somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্যার, আমাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবে কে ?

২৫ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ২২ তারিখ। আমি দাঁড়িয়ে আছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। সি বিচে প্রচন্ড ভীড়। মোটামুটি তিল ধারনের জায়গা নেই।

সি বিচে স্পিডবোটে চড়ার ব্যবস্থা আছে। স্পিডবোট বিচ থেকে খুব বেশি দূর যায় না। সি বিচের খুব কাছাকাছি একটা চক্কর দিয়ে চলে আসে। এই এক চক্করেই মানুষ বিপুল আনন্দ লাভ করে।

আমার প্রচন্ড আগ্রহ স্পিড বোটে ওঠার। ২০০৫ সালে প্রথমবারের মত কক্সবাজার গিয়ে খুব বিপদ জনক ভাবে স্পিডবোটে চড়েছিলাম। সে গল্প আরেক সময় বলা যাবে।

স্পিডবোটওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম – “ কত লাগবে?”

স্পিডবোটওয়ালা জন প্রতি পঞ্চাশ টাকা করে চাচ্ছে। আমার মুখ শুকিয়ে গেল । হাতে টাকা পয়সা নেই। পঞ্চাশ টাকা করে স্পিডবোটে ওঠা সম্ভব না।

আমি দরদাম শুরু করলাম –“দশ টাকা করে দিলে হবে ?”

স্পিডবোটওয়ালা মধুর ভঙ্গীতে হাসল। তার হাসিতে অপমান ঝরে পড়ছে। দরিদ্র মানুষদের এ ধরনের অপমান সহ্য করার অভ্যাস থাকতে হয়।

আমার পাশে সত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন । ঘটনার এই পর্যায়ে তিনি আমার হাতে একশ টাকার দুটো নোট গুঁজে দিলেন স্পিডবোটে ওঠার জন্য।

প্রিয় বন্ধুগণ, এই বৃদ্ধের নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ – বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের অতি প্রিয় শিক্ষক।আজ তার জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে লিখব বলেই এত ভূমিকা করতে হল।

মূল ঘটনায় ফিরে আসি। স্পিডবোট ভাড়া নেয়া হয়েছে। বোটে আমরা চারজন – আমি, স্যার, রাজীব সরকার এবং নার্গিস। (আমি স্মৃতি থেকে লিখছি –তাই বোটে মামুন, মুন্নি অথবা হাশিম ভাই এদের কেউ উঠেছিলেন কি না ঠিক মত মনে করতে পারছি না।)

স্পিডবোট চলছে । বাকি সবাই বসে আছে। আমি একা বোটের সামনের অংশে দাঁড়িয়ে আছি এবং ক্রমাগত চেঁচাচ্ছি। বোটের বিকট শব্দে আমার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে না। স্পিডবোটের প্রসঙ্গ এখানেই শেষ করা যাক।
আমার নিজের জীবনে ভ্রমন অভিজ্ঞতা খুব বেশি না। ২০০৮ সালের এই বান্দরবান কক্সবাজার ভ্রমণ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণগুলোর একটা।

এই ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে বান্দরবন থেকে কক্সবাজার বাসযাত্রা। আমি স্যারের পাশে বসেছি। আমাদের ঠিক পেছনের সিটে বসেছে মুন্নি এবং হাশিম ভাই। পাহাড়ী পথ দিয়ে বাস যাচ্ছে। পথের দৃশ্য অতি মনোরম।আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি স্যারকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছি। হাশিম ভাই পরে অভিযোগ করেছেন আমাদের বকবকানিতে তার কান ঝালাপালা হয়ে যাবার যোগাড়।

কয়েক ঘন্টার এই বাসযাত্রায় স্যারের সাথে আমার কথোপকথনের একটা বর্ণনা এখানে দেয়া যেতে পারে।
পাঁচ বছর আগের কথা। কথাগুলো হুবহু আমার মনে নেই। কিন্তু সেদিন তিনি যা বলেছিলেন তার মূল বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকমই ।

আমি বললাম, স্যার, অনেকেই বলে আপনি সবসময় ক্ষমতাবান মানুষদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন এবং কখনোই এদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না।তাছাড়া আপনি কেন্দ্র চালান বিদেশি সাহায্যের টাকায়।

স্যার বললেন, কথাটা ঠিক। কিন্তু এটা না করলে আমি এই প্রতিষ্ঠান চালাতে পারতাম না।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চালানোর জন্য এর কোন বিকল্প ছিল না।

আমি - আপনি নিজে তো মিডিয়ার সৃষ্টি ।

[স্যার এক সময় বিটিভিতে উপস্থাপনা করতেন। সেই প্রেক্ষিতেই প্রশ্নটা করা। আমার এই প্রশ্ন শুনে স্যার মোটামুটি খেপে উঠলেন এবং আমি বুঝলাম অভিযোগটা আংশিক হলেও ঠিক।]

এর জবাবে তিনি যা বলেছিলেন তার মূল বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকম – “মিডিয়ার সামনে প্রতিদিন শত শত লোক এসে দাঁড়ায়। মানুষ কিন্তু এদের সবাইকে গ্রহণ করে না। দর্শকরা তাকেই মনের মধ্যে ঠাঁই দেয় যে দর্শকদেরকে কিছু দিতে পারে। টেলিভিশন ছেড়ে এসে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলেছি, সমস্ত জাতির শিক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমি যদি টেলিভিশনে থাকতাম, তাহলে আজকে টেলিভিশনের যে অধঃপতন ঘটেছে আমি তা ঘটতে দিতাম না। আমি এই অধঃপতন থামিয়ে দিতাম।”

পরে আমার মনে হয়েছে, এই অভিযোগটার মধ্যে কিছুটা গলদ আছে। মিডিয়া আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে সৃষ্টি করেনি। মিডিয়া কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। মিডিয়া তাকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে মাত্র।

আমি প্রশ্ন করলাম –“মানুষ অভিযোগ করে যে আপনি বিদেশী সাহায্যের টাকায় প্রকাশনা ব্যবসা চালান, কম দামে বই বিক্রি করেন। এতে আমাদের প্রকাশকরা মার খায়। আমাদের প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতি হয়।”

স্যার বললেন – “এটা একেবারেই মিথ্যে কথা। এদেশের প্রকাশকরা ডাকাতের মত লাভ করে বলে বইয়ের দাম বেশি হয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে আমরা যে বইগুলো প্রকাশ করি সেগুলোতে আমরা খুব কম লাভ করি।তাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের দাম কম হয়। আমাদের প্রকাশনার অংশটা শুরু হয়েছিল একটু অন্যভাবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য এক একটা বই একশ দুইশ কপি করে কিনতে হয়। তখন দেখলাম দুইশ বই কিনতে যে টাকা লাগে তাই দিয়ে বই প্রকাশ করে ফেলা যায়। এভাবেই শুরু হল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই প্রকাশনা।”

[যারা বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রকাশনা বিভাগ সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানেন না, তাদের জন্য বলছি – বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলা সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের কিছু বই প্রকাশ করে। বইগুলোর দাম কম, ছাপার মান বেশ ভাল। ]

আমি জিজ্ঞেস করলাম – “স্যার অনেকেই অভিযোগ করে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে যাদের অবদান ছিল, যারা পরিশ্রম করেছে তাদের আপনি মূল্যায়ন করেননি।"

এর জবাবে তিনি কি বলেছিলেন সেটা সবার সামনে বলে দেয়াটা ঠিক হবে না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটিও তার জীবনে সব কথা সঠিক বলেন না।

লেখাটা এখানে শেষ করা উচিত। শেষ করি অন্য একটা ঘটনা দিয়ে।

এই ঘটনার প্রায় এক দেড় বছর আগের কথা। স্যারের সাথে নারায়নগঞ্জ গেছি। সেখানে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি আলোকিত মানুষ তৈরীর কথা বলেন, মানুষকে আশাবাদের কথা শোনান, অথচ বিশ্বাসাহিত্য কেন্দ্রে আপনার কর্মচারীরা এত হতাশ কেন ?

স্যার বলেছিলেন, আমার কর্মচারীরা হতাশ কারণ এদের একজনও বই পড়ে না। এদের মধ্যে একমাত্র ইশতিয়াক বোধহয় কিছু পড়ে, আর কেউ বই পড়ে না। এরা আশাবাদী হবে কি করে ?

এরপর আমার প্রশ্ন করা উচিত ছিল, আপনি সারা দেশের ছেলেমেয়েদের বই পড়তে বলেন, নিজের কর্মচারীদের বই পড়াতে পারলেন না কেন ? প্রশ্নটা করা হয়নি। এরকম অসংখ্য প্রশ্ন আমরা বুকের মধ্যে চেপে রাখি।

স্যার চিরকাল থাকবেন না। কেউই থাকে না। আমাদের প্রশ্নগুলো কিন্তু তখনও শেষ হবে না। আমরা প্রশ্ন করব কাকে ?

তবুও তাঁর জন্মদিনে আমারা প্রত্যাশা করি - আমাদের প্রশ্ন আর অভিযোগের জবাব দেবার জন্য তিনি আরো অনেকদিন বেঁচে থাকবেন।

স্যারের জন্মদিনে অনেক অনেক শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:১৬
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×