দিগন্ত পানে যতোটুকু চোখ যায় কেবলই বিশাল শূন্যতা, মাঝে মাঝে নীরবতার সাক্ষী হিসেবে কিছু বৃক্ষের রুদ্র রূপে দাঁড়িয়ে থাকা, আকাশের নীলে আর জমিনের সবুজেও নিজেকে বড় অচেনা মনে হয়।বাতাসে ছুড়ে দেয়া উদ্দীপ্ত ধ্বনি যখন নিজের কাছে ফিরে আসে কম্পিত লয়ে দিগন্তের কোথাও বাধা পেয়ে তখন শূন্যতা যেন পাঁজর ভেদ করে বায়ু শূন্য করতে চায় অস্তিত্বকে। তবে একেই কি বলে হারিয়ে যাওয়া? জীবনের মতো , জীবন শেষে? জীবন যেন এক শক্তি ক্ষয়ী রাসায়নিক বিক্রিয়া যেখানে উত্তাপ আছে, বিকিরণ আছে, পরিবর্তন আছে নেই কেবল আবাদি স্বপ্নের রোপিত বীজ থেকে অংকুরিত চারা গাছ। জীবনকে কখনও মনে হয় মরিচিকা,কখনও কুয়াশাছন্ন সকালের পূর্ব মহুর্তটুকু আবার কখনও বা অমাবশ্যার নিকষ কালো অন্ধকার। এর মাঝেও আঁধার ঠেলে সূর্য উঠেছে, সমূদ্র সম ঢেউয়ে হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে উকি দিয়েছে নানান রঙ বেরঙ স্বপ্ন, নাও ভাসিয়ে জানান দিয়েছে টিকে থাকার দোদুল্যমান অস্তিত্ব টুকু। হয়ত একেই বলে জীবন আর জীবনের নদীরূপী পর্যায় বিপর্যয়।
জীবনের জানালা দিয়ে উকি দেয়া স্বপ্ন গুলো এক সময় দূর থেকে দূরে চলে যায়, হারিয়ে যায়, মানুষ নিজেকে বিলীন করে টিকে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, এইতো জীবনের ভার্সান, নয়া সংস্করণ। হ্যাঁ তসলিম ভাইও আলাদা কেউ নন এমনই একজন মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছেন দেখিয়েছেন আবার প্রজন্মের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে অতীত হয়ে গেছেন দুদিন আগে। আহমেদ আগা তসলিম, আমার দেখা অসাধারণ এক সিংহ পুরুষ, অকুতোভয় এক মুক্তি যোদ্ধা, প্রচার বিমুখ আত্ন ভোলা এক মানুষ।
২০০৫ সালের কোন এক দুপুরে আমার বন্ধু সোহাগের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল তসলিম ভাইয়ের সাথে। পঞ্চাশের কোঠায় উপনীত ছ' ফুটি ঝকঝকে পরিপাটি এক তারুণ্যময় মানুষ এই তসলিম ভাই। মায়া ভরা চোখে মুখে ছিল দেশের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, থাকাটাই স্বাভাবিক '৭১ এ রনাঙ্গন থেকে যে ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা, লড়েছেন বীরের মতো দেশের জন্য।
যখন এনার্জীপ্যাকে ছিলাম তখন সময় খুব কম পড়ে যেত, ঢাকার রাস্তায় চলে যেত প্রাণ শক্তি তবুও মাঝে মাঝে মাসে দুমাসে এক দু বার দেখা হতো তসলিম ভাইয়ের সাথে। ২০০৫ সালের শেষের দিকে পিডিবিতে যোগ দিয়ে চলে গেলাম দিনাজপুরে, কাক্ষিত মুক্তি মিলে গেল ঢাকার কুৎসিত জীবন থেকে। মুক্তির স্বাদে ঘ্রানে কেটে গেল সময়, বছর দেড়েক ঢাকা আসিনি অনেকটা বিরক্তি থেকেই। টের পেলাম দূরত্ব বেড়ে চলেছে কোন একটা জায়গায়, স্রোতের প্রশ্নে এসেছে বিরাম চিহ্ন। যখন আসলাম তখন ঢাকার অনেক পরিবর্তন, শ্রীহীনতায় ছাড়িয়েছে আমার ধারণা। কিছুই ভালো লাগল না, ভাবলাম হয়তো আমিই বেমানান হয়ে গেছি এ জনপদে, সব কিছুর ব্যাখ্যা যেন খুব সংক্ষিপ্ত তখন, চিন্তার আকাশ যেন মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে আমার। কেবল একটা মানুষকেই পেয়েছি সেই আগের উষ্ণতায়, তিনিই আমার তসলিম ভাই।
সাত মসজিদ রোডের চা বারে আড্ডা হতো, দশটা পেরিয়ে কখনও এগারোটায় ঠেকত। আমি দিনাজপুর থেকে আসলে আমার বন্ধু সোহাগ আর রাজীব লোভ দেখিয়ে বলত " চল তসলিম ভাই আসবে চা বারে" আবার উনাকে ফোন দিয়ে বলত " তসলিম ভাই দিনাজপুরের লোক এসেছে, চা বারে যেতে চায়।" অফিসের কাজ সেরে শুরু হতো আড্ডা, কামু ভাই আসতেন, থেকে থেকে রবীন্দ্র নাথ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন, জীবনের প্রভাবক কবিতায় যেন প্রশান্তি মিলত। কতো কে আসত আমাদের সেই আড্ডায়! রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যাভিনেতা, কর্পোরেট হাউসের বড় কর্তা থেকে শুরু করে আমার মতো অতি সাধারণও। জ্ঞানে, চিন্তায়, আদর্শে, উদারতায় আমি কাউকেই তসলিম ভাইয়ের মতো পরিনত দেখিনি। সভ্য আর সম্পূর্ন মানুষ ছিলেন তিনি। একজন খাঁটি মানুষ আর সংস্কারশীল স্বত্ত্বার অধিকারী ছিলেন এই মার্জিত মানুষটি। খুব সুন্দর করে পোষনকৃ্ত প্রচলিত চিন্তা ধারণা থেকে বের করে আনতেন আমাকে, কোন আদর্শ আরোপের ধারে কাছেও যেতেন না, কেবল সাহায্য করে যেতেন নিজের বিবেক বুদ্ধিকে চিনিয়ে দিতে। বহিঃবিশ্বের রাজনীতিতে ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান, সব কিছু ছকে বেধে ছবির মতো বলে যেতেন। কত গল্প শুনেছি তাঁর থেকে, আমেরিকা থেকে চলে আসার গল্প, সংগ্রামের গল্প, পদ্মা নদীতে উদ্দাম সাঁতারের গল্প, গা শিউরে উঠা মুক্তি যুদ্ধের গল্প। সবই যেন আজ স্মৃতি হয়ে গেল।
অকালেই চলে গেলেন, বড় ঋনী করে রেখে গেলেন আমাদের। কত অজানা অধ্যায় আর জীবনের সাতকাহন উন্মোচিত হলো না। খুব বেশি আসহায় লাগছে আজ, বার বার মনে হচ্ছে আরও বেশি সম্মান প্রাপ্য ছিল এই মানুষটির। আমাদের সূর্যালোকে রেখে অন্ধকারের যাত্রায় বিধাতা ঠিকই আলোয় পথ চলাবেন তসলিম ভাইকে তবুও স্রষ্টার কাছে আবেদন তুমি বাংলার বুকে আবাদ করো এমন অকুতোভয় তসলিমদের যাদের ছায়া নিয়ে পথ চলব আমরা আর মাথা উচু করা বৃক্ষের মতো নিজেকে উজাড় করে ভালবাসবে আমাদের। পরশ পাথরের ছোয়ায় উন্মুক্ত হবে আমাদের হৃদয়।
আজ তোমাকে বিদায় নয় তসলিম ভাই, মুক্তি যোদ্ধা তসলিমকে আমার লাল সালাম।
( তসলিম ভাই রাজীব ও সোহাগের জীবনে কখনও ছায়া আবার কখনও এক রকম আলোর জানালা, তসলিম ভাই সম্পর্কিত অনেক তথ্যই পরে আমি রাজীবের কাছে পেয়েছি )