ফেব্রুয়ারী মাসের এক ভোর বেলা দাদাভাই ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজে চড়ে আমাদের ছেড়ে ডাচদের দেশে পাড়ি জমালেন। দেশে রেখে গেলেন মোটামুটি অংকের এক ঋণের বোঝা। দাদাকে হারিয়ে খুব বেশী একা হয়ে গেলাম আমি। বাবা-মা গোপনে সুদিনের প্রহর গুণতে লাগলেন।কিন্তু সুদিন তো সবার জীবনে খুব সহজে ধরা দেয়না ; দিলেও তা আসে অনেক বড় বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। দাদা ওদেশে গিয়েই বুঝলেন অবস্থা ভয়াবহ। নাগরিত্ব বা ওয়ার্ক পারমিট না পেলে এখানে টিকে থাকা কঠিন। চরম কষ্টে দিনাতিপাত করতে লাগলেন দাদা ভাই।সে সময় দাদার সাথে এ বাড়ীর একমাত্র আমার ই-মেইলে যোগাযোগ হতো। দাদার কষ্টের ছিটেফোটাও আমি বাবা-মাকে বলতাম না। অবশেষে গত দু’মাস আগে এক ই-মেইল বার্তায় সুখবর টা এল। দাদা ভাই নেদারল্যান্ডের সিটিজেনশীপ পেয়ে গেছেন, বিশ্বখ্যাত ডেভিটর কোম্পনীতে চাকুরীও পেয়েছেন।মা শুনে সঙ্গে সঙ্গে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লেন, বাবা মহল্লার সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানোর প্রস্তুতি নিলেন, আমাদের অবস্থা হুট করে ফিরে গেল। এই ভাগ্য ফিরাতে গিয়ে দাদাভাইকে কত বড় বিসর্জন দিতে হয়েছে এ কথা জানতে পারলাম আজ সন্ধায় দাদার ই-মেইল পাবার পর। ছোট বেলা থেকেই দাদা ভাই আমার কাছে কিছু লুকায়নি ; আজ-ও লুকালো না। দাদার ইংরেজীতে লেখা ই-মেইলের সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর এ রকম :----
“তন্দ্রা”
ভালোবাসা নিস।
বাবাকে তিন হাজার ডলার পাঠিয়েছি, ঈদের পর আবার পাঠাবো।আমাদের দু:খ এবার ঘুচে যাবে।তুই গত মেইলে জানতে চেয়েছিলি বিষয়টা কিভাবে ঘটলো? তোকে সব খুলে বলছি , বিষয়টা গোপন রাখবি। বেশ কয়েকদিন ধরে অনাহারে দিন কাটাচ্ছিলাম, দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।ঠিক সেই সময় ফিলিপ নামের এক ডাচ যুবকের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে পেশায় একজন ওয়েব ডেভলপার। ফিলিপ নিজেই আমাকে প্রথম প্রস্তাবটি দেয়।এভাবে অনেক ইন্ডিয়ান এদেশে সিটিজেনশীপ নিয়ে আছে।ব্যাপারটি এদেশে খুবই সাধারণ ও বৈধ।আরো সহজ করে বলি।এ দেশে সমকামীতা বৈধ। ফিলিপ আমাকে তার গে পার্টনার হবার প্রস্তাব দেয়। আমি রাজী হলে ফিলিপ আমাদের কিছু অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও চিত্র ঐ দেশের মন্ত্রালয়ে জমা দিয়ে আমার নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করে। গত জুন মাসে আমি সিটিজেনশীপের সমস্ত কাগজপত্র পেয়ে যাই। পেয়ে যাই স্বপ্নের চাকুরিও। আমি কি কাজচা খারাপ করলাম? ধর্ম, জাত, পাত কি বিসর্জন দিলাম। তৃতীয় বিশ্বের নিম্ন মধ বিত্ব পরিবারের কোন ছেলের কি এ গুলো থাকতে হয় ? তন্দ্রা, এবার একটা ভাল ছেলে দেখে খুব ধুমধাম করে তোর বিয়ে দেব। বাবাকে লালমিয়া বাবুর্চিকে বুকিং দিয়ে রাখতে বলিস, তারতো আবার টাইট সিডিউল।
ভালো থাকিস।
ইতি----
তোর দাদা ভাই।।।।
ই-মেইল টা পাওয়া মাত্র আমার ভেতরে কেমন জানি ঘিন ঘিন করছে। মনে হচ্ছে আজ এই রাত্রিতেই দাদা ভাই-এর মৃত্য হয়েছে। আজিমপুরের মত কোন এক কবর স্খানে দাদা ভাইএর আত্বা সমহিত করা হচ্ছে। আমি বাতাসে আগর বাতির সুবাস পাচ্ছি।
শেষ রাতের আকাশে বোধ হয় কিছুটা মেঘ জমেছে। ছিপ ছিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এরকম রাতে দাদা প্রায়ই একটা হিন্দী রবীন্দ্র সংগীত শুনতো। মেয়ে কন্ঠে মিন মিন সুরে দাদার শিউরে বাজতে থাকতো :
“ শাবন-ও গাগনে ঘোর-ও ঘন ঘটা----------আগলা কামিনীরে “
রাতের নিকষ আধার কেটে চারিদিকে আলোর বলি রেখা ফুটে উঠছে। আকাশে যথারীতি মেঘের আনাগোনা। তবে কি মেঘের আলোয় আলোকিত হতে যাচ্ছে পৃথিবী ?????
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ৮:৩৭