somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘‘যা গেছে, তা গেছে’’— তৃণমূল সরকারের দু’বছর

৩০ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ’ কোন সকাল....

২০১১’সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছে তৃণমূল সরকার। ইতোমধ্যেই পেরিয়েছে ২৪মাস। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত সরকারের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন ২৪ মাসে সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু যখন সেই সরকারের প্রধানই বারে বারে দাবি করতে শুরু করেন যে, ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে কিংবা আরও একধাপ এগিয়ে যখন বলেন ১০০ শতাংশ কাজই শেষ হয়েছে, তখন রাজ্যবাসীকেও অভিজ্ঞতার নিরিখে পরখ করে নিতে হয় সরকারের ‘পারফরমেন্স’।
বিরোধী রাজনৈতিক দলের বক্তব্য না হয় এখানে তোলা থাক। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর কৌশলেই এই সরকারের তরফে কখনও ৯০ দিনের মাথায় কখনও এক বছরের মাথায় ঘটা করে বই ছাপানো হয়েছে। দু’বছরের ‘সাফল্য’-র দাবিরও পাতাজোড়া রঙিন বিজ্ঞাপনে প্লাবিত হচ্ছে বাজারী খবরের কাগজ। মহানগরীর রাস্তায় রাস্তায় দেদার খরচে হোর্ডিং, মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন পোজে ছবির বন্যা।
একটি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া সরকার যদি প্রথম থেকেই বলতে শুরু করে সব কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে, তখন স্বাভাবিভাবেই তা নতুন আশঙ্কা, সন্দেহের জন্ম দেয়। আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা টের পাওয়া যায় সরকারের পথ চলার শুরুতেই যখন একাধিক রোগীর অপারেশন থাকায় ব্যস্ত চিকিৎসক মুখ্যমন্ত্রীর ফরমান অনুযায়ী মহাকরণে দেখা করতে না যাওয়ায় তাঁকে ‘শাস্তি’ পান।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রথমেই হুকুম দিয়েছিলেন, ১০ বছর বিরোধীরা যেন মুখে ‘লিউকোপ্লাস্ট’ লাগিয়ে রাখে। চরম অগণতান্ত্রিক মনোভাবেরই এই বহিঃপ্রকাশ ১৯ মাসের মাথায় আর শুধু বিরোধী দলের ওপরেই সীমাবদ্ধ নয়। মেধাবী ছাত্রী থেকে জঙ্গলখন্ডের কৃষক, অধ্যাপক থেকে ‘পরিবর্তনপন্থী’ শিল্পী-মুখ্যমন্ত্রীর রোষানল থেকে বাদ যাচ্ছেন না কেউই।
বিরোধী বামফ্রন্ট কোনো কাজ রূপায়ণে বাধা দিয়েছে এই অভিযোগ তোলা শাসক দলের পক্ষে একটু কঠিন। তবে মিথ্যা অভিযোগ, কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ কিংবা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার দক্ষতা যে হারে প্রতিদিনি বাড়িয়ে চলেছে এই সরকার তাতে কোনকিছুই আর ‘কঠিন’ থাকছে না।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রায় সমস্ত কাজে বিরোধীরা বাধা দিয়েছিল, তা সে অটোমোবাইল কারখানা হোক, বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক, সংখ্যালঘু কল্যাণ হোক, অপারেশন বর্গা হোক, রাস্তাঘাট নির্মাণ হোক, বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হোক। ফলে কেন দু-দুটি শিল্প সম্মেলন করার পরেও দু’-টাকার বিনিয়োগ আসেনি রাজ্যে, কেন একটি নতুন কারখানাও এই সময়কালে মাথা তুলতে পারলো না, কেন নতুন রাস্তা তৈরির কাজও বন্ধ, সেসবের ব্যাখ্যা দেওয়া এখন তৃণমূল সরকারের কর্তব্য।
প্রথমত, পরিকল্পনামাফিক কিছু কাজে নতুন সরকার অবশ্যই হাত দিতে পারতো। ১৯মাস একটি সরকারের কাছে খুব বেশি সময় না হলেও, খুব কম সময়ও নয়। কিন্তু তা না করে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা করতে তারা যত আগ্রহী, নিজেদের কাজে তাদের ততটা আগ্রহ নেই।
যে কাজ বামফ্রন্ট সরকার করেছিল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, পঞ্চায়েত প্রভৃতি ক্ষেত্রে, সেসবগুলি বজায় রাখা বা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ নতুন সরকার করতেই পারতো। পাট্টা বণ্টনের কাজ চালু রাখা উচিত ছিল, নতুন সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের ও বি সি সার্টিফিকেট বণ্টনের কাজ, হাসপাতালগুলিতে ডাক্তার, নার্স-কর্মীদের শুধু ধমকধামক না দিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। ডাক্তারবাবুদের ধমক ও হুমকি ছাড়া স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বৃদ্ধি সম্পর্কে কোনো পরিকল্পনাও নতুন সরকার করেনি। চালু কাজও হচ্ছে না। রেগা প্রকল্পে এরাজ্য এখন শেষের দিকের রাজ্যগুলির সঙ্গে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ করছে। ধান সংগ্রহে বিহারের থেকেও পিছিয়ে পড়েছে। দেনার দায়ে কৃষক আত্মহত্যা করছে। মাঝখান থেকে আবার পঞ্চায়েতের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ঠুঁটো জগন্নাথ করে দিয়েছে তৃণমূল সরকার। সরকারী পরিবহন কর্মীদের পেনশনের ব্যবস্থা বামফ্রন্ট সরকারই করে দিয়ে এসেছে। পেনশন তো দূর অস্ত, রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থার কর্মীদের বেতনও অনিয়মিত হয়ে গেছে। আত্মহত্যার তালিকায় নাম উঠেছে অবসরপ্রাপ্ত পরিবহন শ্রমিকদেরও।
‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকার যদিও তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। ‘বিচ ফেস্টিভ্যাল’ থেকে শুরু করে একের পর এক উৎসব, মেলার আয়োজন নিয়েই ব্যস্ত। পাশাপাশি চলছে পছন্দমতো ক্লাবগুলিকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার পালা।
‘উৎসবের’ আলোয় চাপা পড়ছে বন্ধ চা বাগানের স্বজন হারানো শ্রমিকের কান্না, অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটানো বাগিচা শ্রমিকের যন্ত্রণা, আত্মঘাতী কৃষক পরিবারের হাহাকার! মুখ্যমন্ত্রী সদর্পে বলছেন, ‘উৎসব করবো না তো শ্রাদ্ধ করবো নাকি!’’
মাত্র ২৪ মাসেই এরাজ্যকে পিছন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ‘কৃতিত্ব’ শুধু নয়, ধর্ষণ-নারী নিগ্রহের মত ঘটনার মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে আনা হয়েছে সামনের সারিতে! ‘বেঙ্গল লিডস্‌’!! ৩৪ বছরের অনন্য সাফল্যকে ধুয়েমুছে ফেলার নিদারুণ চেষ্টা!
হাইকোর্টের বিচারপতিকেও বলতে হচ্ছে ‘রাজ্য জ্বলছে’। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলীর খেদ, সরকার কমিশনের সুপারিশও মানছে না। এমনকি সরকারের অভিভাবকের গলাতেও বিরক্তির সুর। ৭০ বছর বয়সী বিধায়ক আবদুর রেজ্জাক মোল্লার ওপর আক্রমণে এবং সেই ঘটনার পরে প্রতিবাদ মিছিলেও গুলি চালানোর ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন গত ৯ই জানুয়ারি মন্তব্য করেন, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে এই সবের কোন যোগ নেই। চারদিকে এক ধরনের গুণ্ডাগিরি (গুণ্ডাইজম) চলছে।’
তৃণমূলের ইশতেহারের ৪২ নম্বর পাতায় বুলেট পয়েন্টে লেখা ঘোষণা ছিলো- ‘আমাদের সব কিছু ছিলো, আমাদের মেধা ‘নাসা’ থেকে ‘ভাষা’ সর্বত্রই।...ফুটুক বাংলার মাটিতে মা-মাটি-মানুষ ফুল। আসুক নতুন ভোর’।
মাত্র চব্বিশ মাসেই সেই ‘নতুন ভোর’ অমাবস্যার রাতের চেয়েও ঘন অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে।

ঘটা করে ‘শিল্প সম্মেলন’, বিনিয়োগ নেই শিল্পে...

রাতের অন্ধকারে হনুমান টুপি পরে শিল্প সংস্থার ম্যানেজার সহ কর্মীদের ভয় দেখিয়ে হলদিয়া ছাড়া করার পর সেই শিল্পনগরীতেই ঘটা করে হয়েছিল শিল্প সম্মেলন। খরচ প্রায় ২০ কোটি টাকা। বিনিয়োগের অঙ্ক কত? শিল্পমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি বলতে পারবো না, আপনারা অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে ঘাঁটুন।’
কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জির সরকার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বিনয়োগ টানতে পেরেছে। অথচ রাজ্যে ‘ছয় লক্ষ চাকরী’ হয়েছে বলে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একটি কলকাতায়, আরেকটি হলদিয়ায়–আঠারো মাসে দুটি শিল্প সম্মেলন। কিন্তু রাজ্য সরকারের একগুঁয়ে মনোভাব, জমি অধিগ্রহণের সমস্যা , শিল্পনীতির অভাব ও রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার সামগ্রিক পরিণতি কোন বড় শিল্পগোষ্ঠী এখানে বিনিয়োগে নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। তৃণমূল জোট সরকারেরই আর্থিক সমীক্ষার রিপোর্ট জানাচ্ছে, ‘পশ্চিমবঙ্গে ২০১১সালে(জানুয়ারি-অক্টোবর) এই সময়ে ৩২হাজার ৩৭৪কোটি টাকার বিনিয়োগ মূল্যের ৯৩টি মাঝারি ও বড় শিল্পের প্রস্তাব এসেছে। বাজেট ভাষণে সামগ্রিকভাবে বর্তমান বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকার এমন প্রস্তাবের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো শিল্প স্থাপন নয়, শুধুই প্রস্তাব! এমনকি জঙ্গলমহলের শালবনীতে এশিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত প্রকল্পও আশঙ্কার কালো মেঘ।

উৎসব আর মোচ্ছব : সরকার চলছে, না ক্লাব?

বামফ্রন্ট সরকারের করে যাওয়া ঋণ মেটাতেই নাকি সরকারের কোষাগার খালি হয়ে যাচ্ছে, তাই উন্নয়নের জন্য টাকা নেই, এই ভাঙা রেকর্ড গোড়া থেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও ২০১১ সালের প্রকাশিত আদমসুমারি জনসংখ্যার তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিটি রাজ্যের মাথাপিছু ঋণের হিসেব করলে দেখা যায় যে, মাথাপিছু ঋণের পরিমাপে ২৮টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান (২০,৪৭১ টাকা) ত্রয়োদশ স্থানে, প্রথম স্থানে নয়, যা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যে বলা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ওপরে আছে পাঞ্জাব (২৬,৭১৪ টাকা), কেরালা (২৪,৫০৫ টাকা), গুজরাট (২৩,০২০ টাকা) ও অন্যান্য রাজ্য। ২০১২-১৩সালের বাজেটে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী বর্তমান আর্থিক বছরে রাজ্য সরকারের মোট আয় ১ লক্ষ ৩৭৫কোটি টাকা। আর এবছরে রাজ্য সরকারের সুদ ও আসল বাবদ মোট ব্যয় ২৫ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা, যা রাজ্য সরকারের মোট আয়ের থেকে অনেক কম! তাহলে উন্নয়নের কাজে বাকি টাকা লাগাতে অসুবিধা কোথায়? আসলে অসুবিধা তৈরি হয়েছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছানুসারে দেদার বেহিসেবী খরচে। কথায় কথায় উৎসবের নামে মোচ্ছব চলছে। আড়াই হাজারের বেশি ক্লাবকে সরকারী কোষাগার থেকে ২ বছরে ১৮২ কোটি ১৭লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে কীভাবে? গত বছরই ৭৮১টা ক্লাবকে দু’লক্ষ করে টাকা দিতে গিয়ে ১৫কোটি ৬২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। কোন কোন ক্লাব পাচ্ছে, কী তার মাপকাঠি, পাওয়া অর্থ কীভাবে খরচ হচ্ছে, তার কোন ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট দিতে হবে কি না, সরকার কোন নজরদারি রাখবে কিনা–সব কিছুতেই রয়েছে ধোঁয়াশা।

‘হাসছে জঙ্গলমহল’-নিদারুণ রসিকতা

বিরোধীদের দাবি নয়, হাসতে থাকা জঙ্গলমহলের উন্নয়নের চেহারা কি তা জানা গেছে খোদ রাজ্যের মুখ্যসচিবের চিঠিতে। রাজ্যের গণবণ্টন এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর মতে এখন ‘আদৌ বিরাজ না করা এক নজরদারি ব্যবস্থা বিরাজমান।’
চিত্তাকর্ষক এমন একাধিক বক্রোক্তিসহ বছরের প্রথম দিনে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ আমলার লেখা ওই চিঠি থেকে স্পষ্ট মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ব্যানার্জির দক্ষতা!
চোখ বোলানো যাক জঙ্গলমহলে মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতির বহরের দিকে। লালগড়ে রেললাইন কোথায়? জানে না কেউই। মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতি ছিল গোয়ালতোড়ে ১০০০ একর জমিতে শিল্প। তার কাজ এক বিন্দুও এগোয়নি। বলেছিলেন, জঙ্গলমহলের জন্য ‘এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক’ তৈরি হবে। এখনো কাজ শুরু হয়নি। ঘোষণা ছিল — জঙ্গলমহলের ২৩টি সার গ্রাম, মিনিকিট সেন্টার, কৃষি উৎপাদন সামগ্রী বিক্রয়কেন্দ্র, ১৫টি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প, ট্যুরিস্ট লজ। উত্তর — হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ছিল — জঙ্গলমহলের ৯০০টি স্কুলে সাঁওতালী ভাষায় পড়ানোর জন্য ১৮০০ শিক্ষক নিয়োগ হবে। সেই কাজ হয়নি। লালগড়ের রামগড়ে একটি পলিটেকনিক তৈরির ঘোষণা, জমিই এখনো হাতে পায়নি কারিগরী শিক্ষা দপ্তর।
লালগড়ে নার্সিং ট্রেনিং স্কুলের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু জমিরই এখনো ব্যবস্থা করতে পারেনি ভূমি দপ্তর। শালবনীতে আই টি আই কলেজের কাজ কতদূর হয়েছে? ৮শতাংশ। বাঁকুড়ার খাতরায় আর একটি আই টি আই কলেজ তৈরির ঘোষণা, কাজ কতদূর এগিয়েছে? ৫শতাংশ। লালগড় কলেজের হাল কী? এখনো কাজ শুরু হয়নি। নয়াগ্রামের কলেজের কাজ আবার পিছিয়ে গেছে খোদ স্থানীয় তৃণমূল বিধায়কের আপত্তিতে। ‘জঙ্গলমহল শান্ত’ বলে দাবি করলেও পুরুলিয়ার বলরামপুরে তিন-তিনবার টেন্ডার ডেকেও তোলাবাজির ভয়ে আই টি আই-র বিল্ডিং তৈরির বরাত দেওয়ার লোক পায়নি রাজ্য সরকার। যৌথবাহিনী তুলে নেওয়ার সাহসও পাচ্ছে না সরকার।

শিক্ষাক্ষেত্র-নৈরাজ্যের খেলাঘর

কলেজ ছাত্র সংসদ দখলে শাসক দলের কাউন্সিলারের নেতৃত্বে সশস্ত্র হামলা-গুলিতে মৃত্যু পুলিসকর্মীর। গত দু’বছরে শিক্ষাক্ষেত্রের কার্যত বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে নৈরাজ্যের এই চেহারাই। তৃণমূলী সরকার ক্ষমতা আসার পর থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রে মতো শিক্ষাক্ষেত্রও আক্রমণের নিশানা হয়েছে। প্রকাশ্যে অধ্যাপক, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হেনস্থা, মারধর করা, জোর করে ছাত্র সংসদ দখল করা, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দ্বারা এস এফ আই সহ বামপন্থী ছাত্রকর্মী, সমর্থকদের মারধর করা, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এস এফ আই কর্মীদের মনোনয়নপত্র তুলতে না দেওয়া, পাস করানোর অযৌক্তিক দাবি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা উপাচার্যকে ঘেরাও, বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করে দু’জন উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার মধ্যে দিয়ে নৈরাজ্যকেই আমন্ত্রণ করা হয়েছে। শাসক দলের সম্পদ ‘আরাবুল ইসলাম’, সুলতান আহমেদে সহ একাধিক নেতার বিরুদ্ধে এমনকি অধ্যাপক, অধ্যাপিকাদের হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে।
আবার ‘দলতন্ত্রমুক্ত’ করার নাম করে রাজ্য সরকার যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গঠন করেছে তাতে শাসক দলের অনুগামীদেরই ভিড়। নির্বাচনের আগে সংবাদ মাধ্যম, মিছিল, মিটিং-এ যাঁরা তৃণমূলের হয়ে গলা ফাটিয়েছেন, তাঁরাই হলেন সরকার নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য। আবার এঁদের সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স এনে নতুন আইন তৈরি করা হলো।

নারী নিগ্রহে প্রথম স্থান

পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কান্ডে মূল অভিযুক্ত অধরা কাদের খান গা-ঢাকা দিয়ে থাকার রসদ পায়। ধর্ষিতা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা আত্মঘাতী হওয়ার মানসিক অবসাদে ভোগেন।
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের বিরুদ্ধে গিয়ে পার্ক স্ট্রিট কান্ডের তদন্ত সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি হয়ে যেতে হয় কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান দময়ন্তী সেনকে।
কাটোয়ার ধর্ষিতা জননীকে প্রমাণ দিতে হয় যে তাঁর স্বামী ১১বছর আগেই মারা গেছেন।
বারাসতের লাঞ্ছিতা তরুণীকে তাঁরই এলাকার বিধায়কের মুখ থেকে শুনতে হয়, ‘মেয়েদের স্কার্টের সাইজ ছোট হওয়ায় সমস্যা বাড়ে।’
ঝাড়গ্রামে অভিযোগ জানাতে আসা লাঞ্ছিতা গৃহবধূর ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট চায় পুলিস।
বাংলা মহিলাদের এই নিদারুণ অবমাননা ও যন্ত্রণার চিত্রই আজকের বাস্তবতা। এর মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে হরেক রকমের পরিসংখ্যান এবং রাজ্য সরকারের মনোভাব। জাতীয় মহিলা কমিশনের পর্যবেক্ষণ থেকে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য কোন কিছুকেই আমল দিতে চাইছে না এরাজ্যের বেপরোয়া সরকার। এরাজ্যের কোথাও দিনে ও রাতের কোনো সময়েই মহিলারা আজ নিরাপদ নন। ৭ থেকে ৭২, সব বয়সের মহিলাই ধর্ষিতা হয়েছেন গত দু’বছরে। জাতীয় মহিলা কমিশনের এই পর্যবেক্ষণ নিশ্চিতভাবে রাজ্যবাসীর কাছে উদ্বেগের।

‘ছোট্ট মন্ত্রিসভা’ এবং....

‘মাথা নয়, কাজে ভারী মন্ত্রিসভা’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেই ‘ছোট্ট মন্ত্রিসভার’ চেহারা কী? রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা এখন ৪৪। তাঁর দলের ১৮৩জন বিধায়কের মধ্যে মন্ত্রী হয়েছেন ৪৪জন। আইন অনুসারে এর বেশি মন্ত্রী করা যাবে না। কিন্তু তাতে সমস্যা মেটেনি। দাবিদারের সংখ্যা অনেক বেশি। এদিকে কেন্দ্র থেকে সমর্থন তোলার পর ছয়জন মন্ত্রীও ‘বেকার’। ফলে তাঁদেরও পুর্নবাসন দিতে হয়েছে মমতা ব্যানার্জিকে। রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের মাথায় উপদেষ্টা হিসাবে বসিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের। তাই বিধানসভায় বিল এনে হাতি পোষার মতো ৪৪টি সংসদীয় সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়, যারা খরচের বহরে ‘আধা-মন্ত্রী’ গোছের।

কৃষক আত্মহত্যার মিছিল…

সরকারটা নাকি ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর। নিদারুণ পরিসংখ্যান বলছে গত চব্বিশ মাসে প্রায় ৮৫ জন কৃষক ও খেতমজুর ফসলে মার খেয়ে, দেনার দায়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। ফসলের দাম না পেয়ে, দেনার দায়ে কোনো কৃষিজীবী মানুষকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে, এমন ঘটনা কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪বছরে কখনো হয়নি। এমনকি বামফ্রন্টবিরোধী কোনো সংবাদমাধ্যমও তা প্রচার করতে পারেনি।
কৃষক পাচ্ছে না সহায়ক মূল্য। সরকার কিনছে না ফসল। মাঠের ফসল গোলাতেই নষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে ফড়ে রাজ। গত দু’বছরে এক ধাক্কায় বোরো চাষ কমেছে ১৫ শতাংশ। পাট চাষের অবস্থাও তথৈবচ। আলুতেও মার খেয়েছে কৃষক। সরকার উদাসীন। আর সরকারের কী বক্তব্য? আত্মহত্যার সংখ্যা ২০ পেরোনোর পরেও কার্যত মুখে কুলপ এঁটেছিল সরকার। পরে চাপে পড়ে মুখ খোলেন খাদ্যমন্ত্রী, ‘দেনার দায়ে কোন আত্মহত্যার খবর নেই। যে কজন মারা গেছে তারা কেউ কৃষক নয়’। এর কিছুদিন পরে আবার বলা হয়, যাঁরা আত্মঘাতী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে নাকি একজনই মাত্র কৃষক!

রেগায় পিছনের দিকে এগোচ্ছে রাজ্য...

বিগত বামফ্রন্ট সরকার ১০০দিনের কাজে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জোর দিলেও তৃণমূলী সরকারের আমলে তা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। একদিকে কৃষির সঙ্কট, চাষে উৎসাহ হারাচ্ছে কৃষক, কাজ কমছে খেতমজুরের অন্যদিকে রেগায় কাজ না মেলায় গ্রামাঞ্চলে সঙ্কট কার্যত মহামারীর চেহারা নিয়েছে। ২০১০-’১১-তে এরাজ্যে রেগা প্রকল্পের অন্তর্গত শ্রমদিবস তৈরি হয়েছিল ১৫৫৩.০৮ লক্ষ। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬৯২.৬৪ লক্ষ। অর্থাৎ ৯০ শতাংশের বেশি শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছিল। ২০১১-’১২-তে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯০০ লক্ষ। অথচ রাজ্যে শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছিল ১৪৮৪.৭৪ লক্ষ। ২০১২-’১৩-তে শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছে ১১৮১.৪১লক্ষ। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য জানাচ্ছে ২০১১-’১২-তে মমতা ব্যানার্জির আমলে গ্রামবাসীরা গড়ে মাত্র ২৬.৪৭ দিন কাজ পেয়েছেন।

ট্রিগার হ্যাপি পুলিস...

১৮মাসে ৬বার। মমতা ব্যানার্জির সরকারের পুলিস কোথাও গুলি চালিয়েছে বিক্ষোভরত মানুষের ওপর, কোথাও বা বিসর্জনের শোভাযাত্রায়। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। এর মধ্যে রয়েছেন দু’জন মহিলা এবং পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীও। এরচেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হলো এই যে, ছ’বার এরকম গুলি চালানোর ঘটনা ঘটলেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে একবারও শোনা যায়নি কোন নিন্দাসূচক বিবৃতি।
বর্ধমানের আসানসোলে দুর্গাপুজোর বিসর্জন নিয়ে গন্ডগোল নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ পুলিস গুলি চালায়। মৃত্যু হয় সুজিত ভার্মা নামে এক যুবকের। নদীয়ার বগুলাতে পুলিসের গুলিতে রাজেশ্বরী মল্লিক নামে কংগ্রেস সমর্থক মহিলার মৃত্যু। এরপর বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে মগরাহাটে পুলিসের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল সায়েরা বিবি (৩২) ও পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী রেজিনা খাতুনের। এরপরে দুবরাজপুরের লোবা গ্রামের ঘটনা, বেসরকারী সংস্থার মেশিন আনতে গিয়ে বিক্ষোভরত মানুষের ওপর গুলিবৃষ্টি পুলিসের। নদীয়ার তেহট্টের হাউলিয়ায় আবার খোদ এস ডি পি ও’র নেতৃত্বে গুলি চালোনা, মৃত্যু স্থানীয় বাসিন্দার।

পরিবহন কর্মীদের আত্মহত্যার মিছিল

মমতার সরকারের আঠারো মাসে আত্মঘাতী পরিবহন শ্রমিকের তালিকা দীর্ঘতর হয়েছে।
তৃণমূলী সরকার আসার পরেই ২০১১ সালের ৭ই অক্টোবর পেনশনের অর্থ না পেয়ে সি এস টি সি-র এক পেনশন প্রাপক আত্মঘাতী হন। সেই শুরু। ঐ বছরই বেলগাছিয়া ডিপোতেই মেসের ভিতর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হন পরবিহন কর্মী শুভাশিস হাজরা। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহ‍‌নের ঠিকা শ্রমিক কোচবিহারের মাথাভাঙার মনীষ ব্রহ্ম ২০১২ সালের ৩রা মার্চ নিজের বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন ছাঁটাই নোটিসের খবর পেয়ে। বালুরঘাটের নারায়ণপুরের নিজের বাড়িতে নিগমের পেনশন প্রাপক দীপ্তিরানী কর্মকার পেনশন না পেয়ে আত্মঘাতী হন। নদীয়ার গয়েশপুরে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন সান্ত্বনা চক্রবর্তী। সি টি সি’র বেলগাছিয়া ডিপোর কর্মী গোপাল দে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন দীর্ঘদিন বেতন না পেয়ে, অভাবের যন্ত্রণায়। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিগমের আর এক কর্মী লোকনাথ দে আত্মঘাতী হন। অভাবের তাড়নাতেই চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হয় উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী দুলাল নন্দীর। পেনশনই পাননি। শুধু তিনি নন, একরকম অনাহারেই কাটাতে হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের। ৯হাজার অবসরপ্রাপ্তের পেনশন বন্ধ চার মাস ধরে। পরিবহন শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের ধরলে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে প্রায় ১লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ।

কার্টুন আঁকলে, ‘অপ্রিয়’ প্রশ্ন করলে জেল!...

সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার কিছু সংলাপকে ব্যবহার করে একটি ব্যঙ্গচিত্র। আর এতেই নাকি ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে খুনের চক্রান্ত করা হয়েছে। আর তাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. অম্বিকেশ মহাপাত্রকে মারধর করে পুলিসের হাতে তুলে দিল তৃণমূলীরা, থানায় কাটাতে হল রাত। তাঁর ‘অপরাধ’ তিনি তাঁর আবাসনের ই-মেল আই ডি ব্যবহার করে ঐ ব্যঙ্গচিত্রটি শুধু ‘ফরোয়ার্ড’ করেছিলেন। আবার খাস জঙ্গলমহলে বেলপাহাড়ির যুবক শিলাদিত্য চৌধুরীকে ‘মাসুল’ দিতে হয়েছে তাঁর একটি নিতান্তই নিরীহ প্রশ্নের জন্য। সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা চলাকালীন শিলাদিত্য চৌধুরী চিৎকার করে প্রশ্ন করেছিলেন বাড়তে থাকা সারের দাম নিয়ে। মঞ্চ থেকেই ক্ষিপ্ত মুখ্যমন্ত্রী বলে দিলেন, ‘আমার কাছে খবর আছে মিটিং ডিসটার্ব করার চক্রান্ত করছে কেউ কেউ। এই একজনকে আমি ধরিয়ে দিলাম, ও মাওবাদী’। কলকাতায় টাউন হলে একটি সর্বভারতীয় ইংরাজী চ্যানেলে অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে অপ্রিয় প্রশ্ন করায় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যায়লয়ের মেধাবী ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকেও ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী!

বন্ধ চা বাগিচা, মৃত্যু মিছিল...

বন্ধ চা-বাগান খোলা তো দূর অস্ত, বন্ধ বাগানের শ্রমিকদের প্রকল্পও কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাড়ছে অপুষ্টি। অর্ধাহারে দিন কাটানো এখন বাগিচা শ্রমিকদের রোজনামচা। মাত্র ২৪ মাসেই তৃণমূল জোট সরকারের আমলে ডুয়ার্সের বন্ধ ঢেকলাপাড়া চা বাগিচায় অনাহারের মারা গেছেন ২৬ জন বাগিচা শ্রমিক। বন্ধ দলমোড় বাগানে অপুষ্টি, অনাহারজনিত রোগে মারা গেছেন ২০জন চা শ্রমিক। কিন্তু, কৃষক আত্মহত্যা, ধর্ষণের মত অনাহারে, অপুষ্টিতে চা-শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে না মা-মাটি-মানুষের সরকার। বন্ধ হয়ে গেছে কাঠালগুঁড়ি চা বাগান।
বামফ্রন্ট সরকার থাকার কারণে, নিয়ম করে বাগিচা শ্রমিকরা বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের জন্য প্রাপ্য ভাতা পেতেন। তৃণমূল জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের জুন মাস থেকে বন্ধ হয়ে গেছে সেই ভাতা। ১০০দিনের কাজ বন্ধ। মিলছে না বি পি এল তালিকার জন্য রেশনের প্রাপ্য অন্নপূর্ণা বা অন্ত্যোদয় প্রকল্পের চাল-গম। বন্ধ পানীয় জলের জোগান। বামফ্রন্ট সরকারের আমলের ‘ফাউলাই’ প্রকল্পের ভাতা, ও এম জি কমিটিও এখন ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

দূরবীন নয়, খালি চোখে দেখা সন্ত্রাস...

২০১১ সালের ১৩ই মে, বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর ২৪ ঘন্টাও কাটেনি। গুলি করে নয়, স্রেফ পিটিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হলো সি পি আই(এম) গড়বেতা জোনাল কমিটির সদস্য কমরেড জীতেন নন্দীকে। ফল বেরনোর পর থেকে শপথ নেওয়ার অর্থাৎ ১৩ই মে থেকে ২০শে মে’র মধ্যেই খুন হলেন ৮জন সি পি আই(এম) নেতা,কর্মী,সমর্থক। নির্বিকার মুখ্যমন্ত্রী ব্রিগেডের সভায় ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘কোথায় সন্ত্রাস? দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে’। পরিবর্তনের দু’বছরেই খুন হয়েছেন ৯০ জন বামফ্রন্ট নেতা, কর্মী, সমর্থক। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এখন আবার জেলা জেলায় চলছে প্রকাশ্য হুমকি, আতঙ্করাজ। বিরোধী দলের মিটিং, মিছিল করার অনুমতিও নেই রাজ্যের বিভিন্ন জনপদে। শুধুমাত্র দিল্লির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই দু’দিনে দেড় হাজারের বেশি পার্টি অফিসে সশস্ত্র হামলা, একজনও হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রামে গ্রামে চলছে তোলাবাজি। তোলার টাকা না দিতে পারায় তৃণমূলী অত্যাচারে, অপমানে আত্মঘাতী হয়েছেন ১৩জন। গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত, বিভিন্ন জেলায় ৪২হাজার ৭২৪জন বামপন্থী কর্মী-সমর্থককে হামলা চালিয়ে ঘরছাড়া করা হয়েছে। তৃণমূলী হামলায় জখম হয়ে হাসাপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে ৫৭৪৩জনকে। শুধু সুশান্ত ঘোষ, লক্ষণ শেঠই নয় মাত্র ২৪ মাসেই এই সরকার ও শাসক দলের নির্লজ্জ রাজনৈতিক আক্রোশে ১৭০টিরও বেশি মামলায় ৩৩৬৬ জন পার্টিকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৮ হাজারেরও বেশি পার্টি কর্মী, নেতাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এমনকি বর্ধমানে এক যুব কর্মীর খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল পার্টি নেতাকেই! শিলিগুড়িতে পার্টির জেলা দপ্তর থেকে মিথ্যা মামলায় অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকার সহ ৫২জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

পুলিস হেফাজতে ছাত্রনেতা সুদীপ্তর মৃত্যু

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদে গত ২রা এপ্রিল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি একসঙ্গে আইন অমান্য কর্মসূচী পালন করে কলকাতায় রানী রাসমনি রোডে। এস এফ আই-র রাজ্য কমিটির সদস্য ২৩বছরের তরতাজা সুদীপ্ত গুপ্ত অংশ নিয়েছিলেন সেই কর্মসূচীতে। আইন অমান্যকারীদের গ্রেপ্তার করে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় বাসের মধ্যেই পুলিস লাঠি চালায়, পিটিয়ে বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয় সুদীপ্তকে, তাঁর মাথায় ‌আঘাত লাগার পরেও পুলিস তাঁকে মারে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। রক্তাক্ত গুরুতর আহত সুদীপ্তকে তাঁর সহকর্মীরা এস এস কে এম হাসপাতালে নিয়ে আসার পরেও সুদীপ্তর যথাযথ চিকিৎসা হয়নি। মৃত্যু হয় সুদীপ্তর।
সুদীপ্তর মৃত্যু সারা রাজ্যে তো বটেই সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। পুলিস সুদীপ্তর মৃত্যুকে ‘দুর্ঘটনা’ বলে সাজিয়েছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সুদীপ্তর মৃত্যুকে ‘তুচ্ছ ঘটনা’ বলে অবজ্ঞা করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় পুলিসের এই নির্মমতায় সমাজবদলের স্বপ্ন মাখা এক তরুণের জীবননাশের ঘটনাকে মানুষ মেনে নেননি। বামফ্রন্ট এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করলেও রাজ্য সরকার তা মেনে নেয়নি। সুদীপ্তর বৃদ্ধ পিতা প্রণব গুপ্ত আদালতে গিয়েছেন সি বি আই তদন্তের দাবি নিয়ে। ‘দুর্ঘটনা’-তেই যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তাহলে তদন্তে কীসের এত ভয় সরকারের?

মাত্র ২৪ ঘন্টায় দেড় হাজার পার্টি দপ্তর ভাঙলো তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা

গোধরার ঘটনার পরে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদী যেভাবে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব আউড়ে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছিলেন, অনেকটা সেরকমই পশ্চিমবঙ্গে করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এলাকা বিরোধীমুক্ত করার নৃশংস অভিযান তৃণমূলের। গত ৯ই এপ্রিল দিল্লিতে তিনি এবং অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র আক্রান্ত হয়েছেন বলে প্ররোচনামূলক বিবৃতি দিলেন। ব্যস্‌, তারপরেই পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শুরু হয়ে গেলো তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের তান্ডব। ৯ এবং ১০ই এপ্রিলের মধ্যে রাজ্যের সব প্রান্তে এমন হামলা চললো যে রাজ্যে বামপন্থীদের দেড় হাজার পার্টি অফিস, গণসংগঠনের অফিস ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো বহু পার্টি অফিস। কয়েকটি জায়গায় কংগ্রেসের পার্টি দপ্তরেও হামলা হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় সি পি আই (এম)-র নেতা ও কর্মীদের বাড়িতেও হামলা করা হয়েছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ নেতা প্রাক্তন বিধায়ক হরিপদ বিশ্বাসের বাড়িতেও হামলা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ঘরছাড়া হয়েছেন অনেকে।

চিটফান্ডে সর্বস্বান্ত মানুষ, মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘যা গেছে তা গেছে’

দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থীরা যে আশঙ্কার কথা বলে আসছিলো সেটাই সত্যি হলো। প্রথমে সারদা গোষ্ঠী পরিচালিত মিডিয়াগুলি বন্ধের ঘোষণা, তারপরে সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের অন্তর্ধান। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এরাজ্যের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা দেখলেন নতুন সরকারের দু’বছরের মধ্যে। সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সংযোগ প্রকাশ্যে চলে আসে বিগত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই। বামফ্রন্ট সরকার আর্থিক সংস্থার প্রতারণার হাত থেকে রাজ্যবাসীকে রক্ষা করতে যে বিল পাস করিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছিল তা অনুমোদিত হয়ে আসেনি তৃণমূল কংগ্রেসের হস্তক্ষেপেই। পরবর্তীতে সারদার আমানত সংগ্রহের ব্যবসাতেও সাহায্য করেছেন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদরা। পরিবর্তে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে বিপুল অর্থের জোগান দিয়েছিলো এই সারদা গোষ্ঠীই। সারদা গোষ্ঠীর মিডিয়াগুলি প্রচার করেছে তৃণমূলের হয়ে। তৃণমূল সাংসদ কুনাল ঘোষ মিডিয়াগুলির পরিচালন দায়িত্ব নিয়ে কোটি কোটি টাকার ‘বেতন’ পেয়েছেন। তৃণমূলের সাংসদ নেতা মন্ত্রীদের অর্থের জোগান, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কেনা থেকে শুরু করে অনেক কাজই করে দিয়েছে সারদা মালিক সুদীপ্ত সেন।
আসলে ‘সততার প্রতীক’ কার্যত পরিণত হয়েছিলেন ‘সারদার প্রতীক’-এ। লক্ষ লক্ষ আমানতকারী তাতে বিশ্বাস করে এবং অবাস্তব সুদের প্রতিশ্রুতিতে সারদায় যারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চয় রেখেছিলেন। তাঁরা অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বিপন্ন সারদার এজেন্টরাও। এঁরা সবাই তৃণমূল সরকারের সঙ্গে সারদাকে একাকার হতে দেখে সারদার ওপরে ভরসা রেখেছিলেন। এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘যা গেছে তা গেছে। এবার আমি কড়া আইন করছি।’
সুদীপ্ত সেন ধরা পড়েছেন বটে, কিন্তু সারদার সম্পত্তির ভাগীদাররা এখনো অধরাই। সম্পত্তি উদ্ধার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরানোও তাই এখনো অনিশ্চিত। লক্ষ লক্ষ আমানতকারীর স্বার্থ না দেখে, সুদীপ্ত সেনকে বাঁচাতে এতটাই মরিয়া ও নির্লজ্জ যে রাজ্য সরকার নিজে থেকে কোনো অভিযোগ (এফ আই আর) এখনো পর্যন্ত দায়ের করেনি। ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ার ভয়ে মুখ্যমন্ত্রী কোনোমতেই সি বি আই তদন্তে রাজি নন। আদালতের নির্দেশে বাধ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর পুলিসবাহিনী তদন্তের ফাইল পর্যন্ত দেখাতে রাজি হয়নি কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে। আর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথে বসিয়ে এখন স্বয়ং সুদীপ্ত সেন বলছেন, ‘রাজ্য সরকারের তদন্ত ব্যবস্থাই ভালো, তার ওপরেই আমার আস্থা আছে। সি বি আই দরকার নেই।’ রাজ্যবাসীও কি সেটাই মেনে নেবেন?


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×