মে মাসের ২৯ তারিখে চীন-আরব রাষ্ট্র সহযোগিতা ফোরাম বেইজিংয়ে কৌশলগত রাজনৈতিক সংলাপে মিলিত হয়েছিল। চায়না-আরব স্টেটস কো-অপারেশন ফোরাম (CASCF) হল চীন এবং আরব লীগের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক সংলাপ উদ্যোগ যা ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি চীন এবং আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে প্রাথমিক বহুপাক্ষিক সমন্বয় ব্যবস্থা।
চায়না-আরব স্টেটস কো-অপারেশন ফোরাম (CASCF) চীনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করেছে। এই ফোরাম যদি সঠিকভাবে অগ্রসর হতে পারে তাহলে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য ইতিবাচক চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিবে। এই চ্যালেঞ্জের পিছনের কারণগুলির বিশদ বিশ্লেষণ এখানে রয়েছে:
১. অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বাণিজ্য:
(ক) চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব।
চীন মূলত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর অধীনে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে আরব রাষ্ট্রগুলির সাথে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি করেছে। চীনা কোম্পানিগুলি বন্দর, রেলপথ এবং জ্বালানি খাত সহ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অসংখ্য অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
(খ) বাণিজ্যিক সম্পর্ক।
চীন ও আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বাণিজ্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন এখন এই অঞ্চলের অনেকগুলি দেশের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য অংশীদার। চীন এই দেশগুলিতে ইলেকট্রনিক্স, যন্ত্রপাতি এবং ভোগ্যপণ্য রপ্তানি করার বিনিময়ে প্রচুর পরিমাণে তেল ও গ্যাস আমদানি করে। অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতা আরব দেশগুলির উপর চীনের প্রভাব বৃদ্ধি করেছে।
২. ভূ-রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ:
(ক) কৌশলগত অংশীদারিত্ব
মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি শুধু অর্থনীতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। চীনের উপস্থিতি রাজনৈতিক এবং কৌশলগত মাত্রাও অন্তর্ভুক্ত করে। আরব রাষ্ট্রগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে চীন ঐতিহ্যগতভাবে আমেরিকার প্রভাবাধীন আরব অঞ্চলে কিছু কৌশলগত সুবিধা লাভ করবে। এর ফলে আঞ্চলিক জোট এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন হতে পারে।
(খ) কূটনৈতিক তৎপরতা
CASCF-এর মাধ্যমে চীন আরব অঞ্চলে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। এই তৎপরতার মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যস্থতা করা এবং স্থিতিশীলতার জন্য চেষ্টা করা। এই কূটনৈতিক তৎপরতা চীনের সফট পাওয়ার বৃদ্ধি করার এক ধরণের প্রচেষ্টা। চীনের এই প্রচেষ্টা পশ্চিমা কূটনৈতিক উদ্যোগের একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে।
৩. সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা:
নিরাপত্তা সহযোগিতা:
চীন কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের সাথে সামরিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র বিক্রি, যৌথ সামরিক মহড়া এবং নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এই ধরনের সহযোগিতা এই অঞ্চলে পশ্চিমা প্রতিরক্ষা ঠিকাদার এবং সামরিক জোটের একচেটিয়া আধিপত্য হ্রাস করতে পারে
৪. আমেরিকা এবং পশ্চিমা মিত্রদের জন্য চ্যালেঞ্জ সমূহ:
(ক) পশ্চিমা প্রভাব কমে যাওয়া।
ক্রমবর্ধমান চীন-আরব সহযোগিতা মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও পশ্চিমা প্রভাব কমে যেতে পারে। আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের অংশীদারিত্বকে বহুমুখী করার ফলে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ভাবে পশ্চিমের উপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে যেতে পারে।
(খ) আকর্ষণীয় স্বার্থ।
অন্য দেশের ব্যাপারে চীনের অ-হস্তক্ষেপ নীতি এবং শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে ফোকাস আরব বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কাছে আকর্ষণীয় একটা বিষয়। কারণ এতে তারা জবাবদিহি হীন যেমন ইচ্ছা তেমনি তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন বহাল রাখতে পারবে। এটি পশ্চিমা পদ্ধতির সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী। কারণ পশ্চিমারা যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা সাহায্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক সংস্কার সম্পর্কিত শর্ত অন্তর্ভুক্ত করে। পদ্ধতির এই ভিন্নতা পশ্চিমা কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে।
(গ) জ্বালানি নিরাপত্তা।
মধ্যপ্রাচ্যে তেল ও গ্যাস রফতানিকারক দেশগুলির সাথে সরাসরি সম্পর্কের মাধ্যমে চীন তার জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করতে পারবে। এরফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজার এবং কৌশলগত অবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলি জ্বালানি নিরাপত্তার এই অবস্থাটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখতে পারে। বিপুল জ্বালানি চাহিদার কারণে চীন তেলের বাজারের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখে।
৫. আমেরিকা এই চ্যালেঞ্জগুলি কি ভাবে প্রশমিত করবে?
(ক) জোট শক্তিশালী করণ।
আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের জোট এবং অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। এই লক্ষ্যে শুধু অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তাই যথেষ্ট নয় বরং এই অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্য জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
(খ) অর্থনৈতিক ব্যস্ততা।
পশ্চিমা দেশগুলির আরব রাষ্ট্রগুলির সাথে তাদের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা উচিত। প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য চুক্তি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। আকর্ষণীয় পশ্চিমা বিনিয়োগ চীনের প্রস্তাবের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। এই সব উদ্যোগের মধ্যে প্রযুক্তি স্থানান্তর, শিক্ষা বিনিময় এবং অবকাঠামো উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
(গ) কৌশলগত কূটনীতি।
মধ্যপ্রাচ্যের বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি ব্যাপক এবং কৌশলগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সংঘাতের মধ্যস্থতা, রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য সমর্থন এবং মানবিক সহায়তা।
(ঘ) নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানো।
আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের চীনের নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতাগুলিকে আমলে নিয়ে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলি খুঁজে বের করে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এতে সন্ত্রাস দমন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
সারসংক্ষেপ:
চীন-আরব রাষ্ট্র সহযোগিতা ফোরামকে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য ইতিবাচক চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা উচিত। এই চ্যালেঞ্জগুলি ঐতিহ্যগত জোটগুলিকে শক্তিশালী করে, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে, কৌশলগত কূটনীতি অবলম্বন করে এবং বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মাধ্যমে মোকাবেলা করা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতার ভারসাম্য বজায় রাখাই মূল বিষয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০২৪ রাত ২:৩৩