আমাদের দেশের মানুষদের ভাঙ্গচুর করা একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। উনিশ থেকে বিশ হলেই, তার উত্তর আমরা দেই ভাঙ্গচুরের মাধ্যমে। হরতাল হলে ভাঙ্গচুর, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে ভাঙ্গচুর, সরক দূর্ঘটনা হলে ভাঙ্গচুর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন বা অন্যান্য ফি বৃদ্ধি পেলে ভাঙ্গচুর, পরিক্ষা না পিছালে ভাঙ্গচুর, স্টক মারকেটের সূচক কমলে ভাঙ্গচুর, বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট না হলে ভাঙ্গচুর। ভাঙ্গচুর না করতে পারলে আমরা যেন অসহায় হয়ে যাই।
দুঃখের বিষয় হল, শুধু যারা অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত তারাই নয়, বরং দেশে যারা আমরা সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত মনে করে থাকি সেই বুয়েট কিংবা অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাতর্থীদেরও বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশের প্রধান উপায় হল ভাঙ্গচুর। তাহলে এই শিক্ষা অর্জন করে কি লাভ হল তাদের? তাদের তো অন্তত উচিত ছিল এই ভাঙ্গচুরের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং অন্যান্যদেরকে এটা থেকে বিরত রাখা।
আমাদের মধ্যে তো দেশ প্রেমের তেমন একটা অভাব নাই। সারা বছরই কোথাও না কোথাও দেশ নিয়ে আলোচনা সভা অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। তাহলে দেশের জিনিস ভাঙ্গচুর কেন? একবারও কি আমরা ভেবে দেখি না, যে যেই জিনিসটা ভাঙ্গলাম, এটা তো আমারই দেশের সম্পত্তি অথবা আমারই কোন ভাইয়ের সম্পত্তি। নিজের দেশের জিনিস কিংবা ভাইয়ের জিনিস ভেঙ্গে আমরা কার ক্ষতি করছি আসলে? কখনও কি এটা ভেবে দেখার প্রয়োজন মনি করি না আমরা? আমরা তো নিজেদেরই ক্ষতি করছি। এই পৈশাচিক, ধ্বংসাত্মক এবং হিংসাপরায়ণ মনোভাব থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না?
আমার তো মনে হয় আমরা এটা খুব ভালো ভাবেই পারি। আজ উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্যে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে অবস্থান করছে। অন্যান্য দেশের কথা যানি না তবে এইটুকু যানি আমেরিকায় প্রতি বছর ৭-১০% টিউশন ফি বৃদ্ধি পায়, এছারাও আমার ৭ বছরের আমেরিকার জীবনে আমি কখনও সেখানে পরিক্ষা পিছাতে দেখিনি। আমেরিকায় তো আমার মতো প্রচুর পরিমাণ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছে। তাহলে প্রতি বছরের শেষে তারা কেন বেতন বৃদ্ধির জন্য ভাঙ্গচুর করছে না কিংবা বিশ্বকাপ থাকা সত্তেও পরিক্ষা না পিছানের কারণে ভাঙ্গচুর করছে না? ওখানে কিভাবে তারা এতো সুবোধ বালক ও বালিকার মতো থাকতে পারছে? দেশে থাকলে তো ঠিকি ভিসি অফিস ঘেরাও, ক্লাসরুম ভাঙ্গচুর শুরু হয়ে যেত।
অন্য মানুষের দেশে যদি এতো ভদ্র ভাবে থাকতে পারি তাহলে আমরা নিজের দেশেও এতো ভদ্র ভাবে থাকতে পারব। অন্যের দেশের প্রতি যদি আমরা এতো ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দেখাতে পারি, তাহলে আমাদের উচিত হবে আমাদের নিজের বাংলা মায়ের প্রতিও সেই অনুরূপ শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। শুধু দেশ নিয়ে গান গেলেই আর দেশ নিয়ে আলোচনা সভা করলেই দেশ প্রেম হয়ে যায় না। দেশ প্রেমের জন্য আমাদেরকে দেশ, দেশের সম্পত্তি এবং দেশের অন্যান্য মানুষের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে যেমনটা আমরা হই বিদেশে গেলে।
মনে রাখতে হবে ভাঙচুর তথা সংঘাত কখনও শান্তি নিয়ে আসে না। শুধু মানুষে মানুষে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, সমাজে আতংক সৃষ্টি করে, দেশের আইন শৃঙ্খলার অবনতি হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা দেশের অপূরণিয় ক্ষতি হয়। তাই আসুন আমরা এই ধ্বংসাত্মক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসি। কারণ আমরা ভাঙ্গচুরের মাধ্যমে শুধু এই গরিব দেশটার ক্ষতিই করে যাচ্ছি বার বার, কোন উপকার করছি না। আসুন আমরা ভাঙ্গচুর না করার প্রতিজ্ঞা করি এবং কাওকে করতে দেখলে তাকেও তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করি।