১
নিস্তব্ধ দুপুরের রঙচটা রোদের ফ্যাকাসে আলো যখন কালো জানালার ফাঁক দিয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে ধীরগতিতে ছুঁয়ে দিলো ম্রিয়মাণ টেবিলের ঐ মৃত লেখার-খাতাটি, মৃদু এক চাপা দীর্ঘশ্বাসে নিজের অজান্তেই পেনসিলটাকে ছেড়ে দিয়েছিলো অন্যমনস্ক ছেলেটি। খসখসে কাগজ আর গ্রাফাইটের বিন্দু-বিন্দু মুক্ত-অশ্রুর মাঝে আজ অচেতন মনের সঞ্চালন। ঝিম্ঝিম্ মস্তিষ্কের অনুরণনে ক্লান্ত দৃশ্যপট। অসচেতন চেতন মন। নিঃসাড় দ্বাররক্ষী। ফলশ্রুতিতে সঙ্গুপ্ত নিরাকার নির্জ্ঞাণ মন আজ উন্মুক্ত বিচিত্র নির্যাসে সিক্ত করছে এক ব্যতিব্যস্ত পেনসিল। ওটাই লিখবে আজ চেপে রাখা আর্তনাদ। ওটাই শোনাবে জান্তব সহজপ্রকৃতির আস্ফালন। কিলবিলে সব অনিয়তাকার অনুভূতি আজ হেসেখেলে বেড়াবে মুক্ত কাগজের ওপর। সচেতন সজ্ঞানের চোরা চোখ আজ নিষ্প্রভ। নীতিচেতনা আজ নির্বিবেক। নৈতিকতাবোধ আজ উদ্বায়ী।
অতঃপর অজ্ঞাত সময় অতিবাহিত এবং অচেনা হস্তলিপির প্রস্ফুটিত মতবাদ পঠনে সচেতন মনের অতর্কিত আক্রোশ। অনুশোচিত দ্বাররক্ষীর লজ্জিত অধোবদন। হতভম্ব চেতন মন। আত্মপ্রকৃতির বোকা হাসি।
পরিশেষে বায়ুর উপস্থিতিতে বারুদের ঘর্ষণে অগ্নিশলাকার প্রজ্বলন এবং গ্রাফাইট, কাগজ ও অজানা কিছুর সমন্বয়ে নিঃসৃত অচেতন অনুভূতিগুলোর পরিত্রাণ। এক অতীন্দ্রিয় ভ্রমণের পরিসমাপ্তি।
২
Surrealism, pure psychic automatism by which it is intended to express, either verbally or in writing, the true function of thought. Thought dictated in the absence of all control exerted by reason, and outside all aesthetic or moral preoccupations – Andre Breton
৩
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্যারিসের এক চিত্র প্রদর্শনীতে কিছু ঝুলন্ত ছবি দেখে শিল্প সমালোচকরা যখন ওগুলোর নাম দিলেন ‘লে ফভস’ বা বুনো জন্তুর দল, সেই থেকেই বোধহয় শুরু। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপ্ত চিত্ররীতিগুলোকে যেন একপাল জন্তুর মতই ভেঙেচুরে দিয়েছিলো আঁরি মাতিসের দলবল আর এই ফভিজম। গঁগা-র রঙের তীব্রতা, ইসলামী বিমূর্ত চিত্রকলা, ভ্যান গঘ বা যেটাই ফভ্দের অনুপ্রেরণা হোক না কেন, একরকম এলোপাতাড়ি তুলকালাম শোরগোল তুলে তারা দৃশ্যপটে ঢুকে পড়েছিলো। ঢুকে পড়েছিলো কোন রকম ইশতেহার ছাড়াই, কোন রকম লিখিত নীতিমালা ছাড়াই। কোন রকম নিয়ম ছাড়াই।
অন্যদিকে, ক্যামেরা ও আলোকচিত্রগ্রহণ প্রযুক্তি যখন বস্তুর অবিকল প্রতিচিত্রণের দায় থেকে শিল্পকলাকে মুক্তি দিচ্ছিলো, শিল্পী ধীরে ধীরে দেখতে চাইলেন অন্তর্গত অনুভূতি, বুঝতে চাইলেন মনোবিশ্লেষণ। ইমপ্রেশনিজমের বিরুদ্ধাচরণ করে মানবপ্রকৃতি এতদিনে শুনতে চাইলো মানবাত্মার নীরব আর্তনাদ! অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে দেখতে চাইলো জগত। কর্কশ, বলীয়ান্, মারমুখো চিত্রকলা। নাটকীয় রঙতুলির আঁচড় বহন করতে শিখলো প্রভূত আবেগভার। বিকৃত নকশা, তীব্র রঙ, বিপর্যস্ত প্রকাশশৈলী। হ্যাঁ, এক্স্প্রেশনিজম! প্রকাশপন্থী দল। শারীরিক বাস্তবতা থেকে আত্মিক অভিজ্ঞতা অধিকতর শ্রেয় – এটা বুঝতে শেখো নির্বোধ মানব! প্রায় একই সাথে গলা মেলালো আরও একটি দল। চিৎকার করে বললো, ফেলে দাও বাস্তবতা! ধরো বস্তুর আত্মাকে। বস্তুর প্রতিকল্পের দাসত্ব তুমি কেন করবে? প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে যতগুলো শিল্প আন্দোলন হয়েছিলো, তার ভেতর অনন্য ছিলো এই জ্যামিতিকবাদ। কিউবিজম। আধুনিক মানুষের গতিশীল জটিলতাবোধ ধারণের চেষ্টা। বস্তুস্বভাবের সাথে শিল্পীর কল্পনাস্বভাবের যুক্তকরণ। পথিকৃৎ ছিলেন সেই পিকাসো আর তার ‘এ্যাভিগ্নন-এর কুমারীরা’। তবে যেই ফভিজমের প্রতিবাদী, এলোমেলো আচরণ সূত্রপাত ঘটিয়েছিলো বস্তু ও মানবাত্মার অনুসন্ধান, কিউবিজম ক্রমান্বয়ে বিরুদ্ধাচরণ করে ফেললো তার সাথে। শৃঙ্খলা, ধ্রুপদী মনোভাবপুষ্ট কিউবিষ্টরা যেন হয়ে উঠতে থাকলেন এক একজন গণিতবিদ! জীবনের উপর বিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিলেন বুঝি তারা!
প্রথম মহাযুদ্ধ। হ্যাঁ, বিশ্বাস ভেঙে গেলো! ধোঁয়া। বারুদ। লাশের গন্ধ। খুনী মানুষ। পুড়ে যাওয়া মূল্যবোধ।
এমতাবস্থায় রুমানিয়ান এক কবি বলে উঠলেন, ‘শিল্পকলা ঘুমিয়ে পড়েছে। শিল্পকলা – তোতাপাখির বুলি। আজ ওর জায়গা নিয়ে নিলো ডাডা। শিল্পের অস্ত্রোপচার আজ অতি দরকারী।’ এই কবির নাম ছিলো ত্রিস্তা জারা। অন্যদিকে হুগো বল্ নামক রোগা-লম্বা এক সুইস কবি-দার্শনিক বলে উঠলেন, ‘ডাডার কোন মানে নেই, যেমন মানে নেই প্রকৃতির।’ প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বের সব শিল্প আন্দোলনের লাশের উপর ডাডা জন্ম নিলো এভাবে। জোহানেস বাডের বললেন, ‘ডাডাবাদী হচ্ছে সেই, যে জীবনকে ভালবাসে। ভালোবাসে তার অসংখ্য রূপে। ডাডাবাদী সেই যে বলে, জীবন শুধু এখানে নেই, আছে ওখানেও, ওখানেও, ওখানেও (ডা, ডা, ডা)।’ জীবন আবদ্ধ পথ নয়। জীবনকে যারা অচেনা রাস্তায় ভালোবাসে, যারা প্রচলিত আইন-কানুন তুচ্ছ-জ্ঞান করে, তারাই ডাডাবাদী। আবার, এটা এমনই মুক্ত, যে প্রকৃত ডাডাবাদীরাও ডাডা-র বিরুদ্ধে। আহ্! মুক্ত, নিয়মবহির্ভূত! মনে পড়ছে ফভিজম! বুনো জন্তুর মতন ভেঙেচুরে ছারখার করে দেয়া সেই আন্দোলনের মতন ডাডাবাদীদেরও অন্যতম লক্ষ্য দাঁড়ালো শিল্পের ধ্বংসসাধন। কবিতা দিয়ে কবিতা ধ্বংস। চিত্রকলা দিয়ে চিত্রকলা খুন। বিস্ময় কোথায় আজ শিল্পে? বিস্ময় নিয়ে আসতে হবে। অবাক হতে হবে। ডা-ডা-ডা – শিশুর এই আধোবোল কী ভয়ংকর আশ্চর্যের!
Dada was, a way of discarding a certain mental attitude and ensuring that we are not influenced, either by our immediate environment or by the past of ridding ourselves of clichés, of freeing ourselves – Duchamp
মুক্ত হবার তৃষ্ণা। প্রভাবিত না হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। ব্যাপারগুলো হঠাৎ করে হয়নি। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে প্রবাহিত বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদগুলোর স্রোতধারা ছিলো এর অন্যতম প্রেষণা।
জ্ঞান পচিয়ে দেয় মানবপ্রকৃতি।
আমি জানি ইতোমধ্যে আমাকে কিছুটা পঁচিয়ে দিয়েছে জ্ঞান। পঁচে গন্ধ বের হওয়ার আগেই শিড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়েছি আর সারিয়ে নিচ্ছি আমার ক্ষত। - কবি ইমরান মাঝি
যাই হোক। প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে গেলাম! ডা ডা ডা! বেশীদূর যাইনি...
১৯২২ থেকে ১৯২৪। ডাডা ভেঙে গেলো।
কেন?
হুম।
সর্বনাস্তিকতা? ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তি? নৈরাশ্যময়তা? এগুলো কি অযৌক্তিক ঠেকছিলো খুব? হয়তো। একমাত্র টিকে রইলো বিদ্রোহী মনোভাব। আর? আর কিউবিজমের কড়া বিধিনিষেধের প্রতিবাদ এবং আধুনিক শিল্পকলায় কিছু নতুন বিষয়বস্তু যুক্তকরন। বিষয়বস্তুগুলো আর কিছুই নয় – অযুক্তি ও অবচেতন।
গড়ে উঠলো সুররিয়ালিজম। পরাবাস্তববাদ।
আন্দ্রে ব্রেঁতো বললেন, ‘বিস্ময় সর্বক্ষণ সুন্দর। যা কিছু বিস্ময়কর, তাই সুন্দর, আর শুধুমাত্র বিস্ময়ই সুন্দর।’ তিনি আরও বললেন, ‘সুন্দর প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করবে, তা না হলে তা সুন্দর নয়।’
যুক্তিদর্শনে নিমগ্ন পাশ্চাত্য যেন তার সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেলো। পরাবাস্তববাদীরা কোরাস গাইলেন, যুক্তি-বুদ্ধি-চেতনা – এইসব আর নয়। এগুলো ভাবনার প্রথাগত পদ্ধতি। এগুলোই আড়াল তৈরি করে। যুক্তিজাল জীবন আর মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে ক্ষয় করে। নৈতিকতা আর নান্দনিক নিয়মনীতি কুসংস্কার মাত্র। স্বপ্ন-বর্ণনা, দিবাস্বপ্ন, স্বতস্ফূর্ত রচনা, অলস পায়চারি, অতিপ্রাকৃত, ছল বিশৃঙ্খলা, অস্বাভাবিকতা, অযৌক্তিকতা এগুলোই ভয়ানক রহস্যজনক। এগুলোই বিস্ময়। এগুলোই মানব মনের অজানা সেই অবচেতন। আত্মোন্মোচন করতে হলে সেই অবচেতনকেই বুঝতে হবে। ব্যাঘাত তৈরী করতে হবে। শৃঙ্খলাকে করতে হবে বিচলিত। ব্যবচ্ছেদ টেবিলের উপর তাই মানব অস্তিত্বের পরিবর্তে সেলাই-মেশিন আর ছাতার আকস্মিক উপস্থিতিই বিস্ময়কর। আর তাই এটা সুন্দরও বটে!
খুবই সংক্ষিপ্তাকারে, একদমই মোটামুটিভাবে, এটাই পরাবাস্তববাদের উত্থান। ডাডা-র উত্তরসূরী হলেও পরাবাস্তববাদ বিপ্লব মানুষের বিরুদ্ধে নয়। মানুষের লজ্জাজনক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। ডাডা-র নৈরাশ্যবাদীতার কবর থেকে পরাবাস্তব জাগিয়ে তোলে আশার মহীরুহ। প্রভাবিত করে নিও-রোমান্টিসিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম আর এ্যাবস্ট্রাক্ট এক্স্প্রেশনিজমের মতন তিনটি উজ্জ্বল শিল্প আন্দোলন। আর মার্কি দ্য স্যড, স্তেফান মালার্ম, আলফ্রেড জারি, লোত্রিমোঁ, রেবোঁ, হেগেল ছাড়াও পরাবাস্তববাদ যার কাছে ঋণী, তিনি তো আর কেউ নন! সেই সিগমুন্ড ফ্রয়েড। যে অবচেতন মনের চিত্রাঙ্কন ও বর্ণনা পরাবাস্তববাদের অভীষ্ট লক্ষ্য, সেই অবচেতন মনের অস্তিত্ব তো সেই ফ্রয়েডের হাত ধরেই। চেতন মন শাসনে রাখে অবচেতন মনকে – এরকম উক্তি তিনিই করেছিলেন বৈ কি! তাই পরাবাস্তববাদের অস্তিত্বের জন্য এক ‘অবচেতন মনের’ অস্তিত্ব কতটা জরুরী? কিংবা কতটা জরুরী ‘অবচেতন/অচেতন চিন্তাশালা/কার্যকলাপে’র অস্তিত্বের?
For surrealists, their works to be addressing a fundamental truth, all that is required is that there are unconscious mental processes - আর এখানেই কিছু প্রশ্ন। এখানেই কিছু দ্বিধা। এখানেই এই লেখার মূল বিষয়বস্তুর সূত্রপাত।
অবাস্তব পরাবাস্তববাদ (শেষ পর্ব)
_________________________
মূল তথ্যসূত্র :
* বিংশ শতাব্দীর শিল্প-আন্দোলন - আবদুল মান্নান সৈয়দ
* Sartre on the Freudian Unconscious and Surrealism - Glenn Mason-Riseborough
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১০ দুপুর ১২:০৯