somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনা: অনিয়ম, অবহেলা নাকি অপরিকল্পিত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা?

২৩ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শাহাবুদ্দিন শুভ :: ২১ জুলাই ২০২৫—এই দিনটি বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় বেদনাবিধুর দিন হয়ে থাকবে। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ২০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন ১৭১ জন। আহতদের অধিকাংশই কোমলমতি শিক্ষার্থী, যাদের ভবিষ্যৎ এই ঘটনার পর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। কেউ কেউ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে বেঁচে আছেন, কিন্তু তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনে আর কখনও ফিরতে পারবেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর অজানা।

দুর্ঘটনা ঘটেছে দুপুর ১টা ৬ মিনিটে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়নের পরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আছড়ে পড়ে উত্তরার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত স্কুল ভবনে। বিকেল নাগাদ নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে, সন্ধ্যায় তা দাঁড়ায় ১৯-এ, এবং রাত ৮টার মধ্যে নিশ্চিত হওয়া যায়—২০টি তাজা প্রাণ হারিয়ে গেছে। আইএসপিআর এর তথ্য অনুযায়ী।

এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতা, পরিকল্পনার ঘাটতি এবং এক প্রকার ভয়াবহ অবহেলার প্রতীক হয়ে রইল। প্রশ্ন ওঠে—কেন রাজধানী ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন করা হবে? আমাদের কি নেই প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত নিরাপদ অঞ্চল? নাকি, আমরা শুধু প্রযুক্তির ওপর ভরসা করে জনজীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েই ‘প্রশিক্ষণ’ চালিয়ে যাব?

প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি : এটি কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে সামরিক প্রশিক্ষণ বিমানের একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:

২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, কক্সবাজার: বিমানবাহিনীর ইয়াক-১৩০ প্রযুক্তিগত ত্রুটিতে বিধ্বস্ত। দুই পাইলট প্রাণে বাঁচলেও এটি প্রযুক্তিগত দুর্বলতার বড় উদাহরণ।

২০২২ সালের ১৬ মে, পটুয়াখালী: নৌবাহিনীর K-8W প্রশিক্ষণ বিমান পড়ে যায় প্রশিক্ষণের সময়।

২০২০ সালের ১ জুলাই, রংপুর: PT-6 বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট নিহত হন।

২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি, কক্সবাজার: প্রশিক্ষণের সময় PT-6 বিধ্বস্ত।

২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর, টেকনাফ: ইয়াক-১৩০ সাগরে পড়ে যায়।

২০১৭ সালের ৯ জুলাই, কক্সবাজার: ইয়াক-১৩০ দুর্ঘটনায় পড়ে।

এই ধারাবাহিকতা বলছে—আমরা শিখি না, শুধুই চালিয়ে যাই।

দায়বদ্ধতা কোথায় : দুর্ঘটনার পরপরই আইএসপিআর তৎপর হয়ে ওঠে, তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা আসে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, এসব তদন্তের ফলাফল কদাচিৎ জনসম্মুখে আসে। দোষীদের চিহ্নিত করা বা ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না।

প্রধান ভাবনার বিষয়গুলো হলো: প্রশিক্ষণ বিমান কেন রাজধানী ঢাকা থেকে উড্ডয়ন করে? বিশ্বের অনেক দেশেই প্রশিক্ষণ ঘাঁটি শহর থেকে দূরে নিরিবিলি অঞ্চলে স্থাপন করা হয়, যাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কম থাকে। প্রযুক্তিগত রক্ষণাবেক্ষণে কতটা তদারকি হচ্ছে? প্রশিক্ষণ বিমানের অধিকাংশই ব্যবহৃত ও সীমিত প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। আধুনিক ফ্লাইট সিমুলেটর ব্যবহারে জোর দেওয়া কি যেত না? দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা কী? একটি জাতি তখনই সভ্য হয়, যখন সে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকের পাশে দাঁড়ায়—সাহায্য নিয়ে নয়, অধিকার দিয়ে।

যা এখন জরুরি : প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া। মৌলভীবাজারের শমেসের নগর, যশোরের বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো থেকে নতুন ফাইলট দের উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া । প্রয়োজন কমগণবসতি পূর্ণ জায়গায় নতুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত।

বিমানগুলোর প্রযুক্তিগত মানোন্নয়ন: বারবার যেসব মডেল দুর্ঘটনায় পড়ছে (যেমন PT-6, Yak-130), সেগুলোর জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তির বিকল্প বিবেচনায় আনা হোক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনবহুল এলাকায় ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণা। সামরিক উড্ডয়নের সময় সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও আগাম সতর্কবার্তা চালু করা। একটি স্বাধীন ও জনসচেতন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা।

শেষ কথা : আজকের এই দুর্ঘটনায় আমরা শুধু মানুষ হারাইনি—হারিয়েছি আমাদের আস্থা, হারিয়েছি শিক্ষার নিরাপদ পরিবেশ, হারিয়েছি রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস। এটা সময় দায়িত্ব নেওয়ার। সময় পরিবর্তনের। শুধু মেলোড্রামা নয়, এবার চাই কার্যকর ব্যবস্থা।

কারণ, যাদের সন্তান আর ঘরে ফিরবে না—তারা চায় না ‘তদন্ত কমিটি’, তারা চায় ন্যায়বিচার।

শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা এবং আহতদের প্রতি রইল আমাদের হৃদয়ের গভীর শুভকামনা।

২১ জুলাই, প্যারিস, ফ্রান্স
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:২০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×