়েন্দা পাঠালাম একজন। --জিমি।”

জীবন এমনি। ও হেনরি’র এই ‘আফটার টুয়েন্টি ইয়ার্স’ গল্পের মতই।

জীবনের ক্যানভাসেই ড. জেকিলের ভেতর থেকে উঁকি দেয় মি. হাইড। ডাকাতের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে নিজামউদ্দিন আউলিয়া। বুনো সারমেয়র রক্ত থেকে ধীরে জঙ্গলের স্মৃতি মুছে যায়, মনিবের প্রেমে প্রভুভক্ত হয়ে ওঠে ‘হোয়াইট ফ্যাঙ’। অন্যদিকে, রক্তের ডাকে গৃহকোণ ছেড়ে জঙ্গলে ফেরে ‘বাক’।

জীবন আর কিছুই নয়, সম্পর্কের সমাহার। ববের মতই রাফ-টাফ চেহারার আড়ালে হীরক হৃদয় নিয়ে কেউ-কেউ ফেরে সম্পর্কের কাছে। কিন্তু ঘটনার ঘনঘটায় জীবন আমাদের ক্রমাগত রূপান্তর ঘটায়। রূপান্তরের শেষ অঙ্কে আমরা কেউ হোয়াইট ফ্যাঙ, কেউ বাক, কেউ জিমি। চরিত্রের ভালো-মন্দ বিচারের নিক্তি গুটিয়ে রাখি। আসামী-ফরিয়াদী নির্ধারণের বিচারকী দৃষ্টি সরিয়ে জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, আমাদের জীবনে ‘পরিস্থিতিই’ প্রভু। ক্রমাগত রূপান্তর হতে থাকা ব্রক্ষাণ্ডে চাইলেই কি আর পুরনো দুয়ারে ফিরে আসা যায়, হে অপেক্ষা-কাতর হৃদয়?

পুরনো দরজায় কড়া নাড়বার আগে হয়তো সুখকল্পনা করা যায়। “জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুঁড়ি কুঁড়ি, বছরের পার/ তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার” ভেবে আন্দোলিত হওয়া যায় নিজের ভেতর। কিন্তু জিমির চিরকুট পাবার পর ববেরও কি মনে হয়, “হাঁসের নীড়ের থেকে খড়/পাখির নীড়ের থেকে খড়/ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল”! এমন বাকহারা মুহূর্তে আমাদের মুখে ভাষা তুলে দেন জীবনানন্দ দাশ: “হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে/সরু-সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,/শিরীষের অথবা জামের,/ ঝাউয়ের-আমের;/কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!” কিন্তু কেউ যদি অবিশ্বাসের চোখে তবু জিজ্ঞেস করে“ ‘আমাদের গেছে যে দিন/একেবারেই কি গেছে/কিছুই কি নেই বাকি”? এই প্রশ্নের উত্তরও দেবেন রবীন্দ্রনাথ: “‘রাতের সব তারাই আছে/দিনের আলোর গভীরে।”


অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোন তূণে’...

দিনের আলোর গভীরে গোপন থাকা তারার মতই পোষা বাকের রক্তে সুপ্ত ছিল শিকারী জীবনের ডাক। তাই সে ফিরে যায় অরণ্যে আবার। কিন্তু দিনের আলোর গভীরে গোপন থাকা রাতের তারার মতই ছিল না রাজবধূ ডায়ানার প্রেমিক ও স্বামী যুবরাজ চার্লসের হৃদয়। তামাম দুনিয়া স্বাক্ষী। স্বাক্ষী রাজবধূর বিষণ্ণ নীলচোখ। স্বাক্ষী বিবিসির প্যানোরামায় দেয়া সাক্ষাৎকার।

বাবা-মা ছিল ডিভোর্সড। তার বুকে ছিল ভাঙাগৃহের বেদনার ভার। তাই, মেয়েটি বারবার ফিরে পেতে চেয়েছে পরিবারের উষ্ণতা। জীবন তাকে দিয়েছে রাজবধূর অমূল্য মুকুট! দিয়েছে মহাতারকার চেয়েও অধীক খ্যাতি। তার জীবনই যেনো রূপকথা। ১৯৮১ সালে টিভি পর্দায় তার বিবাহ উৎসব দেখেছে ৭৫ কোটি দর্শক। তার শবযাত্রায় ছিল ২.৫ বিলিয়ন বা আড়াইশ কোটি দর্শকের ৫০০ কোটি চোখ। কিন্তু হায়! এমনকি রাজপরিবারেও আন্তরিক বন্ধনের উষ্ণতা পায়নি বলে নিজেই বিবিসিকে বলেছেন রাজশ্রী। জীবন কী নির্মম! একদিকে, উপচে পড়েছে অগুন্তি মানুষের ভালোবাসা, আরেকদিকে প্রেমহীনতায় নিজের মধ্যেই কুঁকড়ে গিয়েছেন তিনি! এই তবে হাতের কাছে ভরা কলস রেখে জল পিপাসায় মরার রূপক!

রাজবধূর নি:সঙ্গতাই বুঝি অনুবাদ করেছেন আবুল হাসান: “অতটুকু চায়নি বালিকা!/ অত শোভা, অত স্বাধীনতা !/চেয়েছিলো আরো কিছু কম,/ আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে/বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো/মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক !/ অতটুকু চায়নি বালিকা !/অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম !/চেয়েছিলো আরো কিছু কম।”


‘আই উইল মিট ইউ দেয়ার’...

স্মৃতি যার, দায় তার। পুরনো দরজায় ববের মতন যে দাঁড়িয়ে থাকে সে আসলে ফেরে নিজের কাছেই। কিন্তু একই নদীতে দু’বার যে স্নান করা যায় না সেই সত্য আগেই বলে গেছেন হিরাক্লিটাস। ব্রহ্মাণ্ডের এই নিয়ত বদলই চিরায়ত। স্রোত থেমে গেলে নদী মৃত। মানুষও তাই। ‘বেঁচে থাকলে বদলায়, মরে গেলে পঁচে যায়’। কিন্তু বদলকে মানতে না পারা নিয়েই মানবজীবনে যত সংকট।

গ্রামের শেষ মাথায় ছবির মতন ছড়িয়ে থাকা শাপলার বিলটা, শৈশবে পথের দু’ধারে থাকা দৃশ্যাবলীসহই মানুষ পাল্টায়। কিন্তু হৃদয় এক স্মৃতিভ্রষ্ট ঘুঘু। বদলের স্মুতি ভুলে বারবার ফেরে একই দরজায়। আমরাও কি ‘ইটারনাল সানশাইন অফ দি স্পটলেস মাইন্ড’-এর জোয়েল ও ক্লেমান্টিন? নিজেরই অজান্তে চিরতরে বাঁধা পড়ে যাই এক জোড়া চোখের সাথে, একটা উজ্জ্বল দুপুরের সাথে, তারাভরা আকাশের নিচে ঘুটঘুটে আন্ধার রাতে জোনাক-জ্বলা মায়ানিশির সাথে? নিজেদের স্মৃতিকোষ থেকে পরস্পরের স্মৃতি মুছে ফেলে জোয়েল ও ক্লেমান্টিন। তবু, কোন মায়ামুকুরের কারসাজিতে বারবার তারা ফেরে পুরনো দরজায়?

স্টার ওয়ার্স সিরিজের মুভ্যিগুলো আমার প্রিয়। প্রিয় চরিত্র মাস্টার ইউডা। তিনি বলেছেন, ‘পাস অন হোয়াট ইউ হ্যাভ লার্নড’। জীবনের সকল অভিজ্ঞতা কথামৃতাকারে দিয়ে যান পিতামহ ভীষ্ম। মহামতি ভীষ্ম আর মাস্টার ইউডা দুই পৃথিবীর দুই পথপ্রদর্শক। জীবনের ক্ষয়-লয়-ভঙ্গুরতা দেখতে-দেখতে তারা জেনেছেন, কিছুই আঁকরে থাকতে নেই। মাতৃগর্ভ থেকে সন্তানের যখন বাইরে বেরোবার সময় আসে জননী তাকে আর রাখতে পারে না উদরে গোপন। মাটিতে গোপন বৃক্ষবীজ যখন পায় সূর্যালোকের আহ্বান, ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ করে সে মস্তক উঁচু করে। মানবীয় সম্পর্কগুলোও একইরকম। জীবনেও হেমন্ত আসে। পত্র-পুষ্প ঝরে পড়ার মৌসুমে বৃথা হয় ‘যেতে নাহি দেব হায়’ ক্রন্দন।

আমাকে তাড়া করে বিবিসি প্যানোরোমাকে দেয়া লেডি ডায়ানার বিষণ্ন নীলচোখের সাক্ষাৎকার। “আমি তারে পারি না এড়াতে।/সে আমার হাত রাখে হাতে,/সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,/সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়/শূন্য মনে হয়/শূন্য মনে হয়।” এই ব্যাথিত রাজবধূর সাথে দেখা হলে বলতাম, “প্রাণের আহ্লাদ/ সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।/ সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর/স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,/শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,/শরীরে জলের গন্ধ মেখে,/উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে/চাষার মতন প্রাণ পেয়ে/কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?”

মায়ামুকুরের জাদুর ঝিলিকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া আমি এক আগুন্তক। আমাকে বুকের কাছে নিয়ে চৌকিতে শুয়ে গীত গাইছেন বুড়ি মা—আমার নানুর মা, ‘গাঙ্গে দিয়া ভাইস্যা যায় গো, গাঙ্গে দিয়া ভাইস্যা যায় গো, নানান ফুলের কলি গো, নানান ফুলের কলি গো’।

মায়ামুকুরের জাদুর ঝিলিকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া আমি এক আগুন্তক। ভূতের ভয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁদতে থাকা ছোট্ট মেয়ে আমি। ভয় ভাঙাতে আমাকে কোলে নিয়ে দেউড়ির ওপাড়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির পেছনে অনতিদূরের আমগাছের সারির দিকে আঙুল তুলে ভূতের বাড়ি দেখায় বাবা।

মায়ামুকুরের জাদুর ঝিলিকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া আমি এক ছোট্ট মেয়ে। আমাকে কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছেন আমার নানাভাই আব্দুর রশিদ খান। কাঁধে করে নানুবাড়ী যাওয়া-আসা করতে-করতে নানাভাইয়ের চুলের ঘষায় আমার থুতনির নিচে চামড়া উঠে গেছে, এখনো যেনো তাজা সেই ক্ষত।

মায়ামুকুরের ভেতর চিরতরে বন্দী হয়ে যাওয়া আমি এক ফুলকুমারী। আমাকে সাথে নিয়ে নানুবাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ে হাতে পিতলের কূপি বাতি নিয়ে স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় আমার নানু রাবেয়া খাতুন।

বার্ষিক সমাপনী পরীক্ষা শেষে নানুবাড়িতে দীর্ঘ বেড়ানোর পর্ব শেষে বাড়ি ফেরার সময় ঘনায়। কিন্তু আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের জন্য, পুকুরের শ্যামল জলের জন্য, পুকুড়পাড়ে হেলে থাকা বাঁকা তালগাছের জন্য, রোজ সন্ধ্যায় জমিয়ে বসা কিচ্ছার অলোকসামান্য আশরের জন্য আমার খালি চোখ জ্বলে। হেমন্তের পতন-উন্মুখ পল্লবের মতন আমার পড়-পড় অশ্রুবিন্দুকে সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে আমি পাঠাতে চাই অক্ষিগোলকের ভেতর। কান্না গিলে ফেলতে গিয়ে গলার মধ্যে সিং মাছের খোঁচা খাওয়ার মতন ব্যাথা নিয়ে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়াল করি বাড়ির পেছনে। অত ছোটোবেলায় কেউ তো কাউকে শেখায় না কান্না লুকোনোর ব্যাকরন। তবু, মানুষ কিভাবে শেখে গভীর-গহীন ব্যাথাগুলোকে সিন্দুকে ভরে রাখার কৌশল?

মানুষকে তাড়া করে হারানোর ভয়। বন্ধুত্ব বা প্রেমের মৃত সম্পর্কের দিকে তাকালে ব্যাথায় কাতর হবে হৃদয়, তাই আমরা নিজেকে প্রবোধ দিই। ধুয়ে-মুছে ঠিক-ঠাক করতে চাই সম্পর্কের ভাঙা সেতু। নাড়াচাড়া করতে গিয়ে উল্টো ভাঙনটাই প্রবল হয় শুধু। সম্পর্কেও হেমন্ত আসে। অলংঘনীয় এই সত্যকে কবুল করতে হয়। পতন্মুখ পাতাকে ঝরে যেতে দিতে হয়। এই পরামর্শই দিয়েছেন প্রভু ইউডা। তিনি বলেছেন, ‘লেট গো’। কিন্তু কে না জানে, যেতে দেয়া নয় সহজ। তাই, মনকে দিতে হয় সত্যকে সহজে কবুল করার প্রশিক্ষণ, নিজেকে নিতে হয় বিযুক্ত হবার দীক্ষা। প্রভু ইউডার ভাষায়, ‘ট্রেইন ইউরসেলফ টু লেট গো অফ এভরিথিং ইউ ফিয়ার টু লুজ’। এই গুপ্তজ্ঞান রপ্ত করাই শ্রমণের উদ্দেশ্য।

জীবনের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। একটা ভীতুর ডিম মেয়েকে তার বাবা জোর করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ভূতের বাড়ির সামনে। একটা সাঁতার না জানা ছোট্ট মেয়েকে পুকুরে নিয়ে ‘নিদয়া-নিঠুরের’ মতন ডুবো পানিতে ছেড়ে দিয়ে তার দাদি সৈয়দ বানু বলেছে, ‘সাঁতরা’। ভয়ের চোখে চোখ রাখো, এই ছিল তাদের বক্তব্য। ‘ফেস ইট’। ‘ফেস ইউর ফিয়ার’। কবুল করা শিখতে হয়। জীবনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না গড়া শিখতে হয়। যখন যেভাবে সে আসে তাকে সেভাবে কবুল করার দীক্ষা নিচ্ছি বয়স সাঁইত্রিশে। তাও ভালো, যে কোনো বয়সেই শুরু করা যায়। শ্রমণের ইচ্ছের কাছে বয়স কিছু নয়।

গুরু ইউডা বলেছেন, ‘ইউ মাস্ট আনলার্ন হোয়াট ইউ হ্যাভ লার্নড’। নিজেকে কাপের মতন উপুর করে ঢেলে ঘষে-মেজে ধুয়ে নিয়ে আবার নতুন পানীয় দিয়ে পরিপূর্ণ করার পথই শ্রমণের পথ। এই পথে যেতে যেতেও দেখি, প্রথম কন্যার ঘরে জন্মানো প্রথম নাতনীকে সাথে নিয়ে সুন্দরী, যৌবনবতী রাবেয়া খাতুন কূপিবাতির প্রদীপ জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছেন পুকুরপাড়ের মেঠো পথে। নানি ও নাতনীর পায়ের কাছে ফুটে আছে ভাঁটফুল। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকার এই দৃশ্য স্মৃতিকোষের ভেতর আর তৈরি করে না ক্রন্দন। স্মৃতিকোষের ভেতরে জমা কান্নাকে মোকাবেলা করার পর এখন দাঁড়ানো যায় পুকুরপাড়ে ‘হলদির কেইলের মতন’ একসারি কবরের সামনে। কবরের পাশে দাঁড়িয়েও এখন সহ্য করা যায় শরীর অবশ করে দেয়া ঘুঘুর ডাক।

রুমি বলেছেন, ‘বিফোর ডেথ টেকস এওয়ে হোয়াট ইউ আর গিভেন/গিভ এওয়ে হোয়াট ইজ দেয়ার টু গিভ’। এই পংক্তি পড়ে আব্বির কথা মনে হয়। তিনি আমাকে দিয়েছেন সাহস। তার প্রস্থানের ভেতর দিয়েও আমাকে করেছেন আমার চূড়ান্ত ভয়ের মুখোমুখি। ভীতুর ডিম মেয়ে মন্ত্রের মতন জপেছে ‘ভালো-মন্দ যাহা আসুক সত্যরে লও সহজে’। সহজে নিতে শেখার পর বাড়ির সেই পুরনো দুয়ার আর রিক্ত মনে হয় না। এখন ‘বাড়ি’ আর ‘কবর’-এর ফারাক সামান্য। আমার অভিজ্ঞতায় আগে কবরে মৃতরা থাকতো। এখন সেখানে ঘুমায় প্রিয়জন। প্রিয়জনের কবর ঘিরে সারাবছর সুবাস ছড়ায় দোলনচাপা ফুল। পৃথিবীর যেখানেই দোলনচাপা ফুটবে সেখানেই আমি পাবো ‘বাড়ির ঘ্রাণ’। এই সুঘ্রানের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় জীবিত ও মৃতকে আলাদা করার দেয়াল। ঘ্রাণের চাবিতে খুলে যায় স্মৃতির দুয়ার। এই দুয়ারে দাঁড়ালে পাওয়া যেতে পারে প্রিয় মুখের সাক্ষাত। এই দুয়ার নিয়েই কি তবে মাওলানা রুমি বলেছেন, ‘আউট বিয়ন্ড আইডিয়াস অফ রংডুয়িং এন্ড রাইটডুয়িং/দেয়ার ইজ অ্যা ফিল্ড/ আই উইল মিট ইউ দেয়ার।’

-----
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:৪১
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×