somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মোহাম্মদ আলী আকন্দ
আমি ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ১৯৭৭ সালে এস.এস.সি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে এইচ.এস.সি পাশ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে এলএল.বি (সম্মান) এবং ১৯৮৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএল.এম পাশ করি।

চীন ইউরোপ সম্পর্ক: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

১৩ ই আগস্ট, ২০২৩ ভোর ৬:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ৫ আগস্ট জেদ্দায় ইউক্রেনের সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিয়ে আলোচনার জন্য সৌদি আরব ৪০টি দেশের একটা শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে। এই সম্মেলনে আমেরিকা, চীন, ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নাই। রাশিয়াকে ছাড়াই চীন এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়াতে ইউরোপীয় কিছুটা স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলেছে।

এই সম্মেলন শেষ চীন আগের মতোই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তার নিরপেক্ষতার কথা ঘোষণা করেছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যে সম্মেলনে রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নাই অথচ রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই রকম একটা সম্মেলনে, চীনের উপস্থিতির কারণ হচ্ছে, চীন বিশ্ববাসীকে একটা বার্তা দিতে চায় যে সে অন্তত প্রকাশ্যে এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে দাঁড়াবে না। এটি ইউক্রেনের পক্ষে একটি ক্ষুদ্র বিজয় হতে পারে, কিন্তু জিরো-সম গেমের কূটনৈতিক বিশ্বে, রাশিয়ার একটা বড় পরাজয়ের ইঙ্গিত।

চীনের এই কৌশল থেকে এটা কখনই আশা করা যায় না যে চীন সম্পূর্ণরূপে পশ্চিমা অবস্থানে চলে যাবে, তবে এই সম্মেলনে চীনের উপস্থিতি এবং সমর্থন রাশিয়ার জন্য একটি বড় হতাশার কারণ হবে।

চীনারা অর্থনৈতিক কারণে পশ্চিমের সাথে গভীর ভাবে জড়িত এবং একই কারণে ইউক্রেনীয়দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে এবং রাশিয়ার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দিচ্ছে।

তবে চীন প্রকাশ্যে যাই করুক বা বলুক না কেন, রাশিয়ার সাথে অব্যাহত অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা সম্পর্কের কারণে পশ্চিমা মিত্ররা বিভিন্ন দেশের সাথে চীনের সম্পৃক্ততাকে সবসময় সতর্কতার সাথে দেখে।

জেদ্দায় আলোচনায় অংশ নিলেও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক যাতে নষ্ট না হয় তাই চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই আলোচনার একদিন পরই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে ফোন করেন এবং চীনের নিরপেক্ষতা পুনর্ব্যক্ত করেন।

এখানে পাঠকদের জানতে হবে চীনের ব্যবহৃত "নিরপেক্ষ" শব্দটার আসল অর্থ কি। চীন যখন রাশিয়াকে বলবে "চীন নিরপেক্ষ" তখন অর্থ হবে "চীন রাশিয়ার পক্ষে আছে" আর যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলবে, "চীন নিরপেক্ষ" তখন অর্থ হবে "চীন এই যুদ্ধে কোন পক্ষকেই সমর্থন করে না"

জেদ্দা সম্মেলনের পর রাশিয়া এবং চীনের সামরিক বাহিনী আমেরিকার আলাস্কার উপকূলে নৌ টহল সহ যৌথ মহড়া অব্যাহত রেখেছে। শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে পুতিন অক্টোবরে চীন সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

ইউরোপীয় কূটনৈতিকরা মনে করে চীনের এই "নিরপেক্ষতার" কৌশল হচ্ছে যুদ্ধ থামার ব্যাপারে চীনের কোন উৎসাহ নাই। চীনের আশা, যুদ্ধ চলতে থাকলে চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, রাশিয়া বিশ্বমঞ্চে আরো দুর্বল খেলোয়াড় হবে এবং সে এই সুযোগে ইউরোপের সাথে একচেটিয়া ব্যবসা করবে। চীনের এই সব পরিকল্পনার একটাই নেতিবাচক দিক, তাহলো চীন সম্পর্কে অন্যদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা। অর্থাৎ চীন সম্পর্কে অন্য রাষ্ট্রগুলির ইতিবাচক ধারণা ছাড়া চীনের এই আশা পূর্ণ হবে না।

চীনের দাবার চালটা এই রকম যে, চীন চায় ইউরোপের মাটিকে আমেরিকা এবং চীনের রণক্ষেত্র হিসাবে। এই ক্ষেত্রে চীনের লক্ষ্য হল যত বেশি সংখ্যক ইউরোপীয় দেশের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলা। কিন্তু পাল্টা চালের কারণে গত ৪০ বছর ধরে চীন তিলেতিলে অনেক ইউরোপীয় দেশের সাথে যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে ছিল তা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।

রাশিয়ার সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা না করাতে অনেক ইউরোপীয় দেশকে, বিশেষ করে রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে, নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার এই বিবেচনা থেকেই চীনের সাথে ইউরোপের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এখানেই পূর্বে উল্লেখিত চীনের চালটি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে।

চীনের কৌশল হচ্ছে ইউরোপের সাথে তার সম্পর্কের অবস্থান সবসময় অস্পষ্ট করে রাখা। যাতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি আমেরিকার সাথে যুক্ত হয়ে একত্রে সরাসরি চীনের বিপক্ষে অবস্থান না নেয়। অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপের পক্ষে এখনই চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কঠিন। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে চীনের ইচ্ছার বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ ইউরোপকে আরো বেশি আমেরিকার দিকে ঠেলে দিয়েছে। জেদ্দা শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চীন ইউক্রেনের সাথে পুনরায় যুক্ত হয়ে ইউরোপকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছে।

চীনের যে মূল পরিকল্পনা ছিল, অর্থাৎ ইউরোপের মাটিতে আমেরিকার সাথে মোকাবেলা, এটা যখন ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ব্যর্থ হয়ে গেছে, তখন চীন চেষ্টা করছে ক্ষতি মেরামতের। তাই জেদ্দা সম্মেলনের মত সম্মেলনগুলোতে উপস্থিত হয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়কে অশ্বত্ব করার চেষ্টা করছে যে তারা আসলে শান্তির পক্ষে।

চীনের প্রতি অবিশ্বাস সত্ত্বেও ইউরোপের সাথে বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। অর্থাৎ ইউরোপ চীনে যে পরিমাণ রফতানি করে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে। এই যুদ্ধের মধ্যেও ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সালে চীন থেকে ইউরোপে পণ্য আমদানি আরো বেড়েছে।

আগে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলি চীনকে তাদের ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতো, নিরাপত্তা হুমকি মনে করতো না। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে তারা চীনকে একটি আধিপত্যবাদী শক্তি হিসাবে দেখছে। চীন তার সম্পর্কে ইউরোপিয়ানদের মনোভাব বুঝতে পেরেছে তাই ইউরোপিয়ানদের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার জন্য জেদ্দা সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছে।

ইউরোপের কাছে চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ইউরোপ অনেকগুলি ল্যান্স দিয়ে চীনকে দেখছে। তার মধ্যে মাত্র একটা হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। আরো আছে মানবাধিকারের প্রতি চীনের দৃষ্টিভঙ্গি, তাইওয়ানের প্রতি হুমকিমূলক অবস্থান, এবং চীনের সরকার সমর্থিত কর্পোরেট গুপ্তচরবৃত্তি।

দুইটি বিপরীত বাস্তবতা ইউরোপের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দিকে চীনের সাথে ইউরোপের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজন। আবার চীনের সাথে ব্যবসা করতে গেলে চীনের আচরণের কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। দুইটি বিপরীত বাস্তবতাকে সমন্বয় করার জন্য ইউরোপ একটা কৌশল গ্রহণ করেছে। একদিকে তারা চীনের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য অব্যাহত রাখবে, আরেক দিকে আমেরিকার সাথে নিরাপত্তা সম্পর্ক আরো জোরদার করবে।

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইউরোপিয়ানদের চোখ খুলে গেছে। তারা একসময় রাশিয়াকে চীনের মত অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতো; নিরাপত্তা হুমকি মনে করতো না। তারা জ্বালানির জন্য সম্পূর্ণ ভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল। রাশিয়া ইউরোপের উপর এই সুযোগ গ্রহণ করেছে। তাই ইউরোপ এখন কোন ব্যাপারেই একক ভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল হতে চায় না। চীনের উপর নির্ভরশীল হলে চীন এই সুযোগ আরো নির্মম ভাবে ব্যবহার করবে।

শেষ কথা:
এখন বাস্তবতার আলোকে, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির লক্ষ্য হল, নিরাপত্তার স্বার্থে আমেরিকার সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখা এবং চীনের উপর খুব বেশি নির্ভর না করে বৈশ্বিক ইস্যুতে চীনের সাথে কাজ করা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০২৩ ভোর ৬:২৬
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আদর্শের রাজনীতি না কোটি টাকার হাতছানি...

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:২৫



১. আমি অনেক আগে ব্লগে লিখেছিলাম, বাংলাদেশে ছোট দলগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত। উন্নত দেশের মত ২/৩ টিতে থাকাই উত্তম। কারণ, ছোট দলের নেতাদের টকশো-তে গলাবাজি করা ছাড়া আর কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে উড়ে গেল মাদ্রাসার দেয়াল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৯



ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছেন।

বিস্ফোরণে মাদ্রাসার একতলা ভবনের পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষের দেয়াল উড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তেল আর জল কখনো এক হয় না......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩৫



জুলাই ছিলো সাধারণ মানুষের আন্দোলন, কোন লিডার আমারে ডাইকা ২৪'এর আন্দোলনে নেয় নাই। কোন নেতার ডাকে আমি রাস্তায় যাই নাই। অথচ আন্দোলনের পর শুনি আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড নাকি মাহফুজ। জুলাই বিপ্লবের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্ল্যাং রেভলিউশন: ১৮+ সতর্কবার্তা ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৩০


সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকে একটা ভাইরাল ভিডিও চোখে পড়লো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সদস্য সালাউদ্দিন আম্মার গণজাগরণ মঞ্চ ৩.০ তে উপস্থিত হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন: দেখতে পাইলে বাকশাল, শা*উয়া মা*উয়া ছিড়া ফেল/... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতাঃ হে বলবান

লিখেছেন ইসিয়াক, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪০

কে আছিস বলবান!
হ্ আগুয়ান।
দে সাড়া দে ত্বরা।
ধরতে হবে হাল,বাইতে হবে তরী, অবস্থা বেসামাল।

জ্বলছে দেখ প্রাণের স্বদেশ
বিপর্যস্ত আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
মানবিকতা, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির বাতিঘর।
সর্বত্র আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×