সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১১)
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: শুভঙ্করের ফাঁকি: (৪)
পুনরাবৃত্তি: সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে মোট ১৮টি ধারায় মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এই মূলনীতিগুলিতে এত অসঙ্গতি ও ফাঁকি বিদ্যমান যে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবে না। আমি বিদগ্ধ পাঠকদের শুধু মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য খুব সংক্ষেপে আলোকপাত করবো।
"জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে"
ধর্মনিরপেক্ষতা (secularism):
ধর্মনিরপেক্ষতা একটি রাজনৈতিক ও দার্শনিক নীতি। এই নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্র ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত না হয়ে বরং সংবিধান অনুসারে পরিচালিত হবে। একসময় পোপ বা রাজারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে পরিচয় দিত এবং তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি এই পরিচয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতো। তারা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পায় বলে দাবি করতো। সহজ কথায় ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদ দ্বারা "ঈশ্বরের প্রতিনিধি" এই ধারণাটা পরিবর্তন করে জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি গ্রহণ করা হয়। এখন যেহেতু কোন শাসক নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবি করছে না এবং সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে , এই অর্থে সংবিধানে লেখা থাকুক বা না থাকুক বিশ্বের সব রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ।
"ঈশ্বরের প্রতিনিধিরা" রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর অনেক রাষ্ট্রে আবার ধর্ম ফিরে আসে অন্য ফর্মে। যেমন কোন কোন রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। তখন ধর্ম নিরপেক্ষতার মতবাদকে আরো একটু বিস্তৃত আকারে প্রয়োগ করা শুরু হয়। তখন বলা হয় রাষ্ট্রকে ধর্মীয় বিষয় থেকে আলাদা রাখতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিবে না এবং সমস্ত ধর্মের প্রতি সমানভাবে আচরণ করবে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল ধারণা, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে বিশেষ কোন ধর্মের প্রভাব থাকবে না, এবং নাগরিকদের ধর্ম পালন করার বা না করার স্বাধীনতা থাকবে।
যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি গণতান্ত্রিক মতাদর্শের অন্তর্গত তাই আলাদা ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটির উল্লেখ করার প্রয়োজন হয় না। এই কারণে বিশ্বের প্রায় সব সংবিধানে আলাদা ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা অনুপস্থিত। বাংলাদেশ সহ ৪টি দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশগুলি হচ্ছে ইন্ডিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক ও বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও ২ক ধারায় বলা হয়েছে, "প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন"
এই ধারায় চালাকি করে দুইটি অংশ রাখা হয়েছে। প্রথম অংশে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে অন্য ধর্মের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে, যা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অন্য অংশে অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে এই কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র কর্তৃক কোন বিশেষ ধর্মের বিশেষ মর্যাদা প্রদান, আর ধর্ম পালন এক বিষয় নয়।
ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদের মূল কথা "রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিবে না এবং সমস্ত ধর্মের প্রতি সমানভাবে আচরণ করবে" -- এই ধারণা থেকে সরে এসেছে।
সারসংক্ষেপে বলা যায় যে সংবিধানের প্রস্তাবনা, ২ক ধারা ও ৮ ধারা পরস্পর বিরোধী এবং শুভঙ্করের ফাঁকি।
আমরা পরে আরো দেখবো যে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদগুলো পরস্পর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও কেন ও কি উদ্দেশ্য এই পরস্পর বিরোধী মতবাদগুলিকে একত্রে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-১৫