somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অহল্যা পুরান

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হিন্দু পুরান মতে, স্বর্গের অপ্সরাদের মধ্যে সব থেকে বেশি সুন্দরী হলেন ঊর্বসী। ঊর্বসীর জন্ম আবির্ভাব সম্পর্কে ভগবত পুরানে বর্নিত আছে যে, ভ্যূলোকে ভগবান বিষ্ণুর মানব জোর অবতার নর-নারায়ন যখন হিমালয়ের বদ্রিনাথ মন্দিরে কঠোর তপস্যা শুরু করেন তখন তাদের এই তপস্যা দেবতাদের চিন্তার উদ্রেক হয়ে ওঠে যার ফলাফল স্বরূপ দেবরাজ ইন্দ্র- কামদেব, বসন্ত এবং কিছু অপ্সরাকে তাদের ধ্যান ভঙ্গ করবার জন্য প্রেরন করেন। বিচক্ষন নারায়ন ইন্দ্রের এহেন কারসাজী দেখে একটি ফুল তার ঊরুসন্ধির উপর স্থাপন করেন এবং ইন্দ্র প্রেরিত অপ্সরাদের থেকেও অনেক বেশি সুন্দরী একজন অপ্সরা, ঊর্বসীকে তৈরি করলেন। ঊর্বসীর এহেন রূপ দেখে ইন্দ্র কর্তৃক প্রেরনকৃত স্বর্গের অপ্সররা লজ্জ্বিত হয়ে স্বর্গে ফিরে চলে যায়। নারায়ন তার তপস্যা শেষ করলে, ঊর্বসীকে স্বর্গে ইন্দ্রের কাছে প্রেরন করে দেন। ঊর্বসীর ঊর্বসী নাম ধারন করবার কারন ছিল সে, নারায়নের ঊরুসন্ধি হতে জন্মলাভ করেছিল।

স্বর্গের অপ্সরাদের মধ্যে সব থেকে বেশি সুন্দরী হবার কারনে ঊর্বসীর মধ্যে গর্ব এবং অহংকারের কোন কমতি ছিল না। রামায়নে উল্লেখ আছে যে স্বর্গের সর্বোত্তম অপ্সরা ঊর্বসীর এই অহংকার ভাঙ্গবার জন্য ব্রহ্মা তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে অহল্যাকে সৃষ্টি করলেন এবং তার দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পন করলেন মহর্ষি গৌতমের হাতে যিনি কিনা ছিলেন একজন যোগী, আশ্রমচারী, অনেক গুনের অধিকারী, বুদ্ধিমান এবং বেদ সংক্রান্ত বিষদ জ্ঞানের অধিকারী। দায়িত্ব অর্পন করবার পর ব্রহ্মা মহর্ষি গৌতমকে অহল্যা যখন কুমারী হবে তখন তার নিকট নিয়ে আসবার আদেশ করলেন। অহল্যা ব্রহ্মা কর্তৃক আশির্বাদপুষ্ট ছিল যে তার শরীর এবং সৌন্দর্য্য সর্বদাই ১৬ বছরের কিশোরীর মতই থাকবে। ব্রহ্মার আদেশ মত মহর্ষি গৌতম অহল্যার দেখাশুনা করতে লাগলেন। একসময় যখন অহল্যা চরম সুন্দরী এক তরুনীতে রুপান্তরিত হল তখন মহর্ষি গৌতম অহল্যাকে নিয়ে ব্রহ্মার নিকট হাজির হলেন। অহল্যার ঐশ্বরিক রুপ দেখে শুধু ব্রহ্মাই নয় বরং সকল দেব এবং অসুরগণ চমকায় গেলেন। সকল দেব এবং অসুরগণ তাকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

এহেন পরিস্থিতি দেখে ব্রহ্মা ঘোষনা করলেন যে, সেই জনা-ই অহল্যাকে বিবাহ করতে পারবে যে একটি প্রতিযোগিতায় সবার আগে ত্রি-ভূবন (স্বর্গ, পৃথিবী, মর্ত্য) পরিভ্রমন করে আগে ফিরে আসতে পারবে। ব্রহ্মার এই ঘোষনা শুনে সকল দেবতা এবং মুনি ঋষিগন পৃথিবী অভিমুখে তাদের যাত্রা শুরু করে দিল। ইন্দ্র তার দৈব ক্ষমতাবলে খুব দ্রুত ত্রি-ভূবন পরিভ্রমন করে এসে ব্রহ্মার নিকট অহল্যার হাত দাবী করে বসলেন। কিন্তু সেখানেই তাকে জানানো হল যে ইন্দ্রের আগেই গৌতম মুনি ত্রিভূবন পরিভ্রমন করে ফেলেছেন সূতারাং অহল্যার হাতের দাবীদ্বার শুধু সে। দেবরাজ আশ্চার্যান্বিত হলেন যে এই ত্রিভূবনে তার থেকে দ্রুত কিভাবে একজন সাধারন মানব পুরো ত্রি-ভূবন পরিভ্রমন করতে পারেন? মহর্ষি নারদ মুনি তার এই উদ্বেগ দূর করে জানালেন যে, মহর্ষি গৌতম তার নিত্য পুজার অংশ হিসেবে কামধেনুকে পরিভ্রমন করে ফেলেছেন যেটিই কিনা ত্রি-ভূবন পরিভ্রনের সমান। এজন্য অহল্যার যোগ্য দাবীদ্বার শুধু মহর্ষি গৌতম।

যথা সময়েই সকল নিয়ম কানুনে ধর্ম মন্ত্রের উচ্চারন সহযোগে মহর্ষি গৌতম এবং অহল্যার বিবাহ সমাধা হয়ে গেল এবং একই সাথে অন্যান্য দেব ও মুনি ঋষিকুল ঈর্ষান্বিত হইয়া প্রস্থান করিল। উপহার হিসেবে নব দম্পতি কে ব্রহ্মা ব্রাহ্মগিরি নামক একটি স্থান প্রদান করল যেটি কিনা তাদের সকল ইচ্ছা পূরন করবে। বিবাহ পর্ব সমাপ্ত হইলে, গৌতম এবং অহল্যা তাদের আশ্রমে ফিরে এসে তাদের নতুন সংসার আরম্ভ করিল। রামায়ন মোতাবেক এই আশ্রমটি মিথিলা উপবনে ছিল যেখানে এই দম্পতি তাদের কঠোর তপস্যা এবং সন্যাস জীবন পালন করছিলেন। আবার ব্রহ্ম পুরান মতে, আশ্রমটি পবিত্র নগরী পুশকরের পাশে গোদাভারী নদীর তীরে ছিল।
অহল্যাকে বিবাহ না করতে পারবার গ্লানী এবং ব্যার্থতা দেবরাজ ইন্দ্রের মন হতে কিছুতেই সরছিলনা। খারাপ অভিপ্রায় নিয়ে ইন্দ্র সর্বক্ষন মহর্ষি গৌতমের নিত্য গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন। সে কোথায় যায়, কখন যায়, কেন যায়, কখন আশ্রমে ফিরে আসে। ইন্দ্র দেখল যে মহর্ষি গৌতম প্রত্যহ খুব ভোরে উঠে নদীতে গোসল এবং প্রার্থনার উদ্দেশ্যে আশ্রম ত্যাগ করেন এবং কয়েক ঘন্টা পর ফিরে আসেন। ইন্দ্র এই সুযোগ টিকে কাজে লাগাতে চাইলেন। তিনি চন্দ্র কে অনুরোধ করলেন সে যেন একটি মোরগের রুপ নেয় এবং নিয়মের অনেক আগেই ডাক দিয়ে ভোর হবার জানান দিয়ে দেয়। রাত আনুমানিক ২ টার দিকে চন্দ্র ইন্দ্রকে দেয়া কথামত মোরগের ডাক দিয়ে দেয়। মোরগের ডাক শুনে মহর্ষি গৌতম তার প্রাত্যহিক গোসল এবং প্রার্থনার জন্য আশ্রম ত্যাগ করলেন। এই সুযোগে দেবরাজ মর্তে নেমে আসলেন এবং মহর্ষি গৌতমের রুপ ধারন করে চুপি চুপি আশ্রমে প্রবেশ করলেন। মহর্ষি গৌতম রুপি ইন্দ্র অহল্যার নিকট তার শয্যাসঙ্গী হবার প্রার্থনা করলেন। একজন ক্ষমতাশালী যোগীর সঙ্গিনী হবার সুবাদে অহল্যা তার দিব্যদৃষ্টি দিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো মহর্ষি গৌতমের রুপধারী ইন্দ্রকে চিনতে পারলেন। তথাপি অহল্যা তার সামনে দাঁড়ানো মহান একজন দেবের শয্যাসঙ্গিনী হবার প্রার্থনায় বেশ পূলকিত হলেন। অহল্যা তার দিকে সুমিষ্ট হাসি দিয়ে তার অযৌক্তিক প্রার্থনাকে মৃদু প্রত্যাখান করলেন। মিষ্ট হাসি এবং মৃদু প্রত্যাখ্যানের সুযোগ নিয়ে ইন্দ্র, অহল্যাকে নিয়ে তার সৌন্দর্য্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর চরন আবৃত্তি করে তাকে আরো বিমোহিত করতে লাগলেন। অবশেষে বিমোহিত অহল্যা ইন্দ্রের সাথে পাপাচারে লিপ্ত হল। পাপাচার কর্মটির সিদ্ধির পর অহল্যা তার হুঁশ ফিরে পেলেন এবং ইন্দ্রকে দ্রুত প্রস্থান করতে বললেন।

ইন্দ্রের কামলিপ্সা পরিপূর্ন হবার পর, ইন্দ্র গৌতমের ক্রোধ ভয়ে ভিত হলেন এবং দ্রুত প্রস্থানের তাড়াহুড়া করতে লাগলেন কিন্তু ততক্ষনে সেখানে মহর্ষি গৌতম এসে হাজির হয়ে গিয়েছেন। তাদের দিকে মাত্র এক দেখায় তিনি পুরো ঘটনা আন্দাজ করে ফেললেন। তিনি অহল্যা, দেবরাজ ইন্দ্রকে এবং চন্দ্রকে একই সাথে প্রত্যাশিত অভিশাপ দিয়ে ফেললেন। গৌতম ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন যে যুদ্ধে তাঁকেও ধর্ষিত হতে হবে এবং যে ধর্ষণ প্রথার সূচনা জগতে ইন্দ্র করলেন তাঁর অর্ধেক পাপ তাঁকেই বহন করতে হবে; এবং জগতে দেবরাজের স্থানও স্থাবর হবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই শাপের ফলে ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাস্ত করে লঙ্কায় বন্দী করে আনেন ও নির্যাতন করেন।

পাপাচারে একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালনের জন্য চন্দ্রকে তিনি অভিশাপ দিলেন তার সুন্দর বরন কুশ্রী হবার। বলা হয়ে থাকে, চন্দ্রের কালো দাগ সেই অভিশাপেরই ফসল।

গৌতম অহল্যাকেও অভিশাপ দেন, “মমাশ্রমা সমীপতঃ বিনিধ্বংস”; এবং অহল্যা অপেক্ষাও অধিক সুন্দরী পৃথিবীতে তাঁর রূপের গৌরব খর্ব করতে জন্মগ্রহণ করবেন। কৌশলী অহল্যা তার স্বামীকে বোঝান যে তিনি নির্দোষ, ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধারণ করে তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। গৌতম তখন শান্ত হন। তিনি অহল্যাকে বলেন, রামের দর্শনে তিনি পবিত্র হবেন এবং তখন দুইজনে আবার একত্রে সহবাস করবেন। গৌতম এরপর নিজের আশ্রমে ফিরে যান ও অহল্যা তপস্যা করতে থাকেন।


অহল্যাকে নিয়ে অনলাইনে মুক্তি পাওয়া চমৎকার প্রশংসা কুড়ানো ১৪ মিনিটের একটি শর্টফিল্ম ‘অহল্যা’। মুভিটি মূলত প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নির্মিত। নারীর প্রতি কামভাব সর্বনাশ এনে দিতে পারে যে কোনো পুরুষের। কামনা কখনো কখনো অন্ধ করে দিতে পারে পুরুষকে। বন্দী করে দিতে পারে। আর সেই বদ্ধ জীবনে কেউ তার আপন না। কেউ শুনবে না তার আহ্বান, ডাক। রামায়ণের অহল্যা, ইন্দ্র ও গৌতম মুনির কাহিনিটিকে থ্রিলারের মোড়কে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন সুজয় ঘোষ।
শর্টফিল্মটির লিংক
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৩৯
৩৫টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×