সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (৮)
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: শুভঙ্করের ফাঁকি: (১)
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে মোট ১৮টি ধারায় মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এই মূলনীতিগুলিতে এত অসঙ্গতি ও ফাঁকি বিদ্যমান যে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবে না। আমি বিদগ্ধ পাঠকদের শুধু মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য খুব সংক্ষেপে আলোকপাত করবো।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;
[Pledging that the high ideals of nationalism, socialism, democracy and secularism, which inspired our heroic people to dedicate themselves to, and our brave martyrs to sacrifice their lives in, the national liberation struggle, shall be the fundamental principles of the Constitution;]
৮ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।
[The principles of nationalism, socialism, democracy and secularism, together with the principles derived from those as set out in this Part, shall constitute the fundamental principles of state policy.]
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা এইগুলি শুনতে এবং বলতে বেশ আকর্ষণীয় হলেও এই গুলি শুধু শব্দ নয় এইগুলি একেকটা আদর্শিক মতবাদ। এই মতাদর্শগুলি কখনো কখনো পরস্পর বিরোধী এবং সাংঘর্ষিক। সংবিধান প্রণেতারা হয় এই আদর্শগুলির তাৎপর্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা নাগরিকদেরকে ফাঁকি বা বিভ্রান্ত করার জন্য জেনে বুঝে এইসব পরস্পর বিরোধী মতবাদগুলো একটি সংবিধানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
পরস্পরবিরোধী এই চারটা মতবাদ পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার ভাবে প্রতীয়মান হবে যে এই চারটা মতবাদ এক সাথে একই সংবিধানের মূল নীতি হতে পারে না। এই আলোচনার উদ্দেশ্য কোন একটি মতবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়া নয়, বরং মতবাদগুলির মধ্যে বৈপরীত্য আলোচনা করা।
জাতীয়তাবাদ (Nationalism):
জাতীয়তাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণা, যার পক্ষে এবং বিপক্ষে উভয় ধরনের যুক্তিই রয়েছে। এটি সমাজে ঐক্য আনতে এবং সমাজকে শক্তিশালী করতে পারে, তবে এটা সামাজিক বিভেদ এবং বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতাও সৃষ্টি করতে পারে।
জাতীয়তাবাদ (Nationalism) বলতে সাধারণত এমন একটি মতবাদ বা আদর্শকে বোঝায় যা একটি নির্দিষ্ট জাতি বা জাতিগোষ্ঠীর প্রতি আবেগ, সম্মান, এবং সমর্থনকে জোরালো ভাবে প্রকাশ করে। জাতীয়তাবাদে নিজের জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা, এবং মূল্যবোধকে রক্ষা এবং প্রচার করার উপর জোর দেয়া হয়। এটি রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক সমাবেশ, এবং জাতিগত পরিচয় সংরক্ষণের একটি মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। এই মতবাদ অনুসরণ করার ফলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বৃদ্ধি পেতে পারে। জাতীয়তাবাদ জাতির প্রতি মানুষের আনুগত্য এবং দায়িত্ববোধকে শক্তিশালী করে, যা অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক সংহতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
কিন্তু এই জাতীয়তাবাদ কোন রাষ্ট্রের মূলনীতি হতে পারে না এই কারণে যে একটি রাষ্ট্র অনেকগুলি জাতি নিয়ে গঠিত হতে পারে। জাতি কাকে বলে তা আমরা আগের পর্বগুলোতে আলোচনা করেছি। আমরা এটাও আলোচনা করেছি যে সংবিধানে অন্যায় ভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে বাঙালি জাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ প্রায় ৫০ টি ভিন্ন ভিন্ন জাতি বসবাস করে। সংবিধানে জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতিকে বুঝানো হয়েছে এবং অন্য জাতিগুলিকে অস্বীকার করা হয়েছে।
ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদের ফলে জাতিগত বিভেদ এবং সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত অন্য জাতি, সংস্কৃতি, এবং সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য এবং ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। এটি অন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ সামাজিক সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে শোভিনিজমের (Chauvinism) জন্ম হয়েছে। এই মতবাদের কারণে অন্য জাতির মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আর বাঙালি জাতি নিজেদের "বিশেষ" মনে করে অন্যদের উপর আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করতে পারে।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৮:৩২