somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্যরচনাঃ চুল নিয়ে চুলচেরা

০১ লা এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


( ব্লগার বন্ধুদের মধ্যে যাদের মাথায় চুল নেই, এই লেখাটি তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম )

সম্প্রতি সাদাকালো (মানে কাঁচাপাকা) ও রঙিন (মানে ডাই করা) চুল নিয়ে চারদিকে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। একটি পত্রিকার শিরোনাম দেখলাম, ‘রাজনীতিতে চুলাচুলি।’ ফেবুতে একটা কমেন্ট দেখলাম, ‘যাদের মাথায় চুল নেই, তারা কী করবে?’ খুব গুরুতর প্রশ্ন।
আমার নিজের মাথায় যে ক’টা চুল আছে, তা’ গুনে শেষ করতে পনের বিশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। এ অবস্থায় আমিই বা কী করবো? আমার কাজ হলো লেখালেখি করা। কিন্তু এমন বিরল কেশ মানুষের পক্ষে চুল নিয়ে লেখালেখি করা অনেকটা অনধিকার চর্চার মতো। তারপরেও এক ব্লগার বন্ধুর অনুরোধে আজ ঢেঁকি গিলতে বসে গেলাম।

চুল-দু’ অক্ষরের একটা ছোট্ট শব্দ। অথচ এর ব্যঞ্জনা (Figurative mode of expression) অনেক। সাধারনতঃ মেয়েদের ক্ষেত্রে এই Figurative mode of expression বেশি লক্ষ্যনীয়। তবে আজকাল শ্যাম্পু, জেল, ডাই, কন্ডিশনার ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক কমে এসেছে। আমাদের যুগে (মানে আমরা যখন ছেলে মেয়ে ছিলাম) এসব তো দূরের কথা, টয়লেট সাবান না থাকলে কাপড় কাচার হুইল সাবান দিয়ে মাথার চুল পরিস্কার করেও আমরা ক্লাসে গেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা এ কথা শুনলে নির্ঘাত আঁতকে উঠবে।

তবে ব্যাতিক্রম যে সে যুগে ছিল না, তা’ নয়। যেমন, আমার বন্ধু আফতাব। স্বাধীনতার আগে থেকেই আমরা তাকে চুল নিয়ে নানা কসরত করতে দেখে আসছি। নাইন টেনে পড়ার সময় সে চুলে জবজবে করে শর্ষের তেল মেখে পরিপাটি করে আঁচড়ে ক্লাসে আসতো। তার দুই চিপ গড়িয়ে শর্ষের তেল চুঁয়ে গালের ওপর এসে পড়তো। অংক টিচার জামীল স্যারের একটা বদভ্যাস ছিল। ক্লাসের কোন ছাত্র অংক না পারলে শাস্তি স্বরূপ তার চিপ ধরে তিনি টেনে তুলতেন। আফতাবের বেলায় তাঁর হাতের আঙ্গুল বার বার পিছলে যেতো।
দেশ স্বাধীন হবার পর আফতাবের চুল বদলে গেল। সে চুলে শর্ষের তেল মাখা বন্ধ করলো এবং মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বাবরি চুল রাখা শুরু করে দিল। এই ফ্যাশনটা কয়েক বছর কন্টিনিউ করার পর তার বাবরি চুলে অরুচি হলো। তখনকার জনপ্রিয় সুইডিশ ব্যান্ড ‘বনি এম’-এর এক সদস্যের অনুকরণে সে সেলুনে গিয়ে চুলের ছাঁট বদলে ফেললো। মাথার মাঝখানে ঘাড় থেকে কপাল পর্যন্ত লম্বা ও দুই ইঞ্চি চওড়া সজারুর কাঁটার মতো এক গোছা চুল রেখে দু’পাশে চেঁছে ফেললো। আমরা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে সে বললো, ‘এটা পাঙ্ক।’ ইউরোপে এই পাঙ্ক নাকি লেটেস্ট ফ্যাশন।

অবশ্য পাঙ্কও বেশিদিন টিকলো না। সম্ভবতঃ ১৯৭৮ সালের দিকে আফতাবসহ আমরা কয়েক বন্ধু গর্দানি পাসপোর্টে ভারতে গেলাম হিন্দি সিনেমা দেখতে। জানেনই তো, সেই সময় বাংলাদেশে হিন্দি সিনেমা দেখার কোন সুযোগ ছিল না। তো এই গর্দানি পাসপোর্টটা কী? এই পাসপোর্টের শানে নজুল হলো, এটা আসলে কোন পাসপোর্টই নয়। সীমান্তের এপারে বিডিআরকে কুড়ি টাকা আর ওপারে বিএসএফকে দশ রুপী নজরানা দিলে তারা আমাদের ঘাড়ে (মানে গর্দানে) ধাক্কা দিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকিয়ে দিত। আবার ভারত থেকে ফেরত আসার সময় আমরা একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢুকে পড়তাম। ভারতে যাতায়াতের এই চমৎকার সিস্টেমকে আমরা গর্দানি পাসপোর্টে যাতায়াত বলে অভিহিত করতাম। এই পাসপোর্টে আমরা সেই সময় অনেকবার ভারতে যাতায়াত করেছি।
তো সেবার ভারতে গিয়ে হিন্দি ছবি ‘শোলে’ দেখার পর আমাদের আফতাব হয়ে গেল অমিতাভ। মাথা ভর্তি চুলের মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে সে অমিতাভ বচ্চনের হাঁটা চলা রপ্ত করে ফেললো। বন্ধুদের মধ্যে সে তুলনামুলক লম্বা ছিল বলে আমরা তাকে খেতাব দিলাম ‘বাংলার অমিতাভ’। কেউ কেউ বলতো, ‘গরীবের অমিতাভ’।
কিন্তু এই খেতাবও সে বেশি দিন ধরে রাখতে পারলো না। আশির দশকে ‘ডিসকো ড্যান্সার’ ছবি দেখার পর সে নায়ক মিঠুন চক্রবর্তীর অনুকরণে কানের ওপর থেকে দুই চিপ চেঁছে উধাও করে দিল এবং শীত গ্রীষ্ম সব মৌসুমে গলায় মাফলার জড়িয়ে চলাফেরা করতে লাগলো।

বিয়ে করার পর বউয়ের গুঁতো খেয়ে সে মাফলার খুলে ফেললো বটে, কিন্তু তার চুলের মিঠুন কাট থেকে গেল। ১৯৮৫ সালের দিকে সে তার বন বিভাগের চাকরিতে বদলী হয়ে চলে গেল বান্দরবান। ঈদ পালা পার্বণে বাড়ি এলে দেখতাম, তার চুলে আর মিঠুন কাট নেই। পরিবর্তে নতুন ফ্যাশন ডাই। চুলের এখানে কালো, ওখানে লাল, এমনকি হলদেটে সাদাও। তবে বয়সের কারণে তার মাথা ভর্তি চুল অনেকটাই পাতলা হয়ে এসেছে।
এরপর গত বছর ঈদের সময় দেখা হলো আফতাবের সাথে। জীবনে এই প্রথম দেখলাম, ওর চুলে কোন ফ্যাশন নেই। মাথায় চুলই নেই তো ফ্যাশন হবে কোত্থেকে? ওর বউয়ের কাছে শুনলাম, কিছুদিন সে নাকি উইগ (পরচুলা) পরে চলাফেরা করেছে। পরে ছেলেমেয়েদের ধমক খেয়ে উইগ খুলে ফেলেছে।

আফতাবের চা, পান, বিড়ি-সিগারেট কোন কিছুরই নেশা ছিল না। পোশাক আশাকেও সে যে খুব ধোপ দুরস্ত ছিল, এমন নয়। তার একটাই শখ ছিল চুলের ফ্যাশন করা। শেষ বয়সে এসে চুলের অভাবে তার সেই শখটাও গেল। এই কারণেই কী না জানিনা, চুলকে বলা হয় মীর জাফর। বুড়ো বয়সে, যখন মাথায় রোদ বৃষ্টি সহ্য হয়না, তখনই নাকি সে ফাঁকি দিয়ে পালায়। সারা জীবন তার যত্ন আত্যির কথা একটুও মনে রাখে না।
রচনাঃ ২৩/০৮/২০১৩
*****************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:০৫
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×