somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পঞ্চাশের দশকের কবি আবদুস্ সাত্তারের কাব্যভূবন সোলায়মান আহসান

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পঞ্চাশের দশকের কবি আবদুস্ সাত্তারের কাব্যভূবন
সোলায়মান আহসান

“বিচিত্রমুখী প্রবণতার মধ্যে আবদুস সাত্তার মুখ্যত কবি, পঞ্চাশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি তিনি। গত চার দশক ধরে তাঁর উৎসারিত কবিতা এক জায়গায় থেমে থাকেনি- ক্রম পরিবর্তিত হয়েছে।”
উপরিউক্ত মন্তব্যটি ষাটের দশকের অন্যতম সাহিত্য গবেষক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের।
আবদুস্ সাত্তার (১৯২৭-২০০০) এক বহুমুখী প্রতিভার নাম। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক (নৃতাত্ত্বিক), ভাষাবিদ, অনুবাদক, শিশু-কিশোরতোষ সাহিত্য রচয়িতা, সম্পাদক, স্মৃতি কথক এমনকি কলাম লেখকও ছিলেন। সোজা কথায় এমন নানামুখী কর্মকাণ্ডে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব আবদুস সাত্তার সমান এ দেশে আরো খুব বেশি প্রতিভার সাক্ষাৎ আমরা পাইনি। তবে আবদুস সাত্তারের সকল দিক নিয়ে আলোকপাত করা এক্ষণে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা তাঁর কাব্য প্রতিভার সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেতে প্রয়াস পাবো।
আবদুস্ সাত্তারের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০ (দশ)টি। তিনটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। যেমন ঃ
০১। বৃষ্টি মুখর (১৯৫৯, ১৯৬৯, ১৯৭৫)
০২। আমার ঘর নিজের বাড়ী (১৯৭০, ১৯৭৬)
০৩। অন্তরঙ্গ অনুভূতি (১৯৭১)
০৪। নামের মৌমাছি (ট্রিওলেট) (১৯৭৩)
০৫। দি ইনটিমেট ভয়েস (ইংরেজী কাব্য) (১৯৭৮)
০৬। আমার বনসাব (১৯৮০)
০৭। আমার বাবা মা’র কাসিদা (দীর্ঘ কাব্য) (১৯৮৫)
০৮। পবিত্র নামের কাব্য (১৯৮৫)
০৯। বিম্বিত স্বরূপ (১৯৮৫)
১০। আবদুস্ সাত্তার ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯০)
এছাড়া অনুবাদ কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ
০১। বলি ও ফেনা (আরবী অনুবাদ কবিতা) (১৯৭৩)
০২। আরবী কবিতা (১৩৭২, ১৩৮৩)
০৩। আরবী ফারসী তুর্কী কবিতা (১৯৯০)
বাংলা কবিতা দাঁড়িয়ে আছে তার সহস্রাধিক বছরের ঐতিহ্য নিয়ে। তাই বাংলা কবিতাকে বিশ্লেষণ করতে হলে এ দীর্ঘ কাল পর্বের গতির দিকে আমাদের তাকাতে হবে। এতে আমরা অনুধাবন করতে পারবো কবিতা কীভাবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে বদলে গিয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই পবিরর্তনের প্রথম ও প্রধান পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪- ১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি। বাংলা কবিতা মোড় নিলো ভুসুকুপাদ- চণ্ডীদাশ- আলাওল যুগ পেরিয়ে নতুন যুগে। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ - ১৯৪১) এসে বাংলা সাহিত্যাকে আরো এগিয়ে নিলেন। তাঁর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্য বিশ্ব দরবার হতে স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনলো। কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ - ১৯৭৬) এসে বাংলা সাহিত্যকে বাংলাভাষী আরেক সম্প্রদায় বাঙালী মুসলমানদের জন্য রচনা করলেন ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সাহিত্য।
যে কোন সাহিত্য তখনই জীবন্ত রূপ লাভ করে যখন ঐ ভাষা নিয়ে চর্চা চলে। প্রতিভাধর সাহিত্যিকরা এসে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং সাহিত্যের সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আর এ দিক বিবেচনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বের আন্তর্জাতিক জীবন্ত ভাষাগুলোর মধ্যে অবশ্যই গণ্য। যে কারণে আমরা দেখতে পাই বাংলা ভাষাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সহিত্যিকদের মধ্যে পরিবর্তন, নতুনত্ব এবং টেকনিকের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে আসছে। যেমন রবীন্দ্রানাথের জীবদ্দশায় ত্রিশের উচ্চ শিক্ষিত কবিরা (বেশির ভাগ ইংরেজী ভাষার শিক্ষক) রবীন্দ্রধারার কবিতাকে অস্বীকার করলেন। এদের মধ্যে ছিলেন- জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ - ১৯৫০), অমিয় চক্রবর্তী’ (১৯০১ - ১৯৮৬), সুধ্দ্রীনাথ দত্ত (১৯০১ - ১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ - ১৯৭৪) ও বিষ্ণুদে (১৯০৯ - ১৯৮২),। এসব তরুণ প্রতিভাধর উচ্চ শিক্ষিত কবিদের ‘রবীন্দ্র বিরোধিতা যে শুধু মাত্র দ্রোহসূচক ছিল না, তা অতি অল্প দিনে স্বয়ং রবীন্দ্রানাথ অনুভব করলেন। তিনি তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী অমিয় চক্রবর্তীকে (পঞ্চ পাণ্ডবের একজন) দিয়ে তাঁর বাস ভবনে ঐ সব কবিদের নিয়ে বসেছেন। তবে মত বিনিময় সভা-টভায় তেমন কাজ দেয়নি। শেষতক তিনি উদ্যোগী হলেন কবিতার বিষয় ও টেকনিক নিয়ে নামতে।
এসম্পর্কে শীর্ষ রবীন্দ্র সাহিত্য গবেষক আবু সয়ীদ আইয়বের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য-
“-‘কল্লোল’ এবং পরিচয় গোষ্ঠীর কবিরাও এক হিসাবে রবীন্দ্র বিদ্রোহী ছিলেন, কিন্তু সে-বিদ্রোহ অন্য জাতের। তাতে রবীন্দ্রানাথের গগণচুম্বী প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা-নিবেদনে কুণ্ঠা ছিলো না। বরঞ্চ তার মর্মমূলে এ কথাটাই নিহিত ছিলো যে বাংলা কাব্যে এক নতুন মেজাজ ও আঙ্গিকের প্রবর্তক হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রাথ বাংলা কাব্যকে তাঁর একক সাধনায় এমন পরোৎকর্ষে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেছেন যার নাগাল পাওয়া অনুজ কবিদের পক্ষে অভাবনীয়।”
(আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ)

প্রকৃত পক্ষে ত্রিশের ইংরেজী শিক্ষিত কবিগণ বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, মালার্মে, ভালেরি, গটফ্রিড বেন, আঁদ্রে ব্রেতঁ, স্যামুয়েল বেকেট, জ্যাঁ কেলে, আলেন গিনস বার্গ প্রমুখ পাশ্চাত্য কবিদের সাহিত্য রসে এমন জারিত হয়েছিলেন তা থেকে রবীন্দ্রানাথের কাব্য ভাবধারাকে অনেকটা আটপৌঢ়ে এবং বিশ্বজনীন ভাব বলয় থেকে দূরবর্তী মনে হয়েছে। প্রকৃত অর্থেই এঁদের কাব্য জগৎ থেকে রবীন্দ্র বাক্য ভূবন বহু দূরবর্তী ছিলো। রবীন্দ্রানাথ খুব চট করে তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সেভাবে নিজেকে পরিবর্তনের আবহে পা ফেলাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তা রবীন্দ্রানথের ‘শেষের কবিতা’, পুনশ্চ, ইত্যাদি রচনার মধ্য দিয়েই প্রমাণ রাখলেন।
আসলে কবিতা টেকনিক নয়, ওংস নয়, কবিতাকে বাঁচতে হয় আত্মার সুধা নিয়ে। সেই আত্মার সুধা কি?
কোলরিজ বলেছিলেন, ‘ÔNo man was ever yet a great poet without being at the same time a profound philosopher.’
রবীন্দ্রনাথ সে আত্মার অনুসন্ধান করেছিলেন বলেই ত্রিশের কবিতা থেকে বর্তমান সময় পর্বেও খুব বেশি পিছিয়ে নেই- বরং এগিয়ে। তবে ত্রিশের কবিতার প্রভাবও কিন্তু কম পড়েনি। অন্তত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ এবং বোদলেয়ার অনুবাদক বুদ্ধদের বসুর প্রভাব পঞ্চাশের কবিদের ছাড়িয়ে গেছে আরো দূর অবধি।
আমেরিকার সাহিত্যের ইতিহাসেও আমরা দেখতে পাই এমন একটা পরিবর্তনের হাওয়া। এ পরিবর্তনের পক্ষে প্রথম ব্যক্তিটি ছিলেন এমারসন। তিনি সাহিত্য কর্মের এবং চিন্তাব্যবস্থার একটি ধারাক্রমের সূত্রপাত করেন। বিশ শতকে যে সমস্ত লেখক নতুন নতুন চিন্তার এবং বিচিত্র আবেগকে অনুভব করতে আগ্রহী হয়েছিলেন তাঁদের বিশ্বাসের উৎস ছিল এমারসন। তাঁরা বলেছিলেন- ‘কবিতায় ছন্দ নয়’ কিন্তু ছন্দ নির্মাণের যুক্তিই কবিতা।’
এমারসনের পর আমেরিকার অত্যন্ত পরিচিত কবি লং ফেলো। তিনিও তাঁর কবিতা ‘রাত্রির কণ্ঠস্বর’ এ বললেন- ‘তোমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে অনুসন্ধান করো এবং লিখবার উপকরণ সংগ্রহ করো।’
লং ফেলো কবিতায় টেকনিককে তেমন গুরুত্ত্ব দিতেন না। তিনি বক্তব্যকে সহজভাবে প্রকাশ করতে প্রয়াসী ছিলেন। পরবর্তীকালে এঁদের কাব্য ভাবনা আমেরিকার পঞ্চাশের কবি উইলিয়াম মেরিডিথ, রাবার্ট ফ্রস্ট প্রমুখ কবিদের ওপর প্রভাব ফেলে।
এরপর চল্লিশের দশকে এসে বাংলা কবিতা কিন্তু আরেকটি মোড় নিলো। কবিতা হয়ে উঠলো অনেকটা সুষ্পষ্টভাবে আদর্শ নির্ভর। একদিকে মাক্সীয় চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত শ্রেণী সংগ্রামের বক্তব্য নির্ভর এক কবি গোষ্ঠী। যাঁর মধ্যে সুকান্ত ভট্টচার্য (১৯২৬ - ১৯৪৭), সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ রয়েছেন। অপরদিকে ইসলামী ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ হোলেন ফররখ আহমদ, তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান। সৈয়দ আলী আশরাফ প্রমুখ। একটু লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাবো বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে সেই প্রাচীন কাল হতে আদর্শবাদী একটি ধারা গতিমাণ থেকেছে। পঞ্চাশের দশকেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে পঞ্চাশের কবিদের মাঝে যে প্রবণতা বেশি লক্ষণীয় তা কবিতাকে পূর্বাপর গতির সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখা। আমাদের আলোচ্য কবি আবদুস্ সাত্তারের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি দেখতে পাই। তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষায় তেমন বিশ্বাসী ছিলেন না। কবিতাকে মানুষের আশ্রয় বানাতেই ছিলেন মনোযোগী। বিশেষ করে মানুষকে আত্মমুখী করতে চেয়েছেন। বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লেখক এক সাক্ষৎকার গ্রহণ কালে করিকে তাঁর সাহিত্যের প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্ন রাখলে তিনি যে জবাবটি দেন তা এখানে প্রণিধানযোগ্য ঃ
“আমাকে সব চেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত করেছে পবিত্র কুরআন। যে পবিত্র কুরআন পেয়ে ‘সাবআ মু’আল্লাফা’ খ্যাত কবি লবিদ কবিতা লেখা একরূপ ছেড়েই দিয়েছিলেন।
বিশ্ব বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বাইরন উপলব্ধি করেছেন যে, কুরআন সমস্ত ইউরোপীয় কবিতা অতিক্রম করে শীর্ষে অবস্থান করছে। কাজেই এই পবিত্র গ্রন্থটির প্রভাবই আমার উপর পড়েছে বেশি।”
(মাসিক কলম, জুন ১৯৮৭)
আরেক স্থানে কবি নিজের লেখা সম্পর্কে বলেছেন, “আমি যেভাবেই থাকি না কেন তাতেই আমি খুশি এবং সেই পরিবেশেই আমাকে লিখতে হবে। লেখা আমার আহার পানীয়ের সঙ্গে তালিকাভুক্ত। আর আমার লেখা সম্পর্কে যে যা খুশি বলুক তাতে আমি পরোয়া করি না। আমি স্থির জানি, আমার লেখা সমগ্র প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে।”
আবদুস্ সাত্তারের কবিতার মধ্যে আমরা তাঁর এ সরল উক্তির যথার্থ পরিচয় পাই। জীবনের প্রথম পাদে তিনি কবিতায় নান্দনিকতা এবং প্রেম, ভালবাসা, প্রকৃতির প্রতি আবেগ এসবকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টি মুখর’ যা তিন তিন বার মুদ্রিত হয়েছে, সেই গ্রন্থের মধ্যে আমরা একজন মিতভাষী, ধ্যানী, হিসেবি এবং সর্বোপরি কবিতার জন্য সমর্পিত একজনকে পাই। বিশেষ করে স্বাভাবিকভাবে কবিরা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে উপভোগ করেন। আবদুস্ সাত্তারও তেমনি করেছেন - কবিতায় তার প্রকাশ ঘটেছে।
এ ব্যাপারে ড. আশ্রাফ সিদ্দিকী বলেছেন, “কবির জন্ম টাঈাইলের ‘ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা’ গ্রামে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উদার আবেদন যে কবির কাব্যে একটি প্রধান স্থান হয়ে উঠেছে এ জন্য দায়ী তাঁর এ পটভূমি।”
উদ্ধৃতি ঃ ক. সেই ভালো ফিরে যাবো গ্রামের নিভৃতে
যেখানে মোমের মতো শিয়রে মায়ের স্নেহ জ্বলে,
পিতার অনন্ত প্রেম বিস্তৃত মাঠের
শ্যামল শস্যের চারা, দিনে দিনে বাড়ে
ঘাসের সবুজে ঘন আকাশের নীল
আর প্রাণের সুষমা;
(সেই ভালো, বৃষ্টিমুখর)

খ. শহরের বাইরে এই সুন্দর হিমছড়ি
দ্যাখো কী সুস্নিগ্ধ! হাওয়া কত জ্ঞানী। নিজের ইচ্ছায়
কেমন মসৃণ করে বালির চাঁদর এক ঠায়
বিচিয়ে রেখেছে।
(হিমছড়িতে বিকেল, বৃষ্টিমুখর)

আবদুস্ সাত্তার সহজ সরল বাকভঙ্গিতে মানুষের সাহজিক অনুভূতি নিয়ে কবিতা লিখতে ছিলেন বেশি আগ্রহী। তাতে কবিতার সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক স্থাপিত হতে বেগ পেতে হয় না। পঞ্চাশের দশকের অন্যান্য কবিদের চেয়ে তিনি একটু ভিন্ন মেজাজের।
উদ্ধৃতি ঃ ক. বনের শালিখ সেও পোষ মানে, গান গায়, নাচে
এবং কখনো এসে খাঁচার কানাচে দু’ঠোঁটে ভঙ্গির ঢেউ তুলে বলে সুসুধুর কথা,
পাখী ও মানুষ এক গূঢ় আত্মীয়তা।

কেবল মানেনি পোষ ও বাড়ীর বউ,
(শালিখ, বৃষ্টিমুখর)
আবদুস্ সাত্তার নারীর প্রতি গভীর প্রেম বোধ থেকে উথিথত আবেগ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এ প্রেম সহজ সরল এবং অনেকটা একরৈখিক। এর কারণ কবি যে সময়ের ও সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন, তখন নারীর প্রতি প্রেম অনেকটা এক তরফা এবং আড়ালে-আবডালেই প্রচলন ছিল। তা সাধারণত বিয়োগাত্মক।
উদ্বৃতি ঃ
ক. কী করে তেমাকে আমি ভুলে যেতে পারি?
রূপবতী নারী
তোমার নামের দীপ বুকের অতলে
অন্ধকার দীর্ণ করে সর্বক্ষণ জ্বলে আর জ্বলে।
(নাম, বৃষ্টিমুখর)
খ. কঠিন, অথচ তাও জেনে আমি প্রেমের আহবানে
ভেঙ্গেছি পাহাড়, শিলা; উপরে ঘুরানো সমতলে
চেয়েছি প্রাসাদ এক গড়ে নেবো বড় কৌতূহলে
কিন্তু এ কী! সব শূন্য। কার জন্যে এসেছি এখানে?

নেই। চলে গেছে মায়াবিনী নারী। মোহের আবেশে
আমি আজ নির্বাসিত ছায়াচ্ছন্ন বনানীর দেশে।
(ব্যর্থ প্রেম, বৃষ্টিমুখর)

আবদুস্ সাত্তার যতো সহজ সরল বাক ভঙ্গিমায় কবিতা রচনা করুন না কেন কবিতার ক্ল্যাসিক ফর্ম সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ বেশ ছিল। বিশেষ করে আঠারো মাত্রার অক্ষর বৃত্তের নিপাট বুননে তাঁর একগুচ্ছ সনেট এ কথা বলতে উৎসাহী করে। তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘বৃষ্টি মুখরে’ আমরা ১৫ (পনের)টি সনেটের অস্তিত্ত্ব পেয়েছি।
এগুলো হচ্ছে - মেঘ/সমুদ্র কবিতা হবে/রাত্রির স্মরণে দিনের উক্তি/ব্যর্থ প্রেম/যমজ প্রেমের হাতে/জন্মের ইতিকথা/কেবলা স্মরণে। স্বগতোক্তি/তাহলে সমুদ্র পারে/সে/ভালোবাসা/একটি জিজ্ঞাসা/সম্মুখের এই ঝর্ণা/জীবনে নিহত শত্র“/বৃষ্টি মুখর।

আবদুস্ সাত্তারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টি মুখর’ এর পর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থটি ‘আমার ঘর নিজের বাড়ী’ প্রকাশ পায় দীর্ঘ এগারো বছরের ব্যবধানে। ততোদিনে কবির চিন্তাধারায় এসেছে পরিবর্তন। এ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চল্লিশ (৪০)টি কবিতার মধ্যে চব্বিশ (২৪) টিই সনেট। এরমধ্যে ‘আমার দেশ’ শিরোনামের কবিতাটির ১ (এক) নম্বর কবিতাটি ৪২ পংক্তির যা আঠারো মাত্রার আক্ষরবৃত্তে সম্পন্ন। এ শিরোনামে অপর পাঁচ (৫)টি সনেট সংযুক্ত করে একটি সিকোয়েন্স তৈরী করা হয়েছে।
গ্রন্থভুক্ত অন্যান্য সনেটগুলো হচ্ছে- তোমার উদার রাজ্যে/দ্বীপ/না সমুদ্র, না সে নদী/অসুন্দরে মগ্ন থেকে/ট্রেনে যেতে যেতে/পাণ্ডুলিপি/না, আর পারি না দিনান্ত। অন্য এক আনন্দের পাশে। বিদ্রƒপ/এক দিনের ডায়েরী/ক্লান্তিহীন আনন্দ/নায়িকার আর্তির সপক্ষে/খড়িমাটি রেখা/অদৃশ্য অতিথি/বাউল/রাত্রির স্বপ্ন/আর যাবো না/সে ও আমি/আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব/যখনি এ গ্রামে আমি/শিল্পীর আনন্দ/বাবার মতন।

আবদুস্ সাত্তারকে খুঁজে পেতে হলে তাঁর এসব সনেটগুলোর ভেতর প্রবেশ করতে হবে। বেশির ভাগ সনেটের আঙ্গিক পেত্রাকীয়। ক্ল্যাসিক ধারা কবিতার ফর্ম হিসেবে বাংলা কবিতায় মধু-কবির পর এ পর্যন্ত প্রতি দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিরা সনেট রচনায় আত্ম নিয়োগ করেছেন। কবি কায়কোবাদ হতে শুরু করে ত্রিশের কবি জীবনানন্দ দাশ, চল্লিশের ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, পঞ্চাশের আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, দিলওয়ার, ষাট দশকের মোহাম্মদ রফিক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আফজাল চৈাধুরী, ওমর আলী, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ।

আবদুস সাত্তার একজন দেশপ্রেমিক এবং নিজ গ্রাম ও গ্রামীণ জীবনের প্রতি আজন্ম ভালবাসা তাঁর কবিতায় বেশ বার বার প্রকাশ পেয়েছে। দু’ একটি উদ্ধৃতি দিয়ে একটু আলোকপাত করছি:
উদ্ধৃতি ঃ
ক.
যে দেশে জন্মেছি আমি, সেখানের আলো হাওয়া মাটি
জলের অমৃত ছোঁয়া আমার দেহের প্রতি ভাঁজে
এক হয়ে মিশে আছে; যে মাটিতে জানি সোনা ফলে
যে হাওয়ায় রাত দিন প্রাণের সুঘ্রাণ খেলা করে ;
(আমার দেশ, আমার ঘর, নিজের বাড়ী)

আবদুস্ সাত্তার একজন মহৎ প্রাণের কবি। মানবিক বোধ তাঁর ভেতর ছিল সব সময় টনটনে। তাঁর একদিকে ছিল আপন নাড়ির সম্পর্কের প্রতি গভীর দরদ, অপর দিকে তিনি সব সময় মানবিক বিষয়ে আপ্লুত ছিলেন, সংবেদনশীল ছিল তাঁর প্রাণ। একজন মহৎ কবিই বড় কবি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। যিনি আপন অস্তিত্বকে বিরাটত্বের ভেতর সংস্থাপন করতে পারেন- তিনিই মহৎ প্রাণের অধিকারী হন। আবদুস্ সাত্তারের এ মহৎ প্রাণের মূল উৎস এক আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস। একজন ভক্তপ্রাণের মুসলিম চরিত্র বলতে যা বোঝায়, আলোচ্য কবি ছিলেন তাই।
আবদুস সাত্তারের তৃতীয় কাব্য গ্রন্থটি ‘অন্তরঙ্গ ধ্বনি’ এক বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত। এ গ্রন্থের ছেচল্লিশ (৪৬) টি কবিতার মধ্যে পঁচিশ (২৫) টিই সনেট। অধিকাংশ সনেটের আঙ্গিক আঠারো মাত্রার অক্ষর বৃত্তের। কোন কোন সনেটে তিনি পংক্তি বিন্যাসে খানিকটা ভিন্নতা আনতে প্রয়াস পেয়েছেন। কখনো অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে মুক্তক রীতি গ্রহণ করে সনেটের বন্ধনের বাইরে যেতে চেয়েছেন তা অবশ্যি খুব কমই।

আবদুস সাত্তার সম্পর্কে পূবের্র মতের সপক্ষে আমরা ‘অন্তরঙ্গ ধ্বনি’ কাব্য গ্রন্থে আরো জোরালো কাব্য অনুভুতি খুঁজে পেয়েছি।
উদ্ধৃতি: (ক) পবিত্র বাণীর মন্ত্রে ভালোমন্দ চিনেছি এখন
সত্তার অঙগনে হেঁটে; জীবনের বাগানে একক
বসন্তের মঞ্জরিত সকল ফুলের ভালোবাসা
নির্বিঘেœ ফোটাই সুখে, অবজ্ঞার আস্তাকুঁড়ে ফেলি
পঙ্কিল জীবন বৃত্তি অবারিত ইচ্ছার বিলাসে।

এ শিক্ষার আলো জ্বলে উদয়াস্ত পৃথিবীর ঘরে। গ্রন্থভুক্ত সনেটগুলো হচ্ছে- আমি পিতা/ খ্যাতির সমুদ্র তীরে/ দিনের উপমা/ আমার সম্মুখে/ প্রতিভার মূল্য/ প্রাচীর/ অদৃশ্য অতিথি/ গ্রন্থ/ দৃশ্যান্তর/ শীতের সাজেক ভ্যালি/ রূপবতী/ দূরতমাসু/ নদীর উপমা/ রাত্রি/ মন্ত্র/ একটি সত্য ভাষণ/ দাদার আসনে/ যৌবনোত্তর যৌবন / আবিষ্কার/ আকণ্ঠ তৃষ্ণায়/ স্বাগত ভাষণ/ বলা যায়/ অন্যতর/ আনন্দের পাখি ম্যূরাল।

আবদুস সাত্তার সম্পর্কে ষাটের দশকের কবি সিকদার আমিনুল হক যথার্থ মন্তব্য করেছেন, যা এখানে প্রণিধানযোগ্য। ‘অন্তরঙ্গ ধ্বনির’ কবিতাগুলোতে আবদুস সাত্তারের আত্মগত কবিতার সংযত প্রকরণের সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শুদ্ধতর অনুভুতির পরিমিত প্রকাশের উপরই তার সাফল্য প্রধানত নির্ভর করছে।
(আবদুস সাত্তার জীবন ও সাহিত্য)

আবদুস সাত্তারের চর্তুথ কাব্যগ্রন্থটি ‘নামের মৌমাছি’ আট পংক্তি বিশিষ্ট ৮৭ টি ট্রিওলেট কবিতার সংকলন। এ গ্রন্থে একটি ভিন্ন আঙ্গিকে নিজের আবেগ অনুভুতি এবং বক্তব্যের চারিত্রকে .........কবিকে প্রকাশ করতে দেখি। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থের ভূমিকায় বলা হয়েছে, বাংলা সাহিত্য ট্রিওলেট ফর্মের কবিতা কিছু লিখিত হলেও ট্রিওলেট কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ এই প্রথম। কবিতাগুলোতে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য সৃষ্টির চাইতেও মাত্র আট লাইনের সুনির্দিষ্ট স্তবকের ভিতর শব্দ ধ্বনির সমন্বয়ে বক্তব্য প্রকাশের প্রয়াসই সঞ্চারিত।

এই কাব্য গ্রন্থটি কবির ইতিপূর্বেকার ব্যবহৃত কবিতার ফমের্র বাইরে বিচরণ করার এক দুর্মর ইচ্ছার ফসল। কবিও একটা সময় ক্লান্ত হন প্রথাগত পথে কবিতা রচনা করতে গিয়ে। তখন হয়তো তিনি ছন্দের বাঁধ ভেঙ্গে চলে যান অন্য কোন মুক্ত পক্ষ পাখির সঙ্গে, নয়তো ধার করেন কোন ভিন্ন ফর্ম। ‘নামের মৌমাছি’ তেমন এক প্রয়াস কবির। একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি-
(ক) সাগরের জলে কি লেখা আছে !
প্রেমিক ! তুমি কি জানো সে ভাষা ?
নীরবে দাঁড়িয়ে তটের কাছে
পড়ে দ্যাখো জলে কি লেখা আছে।
ঢেউয়ের দোলায় কেমন নাচে,
অযুত কামনা মায়াবী আশা!
সাগরের জলে কি লেখা আছে
প্রেমিক তুমি কি জানো সে ভাষা ?
(নামের মৌমাছি)

আবদুস সাত্তার একটি ইংরেজী কাব্য গ্রন্থ রচনা করেন যার নাম ‘দি ইনটিমেট ভয়েস’। তিনি ইংরেজী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। শুধু ইংরেজী নয় আরবী, উর্দু, ফারসী, তুর্কি, হিন্দীসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় তিনি মোটামুটি দক্ষ ছিলেন। এসব ভাষা থেকে অনেক অমূল্য সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করে তিনি বাংলা ভাষী পাঠকের জন্য বিদেশী সাহিত্যের স্বাদ গ্রহণের পথ উম্মোচিত করেছেন। উক্ত ইংরেজী কাব্য গ্রন্থটি সম্পর্কে আমরা আপাতত আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি না।

আবদুস সাত্তারের ষষ্ট কাব্যগ্রন্থ ‘আমার বনবাস’ সাতাশ (২৭)টি সনেট, আট(৮)টি ট্রিওলেট ও অন্য দুটি কবিতা নিয়ে মোট উনত্রিশটি কবিতা সম্বলিত। এখানে কবি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস, আদিবাসীদের জীবন, আদিবাসীদের সঙ্গে কবির সখ্যতা, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের উপলদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবি পার্বত্য বাসীদের সঙ্গে বসবাস করে নিজেকে একজন পার্বত্যবাসী ভাবতে প্রীত বোধ করেছেন। উদ্ধৃতি ঃ
স্বেচ্ছায় নিয়েছি আমি বনবাস, বনভূমি আজ
অজস্র আনন্দ নিয়ে দুই কানে বাজায় এস্রাজ।
(আমার বনবাস)

আবার নিজের সম্পর্কে আত্ম বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে -
নিজেকে ব্যাপৃত রাখি নামাজ রোজা ও কলেমায়-
সৎ হই ভালো হই- এসব আমার জন্য নয় ?
আসল মানুষ হয়ে যদিবা জীবন করি জয়-
তেমন স্বার্থের মতো আর কিছু আছে বা কোথায় ?
(স্বার্থপর, আমার বনবাস)

কবিতা সম্পর্কে কবি নিজস্ব উপলদ্ধি ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
কবিতার পৃষ্ঠা হোক এই দেশ, মাটি অনুপম-
উল্টালেই দেখি যেন শব্দ যদি অন্তমিল সবঃ
আমার দেশের এই গাছ-পালা পাহাড় পর্বত
নদী নালা খালবিল আলো হাওয়া মানুষের মুখ
(কবিতা, আমার বসবাস)

আবদুস সাত্তারের সপ্তম কাব্য গ্রন্থটি সম্পুর্ণ তাঁর নিজের জীবনের উপর দীর্ঘ কাব্য। যে কাব্যের মুল সুর হচ্ছে জন্মদাতা পিতা, গর্ভ ধারনী মায়ের প্রতি শুদ্ধা, ভালোবাসা, আবেগ আকুতি প্রকাশের এক ভক্ত কবির পংক্তিমালা। কাব্য গ্রন্থের সূচনায় ‘উৎসর্গ’ শব্দহীন উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-
বাবা-মার পরে যারা আমার বাবা-মা
তারাও অতীত হলে আবার বাবা-মা
অনন্ত কালের ঘরে সকল বাবা-মা
সোচ্চারে নিমগ্ন থাক নিছক সত্য যা
তাই নিয়ে চির কাল ধরে।

আবদুস সাত্তারের অষ্টম কাব্য গ্রন্থ- ‘পবিত্র নামের কাব্য’ গ্রন্থটি-দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় এখানে আলোচনা থেকে বাদ দিতে হলো। তার নবম কাব্য গ্রন্থ ‘বিম্বিত স্বরূপ’ এবং ‘আবদুস সাত্তার ও অন্যান্য কবিতা ‘‘গ্রন্থদ্বয় সম্পর্কে সোজা কথা বলা যায় এখানে কবি আত্ম জিজ্ঞাসা এবং অধ্যাত্মতাকে বেশীভাবে উন্মোচিত করেছেন।

‘বিম্বিত স্বরূপ’ কাব্য গ্রন্থের একচল্লিশ(৪১)টি কবিতার মধ্যে আঠাশটি (২৮) সনেট। আগেই বলেছি সনেট রচনার প্রতি কবির পক্ষপাত আছে এবং তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এখানেও বেশ কিছু ভাল সনেটের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
গ্রন্থভুক্ত সনেটগুলো- বিম্বিত স্বরূপ/ ছবি/ ত্রাস/ আমি/ আমার ছবি আমার প্রাণ/ মুক্তা/ সাতার/ অহংকার/ আপন/ অধিকার/ অভিজ্ঞান/ আকাশ/ একজন ডুবুরী/ কৃঞ্চসাগর তীরে/ কবির স্বভাব/ কাব্যের প্রাসাদ/ শব্দের প্রতীকে/ কতিপয় শব্দ/ কীট/ আমার ভাবনা/ হাফিজের শারাব/ লালন ফকির/ রবীন্দ্রনাথ/ ফররুখ ভাই/ সম্রাট/ কবির আত্মকৃতি/ আমার প্রেম/ রক্তের টান।

নানা বিষয়, ব্যক্তি, অভিব্যক্তি নিয়ে আবদুস সাত্তার সনেট রচনা করতে পটু ছিলেন। বিশেষ করে মানবিক বিষয় যখনি তাকে তাড়িত করতো তিনি সে বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে তার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এটি একজন বড় কবির গুণ। আর এসব নানা প্রসঙ্গে’র অবতারণা করে কবি চেয়েছেন অমরতা-যা প্রতিটি শিল্পীর এক মাত্র লক্ষ্য ও সাধনা।

উদ্ধৃতি ঃ
ছবি নয়, আমার প্রাণের সততা বুলেটে
সুন্দর মুকুট যদি তৈরী করি মৃন্ময় কৌশলে
সাধনা অর্জিত সব মণিরত্ম কারুস্মিত বলে
মানাবে প্রজ্ঞার শিরে; মানুষের হ্নদয়ের তটে
মমতা কমল হয়ে যদি ফুটি মাতানো সুঘ্রাণে
তাহলে কি থাকবো না প্রিয়তর হয়ে সব প্রাণে ?
(ছবি, বিম্বিত স্বরূপ)

আবদুস সাত্তার আরো বেশী ব্যক্তি ও আত্মমুখী হয়েছেন তাঁর দশম কাব্য গ্রন্থে । এখানে তিনি কখনো নিজের সম্পর্কে বলেছেন, কখনো ভক্ত প্রার্ণা এক জন আধ্যাত্মিক পুরুষ বেশে স্রষ্টার কথা বলেছেন, উদ্ধৃতি-

আমার এ দেহ ধরে মহান আল্লাহ বাস করে
তুমিও সেখানে আছো, হে আমার রাসুল, এ ঠিক
আল্লাহ রাসুল মিলে এই দেহ আত্মার অধিক
তখন কি আমি থাকবো না আল্লার ভিতরে ?
(আল্লাহ-রাসুল-এর আলোকে)

‘আবদুস সাত্তার ও অন্যান্য কবিতা’ শিরোনামে তাঁর এই কাব্য গ্রন্থ চুয়াল্লিশ (৪৪) টি কবিতার মধ্যে ছাবিবশ (২৬) টি সনেট স্থান পেয়েছে।

আবদুস সাত্তারের কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি আত্ম জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজেছেন। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস ও ধারণা সম্পর্কে অকপটে উচ্চারণ করেছেন। এ ধরনটি আমাদের মরমী গানের সঙ্গে বেশ সাযুজ্য পুর্ণ। বাকভঙ্গি, প্রকরণ, শব্দ বাচনিকতাকে আধুনিক প্যাটর্ন রেখে মরমী ধারাকে তিনি কবিতায় আনতে সচেষ্টা হয়েছেন। যেমন উদাহরণ দিচ্ছি ঃ

(ক) আবদুস সাত্তার এখন কবিতা লেখেন না; কবি-
নাম চিরতরে মুছে নিজেই কবিতা হবে বলে
শপথ নিয়েছে। আর যা লিখেছেন আজীবন সবি
এখন নিজের কাছে দুঃস্বপ্নের আলো হয়ে জ্বলে।
(আবদুস সাত্তার এখন, বিম্বিত স্বরূপ)

(খ) সম্পাদক তাকে বলি যিনি তাঁর নিজের জীবন
সম্পাদনা করে হোক সকলের অতি প্রিয়জন।
(সম্পাদক, আবদুস সাত্তার ও অন্যান্য কবিতা)

আবদুস সাত্তার পঞ্চাশের অন্যতম কবি। আমাদের দেশে পঞ্চাশ দশকে কবিতার ক্ষেত্রে ব্যপকতা লক্ষণীয়। বেশ অনেকজন প্রতিভা কবিতার জন্য আমরা পেয়েছি। এদের চারিত্র একেক জনের একেক রকম। যেমন আল মাহমুদ লোকজ বিষয় নিয়ে, শামসুর রাহমান নাগরিক বিষয়ে, শহীদ কাদরী আধুনিক মনন, বিশ্বজনীনতা ও স্বাদেশিকতার মিশনে এক বিশিষ্ট শিল্প বোধ কাব্যভঙ্গির, আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ স্বদেশ প্রেম মাটি ও জীবনের নানা সংগ্রাম মুখরতা আশ্রয় করে ইত্যাদি নিয়ে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। আমাদের আলোচ্য কবি আবদুস সাত্তারকে আমরা বলতে পারি আমাদের বহমান মরমী ধারার একজন আধুনিক কবি রূপকার। সেই সঙ্গে তাঁর দেশপ্রেম, নিজ গ্রাম, মাটি, মাটির কাছাকাছি মানুষের প্রতি প্রেম, নিজের পরিচয় সচেতনতা সব মিলিয়ে আবদুস সাত্তার একজন মহৎ কবি।

যে কথাটি আগেও বলেছি , পুনর্বার উচ্চারণ করছিÑ আবদুস সাত্তার ক্ল্যাসিক ফর্মের একজন সার্থক কবি। একজন সার্থক সনেট রচনাকারী। তাঁর একটি ইংরেজী কাব্যগ্রন্থ, আরেকটি ট্রিওলেট, একটি দীর্ঘ কবিতার কাব্যগ্রন্থ এবং একটি ভিন্ন ধারার কাব্য গ্রন্থ বাদ দিয়ে ছয়টি কাব্য গ্রন্থ সব মিলিয়ে ১৪৬টি সনেটের সন্ধান আমরা পেয়েছি। যেখানে মোট কবিতার সংখ্যা ২৩৭টি। নিঃসন্দেহে বলা যায় আবদুস সাত্তার সনেট রচনায় একজন দক্ষ কবি-কর্মী। হয়তো সব সনেটেরই সমান মান রচিত হয়নি। তবে অধিকাংশ সনেট বোধ্য এবং বক্তব্যধর্মী যা সনেটের কঠিন ছন্দ বন্ধনের মধ্যেও স্বচ্ছন্দ্য ও প্রাঞ্জল।

পরিশেষে আবদুস সাত্তার সম্পর্কে যে কথাটি বলতে চাই, তিনি বহু প্রজ লেখক ছিলেন। তাঁর চর্চার বিষয় ছিল বহু ও ভিন্নমাত্রিক। তিনি নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় বিপুল সময় ব্যয় করেছেন। বিভিন্ন ভাষা চর্চা করেছেন। বহুদেশ পরিভ্রমণ করেছেন। নানা অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যের উপাদানে ছড়িয়ে দিতে প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক। নি:সন্দেহে বলা যায় তিনি ছিলেন একাই একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি হিসাবে কবি আবদুস সাত্তার ছিলেন এককথায় আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের উদ্ধৃতি দিয়ে সে পরিচয় দিতে চাই।

‘ব্যক্তি আবদুস সাত্তার এমন এক স্বচ্ছ দর্পণ- যার অন্তস্তল অবধি পরিস্কার দেখা যায়। সরল, অকপট, অকৃত্রিম, মজলিসি আনন্দময়। কিন্তু নিজস্ব বিশ্বাসের প্রশ্নে অবিচল।’

সহায়ক গ্রন্থ :
১। কবির দশটি কাব্যগ্রন্থ
২। আবদুস সাত্তার : জীবন ও সাহিত্য-আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত
৩। আধুনিক বাংলা কবিতা- বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত
৪। আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ- আবু সয়ীদ আইয়ুব
৫। পান্থ জনের সখা- আবু সয়ীদ আইয়ুব
৬। আধুনিক কবি ও কবিতা- হাসান হাফিজুর রহমান
৭। সাহিত্য চিন্তা- শাহাবুদ্দীন আহমদ
৮। পঁচিশ বছরের বাংলাদেশের কবিতা (প্রবন্ধ) ড. সৈকত আসগর
৯। কবি আবদুস সাত্তার সংবর্ধনা স্মারক



আবদুস সাত্তার এর জন্ম ঃ ২০ জানুয়ারী ১৯২৭ খৃষ্টাব্দ। মৃত্যু ঃ মার্চ ২০০০ খৃষ্টাব্দ।

২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×