somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আমি জন্মাতে চাই না

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ৮:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সূর্য ডোবার আগে ছাতিম গাছটার নিচে এসে বসে ওসমান। নদীর ঘোলা পানিতে পাক খাওয়া ঢেউয়ের দিকে সে তাকিয়ে থাকে শুন্য দৃষ্টিতে। উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি রাক্ষসের মতো গ্রাস করছে নদীপাড়ের বাড়িঘর, গাছপালা আর ফসলী জমি। এবারের বর্ষায় এই ছাতিম গাছটাকেও হয়তো গিলে খাবে রাক্ষুসী পদ্মা। আর তারপর? বাপ দাদার দু’কানি ভিটে হয়তো আর রক্ষা পাবেনা। তখন আরো অনেকের মতো ওসমানকেও তার চলৎশক্তিহীন বুড়ো মা আর লিকলিকে শরীরের অপুষ্ট পোয়াতি বউটাকে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্বল বেড়ি বাঁধের ওপর আশ্রয় নিতে হবে। প্রতিবছরই নদী ভাঙ্গে আর কপালভাঙ্গা লোক গুলো আশ্রয় নেয় বাঁধের ওপর। আতংক আর অনিশ্চয়তার ছায়া আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ওসমানকে।
বিয়ের ছয় বছর পর এই প্রথম পোয়াতি হয়েছে বউটা। লক্ষীবালা কাল বিকেলে এসে দেখে গেছে তাকে। সময় হয়ে গেছে। ব্যথা উঠলে খবর দিতে বলে গেছে ওসমানকে। কিন্তু নদীর দিকে তাকিয়ে ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় ওসমানের। একমাস আগেও বাবা হওয়ার আনন্দে উত্তেজিত ছিল সে। তারপর বর্ষা এলো। ফুলে ফেঁপে ওঠা নদীর পানি অজগরের মতো সবকিছু গিলে খেতে খেতে এগিয়ে এলো ওর ঘরের দিকে। আতংকের হিংস্র থাবা কেড়ে নিল ওর বাবা হতে যাওয়ার সব আনন্দ আর উত্তেজনা। মানু মুন্সীর দেড় খানা মাটির ঘর চোখের নিমেষে হারিয়ে গেল পদ্মার পেটে। ছাতিম গাছটা থেকে আর মাত্র দশ বারো হাত উত্তরে ফোঁস ফোঁস করছে পদ্মা নামের অজগরটা। হয়তো আজ কালের মধ্যেই ওসমানের পালা। কানের কাছে সব সময় ক্ষুধার্ত ঘোলা পানির হিংস্র গর্জন। ভয়ে নীল হয়ে যায় ওসমান।
বউটা নতুন পোয়াতি। ছয় বছর কোন ছেলেপুলে হয়নি। গ্রামের লোক এটা সেটা বলতো। শশুর বাড়ির লোকদের সন্দেহ ওসমানকে। গাঁও গেরামের হিসাবে তার বিয়ে হয়েছে বেশি বয়সে। চাচাশশুর আমজাদ মিয়া বলে, ‘আমগো জামাই বান্ঝা। মাইয়ার কোন দোষ নাই।’ খুবই লজ্জার কথা। গ্রামের নারী পুরুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। নারীদের অভিমত, ‘মাইয়া বান্ঝা।’ বেশির ভাগ পুরুষই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, ওসমান সন্তান জন্মদানে অক্ষম। পুরুষ মানুষের সবচে’ দুর্বল জায়গায় ঘা। ওসমান শুকনা মুখে মানুষ জন এড়িয়ে চলাফেরা করে। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস পায়না। ওসমানের পঙ্গু মা দড়ির খাটে শুয়ে থেকে চিন্ চিনে গলায় যথাসাধ্য প্রতিবাদ করে। বলে, ‘পুরুষ মানুষ কখনো বান্ঝা হয়না। তোমাগো মাইয়া বান্ঝা।’
বউটা এসব শুনে শুধু নিঃশব্দে কাঁদে। কায়দা আমপারা ছাড়া তো আর কোন পড়া লেখা নাই। মানুষের অনেক কথা সে ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেনা। আর ওসমান চাষাভুষা মানুষ। অন্যের জমিতে কামলা দিয়ে খায়। বিদ্যার দৌড় টিপসই পর্যন্ত। বুঝতে পারেনা কি করা উচিৎ। গ্রামের দু’চার কলম লেখাপড়া জানা লোক পরামর্শ দেয় শহরে গিয়ে দুজনকেই ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু সে তো অনেক খরচের ব্যাপার। পেটের ভাতই বাড়ন্ত, সেখানে শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখানো! দু’চোখে ভোঁতা অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওসমান। যারা পরামর্শ দেয়, তাদের ভাষা ঠিক মতো বোঝেনা সে।
পুকুরের ঘাটে ওসমানের বউকে দেখে অন্য বাড়ির বউ ঝিরা কেটে পড়ে। বন্ধ্যা নারী দর্শনে অনেক শুভ অশুভের ব্যাপার আছে। গ্রামের মেয়ে মানুষরা এসব মেনে চলে। মা খালা বয়সী মহিলাদের ধারালো জিহ্বা দেখে ভয় পায় বউটা। ওরা ওদের সেই ধারালো জিহ্বা দিয়ে করাত মিলের খাঁজ কাটা চকচকে ব্লেডের মতো বউটার দুর্বল হৃৎপিণ্ডটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে। পড়ি মরি করে এক কলস পানি ভরে বাড়ি ফিরে এসে মাটির দাওয়ায় বসে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে। ওসমান বোঝেনা তার বউ কাঁদে কেন? মেয়ে মানুষের হাসি কান্নার কোন হদিশ নাই, মুরুব্বিদের কাছে বহুবার শোনা কথাটা ওর মনে পড়ে।
বিয়ের দু’বছর পর থেকে কবরেজী ওষুধ খাওয়া শুরু করে বউটা। অনেকে শেকড় বাকড় এনে দেয়। তাবিজ কবজ আর হুজুরের পানি পড়া কিছুই বাদ যায়না। ওসমানের সাথে কামলা খাটা আলতাফ একদিন হাজির করলো ‘জীনের আছর’ তত্ব। আলতাফের বউ মীনার মা স্বামীকে সমর্থন করে তার নিজের চাচির এমন ঘটনা নানা ডালপালাসহ বর্ণনা করলো সবার সামনে। জীন ছাড়ানোর পর তার চাচি এখন প্রতি বছর একটা করে বাচ্চার মা হচ্ছে। ফলে ওসমানের বউয়ের জীন ছাড়ানোর জন্য লোক আনা হল। লোকটার মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ, উকুন ভর্তি জটা চুল। চটের বস্তা কাটা হাতাওয়ালা নোংরা আলখাল্লা। দুর্বোধ্য শব্দে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে ওসমানের দুর্বল বউটাকে কলাগাছের ছতর দিয়ে পেটানো শুরু করলো লোকটা। হাত পা বাঁধা অসহায় বউটা থর থর করে কেঁপে উঠে গগনভেদী চিৎকার দিল, ‘ও মাগো...........’
ধপাস্ করে নরম মাটির একটা বড় সড় চাঙর ভেঙে পড়ে হারিয়ে গেল রাক্ষুসী পদ্মার বুকে। ওসমানের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। আজকের রাতটা কি পার হবে? মানু মুন্সীর বড় ছেলে কলিম দুপুরে এসে খারাপ খবর দিয়ে গেছে। নদীর উজানে দেড় মাইল পশ্চিমে বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। হু হু করে পানি ঢুকছে ফসলী জমিতে। ঘরে চাল নেই ওসমানের। ক’দিন থেকে কাজ কামও নেই। চাল আসবে কোত্থেকে? বউটার এখন তখন অবস্থা। তারপরেও সারারাত উপোষ থাকা ছাড়া উপায় কি? পঙ্গু শরীর নিয়ে মাটির বারান্দায় ছেঁড়া পাটিতে শুয়ে থাকে ওসমানের মা। এই বয়সেও তার ক্ষিধে খুব। সব সময় শুধু খেতে চায়। চিন্ চিনে গলায় বলে, ‘ও বউ, আমারে ভাত দে।’ বউ কোন উত্তর দেয় না। তার চোখ সব সময় ভেজা। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই সে কাঁদছে। ওসমান বোঝে না ওর বউ সব সময় কাঁদে কেন? ছয় বছর পর মা হবে। বন্ধ্যা বদনাম দূর হবে। এ সময় তো তার হাসি খুশিতে থাকার কথা। অথচ সে অহেতুক কাঁদে। মেয়ে মানুষের মন, বোঝা মুশকিল।
গর্ভধারণের তিন মাসের মাথায় খুব ভয়ে ভয়ে স্বামীকে কথাটা বলেছিল বউটা। আনন্দে বিষম খাওয়ার দশা ওসমানের। সেদিন কাজে না গিয়ে সারাদিন বউয়ের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে কাটালো সে। বিকেলে ঘরের চালা থেকে দু’টো চালকুমড়া পেড়ে গামছায় বেঁধে রওনা হল মতি মাতবরের বাড়ি। খবরটা আগে মাতবর সাহেবকে দেওয়া দরকার। মাতবরের দয়াতেই তো আজ এই খুশির দিন। তার ও তার বড় ছেলে আমানের দয়ার শরীর। হোমোপ্যাথি-কবিরাজি, তেলপড়া-পানিপড়া, দোয়া-তাবিজ, জীন ভুত তাড়ানো কোন কিছুতেই তো কিছু হল না। মাতবর সাহেবের হুকুমে তার বড় ছেলে আমান মিয়া ওর বউটাকে শহরে নিয়ে ডাক্তারি চিকিৎসা করাতেই তো আজ ওসমান বাপ হতে চলেছে। আমান মিয়া শহরে ব্যবসা বাণিজ্য করে। নামি দামি লোকজনের সাথে তার ওঠা বসা। সেসব লোকের আশেপাশে যেতেও ভয় লাগে। আমান মিয়া এত বড় ব্যবসায়ী, এত টাকা পয়সা, অথচ বাপের সামনে মাথা তুলে কথা বলে না। বাপের কথার অবাধ্য হবার সাহস নাই। বাপের হুকুমে আমান মিয়া নিজের টাকা খরচ করে বউটাকে শহরে নিয়ে চিকিৎসা করালো। বড় ভাল ছেলে। গায়ের চামড়া খুলে জুতা বানিয়ে দিলেও তার ঋণ শোধ হয় না।
বউয়ের সাথে শহরে গিয়ে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল ওসমান। এত বড় বাড়ি জীবনে চোখে দেখেনি সে। বিশাল ফটকের পাশে লোহার জালি লাগানো ঘরে বিদেশী কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে নেকড়ের মতো। কুকুরটার চোখের দিকে তাকালে বুকের ভেতর ধ্বক্ করে ওঠে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গাট্টা গোট্টা চেহারার দারোয়ানের চোখ দুটো মরা মানুষের চোখের মতো নিস্পলক। চারদিক নিরিবিলি, কোথাও কোন লোকজন নাই। এটাই কি হাসপাতাল? ওসমানের মনের ভাব বুঝতে পেরে আমান মিয়া হেসে বলল, ‘আরে, এটা কি তুমি সরকারি হাসপাতাল পেয়েছ যে চারদিকে লোকজন গিজ গিজ করবে? এ হল প্রাইভেট হাসপাতাল। এখানে নামি দামি লোকেদের চিকিৎসা হয়। ভেতরে গেলে সব বুঝতে পারবে।’
শহরের দামি হাসপাতাল বলে কথা। এরকম নিরিবিলি সাফ সুতরো হওয়ারই তো কথা। এ তো গরিবের হাসপাতাল না। আমান মিয়া ওসমানকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ভয় পেয়োনা। এই বিল্ডিং এর তিন তলায় তোমার বউয়ের চিকিৎসা হবে। মহিলা ডাক্তার চিকিৎসা করবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমান মিয়ার চোখ ইশারায় গেট খুলে দিল দারোয়ান। বলল, ‘সিডি হিট করবো, স্যার।’
বউটার চোখে মুখে ভয়। সে একা যেতে চায় না। শক্ত করে চেপে ধরে স্বামীর হাত। আমান মিয়া বিরক্ত হয়। বলে, ‘আহা, তুমি বুঝছ না কেন? ওখানে শুধু মহিলাদেরই চিকিৎসা হয়। আর ডাক্তাররাও সব মহিলা। পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। ওসমান ওখানে যেতে পারবে না। আমারও থাকা চলবে না। আমি শুধু ডাক্তারের কাছে তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসবো। চলো, চলো, দেরি করো না।’
ওসমানকে নিচতলার ঘরে সোফায় বসিয়ে রেখে ওর বউকে নিয়ে উপরে চলে গেল আমান মিয়া। ফিরে এলো একটু পরেই। হাসি মুখে বলল, ‘ওসমান, তোমার ভাগ্য ভাল। সবচে’ বড় ডাক্তারের কাছে দিয়ে এলাম তোমার বউকে। সারাদিন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বিকেলে ওষুধপত্র দিয়ে ছেড়ে দেবে। আজই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে তোমরা। এখন চল, শহরটা ঘুরে দেখাই তোমাকে। বিকেল পর্যন্ত এখানে বসে থেকে তো কোন লাভ নাই, তাইনা?’
মাতবর সাহেবের ছেলের দয়ার শরীর। এ শহরে থেকে ব্যবসা করে সে। শহরের সব জায়গা তার চেনা। ট্যাক্সি ভাড়া করে চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, শহীদ মিনার কত জায়গায় নিয়ে গেল সে ওসমানকে। দুপুরে কাঁচের দেয়াল ঘেরা হোটেলে বসে বিরিয়ানি খেল ওরা। আহ্, কি স্বাদ! বিকেলে বউয়ের চিকিৎসা শেষে ট্যাক্সিতে করে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ওদেরকে বাসে তুলে দিল আমান মিয়া। বাসের ভাড়া পরিশোধ করে নগদ কিছু টাকাও ওসমানের হাতে তুলে দিল সে। সত্যিই, ফেরেশতার মতো মানুষ। কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসজল হয়ে পড়লো ওসমান। বাসের সিটে বসে আবেশে চোখ দুটো বুঁজে এলো ওর। অথচ বউটা কাঁদছে। কেন কাঁদছে, কে জানে? মেয়ে মানুষের মন। কেন কাঁদে, কেন হাসে নিজেও জানেনা।
‘আপনার পরিবার কান্দে ক্যান?’ পাশের সিটে বসা একজন বৃদ্ধ যাত্রীর প্রশ্নে চোখ মেলে তাকালো ওসমান। বলল, ‘অসুখ।’
‘কাইন্দেন না মা। আল্লায় অসুখ দিছে, আল্লায় ভাল করব।’
হড় হড় করে বমি করে ফেললো বউটা। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বউকে জাপটে ধরে ঝাঁকুনি দিল ওসমান, ‘অ বউ, কি হইছে তর?’
আসলে তার যে কি হয়েছে সে নিজেই কি তা’ জানে? গ্রামে ফিরে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল বউটা। কারো সাথে কথা বলে না, শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে। ওসমানের বিদ্যা হীন বুদ্ধিতে বউয়ের এই মৌনতার রহস্য আরো জট পাকিয়ে যায়। প্রায় প্রতি রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখে বউটা। ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে অন্ধকারে শীর্ণ দুটো হাতে জাপটে ধরে স্বামীকে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত হয় ওসমান, ‘অই, কি হইছে তর? কান্দিস ক্যান?’ অসুস্থ শরীরে সারারাত জেগে থাকে ওসমানের বৃদ্ধা মা। বারান্দায় দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে খুক খুক করে কাশে আর চিন্ চিনে গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘অই ওসমান, তর বউ কান্দে ক্যান?’ অসংখ্যবার জিজ্ঞেস করা এই প্রশ্নের উত্তর নাই। ওসমান নির্বোধ মানুষ। গর্ভবতী হবার পরেও বউটা কোত্থেকে সব শেকড় বাকড় এনে খায়। কেন খায়, কিছুই বোঝে না ওসমান। ওর মা বলে, ‘অই ওসমান, তর বউ তো পোয়াতি হইছে। অহনও এই সব খায় ক্যান?’
আলতাফের মেয়ে মীনার ডাকে চমকে ওঠে ওসমান। ‘চাচা, আজ রাইতের মধ্যে ঘরের মাল সব সরাইয়া ফেলতে কইছে বাবায়।’
‘তোমাগো মালামাল সরাইতাছ নাকি?’
‘হ চাচা। এই লাইগাই তো বাবায় আইতে পারে নাই। আমারে খবর দিতে কইছে।’
ফুঁসে ওঠা নদীর দিকে দিশেহারা দৃষ্টিতে তাকালো ওসমান। দক্ষিনের আকাশে ঘন কালো মেঘ। পশ্চিমে অস্তায়মান সূর্যের লাল আভা ঢাকা পড়ছে মেঘের চাদরে। এলোমেলো বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ। বৃষ্টি আসবে।
পাগলের মতো মাটির হাঁড়ি পাতিল, শিল পাটা আর দা’ বটি চটের বস্তায় ভরে শক্ত করে বাঁধন দিল ওসমান। ভাঙ্গা মগ, একখানা কাঁচের গ্লাস আর থালা বাসন গুলো ছেঁড়া চাদরে ভরে গিঁট দিল সে। ঘর থেকে তিন পায়া ঘুনে ধরা চৌকিটা বের করে উঠানে কাত করে রাখলো। মায়ের দড়ির খাটিয়াটা ঘাড়ে তুলে চাদরের গাঁট্টিটা কাঁধে নিল। ঠিক এই সময় শুরু হল বৃষ্টি। বউয়ের শুকনা মুখটা দেখার চেষ্টা করলো ওসমান। ঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকা অসুস্থ শাশুড়ির পাশ থেকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে বউটা। ধমকে উঠলো ওসমান, ‘অই, উঠতাছিস ক্যান? ওই হানেই হুইয়া থাক্। আমি এইগুলা রাইখা জলদি আইতাছি। ঘাবড়াইস না।’
এক ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় দফায় মালামাল নিতে ফিরে এলো ওসমান। সাথে নিয়ে এলো আলতাফের বড় ছেলে জমিরকে। ঝমাঝম বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসা চোখে ওসমান ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখল প্রচণ্ড ব্যথায় বাঁকা হয়ে যাচ্ছে বউটা।
‘তর বউয়ের ব্যথা উঠছে, ওসমান। লক্ষীবালারে খবর দে।’
‘ইয়ার মধ্যি ক্যামনে কি করি,মা।’ দিশাহারা হয়ে পড়লো ওসমান, ‘বাবা জমির, লক্ষীবালারে একটু খবর দে তো বাপ্। আল্লারে, কি বিপদে ফালাইলা তুমি!’
মাটির ঘরে প্লাস্টিকের ছেঁড়া পাটিতে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বউটা। পাশে তেল চিটচিটে কাঁথার ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে চিন্ চিনে গলায় বিরতিহীন অভিযোগ করে চলেছে তার শাশুড়ি, ‘অই ওসমান, আমার শীত লাগে। আর একখান ক্যাঁথা দে বাবা। অই ওসমান।’ বুড়ির কথার জবাব দেয় না কেউ।
ওসমান তাকিয়ে আছে ভিটার দক্ষিণ দিকে ফলবান কলাগাছের ফাঁক দিয়ে উন্মত্ত পদ্মার দিকে। ছুটে আসছে ক্ষুধার্ত ঘোলা পানি। মুষলধারে ঝরতে থাকা বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গুলো বুকে ধারন করে এলোমেলো নৃত্য করছে ঢেউগুলো। বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়ছে ওসমানের। ভেজা লুঙ্গিটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে দুহাতে চিপে পানি ঝরালো সে। তারপর দ্রুতহাতে গাছ থেকে কাঁচা কলার কান্দিটা কেটে এনে মাটির বারান্দায় রেখে মুরগির কুঠি খুলে সাদা রঙের মোরগটার পাখনা দুটো দড়ি দিয়ে বেঁধে পাশাপাশি রাখলো। রংচটা পুরাতন একটা টিনের বাক্স বের করে আনলো ঘর থেকে। কড় কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। বৃষ্টিভেজা ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকালো ওসমান। অন্ধকার আকাশে বৃষ্টির মাতম। ঘরে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা কুপিবাতির আলোয় বউটাকে আর ঠিকমতো দেখতে পায় না ওসমান। তবে শুনতে পায় ওর গোঙানির শব্দ আর ক্ষীণ কণ্ঠে মায়ের আর্তনাদ, ‘অই ওসমান, শীত লাগে।’
লক্ষীবালা আসার পর ওর হাতে যন্ত্রনাকাতর বউটাকে সঁপে দিয়ে তিনপায়া চৌকি আর বারান্দায় জমা করা জিনিষগুলো জমিরের সাথে ভাগাভাগি করে ঘাড়ে ওঠালো ওসমান। তারপর দুজনে ছুটলো বাঁধের দিকে। অন্ধকারে কাদাপানি ভেঙে ওদের মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে বাঁধের দিকে ছুটে চলেছে আরও মানুষ। ছেলে বুড়ো নারী পুরুষ সবাই ছুটছে। এ গাঁয়েরই মানুষ ওরা, অথচ এখন যেন কেউ কাউকে চেনে না। ওরা চেনে শুধু নিরাপদ আশ্রয়, ঠাঁই নেওয়ার জন্য উঁচু জায়গা। বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকা ছাড়া এ মুহূর্তে আর কোন চাহিদা নেই ওদের।
তৃতীয় দফায় ভিটায় ফিরে এসে আঁধারে কিছু ঠাহর করতে পারলো না ওসমান। কিন্তু কান খাড়া করতেই বুঝলো পায়ের কাছে কল কলে পানির আওয়াজ। এসে গেছে আজরাইল। ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যেতেই আঁধারে দু’জন মানুষের আবছা অবয়ব টের পেল সে। প্রচণ্ড শব্দে বিজলী চমকাল কোথাও। ঘরসহ ভিটার অর্ধেকটা চলে গেছে নদী গর্ভে। অবশিষ্ট ভিটায় শাশুড়িকে জাপটে ধরে বৃষ্টিতে ভিজে থর থর করে কাঁপছে বউটা। পাশে অসহায় লক্ষীবালা। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে ওদের জড়িয়ে ধরলো ওসমান। স্বামীর দু’হাতের ফাঁক গলে যন্ত্রনাকাতর বউটার অজ্ঞান দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
‘জমির, অ জমির, তুই আইছস?’
‘হ চাচা, আমি তোমার পিছনে।’
পঙ্গু মাকে জমিরের পিঠে তুলে দিয়ে বউটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ওসমান। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে। কিন্তু বিজলী চমকানো বেড়ে গেছে। ভিটার দক্ষিণ অংশের একটা বড় মাটির চাঙড় ভেঙে মুরগির কুঠিসহ হারিয়ে গেল নদীতে। তাড়া দিল ওসমান, ‘চল্ বাবা জমির। তাড়াতাড়ি চল্। খাড়ায়া থাকলে বিপদ আছে।’
‘অই ওসমান, শীত লাগে বাবা।’
‘মা, তুই চুপ কর তো! অই জমির, মায়েরে শক্ত কইরা ধরিস। পড়েনা য্যান্।’
বিজলীর আলোয় হারিয়ে যাওয়া বাপ-দাদার ভিটার দিকে একনজর তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ওসমান। তারপর বউটাকে শক্তভাবে বুকের সাথে চেপে ধরে লম্বা লম্বা পায়ে রওনা হয়ে গেল বাঁধের দিকে। পিছে ওর মায়ের অথর্ব দেহটা পিঠে নিয়ে জমির আর লাঠি হাতে লক্ষীবালা। আকাশ চিরে কান ফাটানো বজ্রপাতের সাথে সাথে আবার শুরু হল ঝমাঝম বৃষ্টি।
হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় দৌড়ের মতো করে হাঁটছে ওরা। বুড়ো লক্ষীবালার জন্য মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে ওদের। লক্ষীবালা বক বক করতে করতে ওদের সাথ ধরলে আবার শুরু হয় হাঁটা। বিরক্ত হয় জমির, ‘এত কথা কও ক্যান দাদী? হাঁটো তো!’ লক্ষীবালা তবু বকেই চলে, ‘আহা রে! কি ফুটফুটে সোন্দর একটা মাইয়া হইছিল। কিন্তু ভগবানের কি লীলা, চক্ষু ফুইটা দুনিয়া দেখনের আগেই চইলা গেল।’
জমিরের পিঠে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা ওসমানের মা কঁকিয়ে ওঠে, ‘মাইয়াডারে একটু মাটি দিবার পারলা না তোমরা, পানিতে ভাসায়া দিলা!’
‘মাটি পামু কই?’ কেঁদে ফেলে বৃদ্ধা লক্ষীবালা।
‘মাইয়াডার বাপেও মুখটা দেখবার পারল না!’
‘অই, তোরা চুপ করবি?’ ধমকে ওঠে ওসমান। বউয়ের দেহ কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুখ হাঁ করে হাপাচ্ছে সে। স্বামীর বুকের কাছে মাথা রেখে অচেতন বউটার দুর্বল রক্তশুন্য শরীরটা একটু যেন কেঁপে ওঠে। চোখ মেলে সে তাকায় স্বামীর মুখের দিকে। বিদ্যুৎ চমকের আলোয় বউয়ের যন্ত্রণাকাতর মুখে হাসি দেখতে পায় ওসমান।
‘কি রে, তুই হাসস ক্যান? কি হইছে তর?’
আবার একটু শব্দ করে হাসে বউটা। ‘অ ওসমান’ জমিরের পিঠে গুটি সুটি মেরে ঝুলে থাকা ওসমানের মায়ের কণ্ঠে ভয়, ‘তর বউ হাসে ক্যান?’
কতদিন পর হাসছে বউটা। কিন্তু কেন, তা’ কে জানে? সদ্যপ্রসবা বউয়ের রক্তমাখা নোংরা শাড়ির সাথে বৃষ্টির পানি মিশে বড় বড় ফোঁটায় চুঁইয়ে পড়ছে ওসমানের গা বেয়ে। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওসমানের। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে হাঁটছে সে। সামনে বাঁধের আলো দেখা যায়। সে পর্যন্ত পৌঁছাতেই হবে।
*******************
১০টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×