সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১৭)
সংসদ: রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট
রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট বলতে এমন একটি সংসদ বা পার্লামেন্টকে বোঝায় যা কার্যত নির্বাহী ক্ষমতার অধীনস্থ এবং আইন প্রণয়নের ক্ষমতা বা স্বাধীনতা খুব সীমিত থাকে। এই ধরনের পার্লামেন্ট সাধারণত নির্বাহী শাখার সিদ্ধান্তগুলোকে বিনা বিতর্কে অনুমোদন করে থাকে, এবং এটি কার্যত শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে।
রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকে না, কারণ এই ধরনের পার্লামেন্ট শুধুমাত্র নির্বাহী শাখার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে।
২. সরকারের কার্যকলাপের ওপর কোনও প্রকৃত নজরদারি বা জবাবদিহিতা থাকে না।
৩. বিরোধী দলের কার্যক্রম সাধারণত প্রভাবহীন, এবং তারা পার্লামেন্টে কোন বাস্তব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।
৪. রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট সাধারণত গণতান্ত্রিক নীতি ও প্রক্রিয়াগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয় না।
রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টের কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা বেড়েছে, সরকারের জবাবদিহিতা নাই বললেই চলে, এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকদের কণ্ঠস্বর মোটেই প্রতিফলিত হয় না। ফলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো একজন ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
আগের আলোচনায় আমরা যেমন দেখেছি যে সংবিধানে ১৬৩ বার রাষ্ট্রপতির নাম ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতির কোন ক্ষমতা নাই, এবার আমরা দেখবো ২৬৯ বার সংসদ ও সংসদ সদস্য শব্দগুলি ব্যবহার করা হলেও একটা মাত্র বিধানের মাধ্যমে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের সব ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে।
সংবিধানে ২৬৯ বার সংসদ ও সংসদ সদস্য শব্দগুলি ব্যবহার থেকেই বুঝা যাচ্ছে সংসদের উপর অনেক কর্তব্য, দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। সংবিধান অনুসারে সংসদের মূল কাজ হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা (ধারা ৬৫), রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা (ধারা ৪৮), রাষ্ট্রপতির অভিশংসন (ধারা ৫২), অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির অপসারণ (ধারা ৫৩), সংসদের নিকট মন্ত্রীসভার দায়বদ্ধতা (ধারা ৫৫), সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন ব্যক্তি হবেন প্রধানমন্ত্রী (ধারা ৫৬), যুদ্ধ ঘোষণা (ধারা ৬৩), সংসদের স্থায়ী কমিটিসমূহ কোন মন্ত্রণালয়ের কাজ বা প্রশাসন সম্বন্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে পারবে (ধারা ৭৬), কর আরোপ বা সংগ্রহ করা (ধারা ৮৩), বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি অর্থাৎ বাজেট পাশ ইত্যাদি (ধারা ৮৭, ৮৯, ৯০, ৯১, ৯২), সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের প্রস্তাব (ধারা ৯৬), সংসদে মহা হিসাব-নিরীক্ষকের রিপোর্ট উপস্থাপন করা (ধারা ১৩২), সরকারী কর্ম কমিশন বার্ষিক রিপোর্ট উপস্থাপন করা (ধারা ১৪১), আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে উপস্থাপন করা (ধারা ১৪৫ক) ইত্যাদি।
রাষ্ট্রপতিকে একদিকে ক্ষমতা প্রদান করে যেমন আরেক দিকে কেড়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, ঠিক তেমনি সংসদকে অনেক ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব প্রদান করে মাত্র একটি বিধানের দ্বারা আবার সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পরোক্ষ ভাবে প্রধানমন্ত্রী কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সরাসরি কেড়ে নেয়া হয়েছে কিন্তু সংসদের ক্ষমতা পরোক্ষ ভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে। কারণ সংসদের ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নাম কোথাও উল্লেখ করা হয় নাই। সংসদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার এই কুখ্যাত ধারাটি হচ্ছে ৭০ নং ধারা।
৭০ ধারায় বলা হয়েছে, "কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।"
সহজ কথায় ৭০ ধারার মূল কথা হচ্ছে একজন দলীয় সংসদ সদস্য নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। এই ছোট্ট কথাটি প্রধানমন্ত্রীকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে তুলেছে এবং সংসদকে একটি রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টে পরিণত করেছে।
সংসদ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি ৫৬ ধারা অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। অর্থাৎ সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি। আবার সংসদকে পরিচালনা করেন স্পিকার। এই স্পিকার নির্বাচন করেন সংসদ সদস্যগণ। স্বাভাবিক ভাবেই সংসদ নেতা তার পছন্দের একজন সদস্যের নাম স্পিকার হিসাবে প্রস্তাব করেন। সদস্যরা ভোট দিয়ে স্পিকার নির্বাচন করার সময় ৭০ ধারা খড়গের মত মাথার উপর চলে আসে। অর্থাৎ সংসদ নেতা যার নাম স্পিকার হিসাবে প্রস্তাব করেছেন দলীয় সদস্যরা তাকে ভোট দিতে বাধ্য। এই ভাবে সংসদ নেতার পছন্দ অনুসারে তারই অনুগত, বাধ্য এবং ব্যক্তিত্বহীন একজন ব্যক্তি স্পিকার হিসাবে নির্বাচিত হয়ে সংসদ পরিচালনা করেন। কার্যত সংসদ নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী নির্দেশে স্পিকার সংসদ পরিচালনা করেন। কারণ স্পিকার ভাল ভাবেই জানেন যে সংসদ নেতার ইচ্ছায় তিনি এই পদ লাভ করেছেন। সংসদ নেতা তারপর বিরাগভাজন হলে তার এই পদ চলে যাবে। তাই উপরে বর্ণিত সংসদের সব কাজ ও ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ও নির্দেশে তার পছন্দের স্পিকার দ্বারা পরিচালিত হয়। ৭০ ধারার বিধান অনুসারে সংসদ সদস্যদের কাজ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় বা নির্দেশে যে বিল, প্রস্তাব, ইত্যাদি সংসদে উত্থাপিত হবে সেগুলির পক্ষে ভোট দেয়া।
এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে জাতীয় সংসদ একটি রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট কারণ এটা কার্যত নির্বাহী ক্ষমতার অধীনস্থ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইচ্ছায় পরিচালিত হয় এবং এই সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা বা স্বাধীনতা খুব সীমিত বা নাই বললেই চলে। এই সংসদ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তগুলোকে বিনা বিতর্কে অনুমোদন করে থাকে, এবং এটি কার্যত শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের কারণে এই সংসদ সরকারের কার্যকলাপের ওপর কোনও প্রকৃত নজরদারি বা জবাবদিহিতা আদায় করতে পারে না। ৭০ ধারার কারণে বিরোধী দলের কার্যক্রম সংসদের উপর কোন প্রভাব রাখতে পারে না এবং তারা পার্লামেন্টে কোন বাস্তব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।
৭০ ধারার কারণে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা বেড়েছে, সরকারের জবাবদিহিতা নাই বললেই চলে, এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকদের কণ্ঠস্বর মোটেই প্রতিফলিত হয় না। ফলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো একজন ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-২১