আগের অধ্যায়
কলেজ ছুটি।
হাতে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে হাটছি।আমার পাশে রাতুল আর সামনে সুমনা। ওদের দুজনরই হাতে ঝাল মুড়ির ঠোঙ্গা।সুমনা নিজের ঠোঙ্গা থেকে ঝালমুড়ি নিয়ে মুখে মধ্যে পুরে নিল। পাচটাকার ঝালমুড়িতে সে আলাদাভাবে একটা কাচামরিচ নিয়ে নিয়েছে। ছোট খাট একটা না মোটাসোটা দেখে বড় একটা কাচা মরিচ নিয়েছে।
সেটা ভাবতেই আমার সারা শরীর কেমন শিরশিরিয়ে উঠল। আমি আবার ঝাল সহ্য করতে পারিনা।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, সে ঝাল খায় কিভাবে!
“এত ঝাল খাওয়ার কি দরকার ছিল? চোখের পানি আর নাকের পানি পুরো এক করে ফেলছ,” আমি বলে উঠলাম।
“ঝালমুড়ির সাথে যদি ঝালই না থাকে তাহলে সেটাকে ঝালমুড়ি বলেনা,” সুমনা আমাদের দিকে ঘুরে বলল। ঝালের কারনে সুমনার মুখ বলতে গেলে লাল হয়ে গেছে। যদিও এই লাল লাল ভাবের কারনের তাকে কিছুটা কিউট লাগছে।
সুমনা তার নাকের পানি মুছতে মুছতে বলল, “আচ্ছা আতার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে?”
“তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ?” আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
সুমনা গোলগোল চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর বলল, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ওকে সাহায্য করব।”
“ভাল। আমাকে এর মধ্যে না ঢোকালে খুশি হব।”
“কেন ?” সুমনা জিজ্ঞেশ করে উঠল।
“আমার ইচ্ছা।”
“হুম,” এই বলে সুমনা সামনের দিকে হাটা শুরু করল।
“আমিও সুমনাপু এর সাথে আছি,” রাতুল নিজের মতামত জানিয়ে দিল।
আমি কড়া চোখে রাতুলের দিকে তাকালাম। আমার চাউনি সে উপেক্ষা করে সে মুড়ি চিবোতে মনোনিবেশ করল।
“আচ্ছা নির্জন কোথায়?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“সে বাসায় চলে গেছে, জরুরী কিছু কাজ আছে বলে,” সুমনা জবাব দিল।
“ও, আচ্ছা।”
সুমনা আর নির্জন একসাথে আসা যাওয়া করে, আজকে সুমনা শুধু আমাদের সাথে আছে। আমি জানি না নির্জন কি ভেবে আজকে সুমনাকে একা ছাড়ল কে জানে?
“তুমি কি সাহায্য করবে না ?” সুমনা এবার প্রশ্ন করে উঠল।
“না।”
“কেন?”
আবারো একই প্রশ্ন।
“প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তির না থাকাই ভাল।”
“কিন্তু সে তো আমাদের কাছে সাহায্য…”
“আজেবাজে ব্যাপারে আমি নাই,” আমি সুমনার কথা শেষ হবার আগে বলে উঠলাম।
“তোমার কাছে আজেবাজে ব্যাপার মনে হচ্ছে ?” সুমনা তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল।
“হ্যা, এই প্রেম-ভালোবাসা হুজুগে ব্যাপার এই আছে তো এই নেই।”
“অবজেকশন মামা, প্রেম-ভালোবাসা পবিত্র জিনিষ, এদের নিয়ে খারাপ কথা বলবেনা।”
“একটা লাথি দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিব হারামজাদা, মুখের উপর কথা বলিস,” আমি রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললাম।
রাতুলও আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে থাকল, সে কি যেন বলতে চাচ্ছিল। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আরেকটা কথা বলবি তো তোর জিব টেনে ছিড়ে দিব।”
“আরে বাচ্চা মানুষের সাথে রাগারাগি করছ কেন?” সুমনা এবার বলল।
“আমি বাচ্চা না,” রাতুল এবার কড়া গলায় বলল।
“মুখের উপর কথা বললে কিন্তু জুতো দিয়ে পেটাব,” এবার সুমনা রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল।
সুমনার এই কথা শুনে রাতুল চুপ করে গেল। তবে তার রাগ কমল না। মুখ গোজ করে সে হাটতে লাগল।
আমি সুমনার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আতা খামখেয়ালী ধরনের কবি, তার মাথায় কখন কি আসে সেটা কোন পাগলে ধরতে পারে, আর তুমি তার খামখেয়ালীকে সাহায্য করবে ?”
“এটা তার খামখেয়লীপনা না , সে সিরিয়াস।”
“এ পর্যন্ত তুমি কোনদিন তাকে সিরিয়াস দেখেছ?”
আমার এই প্রশ্ন শুনে সুমনা চুপ করে গেল।
আমি কিছু না বলে সামনের দিকে হাটতে লাগলাম।
“আমি তারপরেও সাহায্য করব, আমার মন বলছে সে সিরিয়াস।”
“যা ইচ্ছা তাই কর,” আমি বলে উঠলাম, “একেক দিন একেক জন এসে সাহায্য চাইবে আর উনি ওমনি লাফিয়ে লাফিয়ে সাহায্য করতে যাবেন।”
“হু, আমার যা ইচ্ছা তাই করব, তুমি আমার সাথে থাকলে থাকবে না থাকলে নাই।”
“আমি থাকব না, আমাকে বাদ দিয়ে এই কাজ কর গিয়ে যাও।”
এই বলে আমি সামনের হাটা শুরু করলাম। একবার ও পিছনের দিকে ঘুরে তাকালাম না।
*
সুমনা সেই বিকাল থেকে রেগে আছে। বিশেষ করে রানার সাথে কথা বলার পর। সে নিজের রুমে এসে ঢুকল। চোখ প্রথমেই গিয়ে পড়ল কম্পিউটারের উপর, বর্তমানে সেটা এখন তার হলেও আগে এর মালিক ছিল রানা। এখন সেই কম্পিউটারের উপর রাগ ঝাড়তে পারলে ভালো হত।
“কীরে কম্পিউটারের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? খেয়ে ফেলবি নাকি?”
এই প্রশ্ন শুনে ঝট করে সে বিছানার দিকে তাকাল, দেখল মীরা বসে আছে।
“আরে মীরা আপু কোন সময় আসলে?”
“বেশ কিছুক্ষনতো হল,” তারপর সুমনার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ কিরে দেখে মনে হচ্ছে মেজাজ খারাপ।”
“হ্যা, রানার সাথে…”
“রানার সাথে ?” মীরা সুমনার কথার মাঝখানে বলে উঠল, “সাজিদের সাথে তোর ব্রেক-আপ হয়ে গেছে না।”
“হ্যা,” সুমনা এককথায় জবাব দিল।
“সাজিদের সাথে ব্রেক-আপের জন্য তোর মন খারাপ হয় নি।”
“খারাপ লাগলেও তেমন খারাপ লাগে নি। আর সে আমাকে ঠিকমত ফোন মেসেজ কিছুই দিত না।”
“ব্রেক-আপ কি তুই করেছিস নাকি ও করেছে?”
“আমি।”
“কিসের জন্য করেছিস সেটা আমি জানতে চাইব না, তবে কাজটা খারাপ করিস নি।”
“তুমি জানলে কিভাবে?” সুমনা জিজ্ঞেশ করল।
“সাজিদ আমার সাথে কথা বলেছে সপ্তাহখানেক আগে,” মীরা বলতে লাগল, “আমি বলে দিয়েছি আরেকবার আমাকে ফোন দিলে, ফোনের মধেই জুতো দিয়ে পেটাব।”
“তুমি দেখছি ওর উপর একদম ক্ষেপে আছ,” সুমনা হালকা হেসে বলল।
“ওর মত ফাতরা পোলাপাইনের উপর আমি ক্ষেপব না তো কি করব?”
সুমনা চুপ করে থাকে।
সাজিদ হচ্ছে সুমনার আর মীরার কাজিন। সে বর্তমানের বিদেশে গেছে পড়ালেখা করতে। অনেকের ধারনা তার মত আদর্শ ছেলে দুনিয়াতে খুব কম আছে, এমন ভদ্র, বিনয় এবং মেধবী ছেলে খুবই কম পাওয়া যায় যদিও মেইয়েদের মহলে তার তেমন একটা সুমনা নেই।
“ও, রানার সাথে তোর আবার কি নিয়ে ঝগড়া হল?” মীরা এবার জিজ্ঞেশ করে উঠে।
“দাঁড়াও আগে চেঞ্জ হয়ে নিই তারপর বলছি?”
সুমনা এই বলে নিজের ড্রয়ারের দিকে গেল।
“আমি রানার পক্ষে।”
সুমনার কথা শোনে মীরা বলে উঠল। সুমনা অবাক হয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। তার এই কাজিনের বদনাম আছে, আর যাই হোক কোনো ছেলের সাথে তার মতের মিল হয় না, কিন্তু আজকে সে সব কথা শোনা মাত্র রানার পক্ষ নিয়ে নিল!
“কি কারনে?”
“এই সব ব্যাপার আসলেই একটু সেনসিটিভ, আর ওই কবিটাকেও তো আমার সুবিধার মনে হয় না। আসলে কবি জাতকেই আমার সুবিধার মনে হয় না।”
কারন আছে। মীরা ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। সেখানে অনেক কিসিমের লোক দেখা যায়। চশমা পরা ভদ্র ছেলে থেকে ঝাকড়া চুলওয়ালা মাস্তান পর্যন্ত।
মীরা সেখানে অনেক কবি টাইপ ছোকরা দেখেছে, যে কাধে নজরুল ব্যাগ, ঝাকড়া চুল আল্লাহই জানে কয়দিন সেই চুলে সাবান-শ্যাম্পু দেয়া হয় না, পুরোনো জামা কে জানে কয়দিন সেটা ধোয়া হয় না। শেভহীন চেহারা নিয়ে আরাম করে সিগারেট ফুকতে ফুকতে রাস্তার মাঝে নির্বিকারভাবে হাটা। আসলে তারা নিজেদের কিভাবে সেটা কে জানে।
ভালো কবি যে নাই সেটা না, যেমন মীরার ক্লাসমেট আছে। সেই ছেলে কবিতা লিখে, খুব সুন্দর কবিতা লিখে আর সবসময় ফিটফাট থাকে সে। মীরা শুনেছে আগামী বইমেলায় নাকি তার একটা কবিতার বই বের হবে।
“মীরা আপু কই হারিয়ে গেলে?”
সুমনার প্রশ্নে মীরার হুশ আসল।
আসলে কবি জিনিষটাই খারাপ!
“শোন, প্রেম-ভালোবাসা একটা সেনসিটিভ জিনিষ,যারা করে তার বুঝতে পারে এটা সাধারন একটা মুখের কথা না,” মীরা সুমনার দিকে তাকাল, “তুইতো বুঝবি, কারন তুই একজনের সাথে রিলেশনে ছিলি।”
“সত্যি কথা বলব আপু,” সুমনা বলে উঠল, “সাজিদের সাথে ব্রেক-আপ হবার পর কেন যেন মনে হল বুকের উপর একটা পাথর ছিল সেটা নেমে গেল।”
“হুম?” মীরার চেহারায় প্রশ্নের চিহ্ন উঠল।
“আসলে বলতে পারব না কেন, তবে এটা ঠিক সাজিদ আমার সাথে চিটিং করেছে।”
সুমনার এই কথা শুনে মীরা কিছু বলল না। সে জানত এক না একসময় তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবে। আসলে সাজিদ যোগ্য ছিল না সুমনার জন্য।
“হুম, তাহলে কি এখন রানার পিছনে যাবি নাকি?”
মীরা এই প্রশ্ন সুমনাকে একটু হলেও অস্বস্তির মধ্যে ফেলল। কিভাবে এই উত্তর দিবে সে ?
সে চুপ করে রইল, তারপর বলে উঠল, “আমি জানি না, এখন হয়তো তার সাথে থাকতে আমার খারাপ লাগছে না, কিন্তু সামনে সেটা আমার ভাল না লাগতেও পারে। আমি আগে হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম এখন সেটা নিতে যাচ্ছি না।”
তারপর বড়সড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি না সাজিদের সাথে ব্রেক-আপের পর সব কিছু কেমন যেন একটা কমপ্লিকেটেড লাগছে আমার কাছে। এখন আপাতত ওইসব চিন্তা বাদ, দুই বছরের কলেজ লাইফটা একটু এঞ্জয় করে নিই।”
মীরা মুখ উল্টিয়ে বলল, “তুই যা ভাল মনে করিস।”
“আচ্ছা,” সুমনা বলে উঠল, “আতার ব্যাপারে কি করব?”
“তুই কি এখনো ওই কবিকে সাহায্য করার কথা ভাবছিস?” মীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেশ করল।
“সে এত করে চাইছে।”
“আমার মতে তোর ভালোর জন্য বলছি, এইসবের মধ্যে যাস নি। ফল ভালো হবে না।”
সুমনা কিছু বলল না চুপ করে রইল। মীরাও বুঝে গেল সুমনা থামবে না। সে তার কাজ করে যাবে। তবে সুমনাও বুঝতে পারল না এই কবি সাহায্য করতে গিয়ে সে যে কি পরিমান সমস্যায় পড়বে সেটা তার ধারনার বাইরে চলে যাবে।
*
আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি। রাতুল পাশে এসে দাড়াল। আমি তাকে না দেখার ভান করে সামনের দিকে তাকাতে লাগলাম।
“মামা, তোমার সাথে কথা আছে,” সে আমার পিঠের দিকে হাত রেখে বলল।
প্রথমে ভেবেছিলাম পাত্তা দিব না কিন্তু কি মনে করে যেন আমি কান থেকে হেডফোন সরিয়ে রাতুলের দিকে তাকালাম।
“কি কথা?”
“আসলে সুমনাপু ওই কবির কাজ নিতে চায়নি প্রথম প্রথম।”
“তুই জানলি কিভাবে?”
“ছিলাম, সুমনাপুর সাথে। ওই কবি বলতে গেলে সুমনাপু এর হাত এমনকি পা পর্যন্ত ধরতে চেয়েছিল। তার কথা ছিল তার জন্য ‘সসার ক্লাব’কে লাভ গুরু হতে হবে না শুধুমাত্র মেয়েটার সাথে হালকা পরিচয় করিয়ে দিলে হবে, তারপর সে যা ম্যানেজ করার করে নিবে।”
আমি কিছু বললাম না।
আমি চুপ করে আছি দেখে রাতুল বলে উঠল, “মামা তুমি কি মনে কর? এই কাজ কি করা উচিত?”
রাতুল আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল, আমি চুপ করে আছি দেখে রাতুল এবার বলল, “মামা ইদানিং দেখছি তুমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছ।”
বুঝতে পারছি এর সাথে কথা বলতে হবে তা না হলে আরো অনেক ব্যাপার-স্যাপার টেনে নিয়ে আসবে যেটা আমার জন্য ভালো হবে না।
“কিসের জন্যে মনে হল?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“তোমার মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস এখন আর নেই, কেমন যেন একধরনের…” এই বলে সে চুপ করে গেল।
“কেমন যেন কি?”
“মানে… বলতে গেলে ন্যাতানো মুড়ির মত হয়ে গেছ। ”
“ভাল উদাহরন।”
এই বলে আমি চুপ করে গেলাম। রাতুলও আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।
আমি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম, ‘ন্যাতানো মুড়ি’, হাহ।