ICDDR,B থেকে যখন চকরিয়ার উদ্দ্যেশে আমাদের মাইক্রোটা রওয়ানা দিছে তখন বেলা তিনটা বাজে। ড্রাইভারের মাইক্রো নিয়ে আসার কথা ৯টা ৩০ এ, সে আসছে ২টা ৩০ এ। চরম বিরক্তি নিয়ে যখন ড্রাইভারকে বললাম, আমরা এত দূরের রাস্তায় যাব আপনার দেরি করাটা মোটেও ঠিক হয় নি। সে অপরাধীর ভঙ্গীতেই বললো, তার বাড়িতে বড় একটা সমস্যা হওয়ায় তার দেরি হয়েছে। সে কারনে সে ক্ষমাও চাইলো।
সময়টা ২০০৪ এর জুলাই বা আগষ্ট মাস হবে। তখন কিছুদিন ICDDR,B তে কাজ করছি। হঠাৎ প্রোজেক্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় অফিসের কম্পিউটার, ফটোকপিয়ার আরো কিছু জিনিশ আমাদের চকরিয়া স্টেশনে পৌছে দেওয়ার জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো, আমার জাপানি বস ইউকিকো ওগাতসুমা।
আমরা ঢাকা থেকে রাস্তার জ্যাম ঠেলে যখন চট্টগ্রাম পৌছাই তখন রাত দেড়টা বাজে। বর্ষার দিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যেতে যেতে ড্রাইভারের সাথে গল্প হচ্ছিল। যখন জানলাম তার বাড়ি মানিকগন্জ এবং সে তার দেরি করে আসার ব্যক্তিগত সমস্যাটা বললো তখন তার উপর আমার আর কোন রাগ নেই।
চট্টগ্রামের কোন একটা হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে রাত ২টা নাগাদ আমরা রওয়ানা দিলাম। গাড়িতে পুরো রাস্তাটা পেছনে ছিলাম, এবার সামনে বসলাম। এত রাতে চকরিয়ার রাস্তাটা যে নিরাপদ না, সেটা নিয়ে ড্রাইভার ও আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম। বৃষ্টিও পড়ছে মুষলধারে। এর ভেতরে ভয়ের কারণেই সম্ভবত ড্রাইভার খুব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে।
চকরিয়ার ৫ /৭ কিলোমিটার আগে একটা মোড় ঘুড়তেই দেখলাম রাস্তার মাঝে কালো বড় কিছু একটা দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টির কারণে গাড়ির হেডলাইটেও জিনিশটা কি বোঝা যাচ্ছিল না। ১০০ কিঃমিঃ গতিতে থাকা গাড়িটাকে একটু একটু করে থামাতে থামাতে আমরা সজোড়ে যেটার সাথে ধাক্কা খেলাম, সেটা রাস্তায় নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি ট্রাক। আমার সিটবেল্ট বাধা ছিলো বিধায় বেচে গেলাম, শুধু ভেঙ্গে যাওয়া সামনের গ্লাসের কাচের টুকরো শরীরে এসে পড়লো। ড্রাইভারের দুই হাত কাচে কেটে রক্ত ঝড়ছে।
দূর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই ২০/৩০ জন লোক এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। রাত তিনটা চারটার দিকে নিরিবিলি একটা রাস্তায় এত লোক কোথা থেকে আসলো সেটা একটা রহস্যই বটে। ডাকাতির যে আশংকাটা আমরা গাড়িতে করছিলাম, এত লোক দেখে ড্রাইভার ও আমি এক্সিডেন্টের ধাক্কা ভূলে ডাকাতের আতংকে পড়ে গেলাম।
কিছু সময় যাওয়ার পর বুঝলাম এরা ডাকাত না। ICDDR,B চকরিয়া স্টেশনের দায়িত্বে যে ভদ্রলোক তাকে ফোন করছি সে ফোন ধরছে না। এত রাতে ফোনে পাওয়াটা সহজ হবে না বুঝতে পারলাম। অনেকক্ষন চেষ্টার পর তাকে পাওয়া গেলো। ঘটনা শুনে এবং অবস্থান শুনে সে বললো আমি দশ মিনিটের ভেতরে আসছি।
ট্রাকটা চাকা পাল্টানোর জন্য থামানো ছিলো, ঘিরে থাকা লোকগুলো জানালো যে দুইজন চাকা পাল্টাচ্ছিলো তারা মারা গেছে। শুরু হলো নতুন টেনশন। একটু পরে পুলিশের গাড়ি এসে থামলো। বিস্তারিত পুলিশকে জানালাম তারা কাগজপত্র দেখলো, গাড়ি চেক করলো। পুলিশি ঝামেলায় পড়লাম।
পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেলো চকরিয়া স্টেশনের ইনচার্জ আসার পর। সে পেশায় ডাক্তার, পুলিশ অফিসারও তাকে চেনে। ট্রাকের চাকার কাছে মরার ভান করে পরে থাকা দুটাকে খোচা দিয়ে বললো তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চল, নাহলে কিন্তু সত্যিই মারা যাবি। অন্যরা ধরাধরি করে লোক দুইটাকে মাইক্রোতে তুলে দিলো। চকরিয়ার স্টেশনে পৌছে দুইটা প্যারাসিটামল খাওয়ায়ে এবং একশ টাকা করে বখশিস দিয়ে আপদ বিদায় করা গেলো।